মাহিনের বয়স তখন কত হবে ছয় কিংবা সাত, ১৯৯১ সাল। সবে মাত্র কিছুদিন হয়েছে কুমিল্লা এলাকাটা ঘূর্নিঝড় পরবর্তী অবস্থা কাটিয়ে উঠেছে। চারদিকে চেয়ে দেখলে এখনও মনে হয় এই বুঝি গত রাতেই বড় আকারের ঝড় উঠেছিল। বছরের মাঝামাঝি সময়। আকাশের যেদিকটা চেয়ে দেখা যায় ক্ষানিক পরপরই কালো-ধূসর মেঘে ঢাকা,আকাশ থমথমে। মাহিনের স্কুল ছুটি হয়েছে আরও আধঘণ্টা আগে। ইস্পাহানি স্কুলের গেট ঘেষে বাচ্চাদের খেলা করার জন্য ছোট্ট একটা যায়গা সেখানে দোলনার উপর বসে মাহিন অপেক্ষা করছে আম্মুর জন্য। স্কুলের বাসটা বাকী সবাইকে নিয়ে ছেড়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই, সকালে আম্মু বলে দিয়েছিল আজ মাহিনকে নিয়ে আব্বুর অফিস হয়ে তারপর বাসায় ফিরবে। কিন্তু আম্মু আসেনি এখনও, মাহিনের অবশ্য সেদিকটা খেয়াল নেই। আম্মু না আসলেই খুশি সে। স্কুল গেটের দিকে একমনে তাকিয়ে দেখলো তার টিচারও বেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু না ভেবেই গেট পেরিয়ে ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলো। প্রতিদিনের মত আম্মু টিফিনের জন্য দশ টাকার একটা নোট পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পাশ দিয়ে সৈনিকদের নিয়ে আর্মি ট্রাক গুলো বেশ ভারী শব্দে ছুটে চলেছে। আম্মু আজ স্কুলে এসে তাকে খুঁজে না পাক, এটাই যেন চাইছে সে, ভেতরে ক্যামন যেন একটা অভিমান কাজ করছে তার। টিপড়া বাজার থেকে কোটবাড়ী অনেক দূর, আব্বু বলেছে ক্যান্টনমেন্টের বাহিরে খারাপ মানুষ থাকে আর ছেলেধরা থাকে তাই বড় গেটের ওপাশটায় কক্ষনও না যেতে, কিন্তু মাহিনের বয়সী স্কুলের আরও বাবুরা যে প্রতিদিন আব্বু কিংবা আম্মুর সাথে ওই গেট পেরিয়ে বাসায় যায় তাদের তো কেউ কিছু করেনা, চিন্তা গুলো মাহিনের মনে খেলা করতে থাকে। অনেকদূর পর্যন্ত হেঁটে এসে মাহিনের পা আর চলতে চাইছেনা। সামনে মসজিদ, পিপাসা পেয়েছে, পানি খেতে হবে। ট্যাপ খুলে পানি খেতে খেতে পকেট হাতড়ে দেখলো টাকাটা পকেটে আছে কিনা। রঙ পেন্সিল মাহিনের খুব পছন্দের, আজ সামনের ষ্টেশনারী ক্যান্টিন থেকে রঙ পেন্সিল আর আইসক্রিম কিনতে হবে, প্রতিদিনই ইচ্ছে হয় কিনতে কিন্তু আম্মু কখনই আইসক্রিম একটার বেশি খেতে দেয়না।
দুটো আইসক্রিম হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল মাহিন, শপের আঙ্কেলটা রংপেন্সিল দেয়নি বলে একটু মন খারাপ, রংপেন্সিল নিলে আইসক্রিম নেয়া যাবেনা, আর আইসক্রিম নিলে রংপেন্সিল। শেষ পর্যন্ত আইসক্রিমটাই জয়ী মাহিনের কাছে। দুটো আইসক্রিম হাতে নিয়ে ভাবছে, ভাইয়ার স্কুলটা আর একটু দূরেই। ভাইয়াকে সাথে নিয়ে খাবে, কিন্তু একটু পরই গলে পড়তে শুরু করলো। যাক নিজেকেই শেষ করতে হবে। মনভরে পরপর দুটো শেষ করে মিলিটারি হাইস্কুল স্কুলের গেটের কাছাকাছি এসে মনে পড়লো আম্মুর কথা। আম্মু কোথায়, স্কুলে গিয়ে তাকে না পেয়ে খুঁজছে নাতো! বাসায় গেলে পিট্টি দিতে পারে। ভাইয়ার স্কুলে গিয়ে ভাইয়াকে খুঁজে পাবে কিভাবে সে, ভাইয়ার ক্লাসরুম কোনটা সেতো জানেনা। গেট থেকে সরে এসে আবার রাস্তায় নেমে এল মাহিন।
সামনের মাঠটা দেখে খেয়াল হল মাঝেমাঝে মাঠের ওইপাশটায় গুলির শব্দ শোনা যায়, তার অনেক দেখার ইচ্ছা ওখানে কারা খেলা করে। আব্বু একটা বন্দুক কিনে দিয়েছে কিন্তু ভাইয়াই ওটা দিয়ে বেশি খেলা করে, মাহিনকে খেলতে দেয়না। মাঠের এপাশ এসে উঠে দেখলো নিচের দিকটা বালু ভর্তি বস্তা দিয়ে ঢাকা, আর ছোট ছোট ইট বাঁধানো গর্ত। আশেপাশে কেউ নেই। নিচে নেমে এসে দেখলো বালুর উপর কিছু পরপরই ছোট ছোট গুলি পড়ে আছে। একটা একটা করে কুড়িয়ে পকেটে ভরতে শুরু করলো মাহিন। সুন্দর দেখতে যেগুলো সেগুলো কুড়িয়ে নিলো সে। কেউ যাতে না দেখে সেই ভয়ে একদৌড়ে রাস্তায় চলে এল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে