জবানবন্দি

মেয়ে তিনটির পরনে নামী ফ্যাশন হাউসের এক্সক্লুসিভ সালোয়ার-কামিজ । পায়ে ফ্যাশনেবল জুতো । হাতে বিদেশী ব্র্যান্ডের ব্যাগ । মেক আপে আঁকা নিখুঁত মুখশ্রী । ঈশ্বরপ্রদত্ত গায়ের রঙ,চোখের রঙ, চুলের ধরণ কিছুই আর বুঝবার উপায় নেই । তিনজনের পারফিউমের ককটেলে আশপাশের কয়েক গজ মাতোয়ারা ।

ওদের মুখ ফুটে বলতে হয়না নিজেদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে । শেখ সাদীর সেই গল্পের মত পোশাক-পরিচ্ছদই জোরগলায় তা ঘোষণা করে । মোহনা কৌতূহলী চোখে ওদের খুঁটিয়ে খেয়াল করে। কন্যাত্রয়ের সাথে পরিচয় গাজীপুরের এই  লিডারশিপ ক্যাম্পে, চারদিন আগে। এই চারদিনের প্রতিবেলায় ওদের পরনের পোশাক তো বটেই, সেই সাথে বদলে গেছে অনুষঙ্গও। প্রতিদিনই ভিন্ন জুতো , ভিন্ন ব্যাগ, ভিন্ন কানের-গলার অলংকার। রঙের বাহার চোখের লেন্সে, আইলাইনার-আইশ্যাডোতে ।প্রতিদিনই ওরা নতুন বেশে, তাই প্রতিদিনই দর্শনীয়। যেন ওরা বিভিন্ন পণ্যের মডেল হয়ে ক্যাটওয়াক করছে ‘ক্যাম্প’ নামের এই র‍্যাম্পে। বলে রাখা ভাল, ওদের ফ্যাশন ম্যানিয়ার সাথে তাল মেলানোর সুপ্ত সাধ (যা সে নিজের কাছেও স্বীকার করতে চায় না)  থাকলেও সাধ্য নেই মোহনার ।

ওদের তিনজনের রোজকার আলাপের বিষয় অবশ্য অভিন্ন ও একঘেঁয়ে । এই যেমন, রুটিনমাফিক  একে অন্যের জামা-জুতোর প্রশংসা  করা, বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের কালেকশন সম্পর্কে কে কতটা আপডেটেড তা জাহির করা, ক্যাম্পের অন্যান্যদের নিয়ে অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করা- এ সবই । মোহনা এই আলাপে অংশ নিতে অপারগ । এ সময় ওর নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় আর অনাহূত মনে হয় ।  অস্বস্তিকর নীরবতায় ওদের কথা  শুনে যায়। ওরাও বুঝে গেছে… তাই এ ধরণের আলাপে ওরা মোহনার অস্তিত্ব ভুলে যায়। একবারের জন্যও ওদের চোখাচোখি হয়না ওর সাথে । মোহনা তখন চুপচাপ ওদের আলাপ শোনে আর ভেতরে ভেতরে বিষোদ্গার করতে থাকে । এই মেয়েগুলো পারেও ! আছে শুধু বয়ফ্রেন্ড-ফ্যাশন-রেস্টুরেন্ট আর টিভি সিরিজ নিয়ে । কেমন অগভীর , চিন্তাশূন্য, স্থূল একেকজন ! এত মেয়েলি তোমরা ! তোমাদের জন্য আমার করুণা হয় !

তিনটি মেয়েই প্রাইভেট ভার্সিটি পড়ুয়া । নিজেদের ঝকঝকে ক্যাম্পাসের কথা বলাবলি করে ওরা। ভ্রু কুঁচকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মোহনাকে  জিজ্ঞেস  করে-

‘তোমাদের সেশন জ্যাম খুব বেশি তাই না? ছ-সাত বছরের আগে অনার্স শেষ হয় না?’

‘সবসময় মারামারি লেগে থাকে? পলিটিক্সের কারণে ক্লাস হয় না নিয়মিত?’

