‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ২

‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ২

ড. রমিত আজাদ

 

“বাঙালি অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর, জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালি দীপংকর।” (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

 

হ্যাঁ, কোন কিছুই দমাতে পারেনি ৬২ বছর বয়স্ক শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর-কে, দুর্গম গিরিপথ, তুষারাচ্ছন্ন অয়ন, প্রতিকুল আবহাওয়া, সব বাধা অতিক্রম করে তিনি পৌছেছিলেন হিমালয় রাজ্য তিব্বতে কেবল জ্ঞানের আলো ছড়াতে।

 

শ্রীজ্ঞান দিপংকর তখন বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য্য ছিলেন। সেখানে তখন অধ্যয়ন করছিলো প্রায় ৮০০০ ছাত্র। তাদের শিক্ষাদানে নিরত ছিলেন ১০৮ জন অধ্যাপক। বিশিষ্ট এই সকল পন্ডিতদের গুরু ছিলেন মহাজ্ঞানী দিপংকর। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেয়া হতো থেরাভেদ, মহাযান বৌদ্ধ দর্শন, বজ্রযান বৌদ্ধ দর্শন, সমাজবিদ্যা, বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ইত্যাদি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান তো বটেই, এমনকি সুদূর চীন, তিব্বত, তুর্কিস্তান থেকেও ছাত্ররা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো। এদিকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান চর্চায় তখন ভাটা চলছিলো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভুত মহাযান ও তান্ত্রিক শিক্ষা পরবর্তিতে বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকশিত হয় এবং বাঙালী পন্ডিতদের মিশনারী কার্যক্রমে তা এশিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

 

বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য্যের গুরু দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তিব্বত রাজার আমন্ত্রণ শ্রীজ্ঞানকে একরকম সংকটেই ফেলে। কেননা, কেবল বিক্রমশীলাই নয় এই ভুখন্ডের একটি বিশাল সংখ্যক বিহার মূলতঃ উনার অভিভাবকত্বেই চলছিলো। তারপরেও ধম্মের খাতিরে বৃহত্তর উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ বয়স, পথকষ্ট ইত্যাদি উপেক্ষা করেও তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহন করলেন। তবে শর্ত আরোপ করলেন যে, তিব্বতে তিনি কেবল তিন বছর কাটাবেন। তিন বছর তিব্বতীদের সাহায্য করে তিনি আবার ফিরে এসে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহন করবেন।

 

শ্রীজ্ঞান দিপংকরের এই সিদ্ধান্ত শুনে আচার্য্য রত্নাকর শান্তি বলেছিলেন, “দিপংকরের অভাবে ভারতবর্ষ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। বহু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের চাবি উনার হাতেই আছে। উনার অনুপস্থিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শূণ্য হয়ে যাবে। …………… যদিও আমি চিন্তিত তারপরেও আমি আশীর্বাদ করি দিপংকরের তিব্বত সফর আনন্দময় হবে।”

 

তিনি বারো জন সহযাত্রী নিয়ে তিব্বত যাত্রা শুরু করেন। তবে নিজভূমি ছাড়বার পূর্বে গৌতম বুদ্ধের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমেই বুদ্ধগয়া গমন করেন ও আরও কিছু তীর্থস্থান দর্শন করেন। তারপর সেখান থেকে নেপালের রাজধানীতে উপস্থিত হন এবং নেপালরাজের আগ্রহে এক বছর সেখানে কাটান। এখান থেকেই তিনি মগধের গৌরবময় পাল রাজবংশের রাজা ন্যায়পাল-কে এক ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন, যার নাম ‘বিমল রত্ন লেখানামা’ (‘Vimala Ratna Lekhanama’)। এই অতুলনীয় ধ্রুপদী চিঠিতে তিনি রাজাকে কিছু বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন যে, রাজাকে সকল অস্তিত্বের প্রতি দয়াশীল হতে হয়, চিন্তা ও কাজে মন্দকে পরিত্যাগ করতে হয়, রাজাকে কার্যে হতে হয় নম্র, বিনয়ী ও প্রেমময়; বোধিচিত্ত (Budhicitta: mind of enlightenment)-এর সাধনা করা এবং ঔদ্ধত ও অহংকার পরিত্যাগ রাজার কর্তব্য। এটিই ছিলো একটি ব্যক্তির অন্তরে ও বাহিরে শান্তি ও সৌম্যের বৌদ্ধ বার্তার সারাংশ। নেপালে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি ‘চর্যা সংগ্রহ প্রদীপ,’ (Carya Samgra Pradipa) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নেপালরাজ শ্রীজ্ঞান দিপংকরকে জাঁকাল অভ্যার্থনা জানিয়েছিলেন।

