অনিয়মের ভালো লাগা (গল্প) – পর্ব ১

অনিয়মের ভালো লাগা (গল্প) – পর্ব ১
————– ডঃ রমিত আজাদ

মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেলো। ঘন কালো চুল, ডাগর কালো আঁখি, বাদামী গাত্রবর্ণ (আমাদের দেশের হিসাবে হবে ফর্সা, কিন্ত এই দেশে ঐ রঙটিকে চকোলেট কালার বলা হয়, যেহেতু রুশরা ভীষন সাদা রঙের হয়)। এই ধরনের মেয়েদের হয় ব্রুনেট অথবা ব্রাউন গার্ল বলা হয়। হঠাৎ মনে পড়লো স্কুল জীবনের একটা গানের কলি। আমাদের ক্লাসের রাসেল নেচে নেচে খুব সুন্দর গাইতো, “ব্রাউন গার্ল ইন দ্যা রেইন, শা লা লা লা লা। দেয়ার ইজ এ গার্ল ইন দ্যা রেইন শা আ আ লা লা লা লা লা।” এবার মনে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগলো, মেয়েটি কি আমার বাংলাদেশের? আবার ভাবলাম নাও হতে পারে, ইন্ডিয়ানও হতে পারে, পাকিস্তানের সিন্ধীরাও দেখতে অনেকটা আমাদের মতোই। অনেক কিছুই হতে পারে, আপাতত ওকে প্রশ্ন না করে ওর দেশ পরিচয় জানা সম্ভব নয়। তবে এই মুহুর্তে সেই প্রশ্ন করার পরিস্থিতি নেই। এটা ক্লাসরূম, আর আপাততঃ আমি ওর টীচার। যদিও এটা স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম নয়।

আমি অনেকগুলো বছর মস্কোতে থাকি। এখানেই পড়ালেখা শেষ করে একটি বড় কোম্পানীর পদস্থ কর্মকর্তা। কোম্পানীটির নাম ‘চেরিশ্নী সাদ’ মানে চেরিফুলের বাগান। বেশ কাব্যিক নাম। একসময় আমার ধারণা ছিল যে, শুধু জাপানেই চেরি ফুল ফোটে। এর সাথে সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত শব্দ ‘সাকুরা’। আরও রয়েছে উৎসব ‘হানামি’। জাপানে অধ্যয়ন করেছে এরকম একজন বাংলাদেশীকে একবার ‘সাকুরা’ ও ‘হানামি’ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি ভালো উত্তর দিতে পারলেন না। পরে বললেন যে, তিনি জাপানী ভাষা ভালো জানেন না, পি,এইচ,ডি, করেছেন ইংরেজীতে, তাই জাপানের কালচার সম্পর্কে ভালো আইডিয়া নেই। এই একটা সমস্যা আমি লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশীরা অনেক দেশেই যায় কিন্তু সেখানকার ভাষা শিক্ষায় আগ্রহ দেখায় না। ফলে ঐ দেশটাকে তারা ভালোভাবে বুঝতে পারে না। কোন একটি দেশের ভাষা জানা না থাকলে ঐ দেশ বা সমাজকে পেনিট্রেট করা যায়না। এদিক থেকে রাশিয়ায় ভালো, সব বিদেশী ছাত্রকেই বাধ্যতামূলক রুশ ভাষা শেখানো হয়। ফলে তারা রাশিয়াকে ভালো বুঝতে পারে। চেরি ফুলের যে কথা বলছিলাম, রাশিয়া এসে দেখলাম, এখানেও অজস্র চেরি গাছ রয়েছে।

এখন আমি এসেছি ‘আভানগার্দ’ নামে একটি কোম্পানীতে ক্লাস নিতে। আই.টি. ও অফিস ম্যানেজমেন্টের উপর মূলতঃ ক্লাসটি। ‘আভানগার্দ’ কোম্পানীর মালিক আবার আমাদের কোম্পানীর মালিকের বন্ধু। আমাদের মালিকই আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, “তুমি তো আই.টি. ও অফিস ম্যানেজমেন্টের উপর ভালো জ্ঞান রাখো, আমার বন্ধুর একটু উপকার করে দাওনা। ওর কোম্পানীটা নতুন, ওর স্টাফদের একটু প্রশিক্ষণ দিয়ে আসো। ওরা পেমেন্টও ভালো করবে।”

পেমেন্টটা নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত ছিলাম না। আমি বর্তমানে যেই কোম্পানীতে চাকরী করছি সেটি মস্কোর বড় ডিলার কোম্পানীগুলোর একটি। এখানকার ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের চীফ হিসাবে আমি যা পাই এটা যথেষ্ট। আমার অন্য একটা বিষয় ভালো লেগেছিলো যে, আমার বস্ আমাকে মূল্যায়ণ করছেন। উনি নিজে ইন্টারভিউ নিয়ে আমাকে কোম্পানীতে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আমার বন্ধু-বান্ধব তখন বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলো যে, এতো বড় একটা কোম্পানীতে এতো সহজে চাকরী হয়ে গেলো! আমি নিজেও বেশ খুশী হয়ে গিয়েছিলাম। আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গিয়েছিলো ভীষণ। কিন্তু জয়েনিং-এর প্রথম দিনেই বস্ আমার আত্মবিশ্বাস ও কিছুটা অহংবোধ এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়েছিলেন।

যেদিন জয়েন করেছিলাম, সেই প্রথম দিনেই লাঞ্চের পর আমার টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনটি বেজে উঠলো। প্রথম দিন তাই বাইরে থেকে কোন কল পাওয়ার কথা না। তাছাড়া আমি নিজেও এখনো আমার এক্সটেনশন নাম্বারটা জানিনা। তাহলে অফিসের ভিতর থেকেই কেউ কল করেছে। টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ রিনরিনে গলায় বললো,
“শরীফ বলছেন?” আমি উত্তর দিলাম, “জ্বী, বলছি।” আমি কোম্পানী প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারী নাতাশা বলছি। গসপাদিন (মানে জনাব বা মিস্টার) কোম্পানী প্রেসিডেন্ট আপনাকে তার রূমে ডাকছেন।” আমি ঝটপট উঠে গেলাম।

কোম্পানী প্রেসিডেন্টের রূমের সামনের স্পেসটি বেশ বড় সেখানে তিনজন সেক্রেটারী বসে আছে। রুশ মেয়েরা চোখ ঝলসানো সুন্দরী হয়। এই তিনটি মেয়েও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এদের মধ্যে কোনজন নাতাশা তা বোঝার উপায় নেই। আমি তাদেরকে প্রশ্ন করলাম, “নাতাশা কে”? সাথে সাথে দুজন একসাথে বলে উঠলো “আমি”। এই একটা সমস্যা রাশিয়ায়। নামের পরিমান খুবই কম, নাতাশা, তানিয়া, ইরা, স্ভেতা, মাশা, ইউলিয়া, ভিকা, ওলগা এই জাতীয় বিশ-পচিশটা মাত্র নাম। তার মধ্যে নাতাশা নামটা আবার বেশী কমোন। আমার মনে পড়ে ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় আমাদের বিশ জনের গ্রুপে চারজন নাতাশা ছিলো। কোনজন কোন নাতাশা এটা বুঝতে হলে আবার ফ্যামিলি নেইম-টা বলতে হতো। আমি সেক্রেটারী দুজনের দিকে তাকিয়েই বললাম, “আমি শরীফ আহমেদ” আমার মনোভাব বুঝতে পেরে ওদের মধ্যে থেকে একজন বললো, “আমি নাতাশা ইউজোফোভিচ। আমিই আপনাকে কল করেছিলাম। গস্পাদিন প্রেসিডেন্ট রূমের ভিতরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।” মেয়েটির ফ্যামিলি নেইম শুনে বুঝলাম ও ইহুদী। ওর দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম বহিরঙ্গে জাতীয়তার ছাপ রয়েছে। মেয়েটির গায়ের রঙ সাদা হলেও চুল কালো, চোখ কালো।

কোম্পানী প্রেসিডেন্টের রূমে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। বিশাল জমকালো রূমের একপাশে উনার টেবিল। তার উপরে কম্পিউটারের বিশাল মনিটর। এতো বড় মনিটর কম দেখা যায়। আবার উনার সামনে একটি দামী ল্যাপটপও দেখতে পেলাম। রূমের যেপাশে উনার টেবিল তার উল্টো পাশে একটি জাঁকালো কনফারেন্স টেবিল। এই দুয়ের মাঝখানে দামী সোফাসেট রাখা। রুশ ফার্নিচারগুলোও গর্জিয়াস হয় তবে ডিজাইনটা থাকে ক্লাসিকাল। উনার সোফাসেটের ডিজাইন আধুনিক। মনে হয় ইটালী বা বাইরের কোন দেশ থেকে আনিয়েছেন। এরকম একটা সেটের দাম ত্রিশ-চল্লিশ হাজার ডলার বা তার বেশীও হতে পারে। কোম্পানী প্রেসিডেন্ট আমাকে দেখে মুখভঙ্গীতে হালকা গাম্ভীর্য্য রেখে বললেন

কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ বসো (উনার সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে)
আমিঃ জ্বী ধন্যবাদ (চেয়ারে বসলাম)
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ আজ তোমার অফিসের প্রথম দিন। ওয়েল কাম টু বোনানজা ফ্যামিলি।
আমিঃ জ্বী, ধন্যবাদ।
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ কেমন লাগছে অফিসের পরিবেশ?
আমিঃ জ্বী, বেশ ভালো।
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ লাঞ্চ করেছ?
আমিঃ জ্বী, করেছি। খুব ভালো লাঞ্চের ব্যবস্থা। আপনার ক্যান্টিনটিও সুন্দর!
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ হ্যাঁ, চেষ্টা করি স্টাফদের ভালো সুযোগ-সুবিধা দিতে। (এর মধ্যে উনার সেক্রেটারী দ্বিতীয় নাতাশা মেয়েটি দুকাপ চা নিয়ে এলো। আমার সামনে একটি চায়ের কাপ ও উনার সামনে একটি চায়ের কাপ রাখলেন। সাথে কিছু কাজু বাদাম ও ড্রাই ফ্রুট দিলো) যাহোক তোমাকে যে জন্যে ডেকেছিলাম। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আর তাছাড়া তোমার পড়ালেখা ভালো ও অন্যান্য রেপুটেশনও আছে। তাই অনেকটা ইনফর্মাল ইন্টারভিউ করে আমি তোমাকে নিয়েছি। তবে শুরুতেই আমি কিছু কথা বলবো মনযোগ দিয়ে শুনবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আর কমার্শিয়াল অরগানাইজেশনের পরিবেশ এক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন নামী-দামী প্রফেসররা। হাইলি কোয়ালিফাইড, হাইলি কালচার্ড মানুষ তারা। তাদের সাথে অন্যদের তুলনা হয়না। কমার্শিয়াল অরগানাইজেশনে সেরকম পাবেনা। যাহোক, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা। তুমি এখানে একজন বিদেশী। তোমাকে এখানে চাকরী দেয়া মানে, আমি মাথায় বাড়তি কিছু ঝামেলা নিয়েছি। তোমার জায়গায় একজন রুশকে নিলে আমার সেই ঝামেলাগুলো থাকতো না।
আমিঃ জ্বী, কিসের ঝামেলা? (আমি হঠাৎ বলে বসলাম)
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ আনেকগুলিই। যেমন তোমার ভিসা ও রেজিস্ট্রেশনের পুরো দায়িত্ব আমার। তোমার বাসস্থানের দায়িত্ব আমার। আবার তোমার চিকিৎসার দায়িত্বও আমার। তারপর খোদা না করুক তোমার যদি নিরাপত্তা জনিত কোন সমস্যা হয় সেই দায়িত্বও আমাকেই নিতে হবে। আমি কেন তোমাকে কথাগুলো বলছি? কারণ এখানে টিকে থাকতে চাইলে তোমাকে কাজের গুনে নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিতে হবে। তুমি যদি একজন রাশানের চাইতে খারাপ কাজ করো, তাহলে তোমাকে এখানে রাখার প্রশ্নই ওঠেনা। আবার তুমি যদি একজন রাশানের সমান সমান কাজও করো তাহলেও হবেনা। যদি তুমি একজন রাশানের চাইতে ভালো কাজ করো কেবলমাত্র তখনই তোমাকে এই কোম্পানীতে ধরে রাখার একটা কারণ থাকবে। একমাত্র এভাবেই তুমি টিকে থাকতে পারবে। তোমাকে আমার ভালো লাগে, আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো, শুধু এটার উপরে ভর করে তোমাকে রাখার কিছু নেই। পুঁজিবাদের এই যুগে পুরো পৃথিবীটাই কম্পিটিশনের পৃথিবী। আশা করি আমার কথা তুমি বুঝতে পেরেছো।

