সূর্য এখনটা যেমন ওঠে, তখনও উঠতো। আকাশও বোধ করি নীলই ছিল। কিন্তু মনে পড়ে সূর্যের আলোটার চেয়ে তার তীক্ষ্ণ ছটা আর অসহ্য তাপটা বেশিই লাগতো। আর আকাশ ছিল ধূসর আমাদের চোখে। হ্যা, তখন আমরা ক্লাস সেভেনে।
তো সারাদিনের অর্থহীন নাটকের মাঝে একটা সময় আমার খুব প্রিয় ছিল। গেমস টাইম। তখন পেছনে ক্লাস এইটের চোখ রাঙানি ছিল না, নাইনের পার্ট ছিল না, টেন এর ভাবলেশহীন ধমক ছিল না, ইলেভেন টুএলভের ভয় ছিল না…. একান্ত নিজেদের সময়। ৪৮ জন ছেলে। একটা ফুটবল। গোল পোস্ট গাছ অথবা শূন্যে ভেবে নেয়া কোন স্থান। কেউ কেউ তো আবার বল ছাড়াই খেলতো। আর সন্ধ্যায় অনিবার্য সিক রিপোর্ট।
জায়গাটা ছিল মূলত এথলেটিক্স গ্রাউন্ড। আর তার সাথে লাগানো ছিল কলেজের বাউন্ডারি। তো আমি দলছুট ছিলাম কিছুটা। ফুটবল খেলতে পারতাম না। ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াতাম। আকাশ পাতাল ভাবতাম। সবচেয়ে বেশি ভাবতাম বাইরের কথা। দেয়ালের ওপাশের বাতাসটা কত মধুর ভাবতাম। আর ও বাতাসে চাপলে কি চলে যেতে পারবো ঢাকা? মাঝে মাঝে দুই হাত শোয়েব আক্তারের মত ছড়িয়ে দিয়ে দৌড়ে বেড়াতাম। কি ভেবে কে জানে….
একদিন এক কলিজার বন্ধু বললো “চল তোরে একটা জিনিশ দেখাই” তার পেছনে পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে পৌছে গেলাম মাঠের মাঝামাঝি একদম শেষ কিনারায়। জায়গাটা একটু নির্জন। ঝোপঝাড় পেরিয়ে। ওর হাতের ইশারায় দেখলাম দেয়ালের নিচে একটা ছোটখাটো গর্ত। বাইরে আখের গাছগুলো কি এক অজানা সুরে নাচানাচি করছে। মুক্তির গানে নাচে নাকি ওরা, মুক্তির সুর? হাটুর উপর বসে মাথা নিচু করে অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম। একটা পাখিও উড়ে গেল। আমি হাটুর উপর বসেই থাকলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে তাকিয়ে স্বাধীনতা দেখতে থাকলাম। মনে আছে অমন শান্তি বুকে পাইনি অনেকদিন। এরপর বন্ধু সেই ফাকা গলে বাইরে বেড়িয়ে গেল। হাতছানি দিয়ে ডাকলো আমাকে। “আয় ব্যাটা” ওর গর্জনে সম্বিত ফেরে আমার। বুক ধকধক করে অজানা শংকায়। আমার পা মনে হয় কেউ মাটিতে আটকে রেখেছে। একদম আস্টেপৃস্টে। আমি নড়তে পারি নাই। দূর্বল কন্ঠে বলেছিলাম “দোস্ত চলে আয়” তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে ও হারিয়ে গেল দেয়ালের ওপাশে। আমার স্বাধীনতার চিন্তায় তখন বাধ সেধেছে ভয়। আমার শরীর কাঁপতে থাকে। এক পর্যায়ে বন্ধু ফিরে আসে। তার সারা মুখ চকচক করে আনন্দে। আর আমার মনে ভয় পেরিয়ে নেমে আসে বিষাদ। চুপচাপ মাঠে ফিরে যাই দুজন। বিড়বিড় করে বন্ধু বলছিল “ছাগল”।
