বিনয়ীরাই বিজয়ী

“You must be humble, as it is one of the greatest [forms of] worship.”
-হযরত আলী (রা)

জার্মানির বন শহরে সুরসম্রাট বিটোভেন-এর বাড়ি। তার মৃত্যুর পর সেই বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। জাদুঘরের একটি ঘরে রাখা আছে সেই মহামূল্যবান পিয়ানো যা দিয়ে বিটোভেন সৃষ্টি করেছিলেন অমর সব রাগ।

একবার সেই জাদুঘর পরিদর্শনে এলো লিবারেল আর্টসের জন্যে বিখ্যাত মার্কিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাসার কলেজের একদল শিক্ষার্থী। স্বাভাবিকভাবেই বিটোভেনের স্মৃতি-বিজড়িত পিয়ানো দেখে তারা উচ্ছসিত হয়ে গেল। এক ছাত্রী সেই ঘরের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীর হাতে গোপনে মোটা বকশিশ গুঁজে দিল। সকাতর অনুরোধ- এক মিনিটের জন্যে বিটোভেনের পিয়ানো বাজাতে দিতে হবে।

অনুরোধ মঞ্জুর হলো। মেয়েটি আবেগে থরোথরো অবস্থায় মুনলাইট সোনাটা-র অংশবিশেষ বাজাল। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে গার্ডকে বলল, যে-সব বিখ্যাত পিয়ানোবাদক এখানে এসেছিলেন, তারা প্রত্যেকেই নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের জন্যে হলেও এই পিয়ানো বাজিয়েছেন।

নিরাপত্তারক্ষী হেসে বলল, মিস, আপনার ধারণা মোটেই ঠিক নয়। বছর দুয়েক আগে মি. পেদেরস্কি (বিশ্বখ্যাত পিয়ানোবাদক) এসেছিলেন। তিনি এই পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, এই পিয়ানো স্পর্শ করার যোগ্যতাও আমার নেই।

বিনয়ের এই প্রকাশ কেবল পেদেরস্কিই নয়, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা যারা করেন তাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখা যায়। যেমন, বিশ্বজোড়া নামডাক হবার পরও পন্ডিত রবিশঙ্কর তাঁর গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নাম নেবার সময় কানে হাত ছোঁয়াতে ভুলতেন না। এই বিনয়ী আচরণের মধ্য দিয়ে রবিশঙ্কর গুরুর প্রতি যেমন শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন তেমনি নিজেও কি অপরের চোখে আরো সম্মানিত হতেন না?

২.
বিনয়ী হবার মাপকাঠি গুগল করে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সহজ যে উদাহরণটি মাথায় ঘুরছে সেটি বলে ফেলি। মুখে বোল ফুটবার পর পরই আমাদের বংশের সব শিশুকে পাকাপোক্তভাবে শেখানো হয়- মুরব্বিদের সাথে দেখা হলে অবশ্যই সালাম দেবে। ছোটবেলা থেকেই বড়দের তাই সালাম দেবার অভ্যাস আমার। তবে দু-এক বছরের বড় কাজিন বা স্কুলের সিনিয়রদের সালাম দিতাম না মোটেই। ওদের অত পাত্তা কে দেয়!

ক্যাডেট কলেজে গিয়ে সে অভ্যাস-ও বদলাল। এক ব্যাচ সিনিয়রকেও যে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া উচিত তা শিখলাম। এখনো ২০০৩ ইনটেকের কোনো সিনিয়রের সাথে দেখা হলে হাই-বাই না বলে আগে সালাম দেই। তাহলে আমাকে কি বিনয়ী বলা যাবে? না, যাবে না।

বরং যদি কোনো জুনিয়রের সাথে দেখা হয়, আর সালামের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই আগে সালাম দিতে পারি নির্দ্বিধায়, তাহলে বিনয়ের ছিটেফোঁটা আমার ভেতরে থাকলেও থাকতে পারে। সমস্যা হলো, আমাদের অধিকাংশের পক্ষেই অধস্তনের সাথে বিনয়ী আচরণ করা এক বিষম বিড়ম্বনা। রিকশাওয়ালা, গৃহকর্মীকে অবলীলায় তুই/তোকারি করাই যেন স্বাভাবিক। প্রত্যেকেই ক্ষুদে হিটলার। তাই দোর্দন্ডপ্রতাপশালী কোনো শাসক বা সেনাপতি বিনয়ী ছিলেন এমন ঘটনা জানলে অবাক হতে হয় বৈকি।

খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজের (ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমরের প্রপৌত্র) শাসনামলে উমাইয়া সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল পশ্চিমে ফ্রান্স থেকে পূর্বে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত। তো, এক রাতে খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজের সাথে দেখা করতে এলেন এক লোক। খলিফা কুপির আলোয় লিখছিলেন।

তেল ফুরিয়ে গিয়ে আলো যখন নিভু নিভু লোকটি বলল, ইয়া আমিরুল মুমিনিন, আমি কি তেল ভরে আনব? খলিফা বললেন, অতিথিকে দিয়ে চাকরের কাজ করিয়ে নেয়া মেজবানের জন্যে অত্যন্ত অসম্মানের। লোকটি তখন বলল, তাহলে কি আপনার চাকরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলব?

