কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ছোটগল্প পড়ে বরাবরই মুগ্ধ হই। বিচিত্র সব বিষয়ের প্রতি পাঠককে তিনি আগ্রহী করে তোলেন, ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেন। মাসখানেক আগে পড়লাম তার লেখা মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার। আইসিইউ-এর নির্জন শীতল ঘরে শুয়ে আছেন একজন মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির অভিনব সংযোজন লাইফ সাপোর্টের সাহায্যে। তার করুণ অসহায়ত্ব ও ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার বিবরণ উঠে আসে তার পুত্রের বয়ানে।
মুমূর্ষু বৃদ্ধের পুত্র গল্পের প্রথমদিকে বলেন:
বাবার নাকে-মুখে জটিল সব যন্ত্র, বাবার চোখ বোজা। এর ভেতরই বাবা মৃদুভাবে মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ, আমার কণ্ঠস্বর বাবা শুনতে পাচ্ছে। …
তার মানে বাবার সেন্স আছে? আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করি।
ডাক্তার: হ্যাঁ, ওনার ব্রেইন সচল আছে। ওনার অন্যান্য সব অঙ্গকে আমরা মেশিন দিয়ে চালু করে রেখেছি। উনি আপনার সব কথা শুনতে পাচ্ছেন।
বাবার সাথে আনন্দ-বেদনায় জড়ানো নানা টুকরো স্মৃতিচারণার ফাঁকে ডাক্তারকে পুত্র আবার জিজ্ঞেস করে:
বাবার কি কষ্ট হচ্ছে?
সাদা অ্যাপ্রোন পরা নির্বিকার ডাক্তার বলেন: হ্যাঁ, হচ্ছে।
আমি: এই যে ভেন্টিলেটর, টিউব—এগুলোতে কষ্ট হচ্ছে বাবার?
গম্ভীর ডাক্তার: হ্যাঁ, হচ্ছে।
আমি: তাহলে এসব যন্ত্রপাতি তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এসব মেশিন উইথড্র করলে উনি মারা যেতে পারেন।
একপর্যায়ে ডাক্তার রোগীর পুত্রকে জানান, লাইফ সাপোর্টে থেকে কেউ কেউ ফেরে কিন্তু তার বাবার ফেরার সম্ভাবনা নেই। যন্ত্রপাতি নাকে-মুখে লাগানো অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সীমানায় কতদিন তিনি ঝুলতে থাকবেন তাও ডাক্তার সাহেবের পক্ষে বলা মুশকিল। তিনি শুধু এতটুকু জানেন, মেডিকেল সায়েন্স মুমূর্ষু রোগীর লাইফ ‘প্রলং’ করার একটা রাস্তা করে দিচ্ছে। সেটা গ্রহণ করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেবার দায় একান্তই রোগী বা তার নিকটজনের।
হতবিহ্বল দ্বিধাগ্রস্ত পুত্র ডাক্তারের প্রতি এবার ছুঁড়ে দেয় কঠিন এক প্রশ্ন:
আমি: বাবা আমাদের মধ্যে ফিরে আসবার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
ডাক্তার: হ্যাঁ, সেটা ঠিক।
আমি: তবু প্রতিদিন চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব, তাই তো?
ডাক্তার: সেটা আপনি বুঝবেন।
আমি: মেডিকেল সায়েন্স জীবন-মৃত্যুর কোনো সমাধান দিতে পারছে না কিন্তু আমাদের একটা নৈতিক দ্বিধার ভিতর ফেলে দিচ্ছে, তাই না কি?
