আনবিয়ারেবল মিনিংলেসনেস অফ বিয়িং

দীর্ঘ ছুটিতে কোথাও যাইনি আমি। কোন রেস্টোরেন্টে, শপিংমলে, বইয়ের দোকানে, পার্কে, বন্ধু-বান্ধবের চৌকোনা ঘরে, কোন সভায়-আড্ডায়–কোথাও না। কোন প্রেমিকের মুঠোয় যাইনি, রিকসায় ঘেঁষিনি। নদী-সমুদ্র,পাহাড়-জঙ্গল কোথাও নিজের শ্বাসমূল খুঁজিনি। তেড়িয়া অভিযাত্রীর ঘাড়ে শুয়ে থাকা ক্যামেরার চোখে আমাজনের দুর্গম নাড়ী-নক্ষত্রে ঘুরেছি (ইউটিউবে)। এই দীর্ঘ আলস্যমোড়ানো ছুটিতে আমার হাত-পায়ের আড়মোড়া ভাঙাতে বুয়া চিকুনগুনিয়ায় নিরুদ্দেশ হল। আমরা–আমি আর আমার ঘরের দেয়াল আঁকড়ে থাকা দশাসই টিকটিকি তবু স্থানচ্যুত হলাম না। হাংরি নাকি-ফুডপান্ডা আমার ক্ষুধা মেটালো, পরিপাটি ডট কম আমার ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করলো। ইয়েলোর পেজে কয়েকটি মাত্র ক্লিকে আমার ওয়্যারড্রোবে ঢুকে পড়লো ম্যানিকিনের পরনের কুর্তি। রকমারি আমার বেডসাইড টেবলে রেখে গেল বাদামি কাগজমোড়ানো বইয়ের গন্ধ। উবার বহুবার মেসেজ পাঠালো, কত রকম অফার সাধলো (সেগুলো আমার নিষ্ক্রিয়তার দেয়ালে ঠোকর খেয়ে ফিরে গেল), তবু চার চাকা ধার করে আমার সচল হওয়া হল না। আমি ইয়েলোর কুর্তি পরে কারও কারও সাথে ভিডিও কলিং, কারও কারও সাথে অডিও কলিংএ সামাজিকতা সারলাম।
সিলিং এর দিকে তাকিয়ে ফ্যানের ঘোরা দেখতে দেখতে একদিন মনে হল, নাহ, আবীরের কোন দরকার নাই আর। বহুবছর ধরে একই হেয়ারস্টাইলের একঘেয়েমিক্লান্ত কারও নতুন হেয়ারকাট চাওয়ার মত সহজ-স্বাভাবিকতায় আমার মন স্বগতোক্তি করল–আবীর গেলে কবীর-সুবীর কেউ আসবে। অনলাইনে সার্ভিস পাওয়া যেমন সুলভ, প্রেম বোধহয় তার চেয়েও সুলভ। বসেরা যেমন প্রফেশনাল আবেগশূন্যতায় অধীনস্তদের ছাঁটাই করেন, তেমনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আবীরকে বাতিল করে দিতে ইচ্ছা করল। যেন বহুদিন একই ক্যান্টিনের খাবার খেয়ে মুখে অরুচি ধরে গেছে। নিজের অমানুষিক নির্বিকারত্বে খানিকটা নাড়া খেয়ে আমি সিনেমা খুলে বসলাম। সিনেমা খুব কাজের। ইঞ্জেকশনের মত পুশ করলে শরীর-মন ঝাঁকি খাবে। আমি কাদামাটির মত, দুধে ভেজানো পাউরুটির মত নরম হবো। সে বেলার ডোজ –ফেয়ারওয়েল মাই কনকিউবাইন। বিষণ্নতা গাঁজার ধোয়ার মত ভেতরে ঢুকল তারপর একটা সাপের মত একেবেঁকে গেল, আর তারপর বাঁকানো বাঁশির কান্নাকান্না সুর আমার শরীরের রন্ধ্রপথে বেরিয়ে আসতে চাইল। Am I in love with the concept of love only? কেন জ্যান্ত মানুষের চেয়ে তার স্মৃতি বেশি দামী হয়ে যায়?