উনার এই হালকা স্বরে বলা কড়া কথাগুলো অনেকগুলো সুঁইয়ের মতো আমার গায়ে বিধলো। কিন্তু উনি যে কতো গুরুত্বপূর্ণ কথা আমাকে বলেছেন। তা বুঝতে আমার আর বাকী রইলো না।
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ কিছু বলবে?
আমিঃ জ্বী না। আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি।

——————————*———-*————————-

আমার টেবিলে ফিরে এসে উনার কথাগুলো আবার ভাবলাম। দারুণ ব্যক্তিত্ব লোকটির। এর আগে যতবার উনার সাথে দেখা হয়েছে, আমার কাছে মনে হয়েছে খুব নরম-সরম, সহজ-সরল একজন মানুষ। আজ আর আমার সেরকম মনে হলো না। আজ একটি ভিন্ন রূপ নিয়ে আমার সাথে কথা বললেন। এতদিন আমি ছিলাম উনার অফিসের বাইরে। আজ আমি উনার অফিসের ভিতরে। হালকা একটি গাম্ভির্য্য নিয়ে কথা বলে তিনি যে আমার বস্ সেটা বুঝিয়ে দিলেন। দারুণ! উনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেলো। যতদূর জানি উনি একেবারেই জিরো থেকে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আজ তিনি মাল্টি মিলিয়নিয়ার। এম্নি এম্নি তো আর মাল্টি মিলিয়নিয়ার হন নি, ভিতরে মাল-মশল্লা আছে বলেই হয়েছেন। তিনি আমাকে আরো একটা জিনিস বুঝিয়ে দিলেন যেটা আমাকে আজই বোঝানোর প্রয়োজন ছিলো। পরে বোঝাতে গেলে দেরী হয়ে যেতো। সেটি হলো আমার অহংবোধ ভেঙে দেয়া। এই অহংকার একটা খুব খারাপ জিনিস। এটা মানুষকে অন্ধ করে ফেলে। কুরআন হাদীসের কথা যদি বলিই, তাহলে এই এক অহংকারের বিরুদ্ধে যত আয়াত ও হাদীস আছে, তা ব্যাখ্যা সহ লিখতে গেলে সারাদিন চলে যাবে। কথা হচ্ছে, এই অহংকার কীসের জন্য হতে পারে। প্রকাশ্য অহংকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সম্পদের অহংকার, জ্ঞান-বিদ্যার অহংকার, রূপের অহংকার ইত্যাদি। আর এক প্রকার অহংকার আছে, যা আপনি ধরতেও পারবেন না, কিন্তু সূক্ষভাবে তা আপনাকে গ্রাস করে ফেলবে এবং এক সময় তার খারাপ প্রভাব আপনার আচরণেও প্রকাশ পাবে, যার ভুক্তভোগী হবে আপনারই কাছের মানুষজন। আর এই অহংকার হচ্ছে ভালোত্বের অহংকার। মানুষের জীবন হলো একটি দীর্ঘ পথ চলা। দীর্ঘ পথ যেমন কোথাও মসৃণ কোথাও বন্ধুর। কোথাও কাঁচা কোথাও পাকা। জীবন পথও তেমনি। চাই বা না চাই যতদিন জীবন আছে ততদিন ঐ পথ চলতেই হবে। তাই পথ চলাটা মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য কত দ্রুত পথ চলতে পারছি এবং কতদূর যেতে পারলাম। অহংবোধ এই পথচলাকে শ্লথ করে দেয়। তাই আমার যিনি শুভাকাঙ্খী তার দায়িত্বই হলো আমার মধ্যে কোন অহংবোধ যদি ধরা পড়ে সেটা ভেঙে দেয়া। অথবা অহংবোধ জাগতে না দেয়া।

এরকম আর একটা অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিলো কয়েক বৎসর আগে। তখন আমি এম, এস, কমপ্লিট করে পি, এইচ, ডি,-তে স্কলারশীপ পেয়েছি। এম্নিতেই এম, এস,-এ ভালো ফলাফল থাকায় একটা অহংবোধ তৈরী হয়েছিলো। তার উপর পেলাম পি, এইচ, ডি,-তে স্কলারশীপ, অহংবোধ দ্বিগুন হয়ে গেলো। এম, এস, করেছিলাম অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পি, এইচ, ডি,-তে স্কলারশীপ পেলাম মস্কোর পিপলস্ ফ্রেন্ডশীপ ইউনিভার্সিটিতে। ওখানে যাওয়ার পর আমাকে বললেন যে, এ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! আমার অলরেডী স্কলারশীপ হয়ে গিয়েছে, এরপর আবার এ্যাডমিশন টেস্ট কি? ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারী আমাকে বললেন, “এখানে এটাই আমাদের ট্রেডিশন। রাশান, বিদেশী, এই ইউনিভার্সিটি বা বাইরের ইউনিভার্সিটি যেখানকার গ্র্যাজুয়েটই হোক না কেন, এ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে পাশ করতে হবে। না হলে আপনার স্কলারশীপ ক্যান্সেল হয়ে যাবে। এই নিন পরীক্ষার সিলেবাস।” যাহোক নির্ধারিত দিনে উপস্থিত হলাম। গিয়ে দেখি আমার মতো আরো দু’জন আছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সব প্রফেসররা। বোর্ড বসেছে, ওপেন ডিফেন্স হবে। প্রফেসরদের বোর্ডের সামনেই দেয়ালে টাঙানো বোর্ডে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রথমেই আমাকে ডাকা হলো। কিছুটা অহংবোধ (যেহেতু নিজেকে ভালো ছাত্র মনে করতাম) কিছুটা উদ্ধেগ নিয়ে বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে মনে ভাবছিলাম, কি আর, কিছু প্রশ্ন স্যাররা করবেন তার উত্তর দেয়া আরকি। স্যাররা প্রথমে মামুলি কিছু প্রশ্ন করলেন। ঝটপট ওগুলোর উত্তর দিলাম। তারপর শুরু হলো দাঁতভাঙা কিছু প্রশ্নের ঝড়। এমন এমন সব প্রশ্ন করেন যার উত্তর আমি কেন, আমার বাবারও জানা নেই। হতভম্ব হয়ে গেলাম। শেষে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী চেয়ারম্যান স্যার প্রফেসর রিবাকোভ আমাকে বললেন। “নাহ্, হচ্ছেনা। আপনার প্রিপারেশন ভালো নেই।” তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি করা যায় বলুন তো?” আমার বুক আশংকায় কেঁপে উঠলো, এই না আমার স্কলারশীপ ক্যান্সেল হয়ে যায়! চেয়ারম্যান স্যারের বয়সীই আরেকজন প্রফেসর (পরে জেনেছিলাম উনার নাম গুতসুনায়েভ, উনিও নামজাদা বিজ্ঞানী) বললেন, ” ওকে আরেকবার চান্স দেয়া যেতে পারে।” চেয়ারম্যন স্যার আমাকে বললেন, “আপনাকে আরেকবার পরীক্ষাটা দিতে হবে। ভালো করে প্রিপারেশন নেয়ার জন্য কত সময় প্রয়োজন আপনার?” আমি ভাঙা মন নিয়ে বললাম, “এক সপ্তাহ সময় কি দেবেন?” “ঠিক আছে এক সপ্তাহই সময় দেয়া হলো। প্রিপারেশন নিয়ে আসেন।” ভেঙে পড়া মানুষের মতো টেনেটুনে পরীক্ষার হলের বাইরে এলাম। আমার পর পরবর্তিজন ঢুকলো। এবার কৌতুহল হলো ওর ভাগ্যে কি হয় জানার। তাই ডিপার্টমেন্ট থেকে চলে না এসে, বাইরে অপেক্ষা করলাম। সেই ছেলেও দেখি ভার মুখ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। প্রশ্ন করলাম, “কি ভাই, কেমন হলো পরীক্ষা?” সে মন খারাপ করে বললো, “নারে ভাই কিছু হলোনা। আবার দিতে হবে পরীক্ষা। কি কি সব প্রশ্ন করে!” তৃতীয় জনেরও একই দশা হলো। মনটা একটু ভালো হলো যখন দেখলাম আমি একা নই, বাকীদেরও আমার মতোই অবস্থা।

যাহোক খুব খেটেখুটে প্রিপারেশন নিয়ে গেলাম এক সপ্তাহ পরে। এবার আর অহংবোধ নিয়ে নয়, একেবারে জবুথবু হয়ে দাঁড়ালাম। আগের বারের মতোই প্রশ্নবাণে জর্জরিতো করলেন প্রফেসররা। তবে এবার গতবারের চাইতে ভালো পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা শেষে প্রফেসররা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বললেন, “হ্যাঁ, কিছুটা ইমপ্রুভমেন্ট দেখা যাচ্ছে। ঠিক আছে, পাশ করিয়ে দিলাম। তবে খুব মনযোগ দিয়ে পড়ালেখা করতে হবে পি. এইচ. ডি. করা অত সহজ নয় কিন্তু!” আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এটা ট্রেডিশনাল একটা টেকনিক। শুরুতেই একজনার অহংবোধ ভাঙিয়ে দেয়া। যাতে সে বুঝতে পারে জ্ঞানের জগৎ বিশাল, সেই জগৎের সামান্যই সে জানে। তার শেখার আরো অনেক কিছুই বাকী আছে। তাকে আরো অনেক কিছুই জানতে হবে। এই অভিজ্ঞতাটি পুরো রিসার্চ লাইফে আমার ভীষণ কাজে লেগেছিলো।

——————————*———-*————————-

স্মৃতি রোমন্থন বাদ দিয়ে বর্তমানে ফিরে এলাম। আমার বর্তমান একটি ক্লাসরূম। একটি কোম্পানীর জনা দশেক সেখানে বসে আছেন। ছয়জন পুরুষ, চারজন নারী। এই একটা বিষয় এই দেশে, সব অফিসেই নারী-পুরুষ সমান সমান। কোথাও কোথাও আবার নারীই বেশী। এর মধ্যে পাঁচজন বয়সে আমার চাইতে বড় হবেন। সবাই ‘আভানগার্দ’ কোম্পানীর কর্মকর্তা। সবাই শেতাঙ্গ কেবল ঐ মেয়েটি ছাড়া।

ক্লাসরূমে আমার সাথে ঢুকেছেন ‘আভানগার্দ’ কোম্পানীর মালিক ইউরি গেরমানোভিচ ইরমোলায়েভ। উপস্থিত সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্বটি ছিলো এরকম। ইউরি গেরমানোভিচ সবার উদ্দশ্যে বললেন
“ইনি জনাব শরীফ আহমেদ। মস্কোর একটি বড় কোম্পানীতে চাকুরী করেন। বয়স কম হলেও নলেজ কম নয়। উনার সাথে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। নিজ বিষয়ের মতো রুশ ভাষায়ও যেমন দখল রাখেন বিদেশী হিসাবে এটা প্রসংশনীয়। তখন মনে হলো আমাদের কম্পিউটার নেটওয়ার্কের প্রোগ্রামটার ব্যাপারে তিনি হেল্প করতে পারবেন। উনাদের কোম্পানীর প্রোগ্রাম এবং আমাদের কোম্পানীর প্রোগ্রাম একই। সেখানে উনার অভিজ্ঞতা ভালোই। প্রোগ্রামের পাশাপাশি ম্যানেজমেন্টের বিষয়েও উনার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু আপনাদের সাথে শেয়ার করবেন। আশা করি তিনি আমাদের আশানুরূপ হেল্প করতে পারবেন।” ইউরি গেরমানোভিচ ইরমালয়েভ ব্যবসার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও। গণিত পড়ান। রুশ অধ্যাপকরা মাথাওয়ালা মানুষ হন, ইরমোলায়েভও তাই। গতকাল উনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমার বস্। ঘন্টা দুয়েক উনার সাথে আলাপ করেছিলাম, একসাথে লাঞ্চও করেছি। ঐ এক আলাপেই বুঝেছি কেমন মাথাওয়ালা লোক উনি। একবার হাসিমুখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “অধ্যাপক মানুষ, ব্যবসায় আসলেন কেন?” তিনি হাসিমুখে বলেছিলেন, “এটা সময়ের দাবী। এই যুগ ব্যবসা-বাণিজ্যের যুগ। যুগের সাথে তাল তো মেলাতে হবে। দেখো একজন চাকুরীজীবি কি করেন? তিনি কেবল নিজেরই অন্ন সংস্থান করেছেন। আর একজন সফল ব্যবসায়ী নিজেরটা তো করেছেনই, পাশাপাশি আরো দশজনেরটাও করেছেন। এটাকে কি আমরা পজেটিভলী নেবোনা? আমি একসময় আলজেরিয়ায় ছিলাম। তখনই ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে আমার ঝোঁক তৈরী হয়।