ডাক্তার: আপনি আমার অনেক সময় নিচ্ছেন। আমি ব্যস্ত আছি। আপনি বাইরে গিয়ে বসেন।
গল্পের শেষভাগে পুত্রের মনে আরো কিছু প্রশ্নের উদয় হয়:
এই দৃশ্যটুকু আমি মঞ্চস্থ করে যেতে পারি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। আমি আমার নাম বলব, বাবা তার মাথা নাড়বে, আমি জানব বাবা বেঁচে আছে। বাবার বেঁচে থাকা মানে যদিও ওই মাথা নাড়াটুকু। বাবার ওই মাথা নাড়ানোর মূল্য প্রতিদিন চল্লিশ হাজার টাকা। আমরা এই অর্থ জোগান দেবার জন্যে নিঃস্ব হয়ে যাব। কিন্তু বাবার জীবনের বিপরীতে টাকার এই হিসাব মর্মান্তিক, অমানবিক, স্বার্থপর। কিন্তু এই জটিল যন্ত্রপাতি কি বাবাকে টিথোনাসের মতো অমরত্ব দিতে পারবে? দিতে পারলেও বাবা কি সে সুযোগ গ্রহণ করতে চাইবে?
শেষের এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তিটি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি, তিনি কি বিদঘুটে সব যন্ত্রপাতি ও টিউবে প্যাঁচানো অবস্থায় হাসপাতালের নির্জন কামরায় মারা যেতে চান? নাকি তার নিজের ঘরে মারা যাবার সময় নিজের চারপাশে সন্তান-স্ত্রী-বন্ধু-আত্মীয়দের দেখতে চান?
কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের গল্পটিতে ডাক্তার সাহেবের বয়ানেই উঠে এসেছে, লাইফ সাপোর্টে থাকা মৃত্যুপথযাত্রীর মস্তিষ্ক সচল থাকে। অর্থাৎ চারপাশে কী হচ্ছে তা সেই মানুষটি ঠিকই বুঝতে পারেন। চেনা পৃথিবী ছেড়ে অচেনা এক জগতের পথে পা বাড়ানোর আগমুহূর্তে শেষবারের মতো মানুষ প্রিয়জনের ডাক শুনতে চায়, তার মুখটা দেখতে চায় কিংবা তার হাত ধরতে চায়। নিতান্ত মানবিক এই অনুভূতিকে নিষ্ঠুরভাবে অগ্রাহ্য করা হয় লাইফ সাপোর্টে ঠেলে দেয়ার মধ্য দিয়ে।
গলা ফুটো করে টিউব ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, প্রত্যেকবার দম নিতে গেলে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। এর সাথে আইসিইউ-এর ভীষণ অনাত্মীয় পরিবেশে মারা যাবার কষ্ট যখন যোগ হয়, তখন সেই মানুষটির মানসিক অবস্থা কেমন হয় তা কি ভেবে দেখে তার পরিবার? মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা জানানোর বলিহারি উপায় আধুনিক মানুষ বের করেছে বটে!
গল্পের ডাক্তার সাহেব তবু মুমূর্ষের স্বজনদের জানিয়েছিলেন যে, রোগীর আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। সব রোগীর ভাগ্যে এরকম সহৃদয় চিকিৎসক জোটে না। অন্তত: কবি রফিক আজাদের কপালে জোটে নি। তার মৃত্যুর এক বছর পর কবিপত্নী জানিয়েছিলেন আইসিইউ-তে কবিকে কী নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল:
আইসিইউ এর অত্যাচার থেকে মানুষটা বেরিয়ে আসতে চাইছিল বার বার। কিন্তু ডাক্তারদের মতামত উপেক্ষা করে আমি তাকে হাসপাতালের বাইরে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিনি। তার শেষ ইচ্ছের একটাও আমি রাখতে পারিনি। এক রাতে অসহ্য হয়ে তার নাকে সর্বক্ষণ ঢুকে থাকা রাইস টিউব তিনবার টেনে বের করে ফেলেছিলেন- তিন বারই দজ্জাল ডাক্তার পুনরায় তা প্রতিস্থাপন করে তাকে এতটাই কষ্ট দিয়েছিল যে, অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করবার ছিল না আমাদের।
এরপর তার হাত বেঁধে রাখা হলো, সবই নাকি রোগীর ভালোর জন্যে করছিল ডাক্তাররা এবং দিনের পরে দিন আমাদের তা মেনেও নিতে হচ্ছিল। এরপর সকালে ২-৪ মিনিট সামান্য সময়ের জন্য আমাদের যে দেখতে দেওয়া হতো, সেই সময়ে একদিন গিয়ে দেখি তার পা দুটো বাঁধা বেডের সঙ্গে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা অবধি চামড়া ছিলে গেছে।
