বার্মা যাচ্ছি শুনে গোত্রবর্ণ (ও স্বভাব) নির্বিশেষে সকল শুভানুধ্যায়ী ভুরু কুঁচকে তাকালেন। কেউ কেউ আলটপকা বলেও ফেললেন, ওহে, নৌকায় চড়ে যাচ্ছ নাকি সাঁতরে যাচ্ছ? এসব কথা গায়ে না মেখে মার্চ মাসের এক সকালে চেপে বসলুম উড়োজাহাজে।
ঘন্টা দুয়েক পর পৌঁছে গেলাম ইয়াঙ্গন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ইমিগ্রেশনের গেরো পেরিয়েই পড়লাম অভাবনীয় চক্করে। বনবন করে মাথা ঘুরতে লাগল। যারা মায়ানমার যাবেন, তাদের জন্যে বলছি। এবেলা কানখাড়া করে শুনে নিন।
মার্কিন ডলারের যে নোটখানা মানি এক্সচেঞ্জে ভাঙাবেন, তা কেবল কড়কড়ে হলেই চলবে না। হতে হবে একদম নিখুঁত। কোনোধরনের কলমের দাগ, স্ট্যাপলারের পিনজনিত ফুটো কিংবা সিলছাপ্পড় থাকলে সে নোটখানা আর নেবে না বার্মিজরা। অনেক দৌড়াদৌড়ির পর চলনসই নোটগুলো ভাঙিয়ে রওনা দিলাম ডাউনটাউনের দিকে।
দেখলাম শহরের রাস্তাগুলো বেশ প্রশস্ত। মোড়ে মোড়ে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে নেই। তবু সবাই দিব্যি সিগনাল মেনে চলছে। হোটেলে পৌঁছলাম সন্ধ্যার পরে। ইয়াঙ্গন মায়ানমারের ব্যস্ততম নগরী হলেও রাত আটটার পর অধিকাংশ পথঘাট শুনশান হয়ে পড়ে।
পরদিন কাকডাকা ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে ঢুঁ দিলাম কাঁচাবাজারে। মাছ মাংস আর শাকসব্জির পাশাপাশি দেদারসে বিক্রি হচ্ছে রংবেরংয়ের ফুল। অফিস আদালত দোকানপাট সবখানেই ওদেশের মানুষ ফুল সাজিয়ে রাখে। ইয়াঙ্গনের আরেকটা বিশেষত্ব হলো, মানুষের চেয়ে কবুতরের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আগলে রেখে নগরায়নের যে চেষ্টা তা করছে তা দেখে ভারি ভালো লাগল।
এরপর হাজির হলাম মহাবনডুলা পার্কে। পার্কের পাশেই ব্রিটিশদের বানানো আদালত ভবন। আরেকপাশে সিটি হল। যার চারদিকে রয়েছে সুলে প্যাগোডা, বাঙালি সুন্নী জামে মসজিদ, ইমানুয়েল ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ও হিন্দু মন্দির। সময় নিয়ে এসব ঘুরে দেখছি। এদিকে সূর্যও চলে গেছে মধ্যগগনে। তাপমাত্রা প্রায় ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস! অগত্যা ঠাণ্ডা ফলের শরবত খেয়ে গলা ভেজালাম। ওদেশে গিয়ে সস্তা এবং ভেজালবিহীন ফল না খাওয়া বোকামিই বটে। কিছুক্ষণ জিরোনোর পর বিকেলনাগাদ হাজির হলাম শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের মাজারে।
ওখানকার পরিবেশটাই এমন যে কল্পনার ট্রেন একরাশ ধোঁয়া উড়িয়ে অবশ্যই আপনার মনকে উদাস করে ফেলবে। বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি বাহাদুর শাহ ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হলেন। তার জীবনের শেষ দিনগুলো গৃহবন্দী হয়ে কাটল অজানা বার্মা মুলুকের ছোট্ট এক কুটিরে। মৃত্যুর পরও রেহাই পেলেন না। দায়িত্বরত ব্রিটিশ অফিসার লুকিয়ে ফেলল রাজ্যহারা সম্রাটের আসল কবর। মুঘল সম্রাটের মতোই করুণ পরিণতি হয়েছিল শেষ বার্মিজ রাজা থিবো মিন-এর। রাজপ্রাসাদ দখলের পর ব্রিটিশরা রাজাকে প্রাণভিক্ষা দিয়ে নির্বাসন দেয় ভারতের রত্নাগিরিতে। ঔপনিবেশিক শাসনের গ্লানিময় কাহিনীগুলো ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম মাজার থেকে। চললাম নিকটস্থ হ্যাপি অ্যামিউজমেন্ট পার্কে।