 

পদব্রজে শ্রীজ্ঞান দিপংকরের তিব্বত যাত্রা ছিলো খুব কঠিন। দুর্গম হিমালয়ের তুষারাচ্ছন্ন পর্বতমালা পার হতে গিয়ে তাঁরা ডাকাতের আক্রমণের মুখেও পড়েছিলেন। র‍্যুটটি ছিলো নেপালের পালপা থেকে মানস সরোবর পর্যন্ত। নেপাল অতিক্রম করে থুঙ বিহারে এলে তাঁর সঙ্গী র্গ্যা-লো-ত্সা-বা-ব্র্ত্সোন-‘গ্রুস-সেং-গে (ওয়াইলি: rgya lo tsA ba brtson ‘grus seng ge) অসুস্থ হয়ে মারা যান। ১০৪২ খৃস্টাব্দে তিব্বতের পশ্চিম প্রান্তের ডংরী প্রদেশে পৌছন। সেখানে পৌছলে ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে তাঁকে থোলিং বিহারে নিয়ে যান। এখানে দীপঙ্কর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বোধিপথপ্রদীপ’ রচনা করেন। ১০৪৪ খৃস্টাব্দে তিনি পুরঙে, ১০৪৭ খৃস্টাব্দে সম-য়ে বৌদ্ধ বিহার ও ১০৫০ খৃস্টাব্দে বে-এ-বাতে উপস্থিত হন।

 

তিব্বতের প্রধান মন্ত্রী দেশের প্রবেশপথে বিপুল সংখ্যক অনুসারীসহ শ্রীজ্ঞানকে জমকাঁলো অভ্যার্থনা জানান। স্বাগত বক্তব্যে প্রধান মন্ত্রী বলেন, “আপনি সর্বাধিক জ্ঞানী ও সর্বাধিক মেধাবী মহাপন্ডিত। তিব্বতের জনগণের সনির্বন্ধ অনুরোধে আপনি দেবত্ব অবতারে আচার্য্যদের ভূমি থেকে এখানে এসেছেন। এই যুগে আপনিই অবতার বুদ্ধের প্রতিনিধি এবং বৌদ্ধ দর্শনের পরমোৎকর্ষের আদর্শ। আপনার বিশুদ্ধতার গুনে জগতের সকল জীব ও দেবতারা আপনাকে পূজা করে।”

উপস্থিত জনতার মুখে তখন উচ্চারিত হচ্ছিলো মহামন্ত্র, “ওম মনিপদ্মে হুম”!

 

(উল্লেখ্য যে তিব্বতীরাই শ্রীজ্ঞান দিপংকরকে অতীশ উপাধী দেয় যার অর্থ মহাপন্ডিত (great scholar))।

 

(চলবে)

১,০১১ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “‘ওম মনিপদ্মে হুম’ – পর্ব ২”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "রাজাকে সকল অস্তিত্বের প্রতি দয়াশীল হতে হয়, চিন্তা ও কাজে মন্দকে পরিত্যাগ করতে হয়, রাজাকে কার্যে হতে হয় নম্র, বিনয়ী ও প্রেমময়; বোধিচিত্ত (Budhicitta: mind of enlightenment)-এর সাধনা করা এবং ঔদ্ধত ও অহংকার পরিত্যাগ রাজার কর্তব্য।" - আহা! আজকের দিনের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর রাজতন্ত্রে অধিষ্ঠিত রাজা রাণীগণ যদি এই উপদেশগুলো মেনে চলতেন!
    আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। অপেক্ষায় রইলাম।

    জবাব দিন
    • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

      আমিও বিষয়টি নিয়ে ভাবি খায়রুল ভাই।
      তবে মাঝে মাঝে যে কোন কোন দেশে সুশাসক চলে আসেনা তা নয়। কিন্তু তাদের খুব বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে দেয়া হয় না। এক্ষেত্রে সক্রেটিস-এর সেই বাণীটি মনে পড়ে, 'রাজনীতিতে সৎ লোক বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনা।'
      বিশ্বব্যপী এখন এক ধরনের গেম চলছে, বিষয়টা নিয়ে কিছু আলোচনা আমার ধারাবাহিক উপন্যাস 'লিস্টনিং টু দ্যা উইন্ড অব চেইঞ্জ'-এ করার চেষ্টা করছি।
      মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ খায়রুল ভাই।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।