কারণ কী? জিজ্ঞেস করতেই নার্স জানালো রোগী বেড থেকে নেমে চলে যেতে চাচ্ছিল বাসায়, সেই কারণে নামতে গিয়ে চামড়া ছোড়ে গেছে সামান্য। কাজেই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করেই রোগীর ভালোর জন্যে পা বেঁধে রেখেছি। স্তব্ধবাক আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম রফিক আজাদের মাথার কাছে- আজ আর তা মনেও করতে পারছি না। হায়রে, রোগীর মানবাধিকার, এখনো সপ্তদশ শতকেই পড়ে আছে বিবর্ণ মোড়কে যেন।
মানুষটাকে বাঁচাবার জন্য কত কষ্টটাই না দিলাম ডাক্তারদের পরামর্শে। কী লাভ হলো! যদি জানতাম তিনি এই মাটির পৃথিবীতে আর থাকবেন না, তাহলে তার ইচ্ছে মতোই না হয় সব হতো। তিনি তো যাবার কালে একটু শান্তিতে যেতে পারতেন। মন যা যা চেয়েছিল সেইমতো না হয় থাকতেন আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুজন-সন্তানবেষ্টিত হয়ে। কী ক্ষতি-বৃদ্ধি ছিল তাতে।
প্যান্ট-শার্ট পরা লোক যারা দু-চার অক্ষর পড়তে পাড়েন তারাও রোগীর নাম জানেন কবি ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে- সেই রোগীকে দিনের পর দিন ডাক্তাররা হাত- পা বেঁধে চিকিৎসা দিচ্ছেন আইসিইউ-তে।(১)
কেবল সুস্থ করে তোলার মহৎ উদ্দেশ্য ছিল বলেই কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কবি রফিক আজাদকে জোরজবরদস্তি করে আইসিইউ-তে ভর্তি করে রেখেছিল? বিড়ম্বনার শিকার ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বলছে, আইসিইউ হাসপাতাল মালিক-ডাক্তার-ওষুধ বিক্রেতাদের জন্যে সাক্ষাৎ পয়মন্ত লক্ষী। কেননা এর আশীর্বাদে তাদের কপাল ফিরে গেছে। আইসিইউ-তে পরিচিত কাউকে যারা কখনো ভর্তি করেন নি তারা বিষয়টি কিছুটা আঁচ করতে পারেন সংবাদপত্র মারফত। ১২ মার্চ ২০১৯ দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ফিচারে বলা হয়:
‘ঢামেকের দীর্ঘদিন ধরে আইসিইউ বাণিজ্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই সিন্ডিকেটের হয়ে মার্কেটিংয়ের কাজ করে হাসপাতালে নিরাপত্তায় নিয়োজিত দুর্নীতিবাজ আনসাররা। পিছিয়ে নেই হাসপাতালের দুর্নীতিবাজ চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়া হাসপাতালের ব্রাদার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, সর্দার ও স্পেশাল বয় তো আছেই। এমনকি এ্যাম্বুলেন্সের চালকও বাদ যায় না। বছরের পর বছর ধরে এরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের ম্যানেজ করে হাসপাতালে মৃত্যুশয্যার রোগীদের নিয়ে চলে কেনাকাটা। এতে অনেক রোগী বাইরের নামসর্বস্ব ওসব ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। অনেকে সুস্থ হলেও মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে জমিজমা বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। এমনকি ওসব হাসপাতালের আইসিইউয়ের মোটা অঙ্কের বিল পরিশোধ না করলে লাশ আটককে রাখার অভিযোগও রয়েছে।’ (২)
৩১ অক্টোবর ২০১৫ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত:
