যা পড়ছি এখন ।। ভাঙো দুর্দশার চক্র

কদিন ধরে পড়ছি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের নতুন বই ভাঙো দুর্দশার চক্র । কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরই মনে হলো হতাশাগ্রস্ত লক্ষ্যহীন কিশোর-তরুণ কিংবা কেবল অর্থ উপার্জনের পেছনে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকা বন্ধুটির হাতে এই বইটি পৌঁছে দেয়া অত্যন্ত জরুরি।

চারপাশে বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতার খোলসে বন্দী মানুষের সংখ্যা। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা, পরমত অসিহষ্ণুতা। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, বিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিকে কি মানুষ বলা যায়? ভাঙো দুর্দশার চক্র বইটির প্রথম অধ্যায়ে পেয়ে গেলাম উত্তর —

পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে অসহায় এবং দুর্বল হচ্ছে মানুষ। দেখবেন, একটা গরুর বাচ্চা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দেয়। … কিন্তু মানুষকে জন্মের পর অন্তত একটানা দুটো বছর বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে হয়। সে থাকে একেবারেই অক্ষম। অথচ এই মানুষই একদিন হযরত মুহাম্মদ (স) হন, গৌতম বুদ্ধ হন, যিশুখ্রিষ্ট হন। আবার দুর্ধর্ষ চেঙ্গিস খান বা হিটলার হয়। গোটা পৃথিবীর চাইতেও বড় হয়ে ওঠে।

এমন যে অসহায় আর দুর্বল মানুষ, সে কী করে বেঁচে থাকে পৃথিবীতে? শুধু কি নিজের শক্তিতে? না। এরিস্টটল বলেছিলেন, ‘মানুষ সামাজিক প্রাণী। সে বেঁচে থাকে তারই মতো মানুষদের শুভবোধের কারণে।‘ মানুষের চারপাশে অনেক মানুষ আছে বলে প্রতিটা মানুষ এ পৃথিবীতে বেঁচে আছে। … না হলে একা মানুষ পৃথিবীতে প্রায় কিছুই নয়। যে-কোনো মুহূর্তে সে হারিয়ে যেতে পারে।

(পৃষ্ঠা ১৫)

আসলেই তো তাই। গোষ্ঠীবদ্ধতা ও সমমর্মিতা ছিল বলেই না আদিম মানব জয় করতে পেরেছিল সমস্ত প্রতিকূলতা। সঙ্ঘশক্তিতে বলীয়ান মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতা। মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করলে কী ঘটবে তা সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।

রাশিয়ার চিঠি-তে তিনি লিখেছেন,

মানুষ যেখানে ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন, পরস্পরের সহযোগিতা যেখানে নিবিড় নয়, সেইখানেই বর্বরতা।

কিন্তু অপরের কথা ভাববার সময় কোথায়? সবাই তো ব্যস্ত সেলফি তোলায়। আত্মপ্রেমে মদির মানুষ হৃদয়ে তো দূরের কথা, ছবিতেও অন্যকে জায়গা দিতে নারাজ। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর সায়ীদ স্যার তাঁর বাল্যকালের একটি স্মৃতির উল্লেখ করে বলেছেন-পাওয়ার মধ্য দিয়ে নয়, মানুষের বড় আনন্দ দেওয়ার মধ্য দিয়েই।

২. ভাঙো দুর্দশার চক্র বইটি মূলত লেখকের দশটি বক্তৃতা ও দুটি সাক্ষাৎকারের সংকলন। উঠে এসেছে তাঁর জীবনের নানা অধ্যায়-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, ষাটের দশকের সাহিত্য আন্দোলন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কাহিনী।

সেইসঙ্গে বিচিত্র সব বিষয়ে তাঁর ভাবনা-বার্ধক্য, ভয়, ইতিবাচকতা, বিশ্বাস, স্বেচ্ছা রক্তদান, সঙ্ঘ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা, মৃত্যু, লক্ষ্য নির্ধারণ ইত্যাদি। আর অসাধারণ কিছু চিরায়ত গল্প, ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ তো আছেই।

বইটি পড়তে পড়তে কখনো হো হো করে হেসে উঠেছি, কখনো আবার পড়া থামিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছি। যেমন কাজ বিষয়ে স্যারের দৃষ্টিভঙ্গি। নেতিবাচকতা একটা মায়া, একটা বিভ্রম, একটা মরীচিকা অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন-