ইয়াঙ্গন শহরে বিশাল কয়েকটা লেক ও পার্ক রয়েছে। প্রত্যেকটিই পরিচ্ছন্ন। মানুষজন সেগুলোতে সপরিবারে বেড়াতে যায়। সবুজ ঘাসের ওপরে বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করার সুযোগ পায়। পার্কে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকলেও তরতাজা অনুভূতি হয়। আর এই পার্ক থেকে যেহেতু বিশ্ববিখ্যাত শোয়েডাগন প্যাগোডা দেখা যায়, এর আকর্ষণ অন্যরকম। শেষ বিকেলের আলোয় প্যাগোডার সোনালি চূড়া বেশ দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে।
পরদিন গেলাম রাজধানীর খুব কাছের ডালা দ্বীপে। ফেরিতে মাত্র ২০ মিনিটের পথ। সুনামিতে বিধ্বস্ত এই দ্বীপের মানুষ দারিদ্র্যের চাবুকে দিশেহারা। সুপেয় পানির সংকট। পরিবেশ রুক্ষ, অস্বাস্থ্যকর। এখানে গিয়ে আরেকবার উপলব্ধি করলাম পরিপাটি সাজানো নগরেরও থাকে একটা কালিমাখা চেহারা। যা সে সবার কাছ থেকে সযত্নে লুকিয়ে রাখে।
রাতের বাসে রওনা হলাম মান্দালয়ের উদ্দেশ্যে। আন্তঃনগর বাসগুলোর সার্ভিস বেশ ভালো। তবে, সাথে ইয়ারফোন রাখা উচিত। কারণ, কোনো কোনো বাসে সারারাত গান বাজায়। ১০ ঘন্টার জার্নি শেষে ভোরে পৌঁছলাম। রাজপ্রাসাদ জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান হলেও আমরা আগ্রহী ছিলাম মান্দালয় পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখার ব্যাপারে। বিধি বাম! আকাশে ঘন মেঘের ভিড়। সূর্য দু-একবার উঁকি দিলেও আশ মিটল না। তবে আল্লাহ এই লোকসান কড়ায় গণ্ডায় পুষিয়ে দিলেন পরদিন।
ট্যাক্সিতে চড়ে দিনভর শহরের আশপাশ চষে বিকেলে দেখতে গেলাম প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ উ-বেন ব্রিজ। পুরোটাই কাঠের সেতু। বৌদ্ধ ভিক্ষু, নানান দেশের পর্যটক আর স্থানীয় মানুষের জমায়েতে প্রাণবন্ত পরিবেশ। সূর্যাস্তের ঠিক আগে নেমে এলো অদ্ভুত এক নীরবতা। প্রকৃতির সাথে কেউ যদি সেই মূহুর্তে একাত্ম হয়ে যেতে পারে, প্রাপ্তির খাতা ভরে উঠবে দ্রুতই।
ব্রিজ থেকেই সোজা বাস স্টেশনে। গন্তব্য শান প্রদেশের নয়নাভিরাম ইনলে লেক। এখানে যেতেও লেগে গেল সারারাত।
সকালের নাশতার পর নৌকা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। দুর্লভ প্রজাতির শামুক ও মাছের নিবাস ইনলে লেকের বুকে গড়ে উঠেছে ভাসমান বাড়িঘর, ফুলের বাগান ও বাজার।
ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে পড়েছিলাম বার্মিজ নারীরা গলা লম্বা করার জন্যে বিশেষ একধরনের শেকল পরিধান করে। চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হলো এবার। ঐতিহ্যবাহী বার্মিজ কুটির শিল্পের পসরা সাজানো রয়েছে একেকটি গ্রামে। পশ্চিমা পর্যটকরা চড়াদাম দিয়ে মহানন্দে কেনে ছাতা, সিল্কের পোশাক ও কাঠের মূর্তি। সন্ধ্যানাগাদ ফিরে এলাম নিকটবর্তী পাহাড়ি শহর নিয়ং শোয়েতে।
পরদিন ভোরে ইয়াঙ্গনের উদ্দেশ্যে ফেরতযাত্রা। আগেই শুনেছিলাম যে, নিয়ং শোয়ে থেকে ফেরার সময় অপূর্ব সব দৃশ্যের সন্ধান মেলে। আসলেই তাই। আঁকাবাঁকা সর্পিল পথের দুধারে লম্বা লম্বা গাছের দীর্ঘ সবুজায়ন। প্রায় ১১ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে রাতে পৌঁছলাম ইয়াঙ্গন। এবার দেশে ফেরার পালা।
বিকেলে ফ্লাইট। তাই সকালে ভাবলাম ঘন্টাদুয়েকের জন্যে বোজিয়ক অং সান মার্কেট ঘুরে কিছু স্যুভেনির সংগ্রহ করা যাক। ব্রিটিশদের বানানো এই মার্কেট বিদেশি ট্যুরিস্টদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে দরদাম করার ক্ষেত্রে সাবধান। কোনোপ্রকার সংকোচ করলে একদম ঠকে যাবেন। খেযাল করলাম, বার্মিজ বিক্রেতাদের সবচেয়ে বড় গুণ তাদের ধৈর্য আর হাসিমুখে কথা বলতে পারা।