‘সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে আইসিইউ বাণিজ্য। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা সংকটের সুযোগ নিয়ে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় আইসিইউ সেবা নিয়ে রমরমা বাণিজ্য চলছে। সরকারি হাসপাতালের এক শ্রেণীর চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে কমিশনের বিনিময়ে রোগী ভাগিয়ে মানহীন এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ স্বল্পতার সুযোগ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের কাছ থেকে উচ্চ ফি আদায় করা হচ্ছে। বাসা-বাড়িতে ফ্লোর ভাড়া নিয়ে শয্যা পেতে কেউ কেউ আইসিইউ বাণিজ্য করছে। কোনো কোনো ক্লিনিকে দৈনিক ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকাও বিল করা হয়।’ (৩)
অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে একদিন আইসিইউ-তে রাখার খরচ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। টাকা শোধ করতে না পারলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ আটকে রাখে এ নজিরও আছে। অনেকসময় রোগী মারা গেছে তবু টাকার লোভে ক্লিনিকগুলো আরো কয়েকদিন আইসিইউ-তে লাশ রেখে দেয়। (৪) নৃশংস এমন ঘটনা বছর কয়েক আগে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করত। আজকাল হরহামেশাই যেহেতু এসব ঘটছে বাঙালির প্রায় সয়ে গেছে। টিভিতে এসব সংবাদ দেখালে আমরা তাই বড়জোর রিমোট চেপে চ্যানেল বদলাই। আর খবরের কাগজে ছাপলে তো কথাই নেই। নির্বিকার চিত্তে পৃষ্ঠা উল্টে কোন শোবিজ তারকার ঘর ভাঙল, কোন ক্রিকেটার ঠ্যাংয়ে ব্যথা পেল এ-জাতীয় সংবাদ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
২.
পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বজুড়ে মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে আকস্মিকভাবে। বাকি ৮৫ ভাগ মানুষের শেষ বিদায়টি হয় স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগে কিংবা বার্ধক্যজনিত দুর্দশায়। (৫) একবারও আমাদের খেয়াল হয় না, আইসিইউ-তে শুয়ে করুণ মৃত্যু আমার কপালেও তো জুটতে পারে। নাকে-মুখে নল লাগানো অবস্থায় আপনি হয়তো মারা যেতে চান না। কিন্তু ভেবে দেখুন তো দৃশ্যপটটা।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তড়িঘড়ি করে আপনাকে সোজা হাসপাতালে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। দিন পেরোলেই যেহেতু কাঁচা টাকা, ক্লিনিকওয়ালারাও ছিল তক্কে তক্কে। অ্যাপ্রোন গায়ে স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে গম্ভীর চেহারা নিয়ে ডাক্তার সাহেব ততোধিক জলদগম্ভীর কণ্ঠে অমোঘ বাণী উচ্চারণ করলেন, ‘রোগীকে যদি বাঁচাতে চান, তাহলে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হবে।’ আপনার স্ত্রী-সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনের বাপের সাধ্য আছে ‘না’ বলার? অগত্যা, নাকে-মুখে-গলায় আজব সব নল লাগানো অবস্থায় একটি হাই-টেক মৃত্যু লাভ করবেন আপনি।
কিন্তু মৃত্যু কি সুন্দর তৃপ্তিময় হতে পারে না? রোমান সম্রাট ও দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস তাঁর কালজয়ী রচনা মেডিটেশনস-এ লিখেছিলেন:
You’ve lived as a citizen in a great city. To be sent away from it, not by a tyrant or a dishonest judge, but by Nature, who first invited you in—why is that so terrible?
Like the impresario ringing down the curtain on an actor: “But I’ve only gotten through three acts!”
Yes. This will be a drama in three acts, the length fixed by the power that directed your creation, and now directs your dissolution. Neither was yours to determine.
So make your exit with grace—the same grace shown to you.