‘অবশ্য তোমাদের টিচাররা তো বোধহয় ক্লাস নেয় না ঠিকমত, তাই না ? প্রাইভেট ভার্সিটিতে চলে আসে।’

‘উঁইপোকার জালায় ক্লাস করো কিভাবে?

শেষ প্রশ্নটা করার সময় ওদের আতংকগ্রস্থ দেখায়।

সাতদিনের এই ক্যাম্পে এসে এই তিনটি মেয়ের দলেই ভিড়েছিল মোহনা । ওদের দলে ভিড়ে অন্যের চোখে নিজেকে ওদের একজন ভাবার গৌরবটুকু চেয়েছিল । কিন্তু ওদের সাথে তার ফারাক বড়ই দুস্তর। মোহনার ভেতর থেকে মিনমিনে একটা কণ্ঠস্বর পরামর্শ দিয়ে যায়, অর্থ-বিত্তে না পারো, নিদেনপক্ষে কথা বলার ধরণ-ধারণ একটু পাল্টাও! কিন্তু অদ্ভূতভাবে  মোহনার ভেতরে একটা প্রতিরোধও কাজ করে । সেই  সত্তা যেন জেদ ধরে বসে আছে স্বকীয়তা রক্ষায়। মোহনা তার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকে দেখেছে পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে দ্রুত পালটে নিতে, যেহেতু কি না সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। কিন্তু এসব দেখে শুনে ওর মন যেন  আরো বেশি করে উল্টো পথে হাটতে চায়। ইচ্ছা করে না ওদের মত বাংলিশ উচ্চারণে বাংলা বলতে। ইচ্ছা  করে না  দু’টো বাংলা কথার পরপর একটা ইংরেজী কথা বলে নিজের  ইংরেজী দক্ষতা তথা স্মার্টনেসের পরিচয় দিতে ।

আরও বেশ কিছু মেয়ে এসেছে এই ক্যাম্পে। এই যেমন বটগাছের ছায়ায় এখন আড্ডা দিচ্ছে ছ’টি মেয়ের একটি  বৃত্ত। পোশাক আভাস দিচ্ছে ওরা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা তার চেয়ে খানিকটা ওপরের সারির। একজন বাদে বাকি সবাই পাবলিক বা ন্যাশনাল ভার্সিটি পড়ুয়া। পোশাক-আশাকে সাদামাটা । সস্তা দোকানের সহজলভ্য জামা-জুতো-ব্যাগ। মোহনা চাইলেই  এই বড়লোক মেয়েগুলোর সঙ্গ ছেড়ে এদের দলে ভিড়তে পারে । কিন্তু তাতে ওর অনাগ্রহ । না,এই মেয়েগুলোর সাথে ঠিক স্ট্যাটাস মেলে না । চাঁদনিচকের ফুটপাতে যে কাপড়গুলো  ঢাঁই হয়ে থাকে, সে ধরণের সস্তা কাপড়ের সালোয়ার-কামিজ একটা মেয়ের পরনে। আর তার পাশের মেয়েটার হ্যান্ড ব্যাগটা…হুম, ওটার দাম তিনশোর বেশি হবে না। পেছনের মেয়েটার পরনে মা-দাদীদের আমলের ওল্ড ফ্যাশনের বোরখা ! না, না , এদের সাথে ঘোরাঘুরি করে নিজেকে এক ধাপ নামিয়ে আনতে মোহনার ভয়ানক আপত্তি। তা হোক না এই মেয়েগুলো কম নাক-উঁচু, হোক না তাদের চোখগুলো অবজ্ঞা-মুক্ত ! উচ্চাকাঙ্ক্ষী মোহনার নজর ওপরের দিকে ।

মোহনা ভেতরে ভেতরে টের পায় তার সাথে আলাপের সময় কন্যাত্রয়ের উন্নাসিকতা  প্রকট নগ্নমূর্তি ধারণ করে। আর এই মেয়েগুলোর সাথে তার আচরণের বেলায় তা  সৌজন্যতার পর্দায় আব্রু রক্ষা করে । কিন্তু ভেতরে তা তো একই গোত্রীয়। ওই মেয়েগুলো অন্তত তার মত হিপোক্রেট নয় । তাদের মনোভাব সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায় । মোহনা এ ভাবনা তাড়াতাড়ি এড়িয়ে যায় । আত্মগ্লানির কুটকুট কামড় বড় ভয়ানক জিনিস !

