সিঁড়ির নিচে নিজের ছোট্ট খোপের ভেতর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে মোবাইলে গান শুনছিল মিলন। আগে যদি জানতাম, মন ফিরা চাইতাম, এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না । গায়িকার আবেগ ওর বুকেও ধাক্কা মারে। চোখ বুঁজে মাথা নেড়েচেড়ে সেও গুনগুন করতে থাকে, মন রে, এই জ্বালা আর… হিলের খট খট শব্দে ওর গান থেমে যায়। চোখ খুলে গলা বাঁকিয়ে দেখে একটা অচেনা মেয়ে ঢুকে পড়েছে। নাকে এসে লাগে পারফিউমের ঝাপটা।
‘কই যান ?’ গলাটাকে কর্কশ বানিয়ে মিলন জিজ্ঞেস করে।
মেয়েটা একটু থতমত খায়।
‘চার তলা।’
‘কার ফ্লাট ?’
‘শাহরিয়ার আলমের ফ্ল্যাটে।’
‘অ…যান!’
মেয়েটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকলে মিলন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এখানে ওর দারোয়ানের চাকরি নিয়ে আসার বছর দেড়েক হবে। কিন্তু এই শাহরিয়ার আলমের ব্যাপারটা সে এখনো বুঝে উঠতে পারল না। প্রথমদিকে লোকটার বউকে প্রায়ই দেখা যেত। তারপর হঠাৎ একদিন খেয়াল করল বহুদিন তাকে আর বেরোতে বা ঢুকতে দেখা যায় না। একদম হাওয়া !
পরদিন শাহরিয়ার আলম যখন বাসা থেকে বেরুচ্ছেন তখন একগাল হেসে এগিয়ে যায় মিলন।
‘স্যার ম্যাডামকে দেখি না যে!’
শাহরিয়ার আলমের চেহারায় বিরক্তি ফুটে ওঠে।
‘ও মায়ের বাড়িতে গেছে।’
তা মায়ের বাড়িতে যেতেই পারে। তাতে সন্দেহের কিছু ছিল না। কিন্তু কিসের মায়ের বাড়ি ! বউয়ের আর ফেরার নাম নেই ! সে যে আর ফিরবে না সেটা পাকাপাকি বোঝা গেল গত রোযার ঈদে। বেচারা শাহরিয়ার আলম ঈদের দিনও একা একাই থাকল বাসায়।
তো এই ভর সন্ধ্যাবেলায় একটা একলা পুরুষলোকের বাড়িতে এই ভরযুবতী মেয়ের আগমনে মিলন অন্য কিছুর আভাস পায় ।
এই রসের কাহিনী শোনানোর জন্য মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে আশপাশের বিল্ডিংগুলোতে ঢুঁ মারে। দারোয়ানদের আড্ডা বসবে এখন। সবাইকে পাওয়া যায় না। জনা তিনেকে আড্ডা শুরু হয়। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আলাপ শুরু করে ওরা।
২.
ভোর ছ’টার দিকে মেইন গেটের তালা খুলে দিয়ে নিজের খোপে ঝিমাচ্ছিল মিলন। হিলের খটখটানিতে ওর ঝিমভাব ছিঁড়ে যায়।
কাল সন্ধ্যায় শাহরিয়ার আলমের ফ্ল্যাটে যে মেয়েটা এসেছিল সে-ই এখন বেরিয়ে যাচ্ছে । মিলন মনে মনে হাসে। যা ভাবছিলাম তাই ! একবার যখন আইছে, তখন আবার আইব ! তয় এই মাইয়ার পাশে শাহরিয়ার আলমরে মানায় না । ব্যাটার বয়স তো চল্লিশ-পাঁচচল্লিশের কম হইব না! আর মাইয়াটা এক্কেরে কচি !