Graceful মৃত্যুর একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ ভারতীয় বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালামের শেষযাত্রা। কর্মঋদ্ধ জীবন ছিল তার। ৮৩ বছর বয়সেও প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট শিলংয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করার সময় হৃৎযন্ত্র বিকল হয়ে যায়, মঞ্চের ওপরেই ঢলে পড়েন তিনি। অল্প কিছুক্ষণ। সব শেষ। হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা জানালেন, তিনি হাসপাতালে আনার আগেই মারা গেছেন। ভাগ্যিস! নইলে ভিআইপি হওয়ার সুবাদে সপ্তাহখানেক লাইফ সাপোর্টে তাকে খামোকা কষ্ট পেতে হতো।
শাস্ত্রে বলে, রণক্ষেত্রে মৃত্যু হলো একজন ক্ষত্রিয়ের জন্যে শ্রেষ্ঠ মৃত্যু। একইভাবে একজন কর্মীর জন্যে পরম সম্মানের মৃত্যু যে কাজ ও মানুষদের ঘিরে তার জীবন আবর্তিত, তাতে নিমগ্ন অবস্থায় মৃত্যু। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠতম গণিতবিদ ছিলে হাঙ্গেরির পল এয়ারডশ। তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল গণিত। তিনি ঠাট্টা করে বলতেন: “The perfect death? ধরো কোনো গাণিতিক সমস্যার সমাধান ব্যাখ্যা করে লেকচার শেষ করছি, এমন সময় শ্রোতাদের মাঝখান থেকে কেউ দাঁড়িয়ে বেমক্কা জিজ্ঞেস করবে, ”What about the general case?” আমি বলব, ওটা না-হয় নতুন প্রজন্মের জন্যে ছেড়ে দিই, কি বলো? বলেই ঢলে পড়ব।” পল এয়ারডশের মৃত্যু এতটা নাটকীয় হয় নি। তবে তিনি মারা যান পোল্যান্ডে একটি গণিত সম্মেলনে আলোচনারত অবস্থায়।
দেশীয় উদাহরণও আছে। বাংলার নারী জাগরণের পথিকৃৎ মহীয়সী বেগম রোকেয়া মারা গিয়েছিলেন লেখার টেবিলে। রাতের বেলা লিখতে বসেছিলেন। পরদিন ভোরে তাকে মৃত অবস্থায় যখন পাওয়া যায় তখন টেবিলের ওপর পেপারওয়েট দিয়ে চেপে রাখা ছিল একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ—নারীর অধিকার। হেনরি ডেভিড থরো যেমন বলে গেছেন ঠিক সেরকম মৃত্যু: Live your life, do your work, then take your hat.
এমন মহৎ বা নাটকীয়ভাবে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারা জরুরি নয়। তবে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুস্থ-সবল থেকে কাজ করতে পারার আকাঙ্ক্ষা থাকা জরুরি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আইসিইউ-তে কয়েকদিন ধরে অহেতুক যন্ত্রণা ভোগ করার পর ডাক্তার বা নার্স নল টেনে খুলে ফেলল, রোগী মারা গেল। এটা কেমন মৃত্যু? নাকি আমরা একালের দধীচী হওয়ার ঔদ্ধ্যত্য দেখাচ্ছি? আমার বাবা বা মা-র যত কষ্টই হোক, তার ফিরবার আর কোনো আশা না থাকার পরও মেডিকেল সায়েন্স তার মৃত্যুকে রাবারের মতো টেনে যতই প্রলম্বিত করুক, চিকিৎসা ব্যবসায়ী ক্লিনিক মালিক ও ডাক্তারদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফুলেফেঁপে তো উঠছে। ওতেই আমার জীবনের সার্থকতা — এমনটাই কি ভাবছি? আমার একান্ত প্রিয়জনকে লাইফ সাপোর্টে রাখার পরামর্শ যে চিকিৎসক দিচ্ছেন, তিনি নিজে কি ওভাবে মারা যেতে চান? এই প্রশ্ন কি কখনো মনে জেগেছে?
৩.