 

আপাতত দু’টো দল থেকেই ও বিচ্ছিন্ন হয় । একা একাই ঘুরে দেখে চারপাশ । ওর চোখ তীক্ষ্ণ , অন্যদের ব্যাপারে ওর কৌতূহলও বেশ । হঠাৎ ওর চোখ আটকে যায় ক্যাম্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মেয়েটির প্রতি । এই ক্যাম্পেরই আয়োজকদের একজন – রেহান ভাই ওর ছবি তুলে দিচ্ছে । রেহান ভাইয়ের বেশ নামডাক আছে মেয়েমহলে । মানুষটা দেখতে নিতান্তই সাদামাটা । কিন্তু দুর্দান্ত ব্রিলিয়ান্ট,স্মার্ট আর ক্যারিশমাটিক । মেয়ে পটানোয় সিদ্ধহস্ত । এই মোহিনীকেও মোহনা আগে থেকেই চেনে । মেয়েটার কীর্তি দেখে মোহনার পিত্তি জ্বলে যায় । তা বাবা, স্রষ্টা তোমার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে কিছু বাড়তি রূপ দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাই বলে তার যথেচ্চাচার করে সুবিধা আদায় করতে হবে । জামাকাপড় যা পরো, তাতে মাশাল্লাহ শরীরের ভাঁজ-খাঁজ তো ভালই প্রদর্শন হয় ! রূপ তো দুইদিনের । যৌবন শেষ, রূপও টা টা বাই বাই ! আসল কৃতিত্ব তো গুণে ! তুমি নিজে কতটা অর্জন করতে পেরেছ !  রেহান ভাইয়ের মত ট্যালেন্টেড মানুষের সৌন্দর্যের প্রতি এহেন প্রকাশ্য পক্ষপাতিত্ব মোহনার কাছে অপ্রত্যাশিত। এমন গুণী মানুষ কেন রূপের কদর করবেন! স্টিফেন হকিংয়ের ঘরে নাকি মেরিলিন মনরোর একখানা বিশাল ছবি  টাঙানো আছে। কেন বাবা ? মাদাম কুরীর ছবি নয় কেন ! তো স্টিফেন হকিং-ই রূপের কদর করলে রেহান কোন ছার !

ভাবনা ডালপালা মেলতে থাকে, আর তা বেয়ে বেয়ে মোহনার রাগ মগডালে চড়তে থাকে । এই যে সে এত গুণে গুণান্বিতা, এই তো সেদিনই তার এক শিক্ষক তার নামের সাথে ‘মাল্টিডাইমেনশনাল’ বিশেষণ জুড়ে দিলেন, এই যে গত বছর ক্যাম্পে ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব সে এত দক্ষতার সাথে পালন করল, কিন্তু কই, তার প্রতি তো রেহান ভাইয়ের কোন বাড়তি মুগ্ধতা কাজ করেনি কখনো । বাহ রে বা, পূর্বপুরুষের জিনের কেরামতিতে প্রাপ্ত রূপই হয়ে গেল আকর্ষণের পূর্বশর্ত । সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র ! আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী!  অন্তরের সৌন্দর্য এমন অবহেলায় অনুদযাপিত থাকবে ! আহ্ , রেহান ভাই ! আপনাদের জন্য আমার করুণা হয়!