মিলন আরও কিছুক্ষণ ঝিমায়। তারপর আড়মোড়া ভেঙে গেটের সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে । রোজ এ সময় সামনের বিল্ডিংয়ের কলেজপড়ুয়া মেয়েটা ইউনিফর্ম পরে বেরিয়ে যায়। মেয়েটাকে মিলনের ভাল লাগে। সে বেরোলেই মিলন হাসি হাসি মুখে এগিয়ে যায়, আপা, রিকশা-সিএনজি কি লাগবে কন ? আইনা দিব ?
মিলনের ভাগ্য ভাল ওই বিল্ডিংয়ে কোন দারোয়ান নেই । নইলে রোজরোজ অন্য বাড়ির দারোয়ান গায়ে পড়ে এত খাতির দেখালে নির্ঘাত ঝগড়া বেঁধে যেত ।
মেয়েটাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়ে ফিরতেই পাশের বাড়ির দারোয়ান আবু মিয়া সুর করে টেনে টেনে বলে, ‘কি মিয়া, হইছ তো দারোয়ান, ভাব দেইখা মনে হয় সেইটা মাজে-মইদ্দে ভুইলা যাও। এত গার্জিয়ানগিরি দেখাও কেন?’
আরেক দারোয়ান জহর আলী বলে, ‘আর তুমি তো মিয়া অর বয়সটা ভুইলা যাও। বিয়া-শাদী না কইরা ব্যাটার অবস্থা খারাপ! অই মিলইন্যা তুই বিয়া করতাছস না ক্যান ? যা, বাড়ি গিয়া বিয়া কইরা আয়।’
ওদের জটলার ভেতর কাজের বুয়া সেলিনা ঢুকে পড়লে জহর আলী বলে,
‘মিলন, তুই সেলিনারে বিয়া করলে পারস ! অই সেলিনা তর ভাতার তোরে ছাইড়া দিছে না ?’
সেলিনা ক্ষেপে যায়। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘খায়া-দায়া আর কাম নাই তো আপনেগোর! খালি শয়তানি-ফাইজলামি লইয়া আছেন!’
মিলন চোখের চাহনিতে ইঙ্গিত করে নিচু গলায় বুঝিয়ে দেয়,
সেলিনার স্বামী না থাকলে কি হবে, তিনতলার গৃতকর্তার সাথে তার ইটিশপিটিশ চলে!
গলিতে ফেরিওয়ালা-সবজিওয়ালা-ময়লাওয়ালাদের আনাগোনা শুরু হয়। অন্য দারোয়ানেরা যে যার কাজে ফিরে গেছে । মিলন এদের সাথেই গল্প জুড়ে দেয় । মাছওয়ালা মিজান মিয়ার মাছের ঝাঁকায় উঁকি দিয়ে বলে,
‘অ মিজান মিয়া, কি কি মাছ আনলা দেখি ? কোত্থাইকা আনছ ? পচা নাই তো ? দাঁড়াও তুমি, তিনতলার ভাবীরে জিগাই, নিব কিনা ।’
বেলা আরেকটু বাড়লে বাড়িওয়ালার কাজের বুয়া মধ্যবয়সী হাসিখুশি জমিলা খালা মিলনের খোপে সকালের খাবার দিয়ে যায় । জমিলা খালা গল্পের ওস্তাদ । কাজ ফেলে হাত-পা ছড়িয়ে বসে মিলনের সামনে গল্পের ঝাঁপ খুলে দেয়।
‘ও খালা তোমার মাইয়ার কি খবর ?’
