১৯২২। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তখন সুইজারল্যান্ডের লোজ্যান-এ। টরন্টো ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে গেছেন ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি ও তুরস্কের মধ্যে চলমান ‘লোজ্যান কনফারেন্স’ কাভার করতে। জীবিকার তাগিদে তিনি সাংবাদিকতা করছেন বটে কিন্তু অন্তরে দুর্মর আকাঙ্ক্ষা সাহিত্যিক হবার। তখনো পর্যন্ত লেখক হিসেবে খ্যাতিমান হওয়া তো দূরের কথা, হেমিংওয়েকে কেউ চিনতই না।
অধিকাংশ নবীন লেখকের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, সমঝদার কেউ প্রশংসা করলে তারা যেন বর্তে যায়। তাই লোজ্যানে সেই সময় উপস্থিত নামকরা এক সাংবাদিক যখন তার লেখার প্রশংসা করলেন হেমিংওয়ে দারুণ উৎসাহিত হলেন। সেই সাংবাদিক আরো কিছু গল্প পড়ার আগ্রহ জানালেন। হেমিংওয়ে তার স্ত্রী এলিজাবেথ হ্যাডলির কাছে বার্তা পাঠালেন — শিগগির চলে আসো। সাথে আমার লেখাগুলো নিও।
হেমিংওয়ে দম্পতির তখনকার নিবাস ছিল প্যারিস। হ্যাডলি ব্যাগ গোছানোর সময় তার পতিদেবতার যাবতীয় লেখা একটা স্যুটকেসে ভরে নিলেন। প্যারিসের লিওঁ স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগে হ্যাডলির মনে পড়ল যে লোজ্যান পৌঁছতে অন্তত ৮ ঘন্টা লেগে যাবে। তাড়াহুড়ো করে ট্রেন থেকে নামলেন এক বোতল পানি কেনার জন্যে। বগিতে ফিরে দেখেন স্যুটকেসটা লাপাত্তা। কন্ডাক্টরকে সাথে নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও স্যুটকেসের কোনো হদিস পাওয়া গেল না।
অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনায় ভীষণ মুষড়ে পড়লেন হ্যাডলি। পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে লোজ্যান পৌঁছলেন। স্টেশনে উপস্থিত হেমিংওয়ে স্ত্রীর শোকবিহ্বল অবস্থা দেখে তো বিস্মিত। পরবর্তীতে A Moveable Feast বইতে তিনি লিখেছেন —
“I had never seen anyone hurt by a thing other than death or unbearable suffering except Hadley when she told me about the things being gone. She had cried and cried and could not tell me. I told her that no matter what the dreadful thing was that had happened nothing could be that bad, and whatever it was, it was all right and not to worry. We could work it out.” (১)
হেমিংওয়ে তার স্ত্রীকে বললেন, চিন্তা কোরো না। প্রত্যেকটা লেখার কার্বন কপি ও ডুপ্লিকেট কপি রেখেছি। এটা শুনে হ্যাডলি আরো ভেঙে পড়লেন। কারণ স্যুটকেস গোছানোর সময় তিনি সমস্ত লেখার কার্বন কপি ও ডুপ্লিকেট কপিও নিয়েছিলেন। এইবার হেমিংওয়ের মাথায় যেন বাজ পড়ল। পরদিনই সোজা প্যারিস চলে গেলেন। লিওঁ স্টেশনের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড সেকশনে বহু খোঁজাখুঁজি করলেন। But with no luck!
একটা অসমাপ্ত উপন্যাস, ১২ টা ছোট গল্প ও অন্যান্য লেখা¬— হেমিংওয়ের কয়েক মাসের কঠোর পরিশ্রমের ফসল; সব নিমেষে হারিয়ে গেল। যা উদীয়মান একজন লেখকের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। এদিকে তখন হেমিংওয়ে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় লেখা ছাপানোর জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আবারো কয়েক মাস খেটেখুটে গল্প লেখার সময় তার হাতে নেই। হেমিংওয়ে তাই বাধ্য হলেন তার লেখার স্টাইল বদলাতে। দ্রুত লেখার জন্যে বেছে নিলেন সহজ নির্মেদ গদ্য — রচনার শুরুতে ছোট অনুচ্ছেদ এবং ছোট ছোট বাক্য। বহু বছর পরে তিনি তরুণ লেখকদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, “The first and most important thing of all, for writers today, is to strip language clean, to lay it bare down to the bone.”
