অশান্ত শহরটি যেভাবে বশ মেনেছিল

( বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহোর How the city was pacified গল্পের মর্মানুবাদ এটি।)

অনেককাল আগের কথা। পিরিনীজ পর্বতমালার পাদদেশে ছিল এক শহর। কিংবদন্তি অনুসারে, শহরটা নাকি গুণ্ডা-বদমাশদের জন্যে ছিল রীতিমতো অভয়ারণ্য। আর দুষ্টের শিরোমণি ছিল আহাব নামের এক আরব। এহেন দুষ্কৃতিকারীর জীবন পুরোপুরি বদলে গেল স্থানীয় পাদ্রীর কাছে ধর্মবাণী শোনার পর। তার বোধোদয় হলো যে, শহরের পরিস্থিতি বিশৃঙ্খলভাবে চলতে দেওয়া উচিত হচ্ছে না।

আহাব খুব ভালো করে জানত শহরের সবাই তাকে যমের মতো ভয় পায়। তবু কাউকে জোরজবস্তি করে সে এই বিষয়ে বুঝাতে গেল না। যেহেতু মানুষের স্বভাব সম্পর্কে তার ছিল পরিষ্কার ধারণা। সে যদি সৎ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সবাই এটাকে তার দূর্বলতা ভাববে। শিগগিরই দেখা যাবে লোকজন তাকে আর আগের মতো তোয়াজ করছে না।

তাই অনেক ভেবে সে একটা বুদ্ধি বের করল। পাশের শহর থেকে ডেকে নিয়ে এলো বেশ কয়েকজন কাঠমিস্ত্রিকে। তাদের হাতে একটা নকশা ধরিয়ে দিয়ে কি যেন বানানোর নির্দেশ দিল। শুরু হয়ে গেল মিস্ত্রিদের কাজ। সারাদিন, সারারাত ধরে তারা হাতুড়ি-বাটাল দিয়ে তক্তার ওপর পেরেক ঠুকছে, নয়তো করাত দিয়ে কাঠ চেরাই করছে কিংবা তক্তাগুলো একটার সাথে আরেকটা জোড়া লাগাচ্ছে। সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। শহরের লোকজন হাঁ করে এসব দেখতে লাগল।

দশদিন পর শহরের মাঝখানে খোলা চত্বরে নিয়ে আসা হলো প্রকাণ্ড এক বস্তু। কাপড় দিয়ে আগাগোড়া ঢেকে রাখা। উদ্বোধন করার আগে আহাব শহরের সমস্ত বাসিন্দাদের ডেকে পাঠাল।

তারপর কোনোধরনের ভণিতা বা ভাষণ দেয়া ছাড়াই খুব গাম্ভীর্যের সাথে আহাব কাপড়টা সরিয়ে ফেলল।

কাপড়ের নীচ থেকে বেরিয়ে এলো ফাঁসির মঞ্চ। দড়ি, পাটাতনের নিচে লুকোনো দরজা সবই আছে ওতে। এত মজবুত করে পুরো জিনিসটা বানানো হয়েছে যে ঝড়বৃষ্টির ঝাপটায় ওটার কিছুই হবে না।

আহাব খেয়াল করল সমবেত জনতা উৎসুক দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছে। তাদের নীরবতার সুযোগ নিয়ে সে ভরাট গলায় বেশ কিছু ফরমান ঘোষণা করা শুরু করল। যেমন- এখন থেকে সবধরনের জুলুম থেকে কৃষকরা নিরাপদ থাকবে, গবাদিপশুর খামারিদের নানারকম সুযোগসুবিধা দেয়া হবে এবং এই শহরে নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যে-ই কেউ করবে তাকেই পুরস্কৃত করা হবে। সর্বশেষ (এবং মারাত্মক) আইন হলো- প্রত্যেক বাসিন্দাকে হয় কোনো আইনসম্মত পেশা খুঁজে নিতে হবে নয়তো এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। পুরো সময়ে সে কিন্তু একবারের জন্যেও ‘ ফাঁসিকাষ্ঠ‘ শব্দটি উচ্চারণ করল না।

সভা ভাঙার পর পক্ষে বিপক্ষে কয়েকটি দল তৈরি হয়ে গেল। অধিকাংশ মানুষ একমত হলো যে, পুরোহিতের কথা শোনার কারণেই আহাবের আজ এই দশা! কী সব উল্টোপাল্টা নিয়ম বের করেছে। আগের সেই ডাকাবুকো ভাবটাও তার মধ্যে আর নেই। তারা একমত হলো যে, আহাবকে খুন করতে হবে।

কয়েক দিন ধরে হত্যা করার নানান কৌশল বের করল তারা। কিন্তু প্রতিবারই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই ফাঁসিকাষ্ঠের ছবি। তাদের মনে প্রশ্ন জাগল- শহরের মধ্যখানে ওটা কী করছে? আহাবের কথা যারা মানবে না তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার উদ্দেশ্যে কি ওটা বসানো হয়েছে? আসলে কারা আছে আহাবের দলে? আমাদের মধ্যেও ওর গুপ্তচর কেউ নেই তো?

ঘাড় উচুঁ করে তারা দেখতে লাগল মূর্তিমান আতংক ফাঁসিকাষ্ঠটি। তাদের মনে হলো ওটাও যেন তাদের দেখছে। ধীরে ধীরে বিদ্রোহীদের প্রাথমিক জোশ নিভে যেতে লাগল। বরং ভয় জেঁকে বসল তাদের অন্তরে। আহাব কেমন একগুঁয়ে মানুষ- এটা তাদের ভালোমতোই জানা ছিল। আহাব যদি কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত একবার নেয় তবে ওটা করেই ছাড়ে।

কয়েক দিনের মধ্যেই কিছু লোক শহর ছেড়ে চলে গেল। আর বাকিরা বেছে নিল নতুন নতুন পেশা। হয় তাদের যাবার কোনো জায়গা নেই বলে কিংবা ফাঁসিকাষ্ঠের ভয়ে। কিছুদিন পরই শহরের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেল। শহরের অধিবাসীরা উৎকৃষ্ট মানের গম চাষ আর উল রপ্তানি করা শুরু করল। একসময় শহরটি পরিণত হলো পুরো অঞ্চলের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রে।

ফাঁসিকাষ্ঠ কিন্তু দশ বছর ধরে ওভাবেই শহরের মধ্যখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। বারকয়েক শুধু দড়িখানা বদলাতে হয়েছিল। যদিও কখনোই কাউকে ঝুলানোর দরকার পড়ে নি। আহাব নিজেও এ ব্যাপারে টুঁ শব্দটিও করে নি। কারণ, সাহসকে ভয়ে, বিশ্বাসকে সন্দেহে এবং বাহাদুরির গপ্পোকে আনুগত্যের মিনমিনে আওয়াজে পরিণত করার জন্যে ফাঁসিকাষ্ঠের বিশাল ছায়াই যথেষ্ট ছিল।

দশ বছর পর শহরে শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হলো পুরোপুরি। তখন আহাব ফাঁসিকাষ্ঠটি গুঁড়িয়ে দিল। এর বদলে সেই জায়গায় স্থাপন করল উচুঁ একটি ক্রুশ। দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের ভিসকোস শহরের আকাশে আজো যা রাজত্ব করছে।

৪,৬৮৯ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “অশান্ত শহরটি যেভাবে বশ মেনেছিল”

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।