তাদের অফিসে একটা নতুন প্রোগ্রাম ইনস্টল করা হয়েছে। মেইনলি ঐ প্রোগ্রামটির উপরেই ক্লাস নিলাম। ঘন্টা দুয়েকের মত ক্লাস হলো। মাঝখানে ছোট ছোট দুটি ব্রেক নিলাম। টানা পয়তাল্লিশ মিনিটের উপর ক্লাস নেয়া ঠিক না। এতে ব্রেনের উপর চাপ পড়ে। তাছাড়া মানুষের ব্রেন কোন কিছুর উপর একটানা পয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি চিন্তাও করতে পারেনা। ক্লাসের পরে লাঞ্চ আওয়ার ছিলো। ইউরো গেরমানোভিচ আমাকে আগেই বলেছিলেন, যে কয়দিন ক্লাস নেব এখানেই যেন লাঞ্চ করি।

লাঞ্চ আওয়ারে ক্যান্টিনে গিয়ে আবারও ঐ মেয়েটিকে দেখলাম। অন্য একটি টেবিলে বসেছিলো। আবার চোখ আটকে গেলো ওর ডাগর কালো আঁখি দুটিতে। তার উপর পরিপাটি ভ্রু, নিঁখুত দুটি রেখা, মেক-আপ করা নয়। প্যান্ট-শার্ট পরিহিতা স্মার্ট গার্ল হলেও, মেয়েটি যে প্রাচ্যদেশিয়া এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য টার্ম দুটি শুনে আসছি সেই স্কুলজীবন থেকে। মোটের উপর যা বুঝতাম তা হলো, এশিয়ার দেশগুলি হলো প্রাচ্য আর ইউরোপীয় দেশগুলি হলো পাশ্চাত্য (প্রতিচ্য)। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের কোর্স করার পর তার নিগূঢ় অর্থ বুঝতে পেরেছি। প্রাচীনকালে দুটি বৃহৎ সাম্রাজ্য ছিলো, একটির নাম ছিলো রোম সাম্রাজ্য, আরেকটির নাম পারস্য সাম্রাজ্য। এরা ছিলো পরষস্পরের শত্রু। দুয়ের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। সেই রোম থেকে পারস্য অভিমুখে অভিযান চালাতে হলে সৈন্যদের অগ্রসর হতে হতো পূর্ব দিকে, বিপরীতক্রমে পারস্য থেকে রোম অভিমুখে অভিযান চালাতে হলে সৈন্যদের অগ্রসর হতে হতো পশ্চিম দিকে। সেই থেকেই রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে বলা হয় পাশ্চাত্য আর পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে বলা হয় প্রাচ্য। এই দুয়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনা, জীবনধারা সবই ভিন্ন। তাই তারা কখনোই একে অপরকে বুঝতে পারেনি। east is east, and west is west, and never the twain shall meet. কথাটি বলা হয়েছিলো কবি Rudyard Kipling. লিখিত The Ballad of East and West কবিতায়। প্রাচ্যের লোকেরা একটু আধ্যাত্মবাদী আর পাশ্চাত্যের বাসিন্দারা অনেকটাই বস্তুবাদী। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। প্রেম বলতে পাশ্চাত্যরা বোঝে দেহের স্বাদ, আর আমরা প্রাচ্য দেশীয়রা বুঝি সর্বাতিক্রমী এবং পারমার্থিক অর্থে রূপের অতীত অপরূপ সৌন্দর্য্যকে। দেহের চাইতে মনের স্বাদ বেশী পেতে চাই আমরা প্রাচ্যবাসীরা। ক্যান্টিনের সাউন্ড বক্সে মৃদু বাজনা বাজছিলো। সুরলহরীটি আমার পরিচিত, খুব সম্ভবত রুশ সুরশিল্পী চাইকোভ্স্কী হবে। রাশিয়া ইউরোপও নয় আবার এশিয়াও নয়। তার মাঝামাঝি কিছু একটা হবে। চাইকোভ্স্কী-র সুরও আমার কাছে মাঝামাঝি মনে হয়। সেই সুরের মৃদু মুর্ছনায় সুক্ষ্ণ স্পর্শাতুরতায় ঐ প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিকে বেশ মানানসই মনে হচ্ছিলো। আমার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিলো, মেয়েটি বাংলাদেশের কিনা। কিন্তু যেচে পড়ে ওকে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবেনা ভাবলাম। এই বিষয়ে আমার মধ্যে এম্নিতেই একটা জড়তা কাজ করে। তাছাড়া আজ প্রথম দিন। এর বাইরে আমি আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছি যে, কোন মেয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট দেখালে সাথে সাথে তার ডাট বেড়ে যায়। দরকার নাই আমার ওর ডাট বাড়ানোর। লাঞ্চের শেষে কফি খেতে খেতে ঐ টেবিলের দিকে তাকাতেই ওর সাথে চোখাচোখি হলো। মেয়েটি আমাকেই দেখছিলো। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলাম। জানিনা ও কি ভেবেছে, যা ভাবে ভাবুক! লাঞ্চ শেষ করে আমার অফিসে চলে এলাম।

——————————*———-*————————-

একদিন গ্যাপ দিয়ে তার পরদিন আবার ‘আভানগার্দ’ কোম্পানীতে গেলাম। যথারীতি ক্লাস নিচ্ছিলাম। প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটি গত পরশু দিনের জায়গাতেই বসেছিলো। আজ আমি ওর দিকে একবারও তাকালাম না। ইচ্ছে করেই কাজটা করলাম যেন ও মনে করে ওর প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও আগ্রহ নেই। ক্লাসের একফাঁকে বললাম, “কোন প্রশ্ন আছে কি?”
বয়স্ক একজন ব্যক্তি উচ্চাহাস্য করে বললেন, “আপনার দেশ কোথায়?”
এবার আমিও জোড়ে হেসে বললাম, “যাক ভালো, কোন টেকনিকাল কোশ্চেন করেননি। আপনার মতন বয়স্ক, অভিজ্ঞ একজন লোক জটিল প্রশ্ন করলে হয়তো আটকে যেতাম। সহজ প্রশ্নের, সহজ উত্তর দিচ্ছি। আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ” এবার ইয়াং মতন একজন বললেন, “আমিও তাই ভেবেছিলাম, ইন্ডিয়ান নন, বাংলাদেশী।”
আমিঃ কি করে বুঝলেন?
ইয়াং স্টাফঃ ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশীদের মধ্যে চেহারায় মিল যদিও বেশি, তবে অমিলও রয়েছে। আপনাদের চেহারা ওদের চাইতে শার্প হয়। তাছাড়া ফেসের এক্সপ্রেশন একেবারেই ভিন্ন।
আমিঃ ও আচ্ছা। কিন্তু ফেসের এক্সপ্রেশনে পার্থক্যটা কি?
ইয়াং স্টাফঃ আমি ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়তাম আমার সাথে ইন্ডিয়া বাংলাদেশ দুটি দেশের ছাত্র-ছাত্রীরাই পড়েছে। তখনই লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশীদের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে এক ধরনের সরলতা থাকে যেটা ইন্ডিয়ানদের মধ্যে নেই।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর লাঞ্চের উদ্দেশ্যে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিলাম এসময় আমি গত পরশু দিন থেকে যা চাচ্ছিলাম সেটাই ঘটলো। হঠাৎ প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে এলো। খুব মিষ্টি কন্ঠে পরিষ্কার বাংলায় আমাকে বললো।
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ আপনি কি বাংলাদেশের? আমিও বাংলাদেশের।
আমিঃ তাই? তা কি নাম আপনার?
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ সুমনা আফসানা বৃষ্টি
আমিঃ বাহ্, খুব কাব্যিক নাম তো!
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ আপনার নামও তো সুন্দর! শরীফ। (প্রথম ক্লাসেই আমি আমার নাম বলেছিলাম। তাই ও মনে রেখেছে)
আমিঃ সেকেলে নাম। বোধহয় আমার দাদা রেখেছিলেন নাম। আপনার নামটা আধুনিক এবং পোয়েটিক। তবে এর মধ্যে আপনার ডাক নাম কোনটি?
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ এ প্রশ্ন করলেন কেন?
আমিঃ আপনার নামের তিনটি অংশ, সুমনা, আফসানা, ও বৃষ্টি। তিনটিই ডাক নাম হবার যোগ্য। তাই বলছিলাম।
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ আপনি হলে কোনটিকে ডাক নাম বলে চুজ করতেন?
আমিঃ উঁ, বলা মুশকীল। সুমনা মানে সুন্দর মন। আপনি দেখতে সুন্দরী, মনটাও সুন্দর হবে নিশ্চয়ই। (আমার মুখে তার রূপের প্রশংসা শুনে মুখটা হঠাৎ আরক্তিম হয়ে উঠলো। এটা স্বাভাবিক, বেশীরভাগ মেয়েরই তাই হয়। সেই প্রশংসা মন থেকে হোক আর উৎকোচ হোক) আবার বৃষ্টি নামটিও সুন্দর।
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ আফসানা সুন্দর নয়?
আমিঃ হ্যাঁ শ্রুতিমধুর। তবে শব্দটা ফার্সী। আমি তার অর্থ জানিনা। ইন্টারেস্টিং দুদিকে দুটি বাংলা শব্দ মাঝখানে একটি ফার্সী শব্দ। যেন বাংলা শব্দ দুটি ফার্সী শব্দটাকে গার্ড দিচ্ছে।
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ কি সব মজার মজার কথা বলেন (আমার কথা শুনে হেসে ফেললো ও)।
আমিঃ যাহোক, আমি হলে বৃষ্টি-টাকেই ডাক নাম হিসাবে চুজ করতাম। ছোট্ট আর মধুর।
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ আপনি বৃষ্টি পছন্দ করেন?
আমিঃ হু, খুউব।
প্রাচ্যদেশীয় মেয়েটিঃ আমার ডাক নাম বৃষ্টি-ই।
আমিঃ দেখেছেন আমার পছন্দের সাথে কেমন মিলে গেলো।
আমার কথা শুনে ও সলজ্জ্ব হাসি হেসে একটা নোড করলো। ভঙ্গিটি ভারী চমৎকার লাগলো। মনে হলো বটল্ ব্রাস গাছের একটি কচি শাখা একবার মাত্র দুলে উঠলো।

মেয়েটিকে আমি গভীর মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। তন্বী মেয়েটি লম্বায় আমার চাইতে সামান্য উঁচু হবে। গাত্রবর্ণ এদেশের মেয়েদের তুলনায় চাপা হলেও বাংলাদেশের মেয়েদের তুলনায় উজ্জ্বল গৌরবর্ণ। মুখটি পানপাতা গড়নের কাছাকাছি। দুই কপোলে স্নিগ্ধ গোলাপী আভা। বোচাও নয় আবার তীক্ষ্ণও নয় এমন মাঝারি গড়নের নাক। ডাগর ডাগর দুটি কালো আঁখি। সব চাইতে সুন্দর উজ্জ্বল গোলাপী রঙের ওর পাতলা ঠোট দুটি। ঐ ঠোট দুটিতে রয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় বেদানা দানার লালিত্য অপূর্ব রস-মাধুর্য্য। সেই পাতলা ঠোট দুটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে একটি ছোট্ট তিল। অপরূপ সুন্দরী, যেন প্রকৃতির আপন হাতে গড়া।
——————————*———-*————————-