বান্দরবানের লামায় গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ধ্যানকেন্দ্র কোয়ান্টামম। ২০১৮ সালে সেখানে একটি মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। পাহাড়ী জনপদের দুস্থ মানুষদের সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে সারাদেশের শতাধিক চিকিৎসকবৃন্দ তাতে অংশ নেন। ক্যাম্প শেষে চিকিৎসকদের নিয়ে আয়োজিত সভায় আমারো উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সভার প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশে প্যালিয়েটিভ মেডিসিনের পথিকৃৎ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. নিজামউদ্দিন আহমেদ। তিনি সমবেত চিকিৎসকদের জিজ্ঞেস করলেন: ‘কয়েকটি প্রশ্ন আমি নিজেকে করছি। সাথে সাথে আপনারাও নিজেকে প্রশ্নগুলো করবেন কিনা ভেবে দেখুন। কোথায় মারা যেতে চাই? হাসপাতালে?’ ডাক্তাররা এদিক-ওদিক মাথা নাড়াতে লাগালেন।
বিস্ময়ের সুরে ডা. নিজামউদ্দিন মন্তব্য করলেন, ‘আশ্চর্য! কী স্ববিরোধী কাজ! আমরা প্রত্যেকেই হাসপাতালে কাজ করি। ওখানে অনেককে আমরা মৃত্যুর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। অথচ নিজেরা হাসপাতালে মরতে চাই না। আমরা সবাই বাসায় মারা যেতে চাই। কিন্তু কেউই বাসায় মরব না। কারণ মরার সময় যখন কাছে আসবে, আমাদেরকে চ্যাংদোলা করে যারা যার পরিবার আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী হাসপাতালে ফেলে দেবে। ধরুন, ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ-তে থাকার খরচ যদি সরকার দেয় তাহলে কি ওরকম একটা আইসিইউ-তে আপনারা মারা যেতে চান?’
ডাক্তাররা আরো জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন: না।
তখন অধ্যাপক ডা. নিজামউদ্দিন বললেন, আমরা ম্যাসাচুসেটস হাসপাতালের আইসিইউ-তে মরতে চাই না, দেশের কোনো আইসিইউ-তে তো একেবারেই না। তাহলে রোগীদের আমরা আইসিইউ-তে কেন রেফার করি?
সেখানে উপস্থিত ডাক্তারদের কাছ থেকে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর সেদিন আসে নি। এর কারণ হতে পারে, অধিকাংশ মানুষের বিশদ পরিকল্পনা থাকে উচ্চতর ডিগ্রি, ক্যারিয়ার, বিয়ে, ব্যাংক-ব্যালান্স গোছানো কিংবা সন্তানের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে। শুধু জীবনের শেষ অধ্যায়টি নিয়ে কোনো পরিকল্পনা থাকে না। ফলে যে মানুষটি বার্ধক্যজনিত কারণে বা নিরাময়ের অযোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তাকে বৃথাই লাইফ সাপোর্টে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। একদিকে সেই মানুষটির পরিবারের সদস্যরা শেষদিনগুলিতে তার পাশে থাকতে পারছেন না, অন্যদিকে লাইফ সাপোর্ট নামক ব্যয়বহুল অবিদ্যা সেই পরিবারটিকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার গল্পটিতে গল্পকার স্পষ্ট করে বলতে না পারলেও এ ব্যাপারে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার : অহেতুক লাইফ সাপোর্টে রাখার অর্থ একজন মানুষকে অসম্মানের সাথে মারা যেতে বাধ্য করা।
তথ্যসূত্র:
১. লোকটি তবে কবি ছিল? বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ মার্চ ২০১৭
২. আইসিইউ বাণিজ্য ॥ ঢাকা মেডিক্যাল ঘিরে শক্তিশালী সিন্ডিকেট, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১২ মার্চ ২০১৯
৩. আইসিইউ বাণিজ্য, দৈনিক সমকাল, ৩১ অক্টোবর ২০১৫
৪. হাসপাতালে আইসিইউ বাণিজ্য ॥ লাশের চিকিৎসা করেও নেওয়া হয় টাকা, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ এপ্রিল ২০১৭
৫. কোয়ান্টাম বুলেটিন, জুলাই ২০১৯
🙁 🙁 🙁
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
কখনোই এভাবে চিন্তা করিনি। 🙁
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
লাইফ সাপোর্ট নিয়ে ভুল ধারণা ও বাণিজ্য দুটোই বর্ধিষ্ণু।