নিজের ভাঁজ খুলে খুলে ভেতরে ঢুকছি যখন তখন হুটহাট অনধিকার প্রবেশের মত বাবার কল–একবার, দু’বার, তিনবার। ধ্যাৎ! এত মাতব্বরি-নজরদারি ভাল লাগে না! খানিকপর মা লাগাতার কল করবে। বাড়িতে যাওয়ার জোরাজুরির রেকর্ড বাজাবে। বাড়িতে যাওয়াটা এখন আইসিইউতে যাওয়ার মত। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যাবো অসুখে, বিপদে। প্রথমে ফুরিয়েছে দৈনন্দিন স্নেহ-মমতার চাহিদা, প্রেমিকদের কাছ থেকেই যথেষ্ট মেলে। টাকা-পয়সার বন্ধনও কেটে গেল কিছুদিন বাদে–অন্নদাতা-বস্ত্রদাতা-বিলাসদাতা চাকরি জোটার পর। আহা, ছোটবেলায় একবার চাচাতো ভাই মামুন বলেছিল, জানো, তোমাকে না রেললাইন থেকে কুড়ায় আনছে। পলিথিন দিয়া প্যাঁচানো ছিলা তুমি। পাঁচ বছরের আমার এ কথা শুনে প্রথমে নাক-মুখ লাল, তারপর ঘরে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে হেঁচকি তুলে কি কান্না! এখন দিব্যি মনে হয় কোন সুতায় গেঁড়ো বাঁধবো না, কোন আঠায় আটকে থাকবো না, কোন চুম্বকে সাঁইসাঁই ছুটবো না। শৈশব পেরোনোর পর মরে গিয়ে নতুন করে জন্মেছি। এই জন্মে মা-বাপ কেউ নেই, নিজেই নিজের গর্ভ কিংবা গর্ব থেকে বেরিয়েছি। চিন্তায় ভাসতে ভাসতে নিজের অস্তিত্বকে কেমন অশরীরী-বায়বীয় মনে হয়। চোখ-কান-নাক-জিভ-ত্বক–সব ক’টা ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। আমি শুধু ভাবছি। আমি এবার নিয়মমাফিক ধ্যানে তলিয়ে যাই। ধ্যানস্থ হয়ে গহীন অরণ্যে হারাই। অচিন প্রাচীন বৃক্ষের বাকলে হাত বুলাই। কীটপতঙ্গের বিচিত্র শব্দ শুনি। ঝোঁপানো গাছে আলো ঠিকরানো সবুজ পাতা আর সবুজাভ গোলাপি করমচার থোকা মনভালো-মনভালো আলো ছড়ায়। তারপর আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে বৃষ্টিতে ভিজি। আমার চোখ দিয়ে জল গড়ায়। আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে জল ঝরাই। কান্নায় এত আনন্দ গো!
ধ্যান থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার পর জানালায় বৃষ্টির ছাঁট দেখতে পাই। আমার বাসার গলিতে আমাদের ছোট নদীর মত এই বৈশাখ মাসে হাঁটু জল থাকবে। সেই জল ডিঙিয়েই ডেলিভারিম্যান পৌঁছে দেবে খাবার-বই-কসমেটিকস-কুর্তি এবং আরও যা যা চাই। আমার প্ল্যাটিনাম ক্রেডিট কার্ড আমাকে রাজার মত সেবা দেয়। তার জন্য কতখানি চাকরের মত খাটতে হয়, তা উহ্য থাকুক। বন্ধু নয়, প্রেমিক নয়, বাবা-মা নয়, এই ক্রেডিট কার্ড নিবেদিত ত্রাণকর্তার মত হাজির হয়। আবীর ভাইবারে মেসেজ দিয়েই যায়–ইউ আর মেন্টালি সিক! কনসাল্ট আ সাইকোলজিস্ট। ইউ গট ডিপ্রেশন।
আমি ওর পাগলের প্রলাপ কানেই তুলি না। ইউটিউবে আমাজনের গহীনজঙ্গলে হারিয়ে যাই। সশরীরে কখনো যাবো না জানি। ওই প্রখর রোদে আমার চামড়া পুড়বে। গায়ে লাফিয়ে পড়া পোকামাকড়ের অ্যালার্জিতে চাকা চাকা লালে শরীর ভরবে। ধুলা-বালি-পরাগরেণু আমার সংবেদনশীল ত্বকে ব্রণের মহামারী আনবে। আমি মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে বলি,
মিরর মিরর অন দ্য ওয়াল
হু ইজ দ্য ফেয়ারেস্ট অফ দেম অল?