‘আর কইস না বাবা। অর শাশুড়ি কুটনী মাগীটা মাইয়ার জীবনটা এক্কেরে শ্যাষ কইরা দিল ! সেইদিন অরে দেখতে গেছি, গিয়া দেখি বাড়িত ঝগড়া । জামাই মাইয়ারে নতুন শাড়ি কিন্যা দেছে ক্যান, এই নিয়া ঝগড়া । আমারে দেইখা…’
জমিলা খালার গল্প চলতেই থাকে । কিছু কিছু মিলনের কানে ঢোকে, কিছু কিছু কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায় ।
কিন্তু জমিলা খালার গল্প আর থামতেই চায় না। এবার সে বাড়িওয়ালার বউ আর ছেলের বউকে নিয়ে পড়ে।
‘বাড়িওয়ালার বউটা ভাল। কিন্তু ছেলের বউটা এমুন ঝগড়াইট্টা। সেইদিন হইছে কি…’
বাড়িওয়ালার কাজের ছেলেটা এসে বাগড়া বাঁধায় , ‘তুমি কাজ-কাম ফেইলা কি কর এইখানে ? আম্মায় তোমার উপর আইজ এমুন খেপছে!’
জমিলা খালা পানের পিক ফেলে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায়।
৩.
ময়নাতলা বস্তি সারাদিনে কয়েকবার চষে বেরিয়েছে মিলন। নিচতলার দুই বুড়োবুড়ি, ছেলেমেয়ে সব বিদেশে থাকে, মাস দুয়েক আগে মিলনকে বলেছিল একটা বুয়া খুঁজে দিতে । ময়নাতলা বস্তির একটা মেয়েকে জুটিয়ে দিয়েছিল সেই কাজ। মনিরা। ভালই কাজ করছিল । আজ সকালে বুড়ো-বুড়ির খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মোবাইলফোন, টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে । বস্তি থেকেও হাওয়া। সেই কড়া ঘুমের ওষুধে বুড়োর এখন জান নিয়ে টানাটানি। তার ভাস্তে এসে মিলনকে শাসিয়ে গেছে, মনিরাকে খুঁজে বের করতে না পারলে তাকেই পুলিশে দেবে! বুড়োর ভাস্তের শাসানিতে সে ভয় পেয়েছে এমন না।
কিন্তু বাড়িওয়ালাও তাকে ডেকে ঝেড়েছে অহেতুক।
‘কাজের বেটি যোগাড় করে দিতে বলল আর তুই একটা চুন্নী জুটায় এনে দিলি ! ভালমত খোঁজ নিবি না হারামজাদা!’
‘খোঁজ নিছলাম তো খালুজান ! কেউ তো অর নামে খারাপ কিছু কয় নাই ! বস্তির মুদির দোকানদার করিম ভাইরে জিগাইছিলাম । সেলিনারে জিগাইছিলাম। কেউ খারাপ কিছু কয় নাই ! মাইনষের মনে কি আছে আমি কেমনে কমু কন?’
‘দোষ করছিস আবার ফাল পারিস কেন ? নিচতলার চাচা মরে গেলে দেখিস তোর কি হয়! এইসব দায়িত্ব আর নিবি না তুই! ’
মনমেজাজ খারাপ করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে মিলন। রাস্তার মানুষজন দেখতে থাকে আর বিড়বিড় করে ঝাল ঝাড়তে থাকে।
শাহরিয়ার আলমের বাসায় যে মেয়েটা ইদানীং আসে তাকে রিকসায় দেখা যায়। এদিকে আসছে। বেটি কি জানে না আইজ কি হইতাছে বিল্ডিংয়ে ! আর ব্যাটা শাহরিয়ার আলম তুমি মাইয়াটারে মানা করবা না ? নাকি দুনিয়া উল্টায় গেলেও তুমি খবর রাখ না ? ধরা খাইবা আইজ তুমি!
মেয়েটার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও। ওর এমন দাঁত-মুখ খিঁচানো চেহারায় মেয়েটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেট দিয়ে ঢোকে। লাল শাড়ি পরে বেশ সেজেগুজে এসেছে সে। নিচতলায় এত মানুষের জটলা দেখে পিছিয়ে আসে। ভয় পাওয়া চেহারা নিয়ে মিলনকে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হয়েছে মিলন ভাই ?’