খলিফা এবারও তাকে নিরস্ত করলেন। বললেন, ও বেচারা একটু আগে ঘুমাতে গেছে। কাঁচা ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না। এটা বলে তিনি নিজেই উঠে গিয়ে কুপিতে তেল ভরলেন।

আগত অতিথি তো মহা বিস্মিত। সে বলল, ইয়া আমিরুল মুমিনিন, এই সামান্য কাজটি করা কি আপনার শানের সঙ্গে মানায়? খলিফা হেসে বলল, কেন? আমি যখন উঠে গিয়েছিলাম তখনো উমর ছিলাম। তেল ভরে ফিরে আসার পরেও তো আমি উমরই রয়ে গেছি। ক্ষতিবৃদ্ধি তো কিছু হয় নি আমার। বিনয়ী মানুষই স্রষ্টার চোখে শ্রেষ্ঠ।

অবশ্য উদাহরণ খোঁজার জন্যে তেরশ বছর পেছনে না গেলেও চলবে। একবার আইআইটি বারাণসির সমাবর্তনে গিয়েছিলেন ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ পিজে আবদুল কালাম। মঞ্চে উঠে ড. কালাম দেখলেন পাঁচটি চেয়ার সাজিয়ে রাখা আছে। মাঝের চেয়ারটি বাকি চারটির তুলনায় খানিকটা উঁচু।

ড. কালাম কোনোভাবেই সেই চেয়ারে বসতে রাজি হলেন না। উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অনুরোধ করলেন উঁচু চেয়ারটিতে বসতে! অতঃপর আরেকটি সাধারণ চেয়ার আনা হলো। এবার ড. কালাম আসন গ্রহণ করলেন। অসাধারণ এই মানুষটির কাছে আমাদের (এবং ভিআইপিদের) শেখার অনেক কিছুই আছে বটে।

৩.
কিন্তু বিনয়ী হয়ে লাভটা কী? পবিত্র বাইবেলে আছে, যে নিজেকে বড় বলে, তাকে অবনত করা হবে, আর যে বিনয়ী হয়, তাকে সম্মানিত করা হবে। (লূক ১৮;১৪)। (২) বিধিবাম! আজকাল সম্মান-শ্রদ্ধার বাজারমূল্য তেমন একটা নেই। নতুন কোনো অভ্যাস গড়ে তোলা বা কিছু শিখবার আগে আমরা আধুনিক মানুষরা খোঁজ নিই পয়সার ঝনঝনানি নিকটে না হোক দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে তো?

দ্বিমত পোষণকারীদের জন্যে ছোট্ট উদাহরণ। কাকডাকা ভোরে ওলি বুজুর্গরা নামাজে কিংবা ঋষিরা প্রার্থনায় নিমগ্ন হতেন-এই তথ্যে আমাদের সুখনিদ্রা ব্যাহত হয় না। কিন্তু হাফিংটন পোস্ট কিংবা অন্য কোনো অনলাইন পোর্টালে যখন দেখি ওয়াল স্ট্রিট আর সিলিকন ভ্যালির সিইও-রা ভোরবেলা ট্রেডমিলে নানারকম ইতং-বিতংয়ে ব্যস্ত থাকেন, তখন আমরাও ভোরবেলা উঠবার ব্যাপারে আগ্রহ হয়ে উঠি।

তূলনামূলক ব্যাখ্যায় না গিয়ে বিনয়ী হবার অর্থকরী দিকটা বরং তুলে ধরি। ব্যবসায় শাস্ত্রের তীর্থস্থান হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের মুখপত্র হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, বিনয়ী কোনো মানুষ কোম্পানির প্রধান হলে কোম্পানির পারফরম্যান্স তখন সবচেয়ে ভালো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ১০৫ টি কম্পিউটার সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর গবেষণা পরিচালনা করে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। (৩)

একই পত্রিকায় ২০১৪ সালে প্রকাশিত The Best Leaders Are Humble Leaders শীর্ষক নিবন্ধে আরো মজার তথ্য আছে। কর্মী বিনয়ী হলে মুনাফা বাড়ে এটা টের পেয়ে টেক-জায়ান্ট গুগল নতুন এক্সিকিউটিভ নিয়োগের সময় প্রার্থী কতটা বিনয়ী সেটার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া শুরু করেছে! (৪)

বিনয়ী মানেই অবনত হওয়া নয়। বিনয় মানে দূর্বল চিত্তের মানুষের মিনমিনে আওয়াজ নয়, বরং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আত্মবিশ্বাসী মানুষের সফলতার নেপথ্য রহস্য হলো বিনয়।

অতএব, আসুন পারস্পরিক আচরণে সংযত ও বিনয়ী হই। বিনয়ের অক্ষয় কিরণে পরকালে পরিত্রাণ লাভের পাশাপাশি ইহকালেও আর্থিক সমৃদ্ধি বাড়ার সম্ভাবনা বাড়বে দ্রুত বেগে।

তথ্যসূত্র:
১. Al-Ghazali The Mystic, মার্গারেট স্মিথ, হিজরা ইন্টারন্যাশনাল পাব্লিশার্স, ১৯৮৩, পৃ: ৪৮
২. বাইবেল কণিকা, আলোকিত জীবনের হাজার সূত্র কোয়ান্টাম কণিকা, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, ২০১০, পৃ: ৩২১
৩. If Humble People Make the Best Leaders, Why Do We Fall for Charismatic Narcissists?, মার্গারিটা মেয়ো, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, এপ্রিল ২০১৭
৪. The Best Leaders Are Humble Leaders, জিনিন প্রাইম ও এলিজাবেথ সালিব, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, মে ২০১৪

৬,৩৪৫ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “বিনয়ীরাই বিজয়ী”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।