রেহনুমাদের হলের গেটে অসংখ্য পোস্টার সাঁটা।চিত্র প্রদর্শনী,নাট্যোৎসব,আবৃত্তি কোর্স,বিতর্ক প্রতিযোগীতা –এসব তো আছেই,সেই সাথে টিউশনি আর পার্ট টাইম চাকরীর পোস্টারও অনেক।আজকাল টিউশনির বিভিন্ন মিডিয়া আছে।তারা বিশাল তালিকা ঝুলিয়ে দেয়-‘অমুক অমুক জায়গার তমুক তমুক ক্লাসের ছাত্র/ছাত্রীর জন্য শিক্ষিকা প্রয়োজন!’ অবচেতন মনেই এতদিন সেসব পোস্টারের দিকে তাকিয়েছে রেহনুমা।খুব একটা গা করেনি।শুধু টিএসসিতে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর কোন পোস্টার থাকলে সেদিকে আগ্রহ নিয়ে তাকায়।সময়-সুযোগ মিলে গেলে দু’একটা সিনেমা দেখা হয়ে যায়।কিন্তু গত চার-পাঁচদিন ধরে গেটের পোস্টারগুলো খুব ভালভাবে খেয়াল করছে ও,বিশেষ করে টিউশনিগুলোর।একটা টিউশনির খুব দরকার।ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা ট্যুর আয়োজন করা হয়েছে বান্দরবানে।হাজার চারেক টাকা লাগবে।কিন্ত মার কাছে টাকার কথা মুখ ফুটে বলার সাহস নেই তার।ছোট চাকুরে মায়ের ঘাড়ে বেশি বোঝা চাপাতে ইচ্ছে করেনা ।তাছাড়া সামনে আছে ঈদ।মা আর ছোট ভাইকে কোন কিছু উপহার দেয়ার শখটা উথলে উঠছে মনে।গতমাসে শুধু ডাল-ভাত-ভর্তা খেয়ে খাবারের খরচ থেকে বেশ কিছু টাকা বাঁচিয়েছিল সে।ভেবেছিল সেটা দিয়ে মা আর ভাইয়ের জন্য কিছু একটা কিনবে।কিন্তু মার্কেটে গিয়ে একটা সালোয়ার-কামিজ এত পছন্দ হল যে মা-ভাইয়ের কথা বেমালুম ভুলে হুট করে কিনে ফেলল সেটা।এখন মনে মনে নিজেই নিজেকে দুষছে-রেহনুমা,তুমি বড় স্বার্থপর মেয়ে!নিজেরটা খুব ভাল বোঝ!এত্ত বড় একটা মেয়ে তুমি,অথচ এখনো মায়ের টাকায় চল!কখনো মাকে দিয়েছ কিছু ? বিবেকের কাঁটার খোঁচা থেকে বাঁচতে রেহনুমা তাই টিউশনি খুঁজতে নেমেছে।হঠাৎ গেটের এককোণে একটা পোস্টার চোখে পড়ল-‘ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রীর জন্য শিক্ষিকা আবশ্যক।যোগাযোগ করুন-০১৭…’ কতক্ষণ আগে পোস্টার টানানো হয়েছে কে জানে!দেরি করলে যদি অন্য কেউ টিউশনিটা বাগিয়ে নেয় ! রেহনুমা তাই তৎক্ষ্ণণাৎ ওই নম্বরে কল দেয়।কিন্তু কেউ কল ধরেনা।একেরপর এক ওয়েলকাম টিউন বেজেই চলে।এক ঘন্টা পর আবার কল দেয় সে।এক মহিলা ধরেন।
‘হ্যালো,আমি রেহনুমা বলছি।টিউশনির ব্যাপারে…’
‘আপনার কোয়ালিফিকেশন?’
‘ঢাবিতে ম্যাথমেটিক্সে পড়ছি,সেকেন্ড ইয়ার।’
‘ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চা পড়াতে পারবেন তো?’
‘জী পারব।’
‘আগে কখনো টিউশনি করেছেন?’
‘হুম।’
‘সপ্তাহে ছয়দিন পড়াতে হবে কিন্তু!’
‘অ্যাঁ!ছয়দিন!’আঁতকে ওঠে রেহনুমা।
‘হ্যাঁ,ছয়দিনই।এর কম চলবেনা!কেজি টুয়ের বাচ্চা।আর সাড়ে তিন হাজারের বেশি দিতে পারবনা ।চলবে?’
‘হ্যাঁ,চলবে।আমি কবে দেখা করব ?’