মিলনের ইচ্ছা ছিল দু’টো কড়া কথা শোনানোর। কিন্তু মেয়েটার এমন কোমল কণ্ঠস্বর, তার ওপর আবার তার নাম ধরে ডেকেছে! ওর ফুটন্ত মেজাজ শীতল হয়ে আসে।
‘চুরি হইছে নিচতলায়। আপনে যান উপরে, সমস্যা নাই।’
মেয়েটা সিঁড়ির দিকে এগোলে মিলন আবার ডাকে, ‘আপা, আপনে তো দেখি আমার নাম জানেন। আপনারটা তো জানি না!’
মিষ্টি হেসে মেয়েটা বলে যায়, ‘শ্রেয়া।’
সেদিন ঠিকই বাড়িওয়ালার চোখ এড়াতে পারেনি মেয়েটা । পরদিন বাড়িওয়ালা মিলনকে জিজ্ঞেস করেছিল,
‘লাল শাড়ি পরা মেয়েটা চারতলায় কার ফ্ল্যাটে গেছল রে ?’
‘শাহরিয়ার আলমের ফ্লাটে।’
‘কে হয় ?’
মিলন বানিয়ে বলে, ‘বইন-টইন হইব ।’
‘কিভাবে বুঝলি বোন ?’
মিলন আবার গল্প ফাঁদে,
‘স্যারের মায়ের সাথে আইছিল তো একবার।’
‘কখন গেছে ?’
‘বেশিক্ষণ ছিল না খালুজান। পনের-বিশ মিনিট। হাতে বই দেখলাম । বই নিতে আসছিল বোধহয়। স্যারের বাসাভর্তি খালি বই আর বই !’
মেয়েটা আসলে গিয়েছিল পরদিন ভোরবেলা। ছ’টার দিকে । লাল শাড়িটা কোনরকমে পেঁচিয়ে।
৪.
শাহরিয়ার আলমকে গেটের দিকে এগোতে দেখে ছুটে আসে মিলন। দাঁত কেলিয়ে বলে,
‘স্যার !’
‘কি ?’ বরাবরের মত বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে শাহরিয়ার আলম।
‘স্যার, সেইদিন বাড়িওয়ালা খালুজান আমারে জিগাইছিল শ্রেয়া আপা আপনার কি লাগে । আমি কইছি আপনার বইন লাগে।’
শাহরিয়ার আলমের ভ্রূ কুঁচকে যায়। তাকে খানিকটা চিন্তিত দেখায়। কিছু না বলে বেরিয়ে যায় সে।
তবে এরপর থেকে মিলন শাহরিয়ার আলমের পাত্তা পাওয়া শুরু করে । মাঝেমধ্যেই হাতে একশ-দুশ টাকা গুঁজে দেন। শ্রেয়া এলে প্রায়ই মিলনকে দিয়ে শিক-নান নয়ত বিরিয়ানী আনান। এমনকি শ্রেয়ার জুতো ছিঁড়ে গেলে সেটা মুচির কাছ থেকে সারিয়ে আনতেও মিলনকেই ছুটতে হয় ।
এই গোপন সম্পর্কটার সাথে নিজেকে জড়াতে পেরে মিলনের খুশি খুশি লাগে। আর তার কৌতূহলও গাঁজার নেশার মত দিনদিন বাড়তেই থাকে। ঘরের ভেতরের খবর জানতে শাহরিয়ার আলমের বুয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
‘ম্যাডামরে কেমন দেখলা?’
বুয়া আকাশ থেকে পড়ে।
‘কোন ম্যাডাম?’
‘দেখ নাই ! কাল সন্ধ্যায় একটা মাইয়া আইছে তোমার স্যারের বাসায়। এখনো আছে তো।’
এই বুয়া বড় সরল। কারও সাতে নেই, পাঁচেও নেই। কোন বাড়তি কৌতূহল না দেখিয়ে সে বলে, ‘তাইলে ঘরের ভিতর শুইয়া ছিল । স্যারে তো আমারে ঘর মুছতে কয় নাই । আর আমিও দেখি নাই!’