আমি নিজেকে ভেলভেটে মুড়িয়ে রাখবো। নিজেকে মমি বানিয়ে রাখবো। চাকরির জন্যও বাইরে যাবো না। গ্রাফিক্স ডিজাইনাররা দিব্যি ফ্রিল্যান্সার হয়ে কাজ করতে পারে। আমি এই বাসা থেকে কোথাও বেরোব না। আমার মুরাকামির ম্যান-ইটিং ক্যাটস গল্পটা মনে পড়লো। সেই বয়স্ক মালকিন যে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে বদ্ধ ঘরে ক্ষুধার্ত পোষা বেড়ালরা তাকে খেয়ে ফেয়েছিল। এইরকম বদ্ধ বাসায় কখনো যদি মরে পড়ে থাকি? যদি তেলাপোকা পিঁপড়ার ভোজ হই? কিংবা যদি ডেলিভারিম্যানের পরিচয়ে কোন লম্পট ঘরে ঢুকে রেপ করে মেরে ফেলে চলে যায়?
আমি জানি এরকম কিছুই ঘটবে না। একটা দিন আরেকটার ক্লোন, রেপ্লিকা, ফটোকপি, ডুপ্লিকেট–এই শুধু উনিশ আর বিশ। আমার নিস্তরঙ্গ জীবন ঘটনাহীন, প্লটহীনভাবে টেনে টেনে বড় হবে। আমি নিজের মধ্যে ঘুরপাক খাবো। যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাই আছে ভাণ্ডে। নিজেকে ধ্যানস্থ বুদ্ধের সাথে তুলনা করলে কি অসম আত্মতৃপ্তি হয়! আমি লালন ফকিরের মত নিজের ভেতর জগত খুঁজবো, মনের মানুষের সন্ধান করবো। কিংবা বুর্জোয়া আত্মকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্নতায় খেয়ালখুশিতে বাঁচবো কিংবা মাথার ওপর বনবন ঘোরা ওই সিলিং ফ্যানে একদিন ঝুলে পড়ার জন্য অস্থির হবো। ডেল কার্নেগি, শিবখেরা, লুইজ এল হে কত কত মোটিভেশনাল স্পিকারদের গিলে খেয়েছি একদিন। তারপর যুগান্তকারীর এপিটাফ নিজের বুকে লাগিয়েছি। তারপর সেই এপিটাফে শ্যাওলা জমলো, রঙ চটলো, ঝুরঝুর ভেঙে পড়লো। অজ্ঞাতনামা কারও কবর হয়ে গেল। একজন গড়পড়তা বেখাপ্পা ভঙ্গুর মানুষের প্লাস-মাইনাসে কি ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় এই দুনিয়ার।


দিন পনের পর খোপ ছেড়ে বেরোলাম। আরও দিন পনের অজ্ঞাত থাকতে চেয়েছিলাম। সোহান–আমার প্রাক্তন ও প্রথম, অতীত ও নস্টালজিয়া ছ’বছর পর ঢাকার রাস্তায় সুদূর ফ্লোরিডা থেকে।
এই ক’দিনের আলো না লাগা ফ্যাকাশে চামড়ায় রোদের ঝাঁজ লাগলে নেতিয়ে পড়া নাইটকুইন লাগে নিজেকে। বানভাসি মানুষের মত গলাপর্যন্ত স্মৃতিতে ডুবে থাকি। সোহানের সাথে কত তিক্ত স্মৃতিও তো আছে, কিন্তু এই দুপুরে সেসব ছেঁকে ফেলে শুধু নরম তালশাঁসের মত মিষ্টি, জলীয় স্মৃতি আমার পুরান সময়ের তৃষ্ণা বাড়ায়।
রুফটপ রেস্টোরেন্টে ওকে দেখে ভেতরের তরলভাব জমাট হল, দিব্যি শক্ত ডাঙায় দাঁড়ানো শক্তপোক্ত মানুষ হয়ে গেলাম। কেমন আছ-ভাল আছ শেষে আমি সোহানকে গভীর মনোযোগে দেখি। ও হেসে ওঠে, ‘আমার পোর্ট্রেট আঁকবা নাকি? এত কি দেখো?’
