মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় তিনি ষষ্ঠ সম্রাট আওরঙ্গজেব। ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক ময়দানে ‘আওরঙ্গজেব’ এখনো প্রাসঙ্গিক ইস্যু। ভিন্নধর্মের প্রতি আওরঙ্গজেবের তীব্র বিদ্বেষ ও যুদ্ধ-উন্মত্ততা সবিস্তারে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেছেন এমন ঐতিহাসিকের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়।
এমনকি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তাঁর বিখ্যাত দি ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইয়ে মন্তব্য করেছিলেন, Aurungzeb .. a bigot and an austere puritan, he was no lover of art or literature… The last of the so-called ‘Grand Mughals,’ Aurungzeb, tried to put back the clock, and in this attempt stopped it and broke it up. মন্তব্য করতে ছাড়েন নি পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল জিন্নাহও—Aurangzeb presided over a conquest state where Hindus had to submit to his rule most unwillingly.
তাই Aurangzeb : The Man and The Myth বইটা পড়ে ভীষণ চমকে গেছি। সম্রাট আওরঙ্গজেবকে হাজির করা হয়েছে প্রচলিত বয়ানের বাইরে গিয়ে। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার-সহ অধিকাংশ ইতিহাসবিদ সম্রাট আওরঙ্গজেবের যে চরিত্র বয়ন করে থাকেন, বলিষ্ঠ যুক্তির দক্ষ প্রয়োগ সেই ধারণার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন বইটির লেখক অদ্রে ত্রুশকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক ত্রুশকে দেখিয়েছেন, সম্রাট আকবর ও শাহজাহানের আমলে মুঘল আমীর-ওমরাহদের সাড়ে ২২ শতাংশ ছিলেন হিন্দু। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে হিন্দু অভিজাতদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৩১ শতাংশে। শুধু তা-ই নয়। আওরঙ্গজেবের মুখ্য অর্থমন্ত্রী ছিলেন রাজা রঘুনাথ। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের উজিরের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। একজন আমলা কোন ধর্মের অনুসারী তার চেয়ে তিনি মেধাবী ও দক্ষ কিনা এটাই ‘ধর্মান্ধ’ আওরঙ্গজেবের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ঘটনা ও রটনার ব্যবচ্ছেদ করার পর অধ্যাপক ত্রুশকে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তা হলো ঔপনিবেশিক আমলের ব্রিটিশ অনুবাদক ও ইতিহাসবিদরা ভারতীয় মুসলমান শাসকদের বিষোদগার করেছিলেন তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। Aurangzeb : The Man and The Myth বইয়ের পৃষ্ঠা ১৪২ থেকে উদ্ধৃত করছি—
‘Many translations of Mughal Texts are of questionable quality, brimming with mistranslations and abridgements. Some of these changes conveniently served the agendas of the translators, especially colonial-era translations that sought to show Indo-Muslim kings at their worst so that the British would seem virtuous by comparison (foremost here is Elliot and Dowson’s History of India, as told by Its own Historians). Such materials are great resources for learning about British Colonialism, but they present an inaccurate picture of Mughal India.’ (১)
আর পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্পর্কে কঠোর এই মন্তব্য কেন করেছিলেন সেটারও উত্তর দিয়েছেন অধ্যাপক ত্রুশকে। টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়াকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি খোলাখুলি বলেন, “Nehru was reading colonial era history. The reason people believe it is because it [this representation of Aurangzeb] does have a scholarly basis. But a major point of that [scholarship] was to make the British look better.” (২)
ঔপনিবেশিক আমলে সম্রাট আওরঙ্গজেবের চরিত্র হননের এই প্রচেষ্টা ছিল না বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হর্তাকর্তারা (ও তাদের মদদপুষ্ট ভাড়াটে ইতিহাসবিদরা) ধারাবাহিকভাবে এ অপকর্ম করে গেছে। তাদের বিষোদগারের শিকার হয়েছেন বহু ভারতীয় শাসক।
ভেবে দেখুন, উত্তাল মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষে কেন এসেছিল? ব্যবসাবাণিজ্য করে নিজেদের দারিদ্র্য ও অন্নকষ্ট দূর করার জন্যে। তাহলে সেই বণিকের দল মিথ্যা ইতিহাস রচনার পরিশ্রম কেন করতে গেল? আসলে সত্যের বিকৃতি না ঘটালে ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের চক্রান্ত তারা বাস্তবায়ন করতে পারত না। এ-যুগের শকুনের দল খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ দেশগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বুলি আওড়াতে থাকে ও মিডিয়া মারফত নানাবিধ প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়। তাদের পূর্বপুরুষরাও (নাকি পূর্বশকুন!) ঠিক একই কাজ করত। রক্তের দোষ যাবে কোথায়!