এরপর বহু রাতে আমি ওই গর্তটা স্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্ন বলা উচিত। দেখতাম ঐ গর্তের পাশে আমি দাড়িয়ে আছি আমাকে ঘিরে প্রিন্সিপাল, এডজুটেন্ট সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আর নুরুল স্টাফজি একটা প্রকান্ড বাঘের থাবা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি চিৎকার করে উঠছি “আমি বাইরে যাব। আমি বাইরে যাব…. ”
ঘটনার কিছুদিন পরেই একজন ক্লাস সেভেন কলেজ পালানোয় সেই গর্তটা বন্ধ করে দেয়া হয়। ঝোপঝাড় ও কেটে সোজা করা হয়।
কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই গর্ত আমার জীবনে অনেক বড় মানে বহন করে। আমি বুঝি আমি কতটা ভীতু। বুঝি মুক্তির জন্য মানুষ কতটা ব্যাকুল একই সাথে কতটা অসহায়। বুঝি স্বাধীনতা কতটা সহজ এবং একই সাথে কতটা কঠিনলব্ধ। বুঝি আমার মত পরাধীন মানুষরা কিভাবে সারাজীবন মুক্তির স্বপ্ন দেখতে থাকবে আর পরাধীনতায় মুখ লুকিয়ে কাঁদবে। জীবন আমাকে সেদিন দেখিয়ে দিয়েছিল, মানুষের অপারগতা তার ধারণার চেয়ে বৃহত্তর।
আমি কখনও কলেজ পালাইনি। আর কলেজ পালানো সেই বন্ধুটাকে আজীবন জেনে এসেছি পরিবর্তনের মূহ্যমান তারকা হিসেবে। এমন তারকা কলেজগুলোতে কম ছিল না আমি জানি। এ ও জানি এরাই পরিবর্তন করবে এই দেশ।
:thumbup:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
খাঁচার পাখি সর্বদা বাইরে যাওয়ার জন্য আকুল। কী অবাধ স্বাধীনতা মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানোর। মনে মনে ভাবে কেউ যদি একবারের জন্য দরজাটা খুলে দিত। তারপর একদিন কেউ একজন দরজা খুলে দেয়। কিন্তু ঝড় ঝাঁপটার আশঙ্কায় পাখির বুক কেপে উঠে। তার আর বাইরে যাওয়া হয় না। খাঁচার কোনেই পড়ে থাকে আজীবন।
আমরা বোধ হয় সবাই খাঁচার পাখি। খাঁচা সোনায় মোড়ানো। কিন্তু তবুও .... তা তো খাঁচাই (সম্পাদিত)
দারুন লিখেছো জিয়া।
আমরা বেশিরভাগ সময় বুঝেই উঠতে পারি না কোনটা আমাদের খাঁচা আর কোনটা আমাদের মুক্ত আকাশ
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ধন্যবাদ ভাই। 🙂
চমৎকার লেখা! স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মাঝে ব্যবধান শুধু ঐ গর্তটার এফোঁড় আর ওফোঁড়। দেয়ালটা তার প্রতিকী পাহাড়াদার।
"বুঝি আমার মত পরাধীন মানুষরা কিভাবে সারাজীবন মুক্তির স্বপ্ন দেখতে থাকবে আর পরাধীনতায় মুখ লুকিয়ে কাঁদবে" - চমৎকার উপলব্ধি।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে আপনি আমার লেখা পড়ে পছন্দ করেছেন ভাইয়া (সম্পাদিত)
দেখতাম ঐ গর্তের পাশে আমি দাড়িয়ে আছি আমাকে ঘিরে প্রিন্সিপাল, এডজুটেন্ট সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আর নুরুল স্টাফজি একটা প্রকান্ড বাঘের থাবা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি চিৎকার করে উঠছি “আমি বাইরে যাব। আমি বাইরে যাব…. ”
রূপকে ও দৃশ্যকল্পে যথার্থ ।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