ওপরে ওপরে করুণায় সরগরম হলেও ভেতরে ভেতরে ক্রমবর্ধমান হীনম্মন্যতা যখন বেয়াড়া হয়ে উঠতে থাকে , তখন তাকে বাগে আনার যথেষ্ট শক্তি সবসময় থাকে না মোহনার ! নির্জীব আর নিষ্প্রাণ লাগে নিজেকে।

মোহনার মন-ভাঙ্গানো ভাবনায় ছেদ টানে একটি পরিচিত মেয়ের অবয়ব। ট্র্যাভেলিং ব্যাগ হাতে এগিয়ে আসছে এদিকে ! সিঁথি ! সাতদিনের ক্যাম্পে সে উপস্থিত হল চারদিন বাদে ! মোহনা ছুটে যায় সিঁথির কাছে। গতবছর ক্যাম্পে পরিচয়। স্বল্প পরিচয়েও বন্ধুত্ব গাঢ় হতে সময় লাগে নি। আর ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগ বন্ধুত্বটাকে আরো পাকা করেছে!

সিঁথি তার তাঁবুতে জিনিসপত্র গোছগাছ করে হাতমুখ ধুয়ে খানিকটা সতেজ হলে, মোহনার তার এতক্ষণের দমিয়ে রাখা প্রশ্নটা উগড়ে দেয়।

‘সিঁথি ! তুই তো এবার আসতে চাসনি !  কি হয়েছিল বল তো ? আমি জানি, তুই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস!’

সিঁথি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর আস্তে করে বলে,

‘ইমরানের সাথে ব্রেক আপ হল। খুব আপসেট ছিলাম, তাই শুরুতে আসতে চাইনি। পরে ভাবলাম এখানে ফ্রেশ এয়ারে কয়েকটা দিন থাকলে হয়ত দমবন্ধ ব্যাপারটা কাটবে ।’ সিঁথি এরপর আস্তে আস্তে পুরো গল্পটা  প্রকাশ করে। মোহনার তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া,

‘তুই মানুষটা  বড় ম্যাটেরিয়ালিস্টিক…।’

‘সরাসরি কনক্লুশনে চলে গেলি ?’

‘নাহলে ?  ভাইয়া চাকরি পাচ্ছে না বলে এভাবে ছেড়ে আসলি তাকে ? এতদিনের প্রেম !’

‘আর তুই  নিজে যে কোন সিরিয়াস রিলেশনে গেলি না তার কারণ ?’

‘আমাদের ফ্যামিলিতে প্রেমের ট্রাডিশন নেই। সবারই অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ । সবাই-ই খুব হ্যাপি ! আমার এক কাজিনের বিয়ে হয়েছে গত বছর। খুবই সুখে আছে। হাজবেন্ড মাল্টিন্যাশনালে আছে। সংসারের শুরুতেই নতুন ফ্ল্যাট, নিজেদের গাড়ি! সিকিওর লাইফ !’

‘তোর অ্যারেঞ্জড ম্যারেজেও তো সবই ম্যাটেরিয়ালিস্টিক ব্যাপার দেখছি !’

তিনকন্যার প্রভাবে মোহনার মধ্যে ইংরেজী বলার বাতিক এসে যায়। খাঁটি আমেরিকান উচ্চারণে সে বলে,

‘ইটস নট এভিরিথিং অ্যাকচুয়ালি ! বাট ইটস এসেনশিয়াল !’

‘সব কি একসাথে পাওয়া যায় বল ? ইমরান তো কবিতা লিখেই জীবন কাটাতে চায়। রোম্যান্টিক ফুল ! ইমরানের মত এমন ইন্টেলেকচুয়াল আর পোয়েটিক মাইন্ডের ছেলেরা করপোরেট সেক্টরে ধাই ধাই করে ওপরে ওঠার মত ক্যালকুলেটিভ হয় না। দু’টো ব্যাপার এক সাথে মেলে না । কাউকে কাউকে পাওয়া যায়, তবে তারা ততদিনে কবিত্ব আর বুদ্ধিজীবিত্ব ছেড়ে বৈষয়িক বিষয়ে মন দিয়েছে। প্রাক্তন কবি, প্রাক্তন বুদ্ধিজীবি! ’

‘ ইমরান ভাইয়ের সাথে থেকে থেকে তুই তো বেশ বুদ্ধিজীবি মার্কা কথা বলা শিখে গেছিস!বিয়ে করবি এমন ভাবনা তো সম্পর্কের শুরু থেকেই ছিল। তাহলে এই সম্পর্ক এতদিন টেনে আনলি কেন ?’