‘আজই বিকাল ৫টায় চলে আসুন।পরীবাগ,ওরিয়েন্টাল অ্যাপার্টমেন্ট।ফ্ল্যাট…’
মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করতে থাকে রেহনুমা।যাক! একটা টিউশনি তো জুটল!যদিও সপ্তাহে ৬দিন খুব বেশি হয়ে যায়! কিন্তু কী আর করা!একেবারে অভুক্ত থাকার চেয়ে নুন-ভাত তো ভাল।অন্তত দু’টো মাস পড়ালেও তো কিছু টাকা জমে যাবে।রেহনুমা মনে মনে বাজেট করে।টিউশনির টাকা থেকে সব্বার প্রথমে ও মায়ের জন্য দেড় হাজার টাকায় একটা শাড়ি কিনবে।ভাইয়ের জন্য ফতুয়া কিনবে পাঁচশ টাকায়।রিকশা ভাড়ার জন্য বরাদ্দ পাঁচশ টাকা।মাঝে মাঝে পায়ে হেঁটে যেতে হবে।নইলে এ পাঁচশ টাকায় চলবেনা।তাহলে হাতে থাকবে একহাজার টাকা।এভাবে দু’মাস পড়ালে অনায়াসে ট্যুরের টাকা যোগাড় হয়ে যাবে।রেহনুমার মনের ভেতর পুলক খেলে যায়।এই প্রথম বারের মত নিজেকে আত্মনির্ভরশীল মনে হয়।
একা একা যেতে মন চায়না তাই পাশের রুমের পর্ণাকে ডেকে নেয় ও।রিকশায় যেতে যেতে পর্ণা জিজ্ঞেস করে, ‘কত দেবে রে?’
‘সাড়ে তিন।’
‘ভালই তো!কি করবি টাকা দিয়ে?’
‘মার জন্য শাড়ি,ভাইয়ের জন্য ফতুয়া ।’
‘ওরেব্বাস!বেতন পেয়ে আমাকে নীলক্ষেতের তেহারী খাওয়াবি কিন্তু!’
‘আচ্ছা!’ হেসে ওঠে রেহনুমা।তৃপ্তির ছটায় ওর হাসি মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
পরীবাগে পৌঁছে দেখে সেখানে ওরিয়েন্টাল অ্যাপার্টমেন্ট দু’টো।কোনটায় যাবে বুঝে পায় না।সেই মহিলাকে কল দেয়।টানা পাঁচবার পাঁচটি নতুন ওয়েলকাম টিউন বেজে চলে।কিন্তু কেউ ফোন ধরেনা।ওরা লক্ষ্য করে একটা অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ান গলা বাড়িয়ে ওদের দেখছে।পর্ণা বলে, ‘চল,দারোয়ানটাকে জিজ্ঞেস করি।’ রেহনুমা ইতস্তত করে।শেষতক জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই,এই বাড়িতে ইংলিশ মিডিয়াম…’
‘অ!টিউশনি?’
‘জী।’
‘আমারে আগে কইবেননা?আমিতো দূর থাইকা দেইখাই বুঝছি!আমি নিজেই পোস্টারগুলা লাগাইছিলাম।’
কলবেল বাজাতেই গৃহপরিচারিকা দরজা খোলে।অভিজাত ড্রয়িংরুমের সোফায় আধশোয়া হয়ে টিভি দেখছেন এক মহিলা।ওদের উপস্থিতিকে খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না।
‘টিউশনি?’
‘জী।’
‘৬দিনই কিন্তু পড়াতে হবে।’
‘একটু কনসিডার করলে হয়না? সপ্তাহে দু’দিন আমার বিকালে ক্লাস থাকে।’
‘নো কনসিডারেশন। দু’-আড়াই ঘণ্টা পড়াতে হবে।’
‘এতক্ষণ!’
‘অবশ্যই!আপনার দেখি কোন আইডিয়াই নেই!সেজন্যই তো এতটাকা দিচ্ছি।নইলে আড়াইয়ের বেশি দিতাম না।আর ইংলিশ মিডিয়ামের বাচ্চা পড়াতে পারবেন তো?’
‘হ্যাঁ,হ্যাঁ!কেজি টু’র ইংলিশ আর এমন কী!’
‘এইতো ভুল করলেন।আপনিতো বাংলা মিডিয়ামে পড়েছেন।ইংলিশ মিডিয়ামের ইংলিশের সাথে বাংলা মিডিয়ামের ইংলিশকে মেলানো যাবেনা!’
আহত হয় রেহনুমা।ও বরাবরই ইংলিশে খুব ভাল।শিক্ষকরা ওর খুব প্রশংসা করতেন।
‘টিউশনি আগে ক’মাস করেছেন?’
‘তিন মাস।’
‘না,না,তাহলে তো চলবেনা!তিন মাস মাত্র পড়িয়েছেন।পড়ানোর আর কতটুকুই জানেন!’ মহিলা এবার হাসিমুখে বললেন, ‘কষ্ট করে এসেছেন,ধন্যবাদ।দুপুরে আরো দু’টো মেয়ে এসেছিল।একজনকে আমার পছন্দ হয়েছে।ওর দু’বছরের টিউশনির অভিজ্ঞতা।’
এবার তিনি গলা চড়িয়ে গৃহপরিচারিকাকে ডাকেন,‘সাবিনা,দরজা খোল,এনারা যাবেন।’
ভদ্র ভাষায় চলে যেতে বলছেন!