গুঁড়ি গুঁড়ি, বাসা পর্যন্ত যেতে আরও অনেক হাঁটতে হবে,আজ বাসায় ফিরলে মার খাবে নিশ্চিত। কিছুদূর হেঁটে যেতেই একটা রিকশা দেখে দৌড়ে কাছে গিয়ে বলল, ‘আঙ্কেল,আঙ্কেল আমাকে বাসায় নিয়ে যাবা, আমার আম্মু তোমাকে টাকা দেবে, বাসা অনেক দূর,আমাকে একটু নিয়ে যাবা?” রিকশাওয়ালা হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ কোন স্কুলের তুমি?” মাহিন পকেট থেকে বাকী টাকা বের করে বলল, “ ইস্পাহানি স্কুল, কোটবাড়ী যাবো, আমি জানি কিভাবে যেতে হয়, এই টাকা তোমাকে দিলে আমায় নিয়ে যাবা?” রিকশাওয়ালা আবার হেসে বলল, “ তোমার আব্বুর নাম জানো? বিল্ডিংয়ের নাম জানো?’’ মাহিন আব্বুর নাম বলে অসহায় ভঙ্গিতে না সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল, “ আঙ্কেল বিল্ডিংয়ের নাম জানিনা, আমি চিনি” রিকশাওয়ালা মাহিনের দুপাশ ধরে রিকসায় বসিয়ে দিতে দিতে বলল, “ আমারে দেখিয়ে দিও ঠিক আছে?” মাহিন এবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে রিকশার ডান পাশটা চেপে ধরে বসলো।
বাংলাবাজার পেরিয়ে বর্তমান ক্যান্টনমেন্ট জিম যেখানে সেখানটায় তখন শুক্রবার করে নাগরদোলা বসত, আব্বুর সাথে মাঝে মাঝে যেত মাহিন। রিকশাওয়ালাকে আনন্দের সাথে চেঁচিয়ে যায়গাটা দেখিয়ে বলে উঠলো, “ আঙ্কেল , আঙ্কেল আব্বু আমাকে এখানে নিয়ে আসে, তুমিও আসবে একদিন, অনেক মজা” রিকশাওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে হাসল।
রিকশা এগিয়ে চলছে, নিজের ভেতরটায় মাহিন কতটুকু আনন্দ বা ভয় অনুভব করছিলো সেদিন সেই অনুভুতিটা সে ভুলে গেছে কিংবা মনে নেই। না, বাসায় ফেরার পর আম্মুকে সেদিন বাসায় পায়নি মাহিন। পাশের বাসার রবিনের আম্মু ফোন করে মাহিনের আব্বুকে জানিয়ে দিয়েছিলো মাহিন ঠিকমত রিক্সায় করে বাসায় ফিরেছে। দুপুরের পর মাহিনের আম্মু বাসায় ফিরে এসে মাহিনকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেছিলো। তারপর থেকে আর মাহিনকে একটার বেশি আইসক্রিম খেলে আম্মু বকেনি, কিংবা রাতের বেলা শহরে গিয়ে রসমালাই খাবার বায়না ধরলেও আব্বু দিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্ত থাকলেও কোনদিন মাহিনকে না করেনি।
মাত্র ১১ বছর বয়সে পড়ালেখার জন্য, নিজেকে গড়ে তুলবার জন্য মাহিনকে পরিবার ছেড়ে বোর্ডিং স্কুলে চলে যেতে হয়, তারপর ক্যাডেট কলেজের ছয়টি বছর, তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে এতগুলো বছর। সেই যে আব্বু-আম্মু-ভাইয়াকে ছেড়ে মাহিন বের হয়েছে এখনও তার চিন্তা-ভাবনায় আব্বু-আম্মু-ভাইয়া দেখতে যেন সেইরকমই আছে। অথচ সেদিনও দেশে ফিরে ভাইয়ার মাথায় আলতো পাকা চুল দেখে মাহিন বলেছিলো, “ভাইয়া, চুল বড় হয়ে গেছে, চুল কেটে আসেন”। শেষ কবে দুস্টুমির জন্য আম্মুর হাতের থাপ্পড় খেয়েছিল মাহিন মনে নেই, তবে ঠিক এই মুহুর্তে গল্পটা লিখতে লিখতে মাহিনের চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে আর মনে হচ্ছে, এই কান্নার কষ্টটুকু ছোট বেলায় আম্মুর হাতের মার খেয়ে পাওয়া কষ্ট বা অভিমানের থেকেও অনেক অনেক গভীর, আরও একটা বার আম্মুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে , “ আম্মু আজ আমাকে একটা থাপ্পড় দাও, আমি একটু কাঁদি অন্তত এই কান্নার থেকে অনেক কম কষ্ট হবে, অন্তত তুমিতো আমার সামনে থাকবে, তোমাকে আবার সেই আগের মত করে দেখতে পাবো,এতগুলো বছর পর”
বিঃদ্রঃ শুধু আমি একজন নই! এরকম অনেক মাহিনই আছে যারা প্রায়ই ফিরে যায় তাদের পুরোনো দিনে, একটু করে হলেও এক ফোঁটা পানি তাদের চোখের কোণে এসে যায়, বাবা-মাকে আরেকবার দেখতে ইচ্ছে হয় ঠিক আগের মত করে। © Rubel Mehedi
অসাধারন :hatsoff:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
🙂 থ্যাংক ইউ