‘তুই যেমন শুরু থেকে প্র্যাকটিক্যাল একটা ধারণা নিয়ে  এগিয়েছিস, আমার সেরকম ছিল না। প্র্যাকটিক্যাল হলাম এতদিন পর ! কিন্তু তোর ম্যাটেরিয়ালিস্টিক লাইফ প্যাটার্নের ভাবনা শুরু থেকেই ছিল। ব্যাপারটা বাই ডিফল্ট আছে তোর মধ্যে। তাই আলাদাভাবে টের পাস না তুই। দেখ মোহনা, আই মিস হিম ! আমি ইমরানকে মোল্ড করতে চাইনি। সো আই লেফট হিম ! আমি সেলফিশ নই । আই অ্যাম ম্যাটেরিয়ালিস্টিক অ্যান্ড সো আর ইউ !  অ্যাডমিট ইট ডারলিং !’

‘বাট আই অ্যাম ওয়াইজার ! আমি কাউকে কষ্ট দেইনি !’

নিজের ম্যাটেরিয়ালিস্টিক অ্যাটিচিউডকে মোহনা যেন উইজডম দিয়ে ঢেকে দিতে চায়। এ ধরণের স্বভাবকে মোহনা  সবসময় হেয় চোখে দেখেছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মেলা যুক্তি তার ঠোঁটের আগায় ছিল। কিন্তু  এখন তার কোনটাই সে ব্যবহার করল না। নিজের মনই তাতে সায় দিল না।

মোহনার সাথে একই তাঁবুতে থাকে জিনাত নামের মেয়েটা। মোহনার চোখে জিনাতও ‘টিপিক্যাল’ মেয়েলি মেয়ে । জাজমেন্টাল  স্বভাবের কারণে মোহনা অন্যদের ব্যাপারে খুব দ্রুত উপসংহারে পৌঁছে যায়। তবে সে এই সিদ্ধান্তেও দ্রুত পৌঁছে গেছে – মেয়েটা খুব উদারমনা।

জিনাত দেখতে সাদামাটা। কিন্তু মেক আপের ম্যাজিক টাচে মেয়েটার যেন রূপান্তর ঘটে। ভেলকি বাজির মত রূপান্তর । ওকে দেখে মোহনারও লোভ হয়। জিনাতের মেকআপ বক্সটা ধার করে একবার। আনাড়ি হাতে ভোল বদলের চেষ্টা।

আর ইউ ইন্সিকিউরড মোহনা ? ভেতর থেকেও কেউ যেন প্রশ্ন করে। ভেতর থেকেই অন্য কেউ জবাব দেয় , ‘যস্মিন দেশে যদাচার!’ আরেকজন বলে, আহা, শুধু অন্যের নজর কাড়ার জন্য কেন হবে ? নিজের কাছেই তো নিজেকে সুন্দর দেখতে ভাল লাগে !

ভ্রু কখনোই আঁকে নি সে। আই ব্রাও পেন্সিল তাই নেই। কাজল দিয়েই ভ্রু আঁকার চেষ্টা। আই লাইনার লাগাবার সময় তা বারবার আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। বার কয়েক টিস্যু ঘষে সেটাকে কিছুটা জাতে তোলা যায় । দ্রুত ইউটিউব থেকে দু’টো ভিডিও টিউটোরিয়াল নামিয়ে নেয় ‘হাউ টু পুট অন আইশ্যাডো’। এভাবে আইশ্যাডো আর ব্লাশন লাগানো হয়। ঠোঁটে লিপকালার।

সাজ শেষে আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখে। ভালই দেখাচ্ছে তাকে। প্রথম চেষ্টায় তার সাজ খারাপ হয়নি। অবশ্য দক্ষ সাজিয়েরা তার সাজের খুঁতগুলো ঠিকই ধরে ফেলবে।  নাহ্ ! এই সাজ নিয়ে ওই তিনকন্যার সামনে যাওয়া যাবে না। আড়ালে হাসাহাসি করতে পারে।  আরো বার দুয়েক প্র্যাক্টিস না করা পর্যন্ত এই সাজ-সজ্জা ওদের দৃষ্টির আড়ালেই থাকুক।