স্যুটকেস হারানোর ৪ বছর পর ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস The Sun Also Rises। এবং অভিষেকেই বাজিমাত। দ্য আটলান্টিক পত্রিকা মতামত দেয় : Hemingway “writes as if he had never read anybody’s writing, as if he had fashioned the art of writing himself.” (২) দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মন্তব্য করে : “The Sun Also Rises is a truly gripping story, told in a lean, hard, athletic narrative prose that puts more literary English to shame.” (৩)
হেমিংওয়ে যদি তার পুরনো ঢংয়ে উপন্যাসটি লিখতেন তাহলে বইটির কপালে পাঠকপ্রিয়তা (ও গবেষক-সমালোচকপ্রিয়তা!) জুটত কিনা সন্দেহ আছে। আর ট্রেনের বগি থেকে সেদিন যদি তার সমস্ত রচনাসমেত স্যুটকেসটা চুরি না হতো তাহলে নতুন ধরনের গদ্যরীতি যে তিনি অবলম্বন করতেন না তার উল্লেখ বাহুল্য।
আপাতদৃষ্টিতে যা মহাবিপর্যয় মনে হয়েছিল, সেটাই গড়ে দিল তার সাফল্যের ভিত্তি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সেদিন তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছিলেন বলেই তার জীবনও বদলে গেল। আসলে প্রতিটি সমস্যার মধ্যেই নতুন সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। ইতিহাসে এর ভুঁড়ি ভুঁড়ি উদাহরণ আছে। যেমন, ১৫০০ সালে পর্তুগিজদের ভারত অভিযান।
ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ঘটনাটির চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তার ‘ফিরিঙ্গি বণিক’ বইতে—
“পর্তুগালের অধীশ্বর ভারত-বিজয়ের আয়োজন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ অর্ণবপোত সজ্জীভূত হইল। তাহাতে গোলা, বারুদ ও কামান উত্তোলিত হইল। যাহারা সুবিখ্যাত নাবিক, সুশিক্ষিত সৈনিক — তাহারাই ভারত-যাত্রার জন্য নির্বাচিত হইল। … ৮ই মার্চ ১২০০ আরোহী লইয়া ত্রয়োদশ অর্ণবপোত বিজয়-যাত্রার জন্য প্রস্ততু হইল।
… আফ্রিকার পশ্চিমতটের নিকট দিয়া দক্ষিণাভিমুখে পোতচালনা করিবার সময়ে, ঝটিকা-বেগে পোতসকল পথভ্রষ্ট হইয়া, অন্য পথে ধাবিত হইতে লাগিল। এই আকস্মিক দুর্ঘটনাই পর্তুগালের পক্ষে এক নতুন সৌভাগ্যলাভের কারণ হইয়া উঠিল। এপ্রিল মাসের শেষে নৌ-সেনাপতি দেখিলেন, —সম্মুখে এক নিবিড় বন; —তাহা ভারতবর্ষের তালবন নহে; এক অজ্ঞাতপূর্ব নতুন রাজ্যের সমুদ্রসীমা!
পর্তুগাল এইরূপে যে রাজ্যের সন্ধান প্রাপ্ত হইল, তাহা এক্ষণে ব্রেজিল দেশ নামে সর্বত্র সুপরিচিত হইয়াছে। একদিকে এই নূতন রাজ্য পর্তুগালের অধিকারভুক্ত হইল, —কেবল বায়ুপ্রবাহের উচ্ছৃঙ্খল গতি এইরূপে অকস্মাৎ পর্তুগালের সৌভাগ্যবর্ধন করিল!” (৪) and thus the immense Empire of Brazil, the brightest jewel in the Portuguese Crown, ” was won in a single day, Providence requiring merely to invoke the winds. (৫)
প্রবল বাতাসের দাপটে ভুল পথে গিয়ে পর্তুগিজ নাবিকরা ব্রাজিলের মতো বিশাল একটি দেশ আবিষ্কার করে ফেলল। এবং উপনিবেশ বানিয়ে ৩০০ বছর ধরে শোষণ করল। ভাবা যায়? রজনীকান্তের সিনেমার চিত্রনাট্যকারও তো এমন অবিশ্বাস্য প্লট লেখার দুঃসাহস দেখাবে না! তবে শুধুই কি আর ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে? সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে সাফল্য পেতে প্রয়োজন সচেতন প্রচেষ্টা। যেমনটা করেছিল মার্কিন হাই জাম্পার ডিক ফবসবারি।
স্কুলপড়ুয়া ফবসবারির খেলাধুলার প্রতি বেজায় আগ্রহ। ফুটবল থেকে শুরু করে হেন খেলা নেই যা সে চেষ্টা করে নি। এমনকি তালগাছের মতো লম্বা হয়েও (৬ ফুট ৪ ইঞ্চি) বাস্কেটবলে পর্যন্ত সে সুবিধা করতে পারল না। শেষমেষ নাম লেখায় হাইজাম্পে। স্কুলে একদিন একজন তার সাথে বাজি ধরল যে সে জাম্প দিয়ে একটা চেয়ারও পার হতে পারবে না। ফবসবারি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। বাজি তো হারলই, সেইসাথে ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ের সময় একটা হাতও ভেঙে ফেলল। কোচও দেখলেন ঢ্যাঙা ছেলেটি টেনেটুনে বড়জোর ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার বার পেরোতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই তাকে নিয়ে কোচের ন্যূনতম প্রত্যাশা ছিল না।