কাজ। জীবনের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট গ্লানি বঞ্চনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এটি। কাজ নয় শুধু, আনন্দের কাজ। ক্ষান্তিহীন নিরবচ্ছিন্নভাবে জীবনকে সজীব করার মতো। মনের একটা খুব বড় গুণ আছে। আমরা যদি মনের মতো কাজের মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে দিতে পারি, তবে জীবনের ভেতর দ্বিতীয় কিছুর জায়গা এমনিতেই কমে যায়। তাই কাজ করা মানেই ইতিবাচক হয়ে ওঠা। আমি সবসময় বলি, কাজ হচ্ছে গঙ্গাজল। কাজের মধ্যে বেঁচে থাকা মানে জীবনোল্লাসের মধ্যে বেঁচে থাকা। নেতিবাচকতা তখন আর স্পর্শ করতে পারে না।

(পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)

আর নিমগ্ন কাজ কীভাবে হতাশা দুঃখবিলাস ঝেঁটিয়ে দূর করে সে প্রসঙ্গে শেষ অধ্যায়ে যে গল্পটি আছে, তা উল্লেখ না করলেই নয়।

জাপানে এক রকমের সুস্বাদু খাবার আছে। নাম সুশি। তাতে প্রথমে কিছু মাছের বাচ্চা কাঁচা অবস্থায় ফালি ফালি করে কাটা হয়। তারপরে একটা সস্ দিয়ে সেগুলো খাওয়া হয়। এটা একটা পৃথিবী বিখ্যাত খাবার। কিন্তু যেসব মাছ দিয়ে সুশি তৈরি হয়, সে মাছ সমুদ্র থেকে ধরে পাত্রে করে নিয়ে আসতে যে সময় লাগে, তার মধ্যে ওই মাছের বাচ্চাগুলোর একটা বড় অংশ মরে যায়। আর মরে গেলে সুশির স্বাদও যায় কমে। এখন এদের বাঁচিয়ে রাখার উপায় কী?

এই নিয়ে শুরু হল গবেষণা। বিস্তর চিন্তাভাবনার পর একটা বুদ্ধি বের হল : যেসব পানিভর্তি বিশাল বিশাল পাত্রে করে ঐ মাছের বাচ্চাগুলোকে আনা হচ্ছে, ওগুলোতে কিছু কিছু হাঙরের বাচ্চা ছেড়ে দাও। এতে দেখা গেল, হাঙরের বাচ্চাগুলো ওদের খাওয়ার জন্য সারা পাত্রজুড়ে যেমন দৌড়াচ্ছে, তেমনি সুশি মাছগুলোও নিজেদের বাঁচানোর জন্য প্রাণভয়ে দৌড়ে চলেছে। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় ভুলেই যাচ্ছে যে, ওদের আসলে মারা যাওয়ার কথা ছিল!

এরপর সায়ীদ স্যার লিখেছেন-

আমার জীবনের ভেতরে আমিও ওরকম এক দঙ্গল হাঙরের বাচ্চা ছেড়ে দিয়েছি। সেই হাঙরের বাচ্চাগুলোর নাম হল কাজ। আমি কাজ বাড়িয়ে দিয়েছি। এমনভাবে বাড়িয়েছি যাতে ও ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা আমাকে দখল করতে না পারে।

সত্যি বিস্মিত হতে হয় আশাবাদী এই মানুষটির বহুমুখী কাজে সম্পৃক্ততার পরিমাণ দেখে। বইপড়া কর্মসূচির মাধ্যমে একটি জাতির মনন নির্মাণের দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা, মুমূর্ষু ঢাকা শহরকে সবুজ করে তোলার আন্দোলন, সাহিত্যচর্চা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিচালনা-আরো কত কী! বিপুল কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বলেই না সাতাত্তর পেরিয়েও তিনি তরুণ। আর তাঁর সেই তারুণ্য ও অদম্য আশাবাদ সঞ্চারিত করে চলেছেন আমাদের মাঝে।

বি.দ্র. ভাঙো দুর্দশার চক্র বইটি প্রকাশিত হয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে। কিনেছি ১৫০ টাকায়।

৫,৮১৯ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “যা পড়ছি এখন ।। ভাঙো দুর্দশার চক্র”