তাঁবুর বাইরে তখন বিকেলের মিষ্টি হলদে আলো। যেন আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে। আরও আছে সুন্দর সজ্জাজনিত আত্মবিশ্বাস। মোহনার চোখ খুঁজে ফেরে রেহান ভাইকে। বরাবরের মত তিনি তখন নারীপরিবেষ্টিত । নারীকুলের শিরোমণি। পায়ে পায়ে সেখানে চলে যায় মোহনা। ভেতরে ভেতরে  সে একবার লজ্জায় আড়ষ্ট হয়, আরেকবার আত্মবিশ্বাসে ঝলমলে করে। এ দুয়ের রশি টানাটানিতে শেষমেশ আত্মবিশ্বাসেরই জয়জয়কার, যেহেতু সৌন্দর্যের জয় সর্বত্র। মোহনা রেহান ভাইকে ঘিরে থাকা মেয়েগুলোর দিকে এক ঝলক তাকায়। গড়পড়তা চেহারা। মেক আপের জালিয়াতিও নেই। এ মুহূর্তে নির্দ্বিধায় সে এই নারীকুলের শ্রেষ্ট সুন্দরী। আহ্লাদী গলায় মোহনা ডাক দেয় ‘রেহান ভাই’। পাকা খেলুড়ে রেহান ভাই সেই কণ্ঠস্বরের অর্থ বোঝেন। সাড়া দেন মোহনার ফ্লার্টি আহবানে। তার চাহনিতে সপ্রশংস দৃষ্টি। সে চাহনি মোহনাকে আরো আত্মবিশ্বাসী করে । রূপের জাল বিস্তার করে সে ছাড়তে থাকে ইন্টেলিজেন্স আর সেন্স অব হিউমারের সুতো । পুরো বিকেল অন্যদের থেকে রেহান ভাইকে আলাদা করে রাখে মোহনা। শেষমেশ অর্গানাইজিং কমিটি থেকেই রেহান ভাইয়ের ডাক পড়লে সুতো ছিঁড়তেই হয়।

নিজের পরিবর্তিত ভূমিকায় মোহনা নিজেই মুগ্ধ ! তার উপলন্ধি- নাহ্ ! রূপের প্রতি পুরুষের মোহ বিষয়টা নেহায়েত মন্দ না ! ওদের কুপোকাত করার একটা বাড়তি অস্ত্র। তার নিজের অস্ত্রটা খুব ধারাল হয় তো নয়, তবু একটা বাড়তি শক্তি তো !অথচ এই অস্ত্রের ভয়াবহ ধারের অপরাধে গতকালই সে ওই সুন্দরী মেয়েটাকে ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিয়েছিল। আহা, ওই মেয়েটা তো সীমা ছাড়িয়েছিল ! কিন্তু অন্য অনেকের চোখে হয়ত তারটাও সীমা ছাড়ানো ! অপরাধবোধটাকে আর চাঙা হতে দেয় না সে। ‘সুখী হওয়ার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া’।

সন্ধ্যা থেকে তোড়জোর চলছে বারবিকিউ পার্টির জন্য। আজই ক্যাম্পের শেষ রাত। মাঝ রাত অবধি চলবে কনসার্ট-হৈ-হুল্লোড়। চামড়া ছাড়ানো মুরগীর স্তুপ জমেছে একদিকে। চলছে মশলা মাখানো। আরেকদিকে কাঠ-কয়লার চুলার বন্দোবস্ত । স্টেজে কনসার্টের সাউন্ড সিস্টেম ঠিক করা হচ্ছে। মোহনা তখন সেই কন্যাত্রয়ের সাথে ।সঙ্গী সিঁথিও । তবে শেষবেলায় এসে কন্যাত্রয়ের সান্নিধ্যে  বেশ লাভই হয়। ওদেরই একজন ক্যাম্পের কোন এক কর্মচারীকে দিয়ে আনিয়ে নিয়েছে এক বোতল হুইস্কি। ক্যাম্পে প্রকাশ্য মদ্যপান নিষিদ্ধ। তাই তারা চলে যায় তাঁবুতে এবং ভদ্রতাবশত মোহনা-সিঁথিকে সাথে না নিয়ে পারে না। মোহনাও এই মুহূর্তে ভাবতে চায় না সে অনাহূত। এই জিনিস একবার চেখে দেখতে হবে! এমন সুযোগ বারবার আসবে না। কন্যাত্রয়ের এক কন্যা বোতলের মুখ খুলতে থাকে। আরেক কন্যা প্যাকেট থেকে থেকে কাজু বাদাম ঢালতে থাকে প্লেটে।তৃতীয়া কন্যা আফসোস করে,‘আহ্ ! বারবিকিউ চিকেনের সাথে খেতে পারলে জোস হত ! হোয়াই ইজ ইট ব্যানড  হিয়ার ?’