মিলন বিরক্ত হয় ।
‘তোমারে দিয়া কিচ্ছু হইব না। চোখ-কান খোলা রাইখা কাজ করবা না!’
মিলনকে হাঁড়ির খবর জানার সুযোগ করে দিতেই কি না, দিনকয়েক পর বুয়া গার্মেন্টসের কাজ নিয়ে চলে যায়। মিলনও একটা চালাক-চতুর চোখ-কান খোলা বুয়াকে শাহরিয়ার আলমের কাজে জুটিয়ে দেয়।
বেশ মুখরোচক গল্পের যোগান দিতে থাকে সে ।
‘সেইদিন কি দেখলাম মিলন ভাই !’ হেসে গড়িয়ে পড়ে নতুন বুয়া।
‘কি দেখলা, কও !’
‘আমি তো ভাণ ধরছি যে জানিই না মাইয়াটা ঘরে আছে। আমি ‘স্যার ঘরটা মুইছা দেই’ বইলা দরজায় দিছি ঠ্যালা । দরজা যে লাগানো নাই হেই হুঁশও নাই অগোর। দেখি মাইয়াটা শাহরিয়ার আলমের উপর শুইয়া…অন্ধকারে তেমন বুঝি নাই…তয় মনে হইল মাইয়াটার গায়ে কিচ্ছু নাই!’
‘কি সিন দেখলা তুমি মোমেনা ! তয় সাবধান থাইক ! নাইলে বাইর কইরা দিতে পারে কিন্তু! আর কাউরে কিছু কইবা না ! খবরদার ! এই এলাকায় কাজ করতে চাইলে আমার কথা শুনবা । কাউরে কিছু কইও না !’
‘আরো কি দেখছি শোনেন…।’
৫.
সন্ধ্যাবেলা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মিলন। মোবাইলে রেডিও চালিয়ে দিয়ে গান শুনতে শুনতে গুনগুন করছিল সে। হঠাৎ ঝড়ের গতিতে গেটের দিকে এগিয়ে আসে শ্রেয়া। কি ব্যাপার! আইলই না একটু আগে ।
‘ম্যাডাম !’
শ্রেয়া একবার পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু কিছু বলে না। গট গট করে হেঁটে যায় । আবছা আলোতেও বোঝা যায় চোখ ভেজা । কাজল ল্যাপ্টানো। নাক আর ঠোঁট লালচে, ফুলে আছে ।
মিলন হাসে। ঝগড়া করেছে বোধহয়। এর আগেও এমন হয়েছে। ঝগড়া মিটে গেলে কাল সন্ধ্যায় ঠিকই আসবে আবার। তখন মুখে থাকবে লাজুক হাসি। এই ঝগড়ার মধ্যেও মিলন বিনোদন খুঁজে নেয়।
শাহরিয়ার আলম আর শ্রেয়াকে এভাবে প্রেম করতে দেখে সিনেমা দেখার চেয়েও বহুগুণ আনন্দ পায় সে। কিন্তু ইদানীং সতর্ক হয়ে গেছে। কাউকে আর কিছু বলে না। জানাজানি হয়ে গেলে সিনেমা যদি শেষ হয়ে যায়! তবে দিনরাত চোখের সামনে এমন প্রেম দেখে দেখে নিজের জন্য ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। বিয়েশাদি, নইলে একটু ফষ্টিনষ্টি করা দরকার। রাতে নিজের খোপের ভেতর শুয়ে ওদের দু’জনকে কল্পনায় আনলে মিলনের শরীর কেঁপে কেঁপে জেগে ওঠে।
৬.