অবশ্য পুরো ভ্রমণেই মুগ্ধ হয়েছি সেদেশের মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে। পর্যটকদের প্রতি তারা অত্যন্ত সহযোগিতাপরায়ণ ও আন্তরিক। প্রতিবেশি দেশ অথচ কত অপরিচিত তার জীবনযাত্রার ধরন ও সংস্কৃতি! দূর ভবিষ্যতে হয়তো আরো গভীরভাবে জানার সুযোগ ঘটবে- এই প্রত্যাশা নিয়েই হাওয়াই জাহাজে উঠে রওনা হলাম দেশের পথে।
🙂
:teacup:
আমিও মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মংডু শহরে গিযেছিলাম। যাহা বাংলাদেশের টেকনাফ থানার পূর্বপাশে নাফ নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত। কিছুদিন পরই রোহিঙ্গাদের উপর নানা অত্যাচরের খবর শুনে খুবই খারাপ লেগেছিল। তবে যে দৃশ্যগুলূ মনে পরে তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যেতে পারা যায়। সেখানে মোবাইল ফোন এবং ক্যামেরা নিষিদ্ধ ছিল। সন্ধার পর পরই মানুষ শূন্য রাস্তা। বার্মিজ মেয়েদের নিয়ন্ত্রনে তাদের ব্যবসা বানিজ্য।যুবতী থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত সকল মেযেরা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জরিত। পক্ষান্তেরে মুসলিম মেয়েরা ঘরে আবদ্ধ। রাস্তাগুলো বেশ প্রসস্থ।
বাহহ ! দিব্যি ঘুরে এলাম মায়ানমার আমিও।
ভালো একখান ট্যুর প্লানার হিসেবে কাজে দেবে তোমার লেখা।
ভাল লাগলো।
অশেষ কৃতজ্ঞতা। চটজলদি লেখা।
তবে প্রতিবেশি দেশ হওয়া সত্ত্বেও কতটা আলাদা ও বিচিত্র তাদের সংস্কৃতি ও জীবনাচার
তা চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। এটাই অনুরোধ।
মোড়ে মোড়ে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে নেই। তবু সবাই দিব্যি সিগনাল মেনে চলছে - এই প্রত্যাশিত নিয়মটুকু আমাদের পুলিশ বাহিনী রাজধানীর রাজপথে আজও বাস্তবায়িত করতে পারলো না। মনে হয় আগামী এক দশকেও তা পারবেনা।
মোড়ে মোড়ে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে নেই। তবু সবাই দিব্যি সিগনাল মেনে চলছে - সুন্দর নাগরিক মনের পরিচয়।
শোয়েডাগন প্যাগোডার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হ'লাম।
পর্যটকদের প্রতি তারা অত্যন্ত সহযোগিতাপরায়ণ ও আন্তরিক - পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার জন্য এটা একটা অন্যতম পূর্বশর্ত। আমরা এ ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
মায়ানমার সফরের ইচ্ছেটা অনেকদিন ধরেই মনে মনে পুষে রেখেছি। শীঘ্রই যাবার আশা আছে। তবে এখন তো আবার নতুন করে রোহিংগা সমস্যা দেখা দিয়েছে। মিডিয়াতে শান্তির প্রচারক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যে নিষ্ঠুর আচরণের বিবরণ পড়ি, তাতে মনে কিছুটা শঙ্কাও জাগে।
আমরা কোথাও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হই নি। বরং যথেষ্ট আন্তরিক ও সহযোগিতাপরায়ণ ছিল সে-দেশের মানুষ।
"মোড়ে মোড়ে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে নেই। তবু সবাই দিব্যি সিগনাল মেনে চলছে - সুন্দর নাগরিক মনের পরিচয়" এটা লিখতে চেয়েছিলামঃ
"অফিস আদালত দোকানপাট সবখানেই ওদেশের মানুষ ফুল সাজিয়ে রাখে - সুন্দর নাগরিক মনের পরিচয়"