এই সোনালি তরল প্রথমবারের মত চেখে দেখবে মোহনা । প্রথম চুমুকে নাক-মুখ কুঁচকে যায়। ঠিক যেন তেতো ওষুধ! ওই মেয়ে তিনটি  অবশ্য বেশ তৃপ্তির সাথে চুমুক দিতে থাকে। বিস্বাদ লাগা সত্ত্বেও উৎসাহ-উত্তেজনায় আর বিনে পয়সায় পাওয়া যাচ্ছে বলে পেগ তিনেক হুইস্কি শেষ করে মোহনা। কিন্তু তেমন কোন প্রতিক্রিয়া অনুভব করে না। শুধু নিজেকে খুব সপ্রতিভ মনে হয়। জড়তা আর অস্বস্তিমুক্ত। তাঁবু থেকে বের হতেই মোহনার চোখ আটকে যায় রেহান ভাইয়ের ওপর। এ মুহূর্তে তার সাথে আরেক সুন্দরী। রেহান ভাইকে কেন চোখে পড়ে বারবার ? তার চোখ দু’টো যেন ছাঁকনির মত বাদবাকিদের ছেঁকে ফেলে দেয় ! মোহনার নিজের ওপর রাগ হয়। রাগ হয় রেহান ভাইয়ের ওপরও। প্লেবয় একটা ! আজকে একে ধরে, তো কালকে ওকে ছাড়ে ! শালা অ্যাডভেঞ্চারিস্ট !

 

কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। দ্বিধাহীন মোহনা আজ আগ বাড়িয়ে কথা বলে  সবার সাথে ।  হঠাৎ গিটারে তোলা চমৎকার একটা সুর  মোহনাকে চুম্বকের মত টেনে ধরে আর ওর মুখরতায় ছেদ টেনে দেয়। এখন স্টেজে গিটার হাতে অচেনা একটা ছেলে । আড্ডাময় পরিবেশটাকে  ধূলিসাৎ করে দিয়ে উদ্দাম করে তুলল সবাইকে। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ! কেউ কেউ দোলাচ্ছে মাথা, কেউ পুরো শরীর। কেউ গানের সাথে মেলাচ্ছে ঠোঁট । দুর্দান্ত স্টেজ পারফর্মার ! তার এক্সপ্রেশন, মুভমেন্ট সবই প্রফেশনাল রকস্টারদের মত। কণ্ঠও বেশ শক্তিশালী । মুহূর্তে মোহনার তীব্র রোম্যান্টিক অনুভূতি হতে থাকে । নিজেকে মনে হয় বলিউডি কোন সিনেমার নায়িকা। কে দেখছে, কী ভাবছে এসবের তোয়াক্কা না করে মোহনা উদ্দামভাবে নাচতে থাকে।  ঝাপসা ঝাপসা বুঝতে পারে তার দৃষ্টির ছাঁকনি এবার রেহানভাইয়ের সাথে সাথে এই ছেলেকেও আটকে দেবে !