ইংরেজরা ভারতীয় শাসকদের চরিত্রে কীভাবে কালিমা লেপন করত তার অন্যতম উদাহরণ মহীশুর অধিপতি টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ তৎপরতা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শাসকদের তুলনায় টিপু সুলতান যথেষ্ট প্রজাবৎসল, অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিকমনা ছিলেন। তার রণকুশলতা ভাবিয়ে তুলল ইংরেজদের। নিজেদের আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী চেহারা লুকোনোর জন্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর জেনারেল রিচার্ড ওয়েলেসলি (পরবর্তীতে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) তাই শুরু করলেন প্রোপাগান্ডা। লন্ডনে পাঠানো তার প্রতিবেদন অনুযায়ী, টিপু সুলতান এমন এক দানব যাকে নিধন করা পরম পূণ্যের কাজ বলে গণ্য হবে। ব্রিটিশ জনগণও যাতে বুঝতে পারে, ব্রিটিশ সৈন্যরা মহীশুর দখল করতে যায় নি, বরং গিয়েছিল স্থানীয় অধিবাসীদের ত্রাতা হিসেবে (পৃথিবীর বহু দেশে এখনো এই একই স্ক্রিপ্ট কি পশ্চিমারা ঘুরেফিরে ব্যবহার করে যাচ্ছে না? থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।) ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশদের এই অপকর্মের বর্ণনা দিয়েছেন সাম্প্রতিককালের সুপরিচিত স্কটিশ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল—
“Richard Wellesley was sent out to India in 1798 as governor general with specific instructions to effect regime change in Mysore and replace Tipu with a western-backed puppet. First, however, Wellesley and Dundas had to justify to the British public a policy whose outcome had long been decided in private.
Wellesley therefore began a campaign of vilification against Tipu, portraying him as an aggressive Muslim monster who divided his time between oppressing his subjects and planning to drive the British into the sea. This essay in imperial villain-making opened the way for a lucrative conquest and the installation of a more pliable regime which would, in the words of Wellesley, allow the British to give the impression they were handing the country back to its rightful owners while in reality maintaining firm control.
Until recently, the British propaganda offensive against Tipu has determined the way that we – and many Indians – remember him. But, as with more recent dossiers produced to justify pre-emptive military action against mineral-rich Muslim states, the evidence reveals far more about the desires of the attacker than it does about the reality of the attacked.” (৩)
রিচার্ড ওয়েলেসলি প্রতিদ্বন্দ্বী সেনাপতি টিপু সুলতানকে খলনায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন দক্ষিণ ভারতে ব্রিটিশ বাণিজ্য তৎপরতা নির্বিঘ্ন করতে। এটা মেনে নেয়া গেলেও, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হর্তাকর্তা থেকে শুরু করে চুনোপুটি ইংরেজরাও বাঙালির এত দুর্নাম কেন করলেন সেটার ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। ভালো-মন্দ, সাধু-বদমাশ সব দেশে সব কালেই ছিল। ইংরেজরা যে-সব বাঙালির সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের মধ্যে দুর্নীতিপরায়ণ লোক ছিলেন না এটা ভাবা বাতুলতা। তাই বলে, বাংলার বেবাক লোক শঠ, মিথ্যাবাদী ও ধূর্ত প্রকৃতির এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? অথচ সে-কালে ইংরেজ ইতিহাসবিদদের লেখা বইপত্র পড়লে সেটাই মনে হতে বাধ্য!
ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলামের একটি নিবন্ধ পড়ার পর আমার ধারণা হলো, ইংরেজরা এই অপকর্মটি করেছিল নিজেদের চৌর্যপ্রবৃত্তির কেচ্ছা গোপন করার জন্যে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা বাঙালি প্রজাদের সম্পদ লুট করে জাহাজে করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দিত। লুটের মাল ব্রিটিশ জাহাজে পাঠালে যেহেতু তারা ধরা পড়ে যাবে, তাই লুণ্ঠনকারী চোরশ্রেণির এসব কর্মকর্তা শরণাপন্ন হতো মার্কিন জাহাজের। ধূর্ত ইংরেজ ভালো করেই জানত, অপরাধের সাক্ষীণ ও ভুক্তভোগী বাঙালিকে আগেভাগেই মিথ্যাবাদী ও শঠ হিসেবে সবার কাছে যদি সে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, বাঙালির সাক্ষ্য ধোপে টিকবে না। নিবন্ধটি থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের লুন্ঠন ও পাচারের বিবরণটি উল্লেখ করছি—
‘According to the Charter of the English East India Company, the British subjects, including the officials of the East India Company’s Government in India were required to remit home their savings in the form of goods purchased on account of the Company and Company’s sales in London. The establishment of the British colonial many of the East India Company officials and Britishers were making fortunes by plundering the subjects of the colonial state. It was unsafe to remit the illegal fortunes through the company’s ships. Instead, they found the Americans best media to remit their ill-gotten fortune via the American ships. They called it clandestine trade. According to Holdern Furber annual remittance to Britain by clandestine trade with the Americans amounted to no less than three hundred thousand pounds a year.’ (৪)
ই্ংরেজরা একইসাথে প্রতিপক্ষকে হীন, ইতর ও খল হিসেবে উপস্থাপন করেছে আবার নিজেদের মহিমান্বিত এক ইমেজ নির্মাণ করেছে। তারা যে বীরত্বগাথা প্রচার করে তাতেও আছে বাগাড়ম্বর ও কল্পকাহিনীর দেদার মিশ্রণ। এ প্রসঙ্গে চিত্তাকর্ষক একটি নিবন্ধ সম্প্রতি বেরিয়েছে দৈনিক বণিক বার্তায়। নিবন্ধটির মূল বক্তব্য হলো, সুতানুটি (বর্তমানে কলকাতা) নয় বরং চট্টগ্রামে বাণিজ্যনগরী গড়ে তোলার খায়েশ ছিল ইংরেজদের। মুঘল বাহিনীর হাতে বেধড়ক পিটুনি খাওয়ার পর ইংরেজরা চট্টগ্রাম দখলের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। পরাজয়ের এ গ্লানিময় ইতিহাস উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন। নিবন্ধটি থেকে চুম্বক অংশ উল্লেখ করছি—
‘এ যুগের কলকাতা বা চট্টগ্রামবাসী সম্ভবত ইংরেজের সেই চট্টগ্রাম অভিযানের ঘটনা জানে না। জানে না, কেননা পরবর্তীকালে ইতিহাসের ওই পর্বটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছিল। ইংরেজদের অতীত কেলেঙ্কারিগুলো আমাদের সমকালীন ইতিহাসে খুব অল্পই টিকে আছে। কলকাতার ইতিহাসের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হলেও সেই ঘটনাটি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার কলকাতার ইতিহাস অংশেও রাখা হয়নি। বরং সেখানে বলা হয়েছে—Charnock had previously had disputes with officials of the Mughal Empire at the river port of Hugli (Hooghly) and had been obliged to leave, after which he attempted unsuccessfully to establish himself at other places down the river. শুনে আশ্চর্য হবেন যে ব্রিটানিকার এ তথ্যটি ভুল। শুল্ক বিবাদের ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তি জব চার্নক নন, গভর্নর উইলিয়াম হেজেস।
ইতিহাসের কিছু ভুল যেমন থেকে যায় সত্যের চেহারায়, তেমনি অনেক গুরুতর সত্য আড়ালে চাপা পড়ে যায়। ভুল-শুদ্ধ বেছে নেয়ার জন্য পাঠককে হিমশিম খেতে হয়। বাংলার ইতিহাস লেখার কাজটি বাঙালির আগে শুরু করেছিলেন ইংরেজ লেখক। সেই ইতিহাসের একদিকে আছে ইংরেজের সততা আর বীরত্বগাথা, অন্যদিকে আছে বাঙালির শঠতা ও ভীরুতার কাহিনী। গৌরবের কোনো অংশে যেমন বাঙালির অংশ নেই, তেমনি পরাজয়ের অংশে ইংরেজের উল্লেখ নেই। অথচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন এ দেশে বাণিজ্য করতে এসেছিল, তখন কতটা সততা আর কতখানি শঠতার আশ্রয় নিয়েছিল, তা এখন ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন। ভারতবর্ষে বাণিজ্য শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার গ্লানি ছিল বেশি। সে কারণে কালিমাযুক্ত অংশগুলোকে যথাসম্ভব ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন ইতিহাস উপহার দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙালি ইতিহাস লেখকরাও তাদের অনুসরণ করেছেন। তাই আমাদের চোখ থেকে হারিয়ে গেছে ইংরেজের পুরনো কিছু কলঙ্ক।” (৫)
ঔপনিবেশিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ইংরেজরা বাস্তব ঘটনার ওপর ছুরি-কাঁচি চালিয়ে অভিনব এক কোলাজ যে তৈরি করেছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিককালে এর সপক্ষে বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। অদ্রে ত্রুশকে ও উইলিয়াম ডালরিম্পলের কাজগুলো সেগুলোরই উদাহরণ। কিন্তু ভাববার বিষয় হলো, মসনদে আসীন শ্বেতাঙ্গ প্রভুকে খুশি করার জন্যে পদলেহী পণ্ডিতের দল যে-সব ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, সেগুলো পাঠ করে নেহরুর মতো বিদ্বান ব্যক্তি যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে আমজনতার কী অবস্থা? আমাদের মগজধোলাই কী পরিমাণ হয়েছে তা টের পেলাম এপ্রিল মাসে এক সেমিনারে অংশ নিয়ে।
আলোচক ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি বললেন, ‘ইংরেজরা আসার আগে আমরা তখনকার হিসেবে সম্পদশালী ও প্রসপারাস দেশ ছিলাম। ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের পর দরিদ্র দেশে পরিণত হলাম।‘ সাথে সাথে শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক তরুণ দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, স্যার, ইংরেজরা কি আগে থেকেই ধনী ছিল না? তারা তো স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছে, যার ফলে শিল্পবিপ্লব ঘটল। আমরাও সেই টেকনোলজি দ্বারা কি উপকৃত হই নি? প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ধৈর্যসহকারে ব্যাখ্যা করলেন, ‘স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্যে যে কাঠামো দরকার তা গড়ার প্রয়োজনীয় পুঁজি ইংরেজ কোথায় পেল? বাংলা লুণ্ঠন করে। শোষণের পর যখন সে একটা পর্যায়ে গেল, তখন তার দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটল।’
তবু তরুণটি সন্তুষ্ট হলো না। সে আবারো প্রশ্ন করতে থাকল। এই তরুণটির মতো এদেশের অনেকেই বিশ্বাস করেন—‘ইংরেজরা অনাদিকাল থেকে ধনী সচ্ছল ও উন্নত সংস্কৃতির ধারক। জাহাজবোঝাই ইংরেজ (ও স্কটিশ) পেটের দায়ে বাংলার আসে নি, বরং বাংলা দখল করতে এসে তারা আমাদের উদ্ধার করেছে মহাসর্বনাশ থেকে।’ তাদের দোষ নেই। ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে তারা ব্রিটিশ বয়ানে রচিত ইতিহাসই গলাধঃকরণ করেন।
তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা দূর করার সচেতন কোনো প্রয়াস কি কোথাও দেখা যায়? সত্যটা তুলে ধরতে আমাদের ইতিহাসবিদরা কি কলম তুলে নিয়েছেন? নাকি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে সৃষ্ট হীনম্মন্যতা এবং আত্মবিস্মৃতির জগদ্দল পাথর বহন করে যেতে হবে আরো বহুদিন? মগজের গহীনে সাঁড়াশির মতো চেপে থাকা এই জাল থেকে কি মুক্তি নেই?
শেকড়-সচেতন না হলে মানুষ বড় বিপন্ন বোধ করে। বিভ্রান্তি তাকে সন্তর্পণে গ্রাস করে। আর দমকা হাওয়া এলে ছিন্নপত্রের মতো উন্মূল হয়ে সে ঘুরতে থাকে শূন্যে। আফ্রিকানরা একারণেই বলে থাকে, Until the lion learns how to write, every story will glorify the hunter. ইতিহাসের পাতা থেকে ঔপনিবেশিক অপলাপের গন্ধ মুছে ফেলার দায়িত্ব আমাদেরই। নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আপন ঐতিহ্যের সাথে। তার পাশাপাশি পূর্বপুরুষের সরলতা ও দূর্বলতার সাথেও। যেন নতুন কোনো ঔপনিবেশিক আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্যে তারা আগাম প্রস্তুত থাকতে পারে।
রেফারেন্স
১. Aurangzeb : The man and The Myth, Audrey Truschke (Penguin:Haryana, 2018) পৃষ্ঠা ১৪২
২. Aurangzeb’s villainisation bad history, but good storyline, দ্য টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া, ১২ আগস্ট ২০১৮
৩. An essay in imperial villain-making, উইলিয়াম ডালরিম্পল, দ্য গার্ডিয়ান, ২৪ মে ২০০৫
৪. The Yankee Maritime Merchants in ‘India Trade’: Their Contributions to American Industrial Revolution 1790-1830, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম (এশিয়াটিক সোসাইটি:ঢাকা, ২০১১) পৃষ্ঠা ৩১
৫. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চট্টগ্রাম অভিযান (১৬৮৬-৮৮) হারুন রশীদ, দৈনিক বণিক বার্তা মার্চ ২২, ২০১৯
Thanks for the informative piece. 🙂
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
জুনায়েদ ভাই,
ধন্যবাদ। কেউ এখনো দ্বিমত করল না দেখে অবাক হচ্ছি! 😛
চমৎকার লেখা, কৌশিক! অনেক অজানা তথ্য জানা হলো।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
জেনে খুশি হলাম। 🙂
ভালো আছেন, জিহাদ ভাই?