স্ত্রীঃ তোমার অফিস কেমন চলছে?
আমিঃ গতানুগতিক। যেমন সবসময় চলে।
স্ত্রীঃ ও। না মানে নতুন কিছু নেই?
আমিঃ নতুন বলতে ঐ যে অন্য কোম্পানীতে ক্লাস নিচ্ছি।
স্ত্রীঃ তুমি বলেছ। কিন্তু সেই সম্পর্কে তো কিছুই বললে না!
আমিঃ না, মানে তেমন কিছু না। ওদের প্রোগ্রামটা একটু বুঝিয়ে দেয়া আর কি।
স্ত্রীঃ তোমার তো টিচার হওয়ার সখ ছিলো তাই না?
আমিঃ কিছুটা।
স্ত্রীঃ কেন টিচার হতে চেয়েছিলে?
আমিঃ জাস্ট একটা আগ্রহ আর কি। খুব সম্ভবত জীবনে কিছু ভালো ভালো টিচার পেয়েছিলাম তাই হয়তো উনাদের মতো হতে চেয়েছিলাম।
স্ত্রীঃ (একটু ঠাট্টা করে বললো) কোন সুন্দরী আছে কি ঐ কোম্পানীতে, তোমার ট্রেইনীদের মাঝে?
স্ত্রীর এই প্রশ্নে একটু ঘাবড়ে গেলাম। কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বৃষ্টির কথা বলবো কি? তারপর ভাবলাম এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। হচপচ গোছের একটা উত্তর দিলাম।
আমিঃ না মানে, তেমন কেউ না। এখানে তো সব অফিসেই নারী-পুরুষ সমান সমান।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো আমার স্ত্রী, তবে এই বিষয়ে কিছু বললো না। একটু চুপ করে থেকে বললো
স্ত্রীঃ আমার বান্ধবী ইরাকে মনে পড়ে?
আমিঃ হ্যাঁ কি হয়েছে?
স্ত্রীঃ বেচারী আজ খুব কাঁদছিলো।
আমিঃ কেন?
স্ত্রীঃ ওর একটা বয় ফ্রেন্ড ছিলো।
আমিঃ জানি, তুমি বলেছ। একটা নাইট ক্লাবের মালিক। ধনী বয়ফ্রেন্ড। ইরা তো ভালোই আছে। ওদের বিয়ে হয়ে গেলে আরো ভালো হবে।
স্ত্রীঃ আরে সেই কথাই। বিয়ে ওদের হওয়ার কোন চান্স নেই।
আমিঃ কেন কেন? এতো সুন্দরী একটা মেয়ে! তোমার ক্লাসের সব ছেলেই তো ওর জন্য পাগোল ছিলো জানি।
স্ত্রীঃ সমস্যাটা সেখানেই। ঐ নাইট ক্লাবের ম্যনেজারের চাকরী নিয়েছিলো ইরা। সেখানেই মালিক জুজেই-এর সাথে পরিচয় হয় ওর।
আমিঃ জানি, তুমি বলেছ। জুজেই কোপভের্দ-এর।
স্ত্রীঃ হ্যাঁ, ঐ কোপভের্দ-এর ছেলেটার সাথেই হঠাৎ প্রেম হয়ে গেলো ইরার। এতো সুন্দরী মেয়ে! কতো ছেলে ওর পিছনে ঘুরতো! হঠাৎ করেই একটা জালে আটকা পড়ে গেলো ও।
আমিঃ (বিরক্ত হয়ে বললাম) জালে আটকা পড়ার কি আছে? দুজন দুজনকে ভালোবাসে। বিয়ে করে ঘর-সংসার করলে আরো ভালো।
স্ত্রীঃ ওটাই বলছি। বিয়ে করার কোন সুযোগ নেই। জুজেই বিবাহিত।
আমিঃ কি? জুজেই বিবাহিত!
স্ত্রীঃ হ্যাঁ, তাই।
আমিঃ ইরা জানতো?
স্ত্রীঃ জানিনা।
আমিঃ আমরা বান্ধবীরা জানতাম না। আজ ইরা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলো। আমরা বললাম, “কি হয়েছে?” ইরা বললো যে, আজ জুজেই একটা এ্যালবাম নিয়ে এসেছে, সেখানে সে ও তার স্ত্রী ছিলো। কোন ছবিতে জুজেই ও তার স্ত্রী চুম্বনরত, কোন ছবিতে তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ, খুব অন্তরঙ্গ ছবিগুলো। ইরা খুব খেপে গিয়ে বলেছিলো, “তোমার স্ত্রীর সাথে ছবিগুলো আমাকে দেখানোর কি আছে?” তারপর কথা কাটাকাটি হয়ে শেষে সম্পর্ক ছিন্ন করে, চাকরী ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বললাম,
আমিঃ কাজটা তো ভালো হয়নি। ইরা একটা ম্যারেড লোকের সাথে প্রেম করতে গেলো কেন?
স্ত্রীঃ কি জানি? মনের অজান্তে ঘটে গিয়েছে হয়তো।
আমিঃ আচ্ছা ইরার দিক থেকে তো বুঝলাম। কিন্তু জুজেই? কেমন শয়তান! ঘরে বৌ থাকতে আরেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক করে। না না, অন্যায়, এ ভীষণ অন্যায়।

—————————–*———–*—————————

এর পর এক সপ্তাহের ব্যবধান হলো। ইউরি গেরমানোভিচের সাথে কথা হয়েছিলো সপ্তাহে দুটা করে ক্লাস নেবো। ডে হিসাবে চুজ করেছি মঙ্গল আর আর বৃহষ্পতিবার। সোমবার সপ্তাহের শুরু ঐদিন আমার নিজের অফিসেই কাজ থাকে বেশী, আবার শুক্রবার সপ্তাহের শেষ ক্লোজিংয়ের একটা ব্যাপার আছে তাই ঐ দিনটাও নিজের জন্য রাখলাম। এভাবে ঐ দুইদিন বাদ দিয়ে ‘আভানগার্দ’-কে সময় দিয়েছি। আজ ক্লাসে ঢোকার আগেই বৃষ্টির সাথে দেখা হলো । করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে দেখে মিষ্টি হাসলো।

আমিঃ কেমন আছেন?
বৃষ্টিঃ জ্বী। ভালো। আপনি?
আমিঃ আমিও ভালো। আসুন ক্লাসে আসুন।
ক্লাসের ভিতরে ঢুকে ও এবার আগের জায়গায় না বসে, সামনের একটি চেয়ারে বসলো।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর আজ উনাদেরকে আগে বেরোতে দিলাম। আমি কম্পিউটার থেকে পেন ড্রাইভটা খোলা ও কাগজ-পত্র গোছানোর জন্য কিছু সময় নিলাম। ক্লাসরূম (এটাই ওদের কনফারেন্স রূমের মতো) থেকে বেরিয়ে দেখলাম, দরজায় কাছেই বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে।
বৃষ্টিঃ আপনি কি ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতে যাচ্ছেন?
আমিঃ জ্বী।
বৃষ্টিঃ চলুন, একসাথেই যাই।
আমিঃ চলুন।

ক্যান্টিনে অন্যান্য খাবারের সাথে আছে গ্লাস ভরা ফলের রস। রুশরা কামপোত নামে এক ধরনের জুস তৈরী করে। পীচ, চেরী, আপেল ইত্যাদি ফল দিয়ে তৈরী। আমি নিজে কখনো তৈরী করিনি যা দেখেছি তা হলো বড় পাতিলে ফলগুলি নেয় আর সেখানে ঢালে প্রচুর পানি, তার সাথে মেশায় পরিমানমতো চিনি। বেশ কিছুক্ষণ চুলায় জাল দেয়ার পর তৈরী হয়ে যায় কামপোত। খুব সাধারন ক্যান্টিন থেকে শুরু করে মোটামুটি সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। আজকাল কামপোতের পাশাপাশি প্যাকেটজাত জুসেরও প্রচলন হয়েছে। প্যাকেটজাত জুস জিভে স্বাদ এনে দেয় সত্যি তবে তাতে প্রচুর পরিমানে প্রিজারভেটিভ থাকে। প্রিজারভেটিভ হিসাবে ব্যবহৃত কেমিকালগুলো স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর। এখানে আরেকটি জনপ্রিয় খাবার ভারিনিয়ে। গ্রীস্মকালে এখানে নানা ধরনের ফল হয়। আর শীতকালে ঠিক বিপরীত। ফল তো দূরের কথা গাছের পাতাই থাকেনা। একেবারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতো নেড়া। শীতকালটা হয় এখানে দীর্ঘ। যেমনি শীতল তেমনি বিষন্ন। ফলহীন এই কালে ফলের স্বাদ পাওয়ার জন্য তারা বের করেছে এক অভিনব পদ্ধতি। নানা ধরনের ফল চিনির সাথে জাল দিয়ে ঘন তরল করে বয়মজাত করে রাখে। তারপর সারা শীত রুটির সাথে মাখিয়ে বা প্লেটে তুলে নিয়ে সেই বয়মজাত তরল খাও। এই ভারিনিয়ে নিয়ে অনেক গানও আছে। ভারিনিয়ে হলো জ্যাম। গ্লাস ভরে চেরির রস নিয়ে এলো বৃষ্টি। আমি নিলাম প্যাকেটজাত অরেঞ্জ জুস। খাওয়া শেষ হওয়ার পর সামান্য ভারিনিয়ে ঢেলে নিলো ছোট্ট তস্তরিতে। দেখে বুঝলাম ক্লুবনিকা মানে স্ট্রবেরীর ভারিনিয়ে। গাঢ়ো লাল রঙের স্ট্রবেরী ভারিনিয়ে চামচে তুলে যখন খেলো সামান্য ভারিনিয়ে ওর ঠোটে লেগে গিয়ে ওর পক্ক ঠোট দুটিকে আরো পক্ক করে তুললো।

আমিঃ ভারিনিয়ে আপনার ঠোটে লেগে গিয়েছে।
(বৃষ্টি টিস্যু পেপার দিয়ে দ্রুত মুছে ফেললো)
আমিঃ মুছলেন কেন? ভালোই তো লাগছিলো।
বৃষ্টিঃ মানে?
আমিঃ ভারিনিয়ে আপনার ঠোটে লেগে গিয়ে পক্ক ঠোট দুটিকে আরো পক্ক করে তুললো।
বৃষ্টিঃ (কিছুটা লজ্জ্বা পেয়ে) এতো সুন্দর করে কথা বলেন আপনি। কবিতা-টবিতা লেখেন নাকি?
আমিঃ হ্যাঁ। লিখিতো মাঝে-সাঝে।
বৃষ্টিঃ তাই? (হেসে ফেললো বৃষ্টি) আমি কিন্তু ধারণা করে বলেছিলাম। তা কে পড়ে আপনার কবিতা?
আমিঃ কে পড়ে তা নাম ঠিকানা সহ বলতে পারবো না। তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই পড়ে।
বৃষ্টিঃ বুঝলাম না।
আমিঃ আমার লেখা কবিতার বই বেরিয়েছে দুটি।
বৃষ্টিঃ ওমা! বই! (বিস্ময়ে ঝিকমিক করে উঠলো ওর চোখ)। বেশ তো আমাকে দেবেন পড়তে?
আমিঃ শুধু পড়তে কেন আমি একবারেই আপনাকে উপহার দিয়ে দেব দুটি বই। কাল নিয়ে আসবো।

———————————*————-*———————

কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ ‘আভানগার্দ’-এ তোমার ক্লাস কেমন চলছে?
আমিঃ জ্বী, ভালো।
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ গুড। আমি অনেক আশা করে তোমার কথা বলেছিলাম ইউরিকে।
আমিঃ জ্বী, আপনি বলেছেন? (আমার ধারণা ছিলো, আমার সাথে কথা বলে ইউরি গেরমানোভিচ ইমপ্রেসড হয়ে আমাকে অফার করেছেন)
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ ইউরি একজনকে খুঁজছিলো। আমি তোমার কথা বলেছিলাম। তাই সে অফিসে এসে তোমার সাথে কথা বলেছিলো। ইনফর্মাল ইন্টারভিউ আর কি। যা হোক। তিনি তোমার উপর সন্তষ্ঠ। ট্রেইনী-রা তো ভীষণ খুশী। স্টার্টিং ভালো হয়েছে। কীপ ইট আপ!
আমিঃ জ্বী, ঠিক আছে।
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ নাও চা নাও। আচ্ছা তোমাদের সাথে ইউরির ওখানে একটা বাংলাদেশী মেয়ে আছে তাই না?
আমিঃ জ্বী
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ ও!