‘নাহ, আঁকবো না। মুখ দেখে ভাগ্যগণনা করবো!’
‘তুমি এই চশমা পরছো কেন? রাগীরাগী, গোমড়ামুখো দেখায়!’
‘চশমা বেচারা আমার নাকে ঝুলে আছে বইলা ওরে এমন কাঠখোট্টা দেখায়!’
আমরা সহজ, সাবলীল, নিরাসক্ত ভঙ্গিতে কথা বলি। কথা বলতে বলতেই আমার জানা হয়ে যায় আমি আর সোহানের ডাকে চৌখুপি ছেড়ে বেরোব না। বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি আর নাই! হুম, মানুষের চেয়ে স্মৃতি বেশি আপন হয়ে যায়।
উঠবো উঠবো করছি যখন সোহান একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দেয়, ‘তোমার জন্য একটা জিনিস আছে।’
আমি নেড়েচেড়ে বলি, ‘গিফট আনছো নাকি? কি এটা? খুলবো?’
সোহান আশপাশ দেখে, তারপর বলে, ‘না, বাসায় গিয়ে দেখো। তুমি অবশ্য আমাকে মাইর দিতে পারো!’
‘মানে কি? কি এটা?’
‘আই নো ইটস উইয়ার্ড। তোমার মনে আছে, আমি ফ্লোরিডায় যাওয়ার আগে আগে তুমি বলছিলা তোমার জন্য একটা জিনিস পাঠাইতে…’
মনে না পড়ারই কথা। কিন্তু সোহানের কাঁচুমাচু দেখে টুপ করে পড়া ফলের মত টুক করে মনে পড়ে যায়। তখন নতুন নতুন ইরোটিসিজমের গন্ধম ফল খেয়েছি। নায়িকাদের অনুকরণে নেশা নেশা গলায় বলেছিলাম ‘ব্রিং মি আ সেক্স টয়, আ ডিলডো।’ সত্যি সত্যি আনতে বলিনি তো, সেটা ছিল আলীবাবার ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রের মত ইরোটিকার দরজা খোলা।
সোহান আবার বলে, ‘তুমি হয়ত মিন করো নাই। এবার আসার আগে আগে আমাদের নেইবারহুডে অ্যাডাল্ট শপটায় হঠাৎ ঢুকে পড়ছিলাম। কি মনে করে জানি তোমার জন্য কিনে ফেললাম। ফ্রয়েড বেঁচে থাকলে জোড়াতালি দিয়ে কারণটা বের করে ফেলতো! শিওর ছিলাম না তোমাকে দিবো কি না। ইউ মে টেক ইট অ্যাজ আ স্যুভেনির অফ দ্যাট মেমরি।’
নিজের যুক্তিতে সোহান সন্তোষ পায় না, অন্য রাস্তা ধরে, ‘অর…উইমেন আর নট ডিপেন্ডেন্ট অন মেন ফর এনিথিং ইন লাইফ…ইউ মে টেক ইট দ্যাট ওয়ে। রিজেক্টও করতে পারো ইফ ইউ ফিল অফেন্ডেড।’
প্রাক্তনের সাথে আমার ফ্লার্ট করতে ইচ্ছা হয়, ‘তুমি আস্ত মানুষটা থাকতে এই সিলিকন না রাবারের যন্ত্র দিয়ে যাচ্ছ?’