মিলনকে তাজ্জব করে দিয়ে সেদিনের পর শ্রেয়া আর ফেরে না। মিলন প্রতিদিনই ভাবে আইজ নিশ্চয় আইব। ঝগড়া তো হয়ই, আগে হইছে না ! কিন্তু নাহ, পাখির দেখা নেই ! শাহরিয়ার আলমকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহসে কুলায় না । নিজের আচরণে মিলন নিজেই অবাক হয়। শ্রেয়া না আসায় তার এমন উশখুশ লাগে কেন! কোথায় থাকে মেয়েটা ? একবার রিকশাওয়ালার সাথে দরকষাকষির সময় বুঝেছিল ও আসে কলাবাগান থেকে । কিন্তু কলাবাগান কি এইটুকু জায়গা! মিলনের তবু ইচ্ছা হয় কলাবাগানে গিয়ে শ্রেয়াকে খুঁজে বের করার। তার জানতেই হবে কি হচ্ছে এই প্রেমকাহিনীতে। সে নিজেও তো এই কাহিনীর একটা চরিত্র! এই প্রেমটাকে সে এভাবে শেষ হতে দিতে চায় না।
একদিন ঠিকই মিলন মোহাম্মদপুর থেকে কলাবাগান চলে যায়। এলেমেলো ঘুরতে থাকে এ রাস্তায়, ও রাস্তায় । হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে রিকসা নিয়ে ফিরে আসে।
৭.
শাহরিয়ার আলমের সাথে একটা মেয়েকে বাসায় ঢুকতে দেখে মিলন। আগে কখনো দেখেনি তাকে। মেয়েটার পিঠে শাহরিয়ার আলমের হাত ।
অ ! এইবার তুমি আরেক মাইয়ারে ধরছ!
রাগে ফুঁসতে থাকে মিলন। বাড়িওয়ালাকে এবার বলতেই হবে ! এত অনাচার চলতে থাকলে আল্লাহর গজব পড়বে এই বাড়িতে!
‘খালুজান, শাহরিয়ার আলমরে নিয়া কিছু কইতে চাই!’
‘তুমি আবার কি বলবা ? সে তো নিজেই বলে গেল!’
‘কি কইল?’
‘আগের বউয়ের সাথে তো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আরেকটা বিয়ে করবে। মেয়েটাকে নিয়ে আসছিল বাসা দেখাইতে। তা মেয়ের নাকি পছন্দ হয় নাই এই বাসা। হাই-কমোড নাই, লিফট নাই!’
‘হেই লোকের চরিত্রে কিন্তু দোষ আছে খালুজান। কেলেংকারী…’
‘এখন সেই কথা শুনে কি করব ? চলেই তো যাচ্ছে!’
৮.
ট্র্যাকে শাহরিয়ার আলমের মালপত্র সব তোলা হয়েছে। খুব বেশি জিনিসপত্র তার ছিল না। একটা ট্র্যাক বইপত্রেই বোঝাই।
এই কাহিনী তাহলে এবার শেষ হচ্ছে। সিনেমায় যেমন দেখায়, ‘সমাপ্ত’, ‘ দি এন্ড’ । প্রিয় সিনেমার শেষটায় এসে মন খারাপ হয়ে যায়, আর এ তো জ্বলজ্যান্ত জীবন! মিলনের বুকটা ভারি হয়ে আসে।
শাহরিয়ার আলম গেটের বাইরে পা বাড়ালে এগিয়ে যায় সে,
‘স্যার, শ্রেয়া ম্যাডাম কেমন আছে ?’
দারুন লাগলো :hatsoff:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
সেলুলয়েডে পোরা জীবন।
দৃশ্যকল্প বাস্তবছোঁয়া।
লেখার গতি আর ঢং সাবলীল।
শেষ লাইনটা বেশ যুতসই ছোটগল্পের সমাপ্তি টেনেছে ...
আরো পড়বার আগ্রহ থাকলো।
পড়তে বেশ লাগল।