কনসার্ট, বারবিকিউ ডিনার সবই শেষ হয়ে গেছে ঘন্টা খানেক আগে। প্রথমবারের মত মদ গেলা আর উন্মত্ত নাচানাচি- এ দুইয়ের কম্বো-টা তার জন্য একটু বেশিই হয়ে গেছে।  বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে মোহনা। গা গোলাচ্ছে ভীষণ। হঠাৎ হুড়মুড় করে বমি বেরিয়ে আসতে চায়। মোহনা ছুটে যায় বাইরে। সবকিছু উগড়ে ফেলে হাত-মুখ ধুয়ে খানিকটা সুস্থ বোধ করে। হালকা ঝিমঝিম ভাব ছাড়া শরীর-উদ্ভূত কষ্ট আর নেই। কিন্তু এক ধরণের মানসিক অবসন্নতার শরীরী প্রতিক্রিয়া ও টের পায়। এই অবসন্নতার মূল কালপ্রিট আত্মবিশ্লেষণ। জেঁকে ধরে আছে তাকে।

বহুগামী মানসিকতার জন্য রেহান ভাইয়ের এত নিন্দা করে সে। কিন্তু ওই গিটারিস্ট ছেলেটা, রেহান ভাই আর  ক্যাম্পাসের সেই কবি কবি ছেলেটা- এই তিনজনের প্রতিই তো তার প্রচণ্ড আকর্ষণ কাজ করে, এবং একই সাথে ।  এই তিনজনই যদি একই সময়ে তার প্রেম প্রার্থনা করে, তাহলে কি সে সানন্দে সায় দেবে না প্রত্যেকের আহবানে ? নাকি সমাজ আর নৈতিকতার দোহাই দেখিয়ে কোন একজনকে বেছে নিয়ে মনে তালা লাগিয়ে সংযমী হবে ? সংযম কি সুযোগের অনুপস্থিতি কিংবা পায়ের শেকল  ?

মোহনা বোঝে, নিজেকে সে যেমনটা ভাবে বা ভাবতে চায়, আদতে সে তেমনটা নয়। নিজের সাথেই যেন তার লুকোছাপা চলেছে। যে বৈশিষ্ট্যগুলোকে ও সবসময় নেতীবাচক  ভেবে এসেছে সেগুলোর বীজ তার ভেতরেই আছে । সবার মধ্যেই কি থাকে না ? শুধু  পারিপার্শ্বিকতাভেদে  কম-বেশি এই যা ! অ্যাবসলিউট কোন কিছু কি হয় ?  আমি একটা হিপোক্রেট , এস্কেপিস্ট, অপরচুনিস্ট, টিপিক্যাল মিডল ক্লাস মেন্টালিটি- মরালিটি্র মেয়ে…। নাকি আমি হিউম্যান ? বিড়বিড় করতে থাকে মোহনা।

১,০৫৯ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “জবানবন্দি”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    "সংযম কি সুযোগের অনুপস্থিতি কিংবা পায়ের শেকল?" - ভাল এক আত্মজিজ্ঞাসা।
    আমার তো মনেহয় মেটেরিয়ালিস্ট আর প্র্যাকটিকাল - একই অর্থ বহন করে। তবুও "মেটেরিয়ালিস্ট"-কে আমরা অপছন্দ আর "প্র্যাকটিকাল"-কে আমরা উৎসাহ দেই।
    কারনটাও সবারই জানা।
    সফল বিবাহে প্র্যাকটিকাল হওয়াটা জরুরী। প্রেমে তা নয়।

    সংসার যদি গাড়ি হয়, স্ত্রী সে গাড়ির মালিক আম স্বামী হলো ড্রাইভার। প্র্যাকটিকাল মানুষকে ড্রাইভার হিসাবে পেতে কেনা চাইবে...

    ভাল লেগেছে :clap: :clap: :clap:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. অরূপ (৮১-৮৭)

    :thumbup: :thumbup: :thumbup: :thumbup:
    লেখাটা কেন মিস করলাম আগে বুঝতে পারছিনা ... চমৎকার লেখা পিয়া
    আত্মবিশ্লেষনের ফ্রেমটা খুব ক্রিটিকাল ... আমারা কোথাও একটা কম্প্রোমাইজ করে জীবন পার করে দেই।
    আবারও বলছি ... চমৎকার


    নিজে কানা পথ চেনে না
    পরকে ডাকে বার বার

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।