আর কিছু বললেন না তিনি। তারপর অফিসের দুয়েকটা বিষয়ে আলাপ করে ছেড়ে দিলেন। উনার রূম থেকে বেরিয়ে হঠাৎ খেয়াল হলো, বৃষ্টির ব্যপারে তো কিছু জিজ্ঞেস করা হলো না। ওকে তো মস্কোতে আগে কখনো দেখিনি। তাহলে মেয়েটি কোন শহরে পড়ালেখা করেছে?
———————————*————-*———————

চতুর্থ ক্লাসের দিন বৃষ্টিকে বেশ সাবলীল লাগছিলো। অন্যান্যদের সাথে সাথে বৃষ্টিও আজ দু’য়েকটি প্রশ্ন করলো। সব চাইতে আকর্ষণীয় আজ যে জিনিসটা লাগছিলো, সেটা হলো ও আজ শাড়ী পড়ে এসেছে। এই একটি পোশাকের প্রতি আমার ভীষণ দুর্বলতা আছে। অদ্ভুত সুন্দর একটি পোষাক। নারী আর শাড়ী এই দুয়ের মধ্যে একটা চমৎকার ছন্দের মিল রয়েছে। বাঙালি নারী আর শাড়ি—এ যেন একে অপরের জন্যই। বারো হাত একখানা শাড়ির সৌন্দর্য্যের কাছে যেন হার মানে অন্যসব পোশাকই। এই একটি পোশাকই যেন নারীকে নারীর রূপে প্রকাশ করে। আর তাই তো বাঙালি নারীদের কাছে শাড়ি খুব শখের একটি পোশাক। বাঙালি নারী আর শাড়ি যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাই যুগ পরিবর্তনের হাওয়ায় সবকিছু বদলে গেলেও বাঙালি নারীদের সৌন্দর্য প্রকাশের জায়গা এখনও চিরায়ত বাংলার শাড়ি দখল করে আছে অদ্বিতীয় মাত্রায়। সেই শাড়িই আজ পড়ে এসেছে বৃষ্টি। ফিরোজা রঙের হালকা কাজ করা একটি শাড়ি। শাড়ির প্রতি আমার দুর্বলতার কারণেই কিনা জানিনা, বৃষ্টিকে আজ ডানাকাটা পরীর মতো লাগছিলো। ঐ একই রূমে আরো তিনজন রুশ রমণী বসে ছিলেন। গাত্রবর্ণ ও সৌন্দর্যে তারাও পরীর কাছাকাছি। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছিলো ঐ ব্রাউন গার্ল বৃষ্টির কাছে আজ তারা ম্লান হয়ে গিয়েছে। যেন অনেক ফুলের ভীড়ে একটি জ্বলজ্বলে প্রস্ফুটিত পদ্ম।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমিই বৃষ্টির দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমিঃ কি? আজ একেবারে নব সাজে আসা!
বৃষ্টিঃ শাড়ির কথা বলছেন? তা নব সাজ কোথায়? এতো সেই পুরাতন শাড়ি।
আমিঃ হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। সেই পুরাতন শাড়ি। যা বাঙালী নারীর চিরায়ত পোশাক। তবে এই শাড়ীই কিন্তু বাঙালী নারীর সৌন্দর্যে পূর্ণতা এনে দেয়।
বৃষ্টিঃ তাই?
আমিঃ আপনাকে এ কয়দিন যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা রয়েছে। আজ আপনার সৌন্দর্য পূর্ণতা পেয়েছে।
বৃষ্টিঃ কাব্য করছেন? অবশ্য আপনিই কবিই।
আমিঃ আমার কবিতাগুলো পড়েছেন?
বৃষ্টিঃ শুরু করেছি। শেষ করিনি।
আমিঃ কেমন লাগছে কবিতাগুলো?
বৃষ্টিঃ সব না পড়ে কোন মন্তব্য করবো না।
আমিঃ ঠিক আছে সব পড়া হলে বলবেন। কষ্ট করে লিখিতো, তাই পাঠকের মন্তব্য জানায় আগ্রহী থাকি।
বৃষ্টিঃ আমিও লিখি মাঝে মাঝে।
আমিঃ (আমি উল্লসিত হয়ে বললাম) তাই? বেশতো। কোথাও ছেপেছেন? দিন না আমকে পড়তে।
বৃষ্টিঃ আমি চুপি চুপি লিখি। মান ভালো হয়না বলে কোথাও ছাপাতে দেইনি কখনো।
আমিঃ আপনার কবিতা পড়তে পারলে খুশি হতাম। চলুন লাঞ্চ করতে যাই।
বৃষ্টিঃ চলুন।

লাঞ্চ টেবিলে বসে আরেকবার ওর দিকে তাকালাম। সুন্দর প্রসন্ন মুর্তি। বয়স পঁচিশের বেশি হবেনা, কিন্তু কোন সিলিনেস নেই। পূর্ণ যৌবনা মেয়েটিকে কি ভাদ্রের ভরা নদী বলবো? নাহ্, এই জাতীয় মন্তব্য অশালীন মনে হয়। ওর সম্পর্কে অশালীন কিছু ভাবতে চাইনা। অন্যভাবে বলতে চাই, রূপলালিত্যে কেমন যেন একটা চেরিফুলের প্রশান্তি এসেছে।
বৃষ্টিঃ আপনাকে এমন সম্মোহিত মনে হচ্ছে কেন?
আমিঃ (হঠাৎ সলজ্জ হয়ে উঠলাম) না, তেমন কিছু না।
আমার মনের কথা কি ও ধরতে পেরেছে? অবশ্য, মেয়েদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা বিধাতা দিয়েছেন। ওরা খুব সহজেই পুরুষের মনের কথা বুঝতে পারে। ওর মুখের আবেগ-দীপ্তি ও রূপে আমি যে মুগ্ধ ও নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছে।
সেদিন লাঞ্চ টেবিলে অনেকক্ষণ ওর সাথে কথা বললাম। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে জড়তা কমে আসছে। অনেক দিনের পরিচিতের মতো অনেক গল্প করলাম। জানলাম ও মস্কোতে পড়ালেখা করেনি। পড়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গে (এক সময়ের লেনিনগ্রাদ)। ওখানে পড়ালেখা শেষ করে পরিচিত একজনার মাধ্যমে এই চাকরীটা পেয়েছে। চাকরীতে কেমন লাগছে জানতে চাইলে বললো, প্রথম চাকরী তো, তুলনা করার কিছুই নাই। তবে পরিবেশ ভালো। সব চাইতে ভালো ইউরি গেরমানোভিচ, চমৎকার একজন মানুষ।এক ফাঁকে আমরা মোবাইল টেলিফোন নাম্বার বিনিময় করে নিলাম। গল্প করতে করতে একসময় আমরা লক্ষ্য করলাম ক্যান্টিন খালি হয়ে গিয়েছে। আর কেউ নেই। লজ্জ্বা পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম।

———————————–*————–*——————

এরপর আবারও এক সপ্তাহের ব্রেক। অফিসে নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম দুদিন। বৃষ্টির কথা যে মনে হয়নি তা নয়, তবে ঐ পর্যন্তই। তৃতীয় দিনে হঠাৎ বৃষ্টির ফোন কল পেলাম। একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আমি তখন কোম্পানী প্রেসিডেন্ট-এর রূমে বসেছিলাম। উনি আমার কাছ থেকে কিছু ফাইল বুঝে নিচ্ছিলেন। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে তাকিয়ে দেখলাম বৃষ্টির নাম। আমি ফোনটা কেটে দিলাম। পাঁচ মিনিট পর আবার ফোন বাজলো। এবারও কেটে দিলাম। দশ মিনিট পর আবারো বৃষ্টির কল এলো। বসের সামনে ফোন রিসিভ করাটা শোভন না। জরূরী ফোন কিনা বুঝতে পারলাম না। এতো বার করছে জরূরী হতেও পারে। তারপর আবার ভাবলাম আমার সাথে ওর জরূরী কি থাকতে পারে? আমি কোম্পানী প্রেসিডেন্ট-এর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি চোখের ভাষায় অনুমতি দিলেন।

আমিঃ হ্যালো।
বৃষ্টিঃ আমি বৃষ্টি।
আমিঃ বুঝতে পারছি।
বৃষ্টিঃ আপনি কি ব্যস্ত?
আমিঃ জ্বী, মানে আমি কোম্পানী প্রেসিডেন্ট-এর সাথে জরূরী কাজে আছি।
বৃষ্টিঃ ও সরি! পরে কথা বলবো তাহলে।
আমিঃ জরুরী কোন কিছু?
বৃষ্টিঃ থাক পরে বলবো।

ফোনটা রেখে দিলো বৃষ্টি।

কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ ফোন কল কার ছিলো? আভানগার্দ-এর ঐ বাঙালী মেয়েটির?
আমিঃ (একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম) না, মানে জ্বী।
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ না, বাংলায় কথা বলছিলে তো তাই। তোমার স্ত্রী হলে তো বাংলায় কথা বলতে না।
আমি আরেকটু বিব্রত হয়ে গেলাম। সেটা কাটানোর জন্য অতিরিক্ত কথা বললাম।
আমিঃ হঠাৎ করেই ফোন করলো। ঠিক কি ব্যপারে ফোন করলো বুঝলাম না। অফিসের কোন ব্যপারে হতে পারে।
কোম্পানী প্রেসিডেন্টঃ (অনেকটা নির্লিপ্তভাবেই বললেন) হতে পারে। যাক আমাদের কাজের কথায় আসি।

—————————–*————*————————–

আমি কাজ শেষে আমার রুমে ফিরে গিয়ে বৃষ্টিকে কল ব্যাক করলাম।
বৃষ্টিঃ হ্যালো।
আমিঃ আমি শরীফ।
বৃষ্টিঃ বুঝতে পারছি।
আমিঃ আপনি ফোন করেছিলেন।
বৃষ্টিঃ হ্যাঁ।
আমিঃ বলেন।
বৃষ্টিঃ কি বলবো?
আমিঃ বারে আপনিই না ফোন করলেন।
বৃষ্টিঃ না, জাস্ট ফ্রী ছিলাম। আপনার কথা মনে পড়লো ভাবলাম একটা ফোন করি।
আমিঃ ও, তাহলে জরুরী কিছু না?
বৃষ্টিঃ কেবল জরুরী কাজেই ফোন করা যাবে?
আমিঃ না না তা কেন? আপনার ইচ্ছে হলেই ফোন করবেন।
বৃষ্টিঃ ইচ্ছে হলেই ফোন করবো?
আমিঃ করবেন অসুবিধা কি?
বৃষ্টিঃ আপনার ঘরওয়ালী কিছু মনে করবে না?
আমিঃ (এবার একটু অবাক হলাম, ঘরওয়ালীর খোঁজ ওকে কে দিলো!) ঘরওয়ালীর কথা আপনাকে কে বললো?
বৃষ্টিঃ কেন, গোপন রাখতে চেয়েছিলেন?
আমিঃ কি আশ্চর্য গোপন রাখা না রাখার কি আছে? জাস্ট আমাদের মধ্যে এই নিয়ে কোন আলাপ হয়নি তাই।
বৃষ্টিঃ মস্কোতে বাঙালী কম্যুনিটি তো ছোট। মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনে। আমি না হয় পিটার্সবার্গ থেকে এসেছি বলে সবাইকে চিনি না।
আমিঃ বুঝলাম। তারপর?
বৃষ্টিঃ গতকাল আখোতনি রিয়াদে গিয়েছিলাম। একটু ঘোরাঘুরি আর সামান্য শপিং-এর জন্যে।
আমিঃ তারপর?
বৃষ্টিঃ সেখানে একটা বাঙালী মেয়ের সাথে দেখা হলো। কোন ইউনিভার্সিটির যেন ছাত্রী। ওকে আপনার কথা বলতেই হরবর করে অনেক কথা বললো।
আমিঃ আমার কথা! কি নাম মেয়েটির? কি বললো?
বৃষ্টিঃ বললো, আপনি খুব ভালো। খুব ট্যালেন্টেড। সুন্দর কবিতা লেখেন। চমৎকার বক্তৃতা দেন। এখানে এ্যাম্বাসেডর থেকে শুরু করে সবাই আপনাকে চেনে। আপনার খুব সুন্দরী একজন স্ত্রী রয়েছে। এই সব আরকি।
আমিঃ ওহো! মেয়েটাতো বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কিছুই বলেছে।
বৃষ্টিঃ আমার কাছে কিন্তু অতিরঞ্জিত কিছুই মনে হয়নি। যাহোক আজ তাহলে রাখি।