উজবুক সোহান কি আমার কথাটাকে সিরিয়াসলি নিল? একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘কেন? তোমার আবীর আছে না…?’
‘খালি আবীর কেন, কবীর-সুবীর-জাবির-দবির যে কেউ-ই থাকতে পারে!’
‘হেঁয়ালি মেয়ে, খামখেয়ালি বন্ধ করেন!’
‘তুমি অবশ্য ভাল সময়ে জিনিসটা আনছো। বলা যায় মাইন্ড রিডারের মত কাজ করছো। আমার ইদানীং মানুষ সহ্যই হয় না। সবাইকে খেদাচ্ছি। ঢাকায় তোমার এই জিনিস বোধহয় সহজে পাইতাম না। সাই-ফাই ম্যুভি ‘হার’ দেখছো? এখন যদি টেকনোলজি আরেকটু ডেভেলপ করে আর একটা অপারেটিং সিস্টেমকে দিয়ে বয়ফ্রেন্ডের কাজ চালানো যায় তাহলে ভালই হয়!’
‘misanthrope হয়ে গেছ নাকি! মানুষ-বিদ্বেষী? নাকি খুব কন্ট্রোলফ্রিক? মানুষে পোষায় না কেন?’
‘আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো? আমি নিজের অনেক কিছু এক্সেপ্ট করতে পারিনা। সেগুলা লুকায় রাখতে বোধহয় মানুষ থেকে পলাই। আই ডোন্ট ফাইন্ড এনি মিনিং এনিহোয়্যার।’
সোহান হাসতে থাকে, ‘শৌখিন existential nihilist?’
আমাদের আলাপ গভীরে ঢোকে না। সোহান আমার আনবিয়ারেবল মিনিংলেসনেস অফ বিয়িং তলিয়ে দেখে না। আমরা প্লাস্টিকের বলের মত, রাবারের হাঁসের মত পানির ওপরে ওপরে ভাসি।
ফেরার সময় মনে হল, পুরানো দিন নিয়ে আদিখ্যেতা অনেকটা ঝরে গেল; মেয়াদোত্তীর্ণ শুকনা পাতার মত।


কাঁচের কফিনে বন্দি। চলৎশক্তিহীন। তন্দ্রার মত আধো ঘুম আধো জাগরণে হাজার দিনরাত্রি যায় আর আসে। যেন বোবায় ধরেছে অনির্দিষ্টকাল। কোমায় চলে যাওয়া রোগীরা যারা ফিরে আসে তাদের কেউ কেউ নাকি কোমাচ্ছন্নতায় অনুভব করতে পারত পরিপার্শ্ব-প্রিয়জন। অথচ মৃতদেহের মত অক্ষম অচল পড়ে থাকা। জ্যান্ত কবরস্থের মত।
আজকে ঘুম ভাঙার পর সেই ভয় আমার হৃহপিণ্ডটাকে চেপে ধরে। অকেজো শরীর। তীব্র অনুভূতিরা বিলুপ্ত প্রাণীর মত বিপদগ্রস্থ। মৃদু-মন্থর-ভোঁতা গুটিকয়েক অনুভূতি সম্বল করে আকাশপাতাল ভাবা ছাড়া আজকাল আর কিছুই করি না আমি। মন অতীত আর ভবিষ্যতে দিখণ্ডিত, নস্টালজিয়া আর ফ্যান্টাসিতে দ্বিচারিণী। মিশ খায় না বর্তমানে, বাস্তবে, আসলে। কোমায় যাওয়া রোগীদের মত যোগাযোগহীন, জীবন্মৃত। আমার ছুটির আরও দিন দশেক বাকি। হয়ত এবার ছুটি শেষে আমি আর কাজে ফিরবো না। অফিসে আমার কিউবিকলের সামনে কাঁচের দেয়াল। আমি ল্যাপটপে চোখ সেঁটে থাকি, মুখ তুলে একটা বিকালও দেখা হয় না আমার।
দেয়ালের টিকটিকিটা কোথায় যেন পালিয়েছে। আমার সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট বিপদসংকেত দেয়– এই ঘরে দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে তোমার হাড়-মাঁস-মজ্জা। এই ঘরের একটা আসবাব হয়ে যাবে তুমি–হয়ত ওই সিলিং ফ্যানটার সাথে জুড়ে যাবে। এই ঘর থেকে বেরোও!