স্তব্ধ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে পর্ণা-রেহনুমা।পর্ণা মুখ খোলে , ‘মহিলার যিদি দুপুরে কাউকে পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তোকে শুধু শুধু ডাকল কেন !’
‘বড়লোকের বউয়ের খায়েশ!’
‘তুই কিছু বললিনা কেন?’
‘ বলার কোন ভাষা ছিল না রে!’
পরীবাগে যেতে-আসতে রিকশাভাড়া খরচ হয়ে যায় ৬০টাকা।রেহনুমার পুরো একদিনের খাবার খরচের চেয়েও বেশি।বাধ্য হয়ে ও পর্ণাকে বলে, ‘১০০ টাকা ধার দিতে পারবি?’
ওর এই হাত পাতা যেন কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নগুলোকে ব্যাঙ্গ করে।
সপ্তাহে ছয় দিনের পরিবর্তে মাসে ছয় দিন হয়ে গেছে মনে হয়... 🙂
এরকম করে নাকি? রেহনুমা কে দিয়ে মহিলাটাকে একটা চড় নিদেনপক্ষে একটা ঝাড়ি দেয়াতে পারতে...পাঠকের স্যাটিসফেকশনের কথা চিন্তা করলে না... 😛
ভাল লিখেছ... :clap:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আমার তো মাসে ছয়দিনও যাওয়া হয় না 😛 😛 😛
টিউশ্যন এর দুইটা ধরন। একটা হল তুমি বাবা একদিন এসে দেখায় দিলেই চলবে। সাধারণত বুয়েটের পোলাপান এই ডায়লগ শুনে। এদের ছাত্র ছাত্রী সাধারণত ইন্টার পরীক্ষার্থী অথবা ভর্তি পরীক্ষার্থী। আরেকটা হল এই গল্পের মত। ছাত্র/ছাত্রী ছোট ক্লাস এ পড়ে হয়ত স্বরে অ স্বরে আ শিখাতে হবে অথবা ইংরেজী মাধ্যমের।
কলেজ থেকে বের হয়ে প্রথম এক বছরের টিউশ্যন কাহিনী নিয়ে একটা সিরিজ লেখা যাবে। কিন্তু লেখাই হয় না।
ভাল হয়েছে... কয়েকদিন বিনা বেতনে টিউশনি করেছিলাম মনে হয়...
একবার মনে আছে,এক টিউশনি তে আমাকে পিরিচে আলু ভাজি আর
বিস্কুট খাইতে দিসিল 😕 ...ফ্রেঞ্চ ফ্রাই না কিন্তু,রুটির সাথে যে আলুভাজি খায়,ওই আলুভাজি 😛
পিয়া,সুন্দর হইসে লেখা টা 😀
সুষমা
আলু ভাজি আমার খুব প্রিয়। কাল সকালেই করতে হবে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
যাইতে তো বলতেই পারে। দুপুরের জঙ্কে পছন্দ হইলেও সন্ধ্যার জঙ্কে ও আরো ভালো লাগতেও পারতো। সবাই তার সন্তানের জন্য ভালোটাই তো চাবে!
তবে লেখা ভালো হইছে।
আমারো অভিজ্ঞতা আছে টিউশনী নিয়া।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
রেহনুমার জন্য মন খারাপ হয়ে গেল।
স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট অনেক।
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
:clap:
৭ দিন পড়াইছিলাম। কয়েকদিন ওদের বইও সংগে করে নিয়ে আসতেও হইতো প্রিপারেশন নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাচ্চাগুলারে পিটানোর জন্য বেতও দিসিল। এইরকম মাসুম বাচ্চাগুলারে পিটানো যায়? অভিভাবকদের মনঃপুত হয় নাই। তাই খতম। কিন্তু একটা টাকাও ছাড়ি নাই। ফাইজলামী পাইছো? এইরকম কিছু নিচু মানসিকতার অভিভাবক আছে। অত্যন্ত নিচু।
এর পর আরো কয়েকটা করছি। কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার সময় তাদের কত আফসোস আর অনুনয়? এমন অভিভাবকও আছেন।
:clap:
বাহ, বেশ ঝরঝরে লেখা
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ভাল লেগেছে। গল্পটা পাঠক হিসেবে আমাকে গল্পের আবহে সহজে নিয়ে যেতে পেরেছে। হয়তো গল্পের স্থান, চরিত্র এবং উপাদানগুলো একসময় চোখে দেখেছি সেকারণেও হতে পারে।
গল্প লেখা চলুক। আরো ভাল গল্প চাই।
আমার বন্ধুয়া বিহনে
:clap: :clap: :clap: :clap:
::salute::