টেলিফোন রেখে দেয়ার পর ভাবলাম। ভালোই হলো ও জেনেছে যে আমি বিবাহিত। আগেভাগে জানাই ভালো। আবার ভাবলাম আমি এসব কথা ভাবছি কেন। আমার বৈবাহিক অবস্থার সাথে ওর সম্পর্ক কি? ঐ সপ্তাহে বৃষ্টি আরো দুবার ফোন করেছিলো।

রোববার ছুটির দিন, অফিস বন্ধ ভাবলাম ও এতবার ফোন করলো আমারও অন্ততপক্ষে একবার ফোন করা উচিৎ, না হলে ভালো দেখায় না। আবার ভাবলাম, কি দরকার? ফোন করব কি করব না ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা তুলে প্রেস বাটনে চাপ দিয়ে দিলাম। কিচেন থেকে হঠাৎ আমার স্ত্রী ডাক দিলো, “এদিকে এসো তো।” চট করে কল কেটে দিলাম। ভাবলাম নাহ্ ভালোই হয়েছে। স্ত্রী হয়তো ভাবতো, ‘কি ব্যপার কার সাথে কথা বলে?’ নারীরা বরাবরই সন্দেহপ্রবন। স্ত্রীর উপস্থিতিতে ফোন করা যাবেনা।

লাঞ্চের পর স্ত্রী বললো, ও শপিং-এ যাবে। আমি বললাম, “আমাকে আসতে হবে?” স্ত্রীঃ “নাহ্ থাক। আমি একাই যাবো”
আমিঃ গাড়ী নেবে?
স্ত্রীঃ না, দরকার নেই। সিটি সেন্টারে যাবো। গাড়ী পার্ক করা নিয়ে ওখানে ভীষণ ঝামেলা। মেট্রোতেই যাবো। ফ্রীলি ঘোরাঘুরি করা যাবে।
আমিঃ ঠিক আছে যাও তাহলে।
স্ত্রীঃ তুমি কি ঘরেই থাকবে?
আমিঃ আপাততঃ বের হওয়ার কোন প্ল্যান নেই।
স্ত্রীঃ থাকো তাহলে। সারা সপ্তাহই তো কাজে ডুবে থাকো। রবিবার দিন একটু বিশ্রাম নাও।

আগে আমরা বরাবর একসাথেই শপিং-এ যেতাম ইদানিং ও একাই যায়। আমার কেনাকাটা ওর পছন্দ হয়না। আমার নিজের জন্য কিছু কিনলেও বলে, “ভালো কিনতে পারোনা। তোমার চয়েজ খারাপ।” আমি ভাবি খারাপ কি? ভালোই তো কিনেছি। আবার ওর কেনা কিছু পড়ে যখন বাইরে যাই, সবাই বলে, ‘বাহ্ খুব সুন্দর তো! দারুণ চয়েজ করেছেন।’

স্ত্রী চলে যাওয়ার পর টিভি সেটের সামনে বসলাম। এখানে কেবেল ছাড়াই টিভি চ্যানেল প্রচুর। সবগুলোই ভালো মানের। তবে ঔনাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়ায়, সংবাদগুলো আসে একপেশে। একটি চ্যানেলে ‘উতামলিওন্নিয়ে সন্তেসেম’ দেখাচ্ছে। নিকিতা মিখাইলকোভের পরিচালনায় এই ছবিটি অস্কার পেয়েছে। ছবির কাহিনী থেকে শুরু করে, উপস্থাপনা, অভিনয় সব কিছুই চমৎকার। অস্কার পাওয়ার মতোই। সোভিয়েত শাসনামলে সাধারণ মানুষের উপর কম্যুনিস্টদের নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে ছবিটি। ছবির একটি রোমান্টিক দৃশ্য দেখে মোবাইলের দিকে আমার চোখ চলে গেলো। বৃষ্টিকে ফোন করলাম। কয়েকবার রিং হলো। ফোন ধরলো না ও। ব্যস্ত থাকতে পারে। পাঁচ মিনিট পর আবার ফোন করলাম। এবারো অনেকক্ষণ রিং হয়ে থেমে গেলো। মেজাজটা বিগড়ে গেলো। নিজে ও এতবার ফোন করলো, আর এখন আমি ফোন করাতেই ওর দাম বেড়ে গেলো! যাহ্ আর ফোন করবো না। এদিকে টেভির ছবিটি জমে উঠেছে। যদিও আমি আগেও ফিল্মটি দেখেছি। ওহ্ প্রথমবার আমি ছবিটি দেখেছিলাম হলে, আমার স্ত্রীর সাথে। অবশ্য তখনো স্ত্রী হয়নি, গার্লফ্রেন্ড ছিলো। ক্লাসমেট থেকে গার্লফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড থেকে স্ত্রী। আমার মনে পড়ে ওর প্রতি আমার আকর্ষণের মূল কারণ ছিলো ওর ইন্টেলিজেন্স। ক্লাসের সেরা ছাত্রী ছিলো সে। সবারই নজর ছিলো ওর দিকে। আমার নজর যে ছিলোনা এমন বলবো না। তবে নিজেকে ওর যোগ্য মনে করিনি কখনো। তাই আগ্রহ দেখাতে সাহস করিনি। এই পৃথিবীটা একটা আশ্চর্য্য জায়গা। ক্লাসের সেই সেরা মেয়েটি কিনা অতি সাধারণ আমার দিকেই নজর দিলো!

ও থাকতো শহরে। আমি থাকতাম ডরমিটরিতে। একদিন দেখি নীচে ডরমিটরির গেটের সামনে ওয়েটিং রূমে বসে আছে। আমি ওকে দেখে বললাম, “তুমি এখানে? কি করছো?” “আমার বান্ধবীর কাছে এসেছিলাম, ও নাই। তাই অপেক্ষা করছি।” মিষ্টি হেসে বলেছিলো ও। বললাম, “কখন আসবে তাতো ঠিক নাই। নীচে অপেক্ষা করবে কেন কষ্ট করে? আমার রূমে চলো।” এক কথায়ই ও রাজী হয়ে গেলো। সেদিন অনেকক্ষণ আমরা গল্প করেছিলাম। তারপর ও প্রায়ই আসতে থাকলো। সেই শুরু হলো। আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার জন্য সবাই পাগোল, আর তুমি কিনা আমাকে চুজ করলে! কারণটা কি জানতে পারি। এই অধমের কোন গুনটা তোমাকে আকৃষ্ট করলো?” ও বললো, “এখানকার বেশিরভাগ ছেলেই ভালো হয় না। শরীরটাকেই কেবল বোঝে। মানুষের মন বলে যে একটা জিনিস আছে। তা বুঝতেই চায়না। তুমি কিন্তু ব্যতিক্রম। খুব সুন্দর কথা বলো। সব চাইতে সুন্দর তোমার হাসি, এতো নির্মল!” আমি বললাম, “আমার কি তোমাকে আকৃষ্ট করলো? কথা না হাসি।” আমাদের দেশে বলে, “ছেলেরা চোখে দেখে পছন্দ করে। আর মেয়েরা কানে শুনে পছন্দ করে।” আমি বললাম, “তার মানে কি এই বলতে চাও যে, যে ছেলে যত সুন্দর কথা বলে তার প্রতি মেয়েরা তত বেশী আকৃষ্ট হয়?” মুচকী হেসে ও বলেছিলো, “ব্যপারটা অনেকটাই তাই।”

ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্না অপরূপ সুন্দরী ও প্রগলভা মেয়েটির ঠোঁট ভরা মধু, গাল ভরা সুগৌর লালিত্য। এমন মেয়ের আশেপাশে প্রলুদ্ধ ভ্রমরের গুঞ্জরণ থাকাটাই স্বাভাবিক। সব কিছু ছাড়িয়ে মেয়েটি আমাকেই বেছে নিলো? ভাগ্য বলতে হবে আমার। আকর্ষণ-বিকর্ষণেরও তাহলে রকমফের আছে। কে যে কখন কার দিকে ছুটে যায়! প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়! কোন গ্রহ কোন ধুমকেতুকে কাছে টানবে, কোন উল্কা ছুটে এসে তার বুকে আছড়ে পড়বে কে জানে? কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম, “নারীমন একবার যেদিকে ছুটিয়া চলে সেদিক হতে সহজে তাকে নিবৃত করা যায়না।”

আমার স্মৃতি রোমন্থনে বাধা দিয়ে টেলিফোনটি বেজে উঠলো। বৃষ্টি কি? না, আমার স্ত্রীর ফোন
আমিঃ হ্যালো।
স্ত্রীঃ তুমি বাসায়?
আমিঃ হ্যাঁ, বাইরে কোথাও যাবোনা তো ঠিক করেছি।
স্ত্রীঃ একা একা বোর ফীল করছো না তো?
আমিঃ না, টিভি দেখছি।
স্ত্রীঃ কফি খেতে পারো। আমি তোমার জন্য ন্যাচারাল বীন গুড়ো করে রেখেছি।
আমিঃ ওকে, থ্যাংক্স।
স্ত্রীঃ আমি বেশি সময় থাকবো না প্রিয়। দ্রুত চলে আসবো।
আমিঃ ওকে, ওয়েটিং।
টেলিফোনে মৃদু চুমু খাওয়ার শব্দ করলো আমার স্ত্রী। আমিও জবাব দিলাম।

পুরনো দিনের একটা গান মনে পড়ে – ‘আগে ছিলো শুধু পরিচয়, পরে হলো মন বিনিময়, শুভ লগ্নে হয়ে গেলো শুভ পরিনয়।’ আমাদের সম্পর্কটাও ওরকম। সম্পর্কটা দ্রুত পরিনয়ের দিকে ছুটে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ ছিলো – মনের মিলনের পাশাপাশি শরীরের নিবিড়তম সান্নিধ্য। এদেশে শারীরিক সম্পর্কটা তেমন ব্যাপার না। প্রায় সব ছেলে-মেয়েই বিয়ের আগে একাধিকের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। বিদেশী ছেলে-মেয়েরাও এখানে কিছুকাল থাকার পর ঐ ক্যরাকটারটি পেয়ে যায়। ব্যতিক্রম থাকে দু’একজন। আমি সেই ব্যাতিক্রমের একজন ছিলাম। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার শারিরীক সম্পর্ক হয়েছিলো মাত্র একজনার সাথে। সেই এখন আমার স্ত্রী। আমার মনে আছে। প্রথম যেদিন ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়, তার পরদিন আমাকে একটা ভীষন অপরাধবোধ চেপে ধরে। এক ধরণের বিষন্নতা ও হীনমন্যতা আমাকে পেয়ে বসেছিলো। একজন বাংলাদেশী হিসাবে সেক্সকে টাবু মনে করতাম সব সময়। বারবার ভাবছিলাম, উত্তেজনা আর যৌবনের টানে সিডিউসড হয়েছি সত্য, কিন্তু কাজটা কি ঠিক হয়েছে? আমার স্ত্রীও ব্যতিক্রমীদের একজন, সেও আমার আমার সাথে সম্পর্কের আগে কুমারী ছিলো। একদিকে মনে হয়েছিলো, সূর্য-নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকে ছুঁয়ে ফেলেছি, আরেকদিকে বুকের উপর একটা ভার ধীরে ধীরে বেড়ে চললো। অপরাধবোধটা আমাকে এতো বেশী চেপে ধরেছিলো যে, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ওকে বিয়ে করবো। যাহোক কিছুকাল পরে সেই গার্লফ্রেন্ড যখন স্ত্রী হলো, ঐ প্রাক বিবাহ সম্পর্কটি নিয়ে আর আমার মধ্যে কোন অপরাধবোধ রইলো না।