বাড়ি যাবো না। চেনাজানা মানুষের কৌতূহল মাছির পুঞ্জাক্ষির হাজার চোখের মত। বাবা-মা,আত্মীয়স্বজন,পাড়াপ্রতিবেশী পিঁপড়ার সারির মত হামলে পড়বে। তাদের হাজার প্রশ্ন-উপদেশ-আদেশ-পরামর্শ-শুভাকাঙ্ক্ষা গুলির ছররার মত ঝাঁঝরা করবে। কখনো কখনো বাবা-মায়ের অত মনোযোগ আর আদরের বিপরীতে নিজের নির্বিকার উদাসীনতায় নিজের গায়েই ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ ছ্যাঁক লাগবে। অনেকগুলো ‘যদি’ দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে…যদি ইনভিজিব্যলম্যান হয়ে অদৃশ্য থাকা যেত… যদি নিজের ভেতরেও নিজেকে প্রমাণের বাসনা ও যুগপৎ ব্যর্থতা দপদপ-দগদগ না করত…যদি আকাশটার মত উপুড় হয়ে দুনিয়া দেখা যেত দূরত্বে থেকে…যদি…
‘অ্যাডভেঞ্চারে আমার পোষায় না। আমার দরকার রিল্যাক্সিং প্লেজার-ট্রিপ। সুন্দর রিসোর্টে থাকবো, পাহাড়-সমুদ্র দেখবো, ছবি তুলবো, ব্যাস!’ এই ডায়ালগ আমারই। আমার এখন বান্দরবানের দুর্গমে পায়ের তলায় মৃত্যু নিয়ে চলতে ইচ্ছা করে। যখন একবার পা হড়কে গেলে খাদে মুখ থুবড়ে পড়ার কিংবা জলে তলিয়ে যাওয়ার ভয়, তখন নিশ্চয়ই শুধু ওই মুহূর্তটায় বাঁচা যায়। রোদে পোড়া চামড়া বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যখন ফ্যাকাশে রক্তশূন্য হয়ে যায়, জোঁকেরা রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে পড়ে থাকে পথে, তখন নিশ্চয়ই নিশ্চিত হওয়া যায় যে তীব্রভাবে বেঁচে আছি! ফোলা পা, এখানে ওখানে ক্ষত, মশার কামড়ের দাগ, নেটওয়ার্কবিচ্ছিন্নতা–তখন কি নিজেকে আদিম মানুষ মনে হয়? ভয়ংকর সুন্দর পাহাড় আর প্রপাতকে দুই পাশে রেখে পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে চলার ধুঁকপুকানি শিরশিরানির মাঝে হঠাৎ বেমানানভাবে রাশিদা আপা হাজির হলেন। ছায়াছায়া ক্লাসঘরের পটভূমিতে সাদামাটা শাড়িপরা চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশের অবিবাহিতা শিক্ষিকা।
বাবার বদলি চাকরির চক্করে দেশের এ মাথা ও মাথা ঘুরতে ঘুরতে আমরা একবার দিনাজপুরে এসে পড়েছিলাম। সেখানকার এক পুরনো প্রাইমারী স্কুলের লাল দালানে ক্লাস থ্রি থেকে ফাইভের কাদামাটির মত বয়সটায় কখনো ইংরেজী, কখনো বাংলা, কখনো সমাজ পড়িয়েছিলেন রাশিদা আপা।
একদিন রঞ্জনার বাড়ির বারান্দায় ওর পোষা টিয়াকে পাকা কলার লোভ দেখিয়ে হেস্তনেস্ত করছি, তখন পাশের বাড়ির বারান্দায় রাশিদা আপা বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন। পুরনো রঙওঠা নোনাধরা বাড়ি, কিন্তু কি পরিচ্ছন্ন। উঠানে ঝোঁপানো জবা, নয়নতারা আর পাতাবাহার। বরই আর আম গাছ সারা উঠানের দখল নিয়ে মুরুব্বীর চেহারায়। ঢুকলাম লাল মেঝের ঠাণ্ডা ঘরে। সামনের দেয়ালে সূঁচিকর্ম। একটা ছোট্ট শেলফে নানা বইপত্র। রাশিদা আপা আমের মোরব্বা আনলেন ফুলতোলা পিরিচে।