সেই সময় (১৯৬৩) হাই জাম্পারদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টাইল ছিল ওয়েস্টার্ন রোল (মুখ নিচের দিকে থাকবে, এক ঠ্যাং প্রথমে নিয়ে পরে আরেক ঠ্যাং) ও সিজর্স। বহু কসরত করেও ফবসবারি এর কোনোটাই আয়ত্ত করতে পারল না। সে ভাবতে শুরু করল। তারপর সিদ্ধান্ত নিল, ভালো করতে হলে তাকে নতুন কোনো উপায়ে জাম্প দিতে হবে। ফবসবারি জাম্প দেয়ার নতুন স্টাইল উদ্ভাবন করল।
ভঙ্গিটা প্রচলিত স্টাইলগুলোর ঠিক উল্টো। লম্বা রানআপ নিয়ে পেছনদিক ফিরে জাম্প করে দু পা একসাথে তুলে শরীরকে বারের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দেয়া। এবং প্রথম দিনেই সে ৬ ফুট উচুঁতে রাখা বারের ওপর দিয়ে জাম্প করল। হাই জাম্পে একজন অ্যাথলেটের উন্নতিটা হয় দিনে দিনে, ইঞ্চির ভগ্নাংশ হিসেবে। সেখানে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ৬ ইঞ্চি উন্নতি বিশাল ব্যাপার। তবু ফবসবারিকে কেউই সিরিয়াসলি নিল না। এমনকি তার কোচও না। সবাই বলল, স্টাইলটা শুধু অদ্ভুত আনকোরা নয়, ভীষণ বিপদজনকও। লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় ঘাড় মটকে যেতে পারে। তুমি বাপু এসব ছাড়ো।
নেতিবাচক কথায় প্রভাবিত না হয়ে ফবসবারি লেগে থাকল। যে অ্যাথলেট চেয়ার পেরোতে গিয়ে হাত ভেঙেছিল সে-ই একসময় সাড়ে ৬ ফুট উচুঁ বার অনায়াসে পেরোতে লাগল। ১৯৬৮ সালে মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক টিমেও চান্স পেয়ে গেল।
প্রতিযোগিতার দিন বাকি সব প্রতিযোগী লাফ দিচ্ছে একভাবে। কেবল ফবসবারি তার নিজস্ব স্টাইলে। স্টেডিয়ামে উপস্থিত ৮০ হাজার দর্শক তো টিটকারি দেয়া শুরু করল। কিন্তু যখন সে একের পর এক প্রতিযোগীকে টপকাতে লাগল, দর্শকরা গলা ফাটিয়ে তাকে উৎসাহ দিতে লাগল।
এবং ডিক ফবসবারি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতে নিল নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। বদলে গেল হাই জাম্পের ইতিহাস। ১৯৭২ সালে পরের অলিম্পিকে ১৬ জন ফাইনালিস্টের ১৩ জনই ফবসবারি ফ্লপ প্রয়োগ করল। বর্তমানে এটাই হাই জাম্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য স্টাইল।
আসলে ঈশ্বরের লীলাখেলা বোঝা ভার। হেমিংওয়ের সমস্ত কিছু তিনি কেড়ে নিয়েছিলেন তাকে আরো মূল্যবান কিছু দেবেন বলে। পর্তুগিজদের উত্তাল সাগড়ে আছড়ে ফেললেন নতুন গন্তব্যের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্যে। আর ফবসবারি প্রচলিত রাস্তায় যদি হোঁচট না খেত সে কখনো আবিষ্কারের প্রেরণা পেত না। আজীবন মিডিওকারই থেকে যেত।
এ উদাহরণগুলো এটাই বলে, জীবনে সকল রাস্তা কখনোই বন্ধ হয়ে যায় না। কোনো না কোনো দরজা খুলে যায়। ইশারা সে-ই বুঝতে পারে যে জানে —
.. হৃদয়ে মোর
তীব্র দহন জ্বালো
আমার এ ধূপ না পোড়ালে
গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
আমার এ দীপ না জ্বালালে
দেয় না কিছুই আলো।
যখন থাকে অচেতনে
এ চিত্ত আমার
আঘাত সে যে পরশ তব,
সেই তো পুরস্কার। (৬)
তথ্যসূত্র:
১. A Moveable Feast, Earnest Hemingway, CHARLES SCRIBNER’S SONS (New York), 1964
২. Hemingway: A Life Without Consequences, James R. Mellow, Da Capo Press, 1993, P. 334–336
৩. The New York Times, 31 October, 1926
৪. ফিরিঙ্গি বণিক, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কল্লোল, ২০১০, পৃষ্ঠা ৬৩-৬৪
৫. Portuguese Discoveries Dependencies and Missions in Asia and Africa, By Alexander James Donald D’Orsey, Asian Educational Service (New Delhi), 1998, P.24
৬. গীতাঞ্জলি, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী, ২৫ বৈশাখ ১৩৪৯, পৃষ্ঠা ১১৬
চমৎকার, কৌশিক। মোটিভেশনাল রাইটার তো হয়েছিসই, এইবার স্পিকার হয়ে যা। 😉
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
ধন্যবাদ মাহমুদুল ভাই। 🙂
আপনার লেখা পড়ি না অনেকদিন। ব্যস্ত নাকি বেশ?