আমার চিন্তায় ছেদ ঘটিয়ে হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে বৃষ্টির নাম দেখাচ্ছে। চট করে মনটা খুশী হয়ে উঠলো।
আমিঃ হ্যালো।
বৃষ্টিঃ আমি।
আমিঃ বুঝতে পেরেছি।
বৃষ্টিঃ ফোন করেছিলেন?
আমিঃ করেছিলাম তো, ধরলেন না।
বৃষ্টিঃ সরি সরি। আমি শাওয়ারে ছিলাম।
আমিঃ ও আচ্ছা।
বৃষ্টিঃ কি করছেন?
আমিঃ তেমন কিছু না। ফিল্ম দেখছি। আপনি?
বৃষ্টিঃ হট একটা শাওয়ার নিলাম। এখন বাইরে কোথাও যাবো শপিং-এ।
আমিঃ লাঞ্চ করবেন না?
বৃষ্টিঃ বাইরে যাচ্ছি তো। ওখানেই ম্যাকডোনাল্ডসে লাঞ্চ করে নেবো।
আমিঃ (হঠাৎ করেই মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো) একাই যাচ্ছেন?
বৃষ্টিঃ একাই তো। দোকা পাবো কোথায়? আমিতো আর আপনার মতো ম্যারেড না।
আমিঃ ও, ভালো। আমাকে নেবেন আপনার সাথে শপিং-এ (আবারো মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো। নিজেই অবাক হচ্ছিলাম কেন এসব বলছি!)
বৃষ্টিঃ ওমা, আপনিও যাবেন নাকি আমার সাথে? গিন্নি কোথায়?
আমিঃ আমার গিন্নিও শপিং-এ গিয়েছে।
বৃষ্টিঃ ও তাই বুঝি আমার সাথে এতো কথা!
আমিঃ সরি এম্নিই বলেছিলাম। কিছু ভেবে বলিনি।
বৃষ্টিঃ না না। ইট্স ওকে। আমিও ঠাট্টা করছি।
আমিঃ কাল তো অফিস।
বৃষ্টিঃ হ্যাঁ, কিন্তু কাল তো আমাদের দেখা হচ্ছে না। মঙ্গলবার আমাদের ক্লাস।
আমিঃ ওকে টিল টুইসডে।
বৃষ্টিঃ ওকে।
রেখে দিলাম টেলিফোনটা।

এক কাপ ধুমায়িত কফি নিয়ে বেলকুনিতে এসে বসলাম। আমার এ্যাপার্টমেন্টের বেলকুনিটি বিশাল। আমি এখানে কয়েকটি চেয়ার পেতেছি। শীতের ঋণাত্মক তাপমাত্রায় এখানে বসার প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু সামারে এখানে বসে কফি খাওয়াটা আমি বেশ এনজয় করি। কফি খেতে খেতে আমার সাদামাটা চোখ দুটিকে গ্রীস্মের মস্কোর মেঘমুক্ত আকাশের দিকে দূর-নিবদ্ধ করে মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো। এদিকে গোধুলির আকাশ ম্লান হতে হতে একসময় তমসায় ছেয়ে গেলো, সেই সাথে নিম্নলোকে ঝলমল করে উঠলো পারমানবিক শক্তিতে প্রজ্জ্বলিত একটি অত্যাধুনিক নগরী। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো ইউরোপের বৃহত্তম এবং পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম নগরী। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক কেন্দ্র। রুশ ভাষায় মস্কোকে বলা হয় মস্ক্ভা। রাশিয়ার অধিকাংশ ঐশ্বর্যভান্ডার মস্কোয় অবস্থিত। জগদ্বিখ্যাত হীরক ভান্ডার থেকে শুরু করে ত্রেতিকোভ আর্ট গ্যালারী ও পুশকিন ভ্যিজ্যুয়াল আর্ট মিউজিয়াম রয়েছে এখানে। রাজধানীর অতিথিদের পরিচয়পর্ব মস্কোর সাথে শুরু হয় ক্রেমলিন দিয়ে। ক্রেমলিন (রুশ ভাষায় ক্রেমেল) শব্দের অর্থ দুর্গ। একসময়ের দুনিয়া কাঁপানো জারের এই দুর্গের ভিতর রয়েছে একাধিক প্রাসাদ ও নয়ানাভিরাম বাগিচা। এখান থেকেই জার পরিচালনা করতেন এশিয়া ও ইউরোপ জুড়ে থাকা বিশাল সাম্রাজ্য। সেই ক্রেমলিন আজ রাষ্ট্রপতির ভবন। এই ক্রেমলিনের ভিতরেই রয়েছে বিখ্যাত হীরক ভান্ডার (Diamond Fund)। যেখানে অনেক মনি-মানিক্যের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে পৃথিবীর সব চাইতে বড় হীরক খন্ড আরলোভ (Orlov) মস্কো শহরটিকে আমি গ্র্যারন্ড শহর বলি। সেই গ্র্যাান্ড নগরী মস্কোয় নব্বইটিরও বেশি পরিদর্শন হল, ১৮০টি থিয়েটার, ৩৫০টি মিউজিয়াম ও নয় শতাধিক গীর্জা রয়েছে। মস্কোর বুক চিরে চলে গিয়েছে মস্কো নদী এই নদীর নীচ দিয়ে গিয়েছে মেট্রো রেলের পথ, আর উপরে চলে বাহারী জাহাজ। সেই জাহাজে চড়ে নদী ভ্রমণ করলে দুই তীরে দেখা যায় সগর্বে মাথা উঁচু করে থাকা অগনিত সোনালী গির্জার চূড়া।
সুপ্রাচীন ও বিশাল নগরী মস্কো জ্ঞান চর্চারও একটি কেন্দ্র বটে। এখানে রয়েছে ২২২টি বিশ্ববিদ্যালয়, এদের মধ্যে ৬০টি স্টেট ইউনিভার্সিটি। এছাড়া রয়েছে অগনিত রিসার্চ সেন্টার। ভোরোভিওভি পাহাড়ে দাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত হয়ে থাকা মস্কো নগরীর দৃশ্য মনোহর। তার উল্টো দিকেই রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির সুদৃশ্য ২৪০ মিটার উঁচু গগনচুম্বী অট্টালিকা। তার চতুর্দিকের নয়ানাভিরাম বাগানটিও কম যায়না। নিসর্গ আর নির্মানের অপূর্ব সমন্বয়।

কম্যুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসীরা রেড স্কোয়ারে শায়িত লেনিন মৌজলিয়াম পরিদর্শন করতে আর পাশ্চাত্য দেশীয়দের আগ্রহ মস্কোর অন্যতম কেন্দ্রস্থল তাগানকায় স্তালিনের ভূগর্ভস্থ নিরাপদ আশ্রয়স্থল দেখতে উদগ্রীব থাকে, সেখানে এখন খোলা হয়েছে শীতল যুদ্ধের স্মৃতিশালা।

মস্কোর যে জিনিসটি আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিলো ও এখনো ভীষণ উপকার করে তা হলো মস্কোর পাতাল রেল, যাকে ওরা মস্কো মেট্রো বলে। মস্কোর প্রায় সমগ্র এলাকা জুড়ে বিস্তৃত পাতাল ট্রেন ব্যবস্থা। এটি বিশ্বের ব্যস্ততম মেট্রো। ১৯৩৫ সালে চালু হওয়া এই আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমে রয়েছে ১২টি লাইন ও ১৮৮টি স্টেশন । ৮৪ মিটার গভীর স্টেশন পার্ক পাবেদি বিশ্বের গভীরতম পাতাল রেল স্টেশন। সব চাইতে মন কাড়া হলো এর স্টেশনগুলির কারুকাজময় নকশা । নানা ধরনের মুরাল, মোজাইক, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য্য ও ঝাড়বাতিতে চিত্তগ্র্রাহী শোভায় শোভিত স্টেশনগুলো। আমার এক লন্ডনী বন্ধু মস্কোর মেট্রো স্টেশনের জৌলুস ও শিল্প-সৌন্দর্য্য দেখে বিস্ময়াভুত হয়ে প্রশ্ন করেছিলো, “এরা এক একটা স্টেশনের পিছনে এতো টাকা-পয়সা খরচ করলো কেন?”

১৯১৭ সালে থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলো কম্যুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল। যারা যখন ক্ষমতায় থাকে তারা তখন সমগ্র জাতিকেই ঐ পথে পরিচালিত করতে চায় বা করে। তাই সেই সময়ে মস্কোর চিত্র ছিলো একরকম। সেই চিত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বচ্চো অর্জনের ছাপ ছিলো নিঃসন্দেহে, কিন্তু ছিল না কোন জৌলুস। আবার ১৯৯০ সালে ঘটে এর ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বকে বিস্মিত করে রাশিয়া তারই প্রদর্শিত পথ ছেড়ে ফিরে আসে পুঁজিবাদে। ক্যাপিটালিজমের গরিমায় নাইটক্লাব, ক্যাসিনো, বার, শপিং মলে নব্যরুপে ঝলমল করে ওঠে মস্কো।

——————————-*————–*———————-

মঙ্গলবার ক্লাস নেয়ার পর যথারীতি বৃষ্টির সাথে দেখা হলো। আজ তার পড়নে শাড়ী নেই সত্য, তবে সাদা টপস্ ও বেগুনী রঙের স্কার্ট-এর ঐ ইউরোপীয় পোষাকেও ওকে চমৎকার লাগছে। তার লাবণ্য ও দেহের দীপ্তি-সৌরভে যেকোন পুরুষেরই মন নেশায় রঙিন হয়ে উঠবে। সুন্দর পরিপূর্ণ প্রসন্ন দৃষ্টি, গভীর কালো চোখের অতল থেকে কোন এক অনুভুতির আভা স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। দুজনের মধ্যে স্থানের ব্যবধান কম হলেও দেহ বা মন কোন কিছুর স্পন্দনই কেউ প্রকাশ করছি না। বৃষ্টির হাতের দু’য়েকটি আঙুল মুহুর্তেই চঞ্চল হয়ে পরক্ষণেই স্থির হয়ে গেলো। আমি ওষ্ঠধর সামান্য কম্পিত করে মৃদু সুরে বললাম,

আমিঃ কেমন আছেন?
বৃষ্টিঃ ভালো। চলুন লাঞ্চে যাই।
আজ লক্ষ্য করলাম অনেকেই মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। রাশানরা সাধারনত এতো উৎসুক হয়না। তারপরেও একেবারে নির্লিপ্ত নয়। আমরা বাংলাদেশীরা যেমন পুরুষ মানুষরা এক হলে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করি। আর মেয়েরা একত্র হলে প্রেম নিয়ে আলাপ করে। রাশানরাও তাই।
আমাদের দিকে মেয়েরাই বেশী তাকাচ্ছিলো। আমি ভাবলাম ওরা এমন করছে কেন? গত দিন অনেক সময় লাঞ্চ টেবিলে বসে ছিলাম তাই? হতে পারে। ওরা কোন ব্যক্তিগত সম্পর্কের গন্ধ পাচ্ছে হয়তো।