রাশিদা আপার ঘরটাকে দেখার পর ক্লান্তিতে আমার শরীর ভেঙে আসে। যেন কতদিন নিশ্চিন্ত নিশ্ছিদ্র ঘুম থেকে বঞ্চিত। বান্দরবানের অ্যাডভেঞ্চার ফুড়ুৎ উড়ে যায়, আমার সেই মফস্বলী শান্তিশান্তি গৃহকোণে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। সেই সরল শান্ত পুকুরের মত জীবন। যেখানে রোদও অত কড়া নয়, উষ্ণ-নরম, মোলায়েম। রাশিদা আপা কি এখনো ওই বাড়িতেই আছেন? আমাকে চিনতে পারবেন? বিশ্বাস করে কয়েকটা দিন থাকতে দেবেন? ক্রেডিট কার্ড-ফুডপান্ডা-ফেসবুককে বিদায় দেবো। আমার অশরীরী মন রাশিদা আপার ঘর-গেরস্থালী ঘুরে বেড়ায়। কাপড় নীলে ডোবাচ্ছেন, মাড় দিচ্ছেন, ধোয়া কাপড় মেলছেন উঠানে। রান্নাঘরে পেঁয়াজ কাটছেন। পুঁটি মাছ ভাজা, মুসুরির ডাল আর পাটশাক ভাজির গন্ধ ভেসে আসছে। রাশিদা আপা কি রাঁধেন, কি বাড়েন জানিনা। কিন্তু আরও আরও খাবারের ঘ্রাণ নাকে আসে। তিল ভর্তা, কুমড়ো ফুল দিয়ে ডিম ভাজা, মুরগীর পাতলা ঝোলে অর্ধেক আলু। বিকালে জানালার পাশে বসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ঢিলেঢালা ফেলে ছড়ানো দিন। দিগ্বিজয়ের স্বপ্ন নেই, বড় শহরের লোভ নেই, জীবনের অর্থ ঘাঁটার রোগ নেই। রাশিদা আপা অবিবাহিত ছিলেন কেন? ভাঙা হৃদয়? শীতল শরীর? নাকি বাপ-মায়ের দায়িত্ব তাকে বেড়া দিয়ে রেখেছিল? নাকি স্রেফ ইচ্ছে করেনি বলে? এই পনের বছরে তিনি বিয়ে করেও থাকতে পারেন।
আমি খাটের তলা থেকে পলিথিনে মোড়ানো ব্যাকপ্যাকটা বের করি। সোহানের সেই প্যাকেটটা নিই। রাশিদা আপার জন্য। তার অসূর্যম্পশ্যা অঙ্গের জন্য। আমাকে আস্ত পাগল ভাবার ঝুঁকিসহ। আমার এই যান্ত্রিক পণ্যজীবন তার নব্বই দশকে আটকে পড়া সীমিত জীবনে ঢুকে পড়ে একটু কাঁপন তুলুক। যন্ত্র অনেকসময় মানুষের চেয়ে বেশি মানবিক হয়। কে জানে, হয়ত তাকে দেখার পর সংকোচে প্যাকেটটা লুকিয়ে ফেলবো ব্যাগের কোন গোপন পকেটে। কত অবদমন, কত সংস্কার মেয়েদের অণু-পরমাণুতে শিষ্টাচারের নামে।
আমি নিজের ওপর গরিমা আরোপের চেষ্টা করি–বুদ্ধও তো একদিন ঘর ছেড়েছিলেন, সেই আনবিয়ারেবল মিনিংলেসনেস অফ বিয়িং ছিঁড়ে বেরোতে। যদিও আমি যাচ্ছি এক গৃহীর বৃত্তাবদ্ধ জীবনেই। হাইওয়েতে ছোটা থামিয়ে সরু আলপথে নেমে পড়া আপাতত। যাত্রাবিরতি। এখনো জঙ্গলের পথ মেলা দূর। ভাবছি আমার পুড়ে যাওয়া জিভে সহজ জীবনের স্বাদ নিতে যাচ্ছি– যেই জীবন আমি যাপন করতে শিখিনি। এই বিচ্ছিন্ন খণ্ডিত জীবনের গল্পহীনতা থেকে বেরিয়ে সুগোল নিটোল গল্পের সন্ধানে (অতি সরলীকরণ কি আমাকে পেয়ে বসল)। কিংবা হয়ত এই যাওয়া যাবতীয় নস্টালজিয়া রোম্যান্টিকতা বিসর্জন দিতে। যেমন করে সোহানকে সামনাসামনি দেখার পর ঝুরঝুর ঝরে পড়েছিল খানিকটা। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আমার আবীরের জন্য মন কেমন করে। এখনো মানুষ আছি তাহলে!