  1. :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:
    অসাধারণ! লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগল। সায়ীদ স্যার বলেন যেমন, তাঁর লেখাও ততটাই চিত্তাকর্ষক আর চিন্তা-জাগানিয়া। সেই তরুণ বয়সে সায়ীদ স্যারের 'বহে জলবতী ধারা : ১ম ও ২য় খণ্ড', 'নিষ্ফলা মাঠের কৃষক', 'ভালোবাসার সাম্পান', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'বিস্রস্ত জর্নাল', 'সংগঠন ও বাঙালি' ইত্যাদি বইগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছিলাম। অভূতপূর্ব কিছু জীবনদর্শনের সন্ধান পেয়েছিলাম। চিন্তার জগতে নতুন নতুন কিছু জানালা খুলে গিয়েছিল। এই রিভিউটা পড়ে মনে হচ্ছে, 'ভাঙো দুর্দশার চক্র' বইটাও তেমনি একটা দারুণ কিছু হবে। বইটার কথা দিনকয়েক আগে একজন বন্ধুও আমাকে বলেছিলেন, তারপর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের কয়েকটা বুকশপে খুঁজেও ছিলাম, কিন্তু পাই নি। কোথায় পাব বইটা? রকমারি-র ওয়েবসাইটে অবশ্য আছে দেখলাম। ধন্যবাদ জনাব কৌশিককে। ক্যাডেট কলেজ ব্লগকেও ধন্যবাদ।

    জবাব দিন
  2. পড়েছি! পড়েছি! এককথায় অনবদ্য। এক কাজিনের কাছ থেকে শুনে বইমেলার শেষদিন কিনেছি কোয়ান্টামের স্টল থেকে। তারপর একটানে পড়ে শেষ করেছি। বইটার শেষদিকে জাপানের সুশি মাছ নিয়ে একটা গল্প আছে। ভীষণ ইন্সপায়ারিং। গল্পটা পড়ার পর প্রথম অনুভূতিটা হয়েছিল অসাধারণ। মনে হয়েছিল, এরপর আর কারো পক্ষে হতাশ, নিরাশ, বিষন্ন থাকা সম্ভব হয় কী করে? বইয়ে এরকম গল্প আছে আরো অনেক। কোনোটা হাস্যরসাত্মক, কোনোটা দারুণ ইন্সপায়ারিং। বহুদিন পর ক্যাডেট কলেজ ব্লগে ঢুকে হঠাৎ এ বইটা নিয়ে লেখা দেখে খুব ভালো লাগল। আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বিক্রয় কেন্দ্রে বইটা পাওয়া যায়, গত সপ্তাহেই ওখান থেকে কিনেছি, এক বন্ধুকে গিফট করব বলে। আরো ভালো বুদ্ধি আছে ই-বুক হিসেবে ডাউনলোড করে পড়তে চাইলে। http://quantummethod.org.bd এই ঠিকানায় ডাউনলোড অপশন দেয়া আছে। ফ্রি ডাউনলোড!!

    জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    বিপুল কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বলেই না সাতাত্তর পেরিয়েও তিনি তরুণ। আর তাঁর সেই তারুণ্য ও অদম্য আশাবাদ সঞ্চারিত করে চলেছেন আমাদের মাঝে --একদম ঠিক কথা। যে কাজ করে আনন্দ পাওয়া যায়, আমাদের উচিত সেসব কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা। এতে ইতিবাচকতা বাড়ে।

    জবাব দিন
    • কৌশিক(২০০৪-২০১০)

      সম্ভবত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই শেষমেষ সফল ও ব্যর্থ মানুষের আলাদা পরিণতির নেপথ্যে। কাজের ব্যাপারে সায়ীদ স্যার আরো কিছু চমৎকার কথা বলেছেন ভাঙো দুর্দশার চক্র বইটাতে।

      একটা মোমবাতির সাফল্য কোথায়? শুধু স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকায়, না জ্বলে জ্বলে আলো দিয়ে নিঃশেষ হওয়ায়? আলো দেওয়াতেই তো তার সার্থকতা। আমাদের জীবনও তা-ই। নিরন্তর কাজের ভেতর জ্বলে ছাই হয়ে চারপাশটাকে আলোয় ভরিয়ে দিতে পারলেই তার সার্থকতা।

      ধন্যবাদ আপনাকে। সুচিন্তিত মতামত দেয়ার জন্যে এবং সময় করে পড়বার জন্যে। (সম্পাদিত)

      জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    আমাদের জীবনও তা-ই। নিরন্তর কাজের ভেতর জ্বলে ছাই হয়ে চারপাশটাকে আলোয় ভরিয়ে দিতে পারলেই তার সার্থকতা। -- জীবনের এই ইঁদুর দৌড়ের মাঝে কথাটা যদি সবাই একটু ভেবে দেখার সময় করতে পারতো!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।