আমিঃ কেমন যাচ্ছে দিন?
বৃষ্টিঃ (রহস্যময় হাসি হেসে বললো) মন্দ নয়।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য টার্ম দুটি শুনি আসছি সেই স্কুলজীবন থেকে। মোটের উপর যা বুঝতাম তা হলো, এশিয়ার দেশগুলি হলো প্রাচ্য আর ইউরোপীয় দেশগুলি হলো পাশ্চাত্য (প্রতিচ্য)। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের কোর্স করার পর তার নিগূঢ় অর্থ বুঝতে পেরেছি। প্রাচীনকালে দুটি বৃহৎ সাম্রাজ্য ছিলো, একটির নাম ছিলো রোম সাম্রাজ্য, আরেকটির নাম পারস্য সাম্রাজ্য। এরা ছিলো পরষস্পরের শত্রু। দুয়ের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকতো। সেই রোম থেকে পারস্য অভিমুখে অভিযান চালাতে হলে সৈন্যদের অগ্রসর হতে হতো পূর্ব দিকে, বিপরীতক্রমে পারস্য থেকে রোম অভিমুখে অভিযান চালাতে হলে সৈন্যদের অগ্রসর হতে হতো পশ্চিম দিকে। সেই থেকেই রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে বলা হয় পাশ্চাত্য আর পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে বলা হয় প্রাচ্য। এই দুয়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনা, জীবনধারা সবই ভিন্ন। তাই তারা কখনোই একে অপরকে বুঝতে পারেনি। east is east, and west is west, and never the twain shall meet. কথাটি বলা হয়েছিলো কবি Rudyard Kipling. লিখিত The Ballad of East and West কবিতায়। প্রাচ্যের লোকেরা একটু আধ্যাত্মবাদী আর পাশ্চাত্যের বাসিন্দারা অনেকটাই বস্তুবাদী। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই। প্রেম বলতে পাশ্চাত্যরা বোঝে দেহের স্বাদ, আর আমরা প্রাচ্য দেশীয়রা বুঝিসর্বাতিক্রমী এবং পারমার্থিক অর্থে রূপের অতীত অপরূপ সৌন্দর্য্যকে। দেহের চাইতে মনের স্বাদ বেশী পেতে চাই আমরা প্রাচ্যবাসীরা।

আমিঃ অফিসের পরে কি করেন?
বৃষ্টিঃ এক এক সময় এক এক রকম।
আমিঃ মানে?
বৃষ্টিঃ মানে এ’ কয়দিন অফিস টাইমের পর আপনার কবিতাগুলো পড়েছি।
আমিঃ ও আচ্ছা। (মনে মনে খুশী হলাম)। ওখানে একটা কবিতা আছে ‘আজ তাকে শাড়িতে দেখেছি’, ঐ কবিতাটা পড়েছেন?
আমাকে অবাক করে ও ব্যাগ খুলে বইটা বের করলো তারপর ঠিক পেইজটা খুঁজে বের করে দেখিয়ে বললো
বৃষ্টিঃ এই কবিতাটি তাই না?
আমি স্পষ্ট কবিতাটি দেখলাম

আজ তাকে শাড়ীতে দেখেছি
—————————ডঃ রমিত আজাদ

মেয়েটিকে প্রায়ই দেখি,
অসম্ভব সুন্দর, নিস্পাপ একটি মুখ,
বৃষ্টির পরে সবুজ সতেজ ঘাস যেমন,
কখনো তুলনা করি বন ছেয়ে যাওয়া পিংক কাসিয়ার সাথে,
ঐ সৌন্দর্য থেকে চোখ সরানো যায়না।
তার অনুপস্থিতি আমার মাঝে শূণ্যতার সৃষ্টি করে।
আবার কখনো কখনো তাকে দেখি,
অনেক মানুষের ভীড়ে হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয়,
অনেকটা দক্ষিণা হাওয়ার দিনে,
গাছের পাতা আর সুর্যের আলোর লুকোচুরির মত
আর আমার চোখ ফিরে ফিরে আসে নতুন মুগ্ধতা নিয়ে।

ব্যাতিক্রম কেবল তার পোশাক,
আধুনিক যুগে সব মেয়ে আর অস্টপ্রহর বাঙালী পোশাক পড়েনা,
সালোয়ার-কামিসের পাশাপাশি
প্যান্ট-শার্ট, স্কার্ট-টপস চলছে বেশ,
একসময় এগুলো ছিল নিতান্তই অপ্রচলিত,
ইন্টারনেট আর আকাশ সংস্কৃতির যুগে,
এখন এটাই হয়ত রীতি।

বাঙালী নারীর আজন্ম লালিত পরিচ্ছদ
শাড়ীটা এখন একেবারেই আনুষ্ঠানিক হয়ে গিয়েছে,
খুব ইচ্ছে হতো চপলমতি ইনোসেন্ট ঐ মেয়েটিকে
একবার শুধু শাড়ীতে দেখতে।

অবশেষে দেখলাম,
অপ্রত্যাশিত একটি জায়গায়, হঠাৎ করেই সে,
ফিরোজা রঙের চমৎকার কারুকাজ করা শাড়ী পড়া,
আমি থমকে গেলাম,
অপ্সরী দেখিনি সত্যি,
কিন্তু ঠিক ঐ মুহুর্তে মনে হলো,
সেই তো অপ্সরী ।

চপলমতি হেটে গেল বাতাসে ঢেউ তুলে,
যেন পাহাড়ী ঝর্নার গায়ে ঝরে ঝরে পরছে সোনালী ফুল,
তখনো নামেনি সন্ধ্যা এই ব্যাস্ত নগরীতে,
বসন্ত এলো এলো বলে ঐ আকাশটাও পুরোপুরি নীল।
শাড়ী? হ্যাঁ শাড়ীই তাকে এতটা সুন্দর করেছে,
শাড়ীই তাকে দিয়েছে রমণীর রূপ,
আচ্ছা এই সুন্দর বসনটি কি চিরস্থায়ী হতে পারেনা?
চিরস্থায়ী সৌন্দর্য হয়ে তুলুক ঢেউ দক্ষিণা হাওয়ায়,
নন্দনের প্রসুন হয়ে বসন্ত বাগানে ফুটুক কামিনী,
তোমাকে আমি বারবার শাড়ীতে দেখতে চাই রমণী।

আমিঃ হ্যাঁ। এই কবিতাটাই।
বৃষ্টিঃ আপনার স্ত্রীর নাম কি?
আমিঃ তানিয়া।
বৃষ্টিঃ বাহ্ সুন্দর নাম তো! উনাকে কি দেশ থেকে বিয়ে করে এনেছেন না এখানেই আপনাদের পরিচয়?
আমিঃ এখানেই পরিচয়।
বৃষ্টিঃ এখানেই পরিচয়, এখানেই বিয়ে? তা বাবা-মাকে জানিয়ে বিয়ে করেছিলেন, না কি না জানিয়ে?
আমিঃ আমি বিয়ের পরে বাবা-মা-কে জানিয়েছিলাম। আর ওর বাবা-মা তো এখানেই থাকে।
বৃষ্টিঃ (একটু অবাক হয়ে) বুঝলাম না। উনার বাবা-মা এখানে থাকে মানে?
আমিঃ আমার স্ত্রীতো মস্কোর মেয়ে।
বৃষ্টিঃ রাশান?
আমিঃ হ্যাঁ। নাম শুনে বুঝতে পারেন নি?
বৃষ্টিঃ তানিয়া নাম তো বাঙালী মেয়েরও হয়।
আমিঃ তা হয়। নামের ব্যপারে তো আমরা বাঙালীরা খুব লিবেরাল। যে কোন ভাষার, যে কোন দেশের নামই রাখি। তানিয়া নামটি তো অরিজিনালী রাশান নাম তাতিয়ানার সংক্ষেপটাই তানিয়া।
বৃষ্টিঃ হ্যাঁ তাই। রাশান স্ত্রী, শাড়ী পড়ে?
আমিঃ না।
বৃষ্টিঃ এ জন্যই বোধহয় শাড়ীর প্রতি আপনার বিশেষ দুর্বলতা আছে।
মনে মনে ভাবলাম মেয়েটি ঠিকই ধরেছে। আমি যখন কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দিয়েছিলাম, তখন আমি মনে মনে এক প্রেমিকার ছবি কল্পনা করতাম। আমার কল্পনার সেই প্রেমিকার পড়নে থাকতো নীল রঙের শাড়ী। সাগরের জলের গভীরতার মতো নীল। মনে করতাম, কোন এক সমুদ্র সৈকতে আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে হেটে যাচ্ছি, আর সাগরের সৈকতে আছড়ে পরা ঢেউগুলো ফেনিল স্বচ্ছ জল হয়ে আমাদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। সাগরের বেয়ারা বাতাসে ওর আচলটা উড়ছে। সাথে যোগ দিয়েছে মাথার কালো চুল গুলো। ও হয়তো এত সব লক্ষ্য করেনি। কিন্তু আমার চোখ কিছুতেই ফাঁকি দিচ্ছে না। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য দেখছি।

কবিতাটি আমার নিজেরই ভীষণ ভালো লাগে। ক’দিন আগে ও নিজেই তো শাড়ী পড়ে এসেছিলো। আমি ভেবেছিলাম ও বলবে যে, ওর ভালো লেগেছে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, “আমার কিন্তু ‘অনিয়মের ভালো লাগা’ কবিতাটিই বেশী ভালো লেগেছে”। ‘অনিয়মের ভালো লাগা’ আমার লেখা আরেকটি কবিতা। একজন বিবাহিত তরুণের আরেকটি মেয়েকে ভালোলাগা নিয়ে একটি কবিতা। আমার মনে আছে, আমি কবিতাটি ছাপানোর পর আমার এক বন্ধু বলেছিলো, “হোপ দিস ইজ নট এ, রিয়েল স্টোরী, তবে অসাধারণ হয়েছে।” বৃষ্টি হঠাৎ করে এই কবিতাটির কথা বললো কেন? তবে কি এটা ওর তরফ থেকে একটা গ্রীন সিগন্যাল?
(চলবে)

অনিয়মের ভালো লাগা
——ডঃ রমিত আজাদ

তোমাকে আমার ভালো লেগেছে,
কিন্তু কি করে বলি বলতো?
আর তুমিই বা কিভাবে নেবে?
আমার কি আর সে বয়স এখন আছে?
যৌবন পেরিয়ে চলে এসেছি অনেকটা দূর,
আর তোমার তো মাত্র শুরু,
তদুপরি আমার পাশে রয়েছে ভিন্ন এক রমণী।
যদি আমি সাহস করে বলেই ফেলি,
যদি তুমি ফুঁসে ওঠো,
যদি এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে শহরময়,
আমি কি ধিক্কৃত হব না?
তোমাকে কেমন করে বোঝাই,
আমার বুক জুড়ে চলছে,
উত্তপ্ত আগ্নেয় লাভার তীব্র তোলপাড়।
তোমার ঘুরে দাঁড়ানোর ছন্দময় স্নিগ্ধতা,
আমার অতৃপ্ত আত্মার মরুময়তা,
বিন্দু বিন্দু করে জমা হওয়া নিস্পেষণ ,
আমার আবেগের আল্পনায় স্নিগ্ধ অনুরণন,
তোমার মমতা খেলে আমার কবিতা হয়ে,
এই গুমোট নগরীর জমাট আঁধার কেটে দিয়ে,
ঐ যে শুনেছিলাম ভালোবাসার কোন বয়স নেই,
তখন বুঝিনি, আর এখন বুঝতে পারছি বেশ,
আমার না বলা কথা ভবঘুরের মত ঘোরে,
নীরব বিবেকের অলিগলিতে,
নিয়ম মেনে চলাই যেখানে রীতি,
সেখানে অনিয়ম চলেনা,
আমি তো নিতে পারব না, জন্ম নতুন এক।
তাই আর হয়না বলা,
কেবল স্বগতোক্তির মত নিজের কথা নিজেকেই বলি,
সেকথা তোমাকে বলা হবে না হয়ত কোনদিনও,
কিণ্তু তোমাকে আমার সত্যিই ভালো লেগেছে।

১,২১৯ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “অনিয়মের ভালো লাগা (গল্প) – পর্ব ১”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    অসাধারন হয়েছে ভাই। এখন আর কবিতা পড়া হয় না তেমন তবে গল্পের মধ্যে কবিতাগুলো অসাধারন হয়েছে। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। পরের পর্ব কবে আসছে? অপেক্ষায় থাকলাম।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।