৬,৪০২ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “আনবিয়ারেবল মিনিংলেসনেস অফ বিয়িং”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতা, বাস্তবতা আর পরাবাস্তব অস্তিত্ব সম্ভাব্যতা লেখার ভিতর লুকোচুরি খেলে গেছে নিরন্তর।
    আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাস্তব আর বাস্তবতার অনাকাঙ্ক্ষ্য চেহারার দ্বৈরথ সবাইকে যে অনভিপ্রেত যাপন আর তার জের বওয়া ক্লান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে সে দৃশ্যকল্প উঠে এসেছে ঠিক সেই অনায়াস দ্বান্দ্বিকতায়।

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    তোমার ফেবু শেয়ারে যা লিখেছিলাম, তার অর্থ হলো "খুব ভাল লেগেছে"।
    এখানে আরও কিছু বলার ইচ্ছা তাই আবার এলাম।
    অনেকগুলা সম্ভবনার সুত্রপাত আছে এইটুকু বর্ননায়।
    অনেক গুলো পরিচিত কিন্ত আনক্সপ্লোরড চরিত্রকে অলরেডি তৈরী করে সামনে নিয়ে এসেছো।
    এদের নিয়ে গল্পটা আরও আগে বাড়ুক
    সোহানরা কি করে সময় কাটায়, আবীররা কিভাবে কোপ আপ করে, রশিদা আপাদের অন্তর্গত টানাপোড়েন থাকে কিনা - এসব তুলে আনার চমৎকার একটা সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছি।
    আরেকটা জিনিষ ভাল লাগলো।
    বেশিরভাগ মানুষের কাছে নিষিদ্ধ ব্যাপারগুলো অবলিলায় বলে গেলে।
    আমি নিজে অবশ্য বলি কিন্তু সেজন্য কটুক্তিও শুনতে হয় না, তা না।
    এই তো সেদিন একজন দেখলাম বলে গেল, "চটি লিখেন না ক্যান?"
    না, যেখানে বলেছে, সেটা চটির ধারে কাছের কিছু ছিল না।
    বুঝলাম, অন্য কোনো লেখা পড়ে এই ঝাড়িটা জমা করা ছিল। অন্যত্র ঝেড়ে গেল।
    এরকম এক্সপেরিয়েন্স তোমারও হতে পারে এই সাহসিকতার কারনে - আগেই পূর্বাভাষ দিয়ে গেলাম।
    সোজা কথা ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সোজাসুজি বলার মত আরেকজনকে পেয়ে নিসঙ্গতা দূর হবার মত একটা অনুভুতি হচ্ছে!!!
    😀 😀 😀 😀 😀


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. তারেক (৯৪ - ০০)

    অসাধারণ লাগলো লেখাটা। মাঝে মাঝেই চমকে গেছি ভাবনাগুলোর বয়ান দেখে। খুবই শক্তিশালী, কিন্তু একই সাথে কেমন দুলকিচালে বলে যাওয়া। দারুণ।


    www.tareqnurulhasan.com

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।