রৌদ্রছায়ার লুকোচুরী
—————– ডঃ রমিত আজাদ
এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। গোধুলির ম্লান আলোয় সবকিছুই কেমন রহস্যময় মনে হয়। দিনের এই সময়টা আমার কাছে সবসময়ই আকর্ষণীয়। ঢাকার সিদ্ধেশরীর ইস্টার্ন হাউজিং এপার্টমেন্টের ক্রীম কালারের পনেরটি দালানই মুগ্ধকর মনে হচ্ছিলো এই আলোয়। এপার্টমেন্টের কমপ্লেক্সের ইন গেইট টা দিয়ে ঢুকে, হেটে হেটে আমাদের বিল্ডিংটার দিকে এগুচ্ছিলাম, চলার রাস্তাটি ইন গেইট দিয়ে সোজা আমাদের বিল্ডিংটা পর্যন্ত ছুটে গিয়েছে। আমার ডানে-বাঁয়ে উঁচু উঁচু ছ’তলা ভবনের সারি, আমাদের বিল্ডিং-এর কাছাকাছি এসে উপরের দিকে তাকাতেই চারতলার একটি রূমের জানালার পর্দা হঠাৎ নড়ে উঠলো। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কেউ একজন পর্দার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছিলো। আমি তাকাতেই চকিতে সরে যায়। তবে কি, ঐ মেয়েটি?
এই এ্যপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে এসেছি দেড় বছর হলো। এখনো সবার সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে পারিনি। এম্নিতেই নতুন জায়গায় আসলে সবার সাথে চেনাজানা হতে একটু সময় লাগে, তাছাড়া আমার ছিলো এইচ, এস, সি, পরীক্ষা, সেটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম ভীষণ। তার উপর আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, ঢাকার মগবাজার, রামপুরা, মালিবাগ এই জাতীয় মধ্যবিত্ত এলাকাগুলোর চাইতে সিদ্ধেশরীর এই অভিজাত এ্যপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের পরিবেশ অনেকটাই ভিন্ন। এখানে একের ব্যপারে অন্যের দৃষ্টি, গরজ, মাথাব্যথা, খুব একটা নেই।
নস্টালজিয়া! ইদানিং ঘটে যাওয়া একটি বিশেষ ঘটনার পর আমার অনেক অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি মনে পড়লো। এখন রাত দুটার মতো বাজে। কোন এক অস্থিরতায় ঘুম আসছে না। ঘুম না আসা পর্যন্ত ইন্টারনেটে বসে সময় কাটানো যায়। ফেইসবুকে চ্যাট করা যায়, স্কাইপে কথা বলা যায়, আধুনিক প্রযুক্তি যে কত সুযোগ খুলে দিয়েছে! সমগ্র পৃথিবীকে এনে দিয়েছে একেবারে আঙুলের ডগায়। সেটাও ইচ্ছা করছে না। মাঝে মাঝে মনটা এমন হয়ে যায় কেন বুঝিনা! পাশের কিচেনে গিয়ে এক কাপ গরম কফি বানিয়ে নিয়ে এলাম। কফি খেলে ঘুম হয়না বলে প্রচলিত আছে। আমার কিন্তু সেরকম না। কয়েক কাপ কফি খেয়েও আমি গাঢ় ঘুম ঘুমাতে পারি। তবে ঘুমের ব্যপার আসছে না। আমি স্রেফ কফি খেতে চাইছি। সুবাসিত ন্যাচারাল বিনের কফির কাপটি হাতে নেয়ার পর বুঝলাম, আসলে আমি নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য কফির পেয়ালা হাতে নিয়েছি। এই মুহুর্তে এই ধুমায়িত কফির কাপটিই আমাকে সঙ্গ দেবে।
মস্কোর এই বহুতল ভবনের বারো তলার এপার্টমেন্টের বিশাল কাঁচের জানালা দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। জানালার ডান পাশে দেখা যায় বড় বড় গাছে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া বিস্তৃত ফরেস্ট পার্কের একাংশ, সামারে সেখানে জন্মে থাকে অজস্র আপেল, পাম, নাশপাতি আর চেরিফলের গাছ। তার কিছু আগে ঐ গাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকে। গোরায় জন্মানো সবুজ ঘাসে আল্পনা আঁকে ঝরা ফুলের পাঁপড়ি, তবে এখনো সামার আসেনি, তাই পত্র-পল্লবহীন গাছগুলো শুধুই ডালপালা নিয়ে রিক্ততা প্রদর্শন করছে।আর বাঁ দিকে দেখা যায় অলিম্পিক স্টেডিয়ামের একাংশ, স্টেডিয়ামের এই অংশটিতে ওয়াটার আইটেম গুলো হয়, তাই তার সুদৃশ্য লেকটি চোখ কেড়ে নেয়। কিন্তু এই মুহুর্তে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, একে তো রাতের অন্ধকার, তার উপর বাইরে প্রচন্ড স্নো ফল হচ্ছে। অবিরাম এই তুষারপাত হয়তো কাল সকাল পর্যন্ত চলবে। তুষারপাতই কি আমার মনটাকে এমন বিষন্ন করে দিলো? হতে পারে। আপাতত ধুমায়িত কফির কাপটি নিয়ে একটা চেয়ার টেনে জানালার সামনে বসে গেলাম। কফি খেতে খেতে তুষারপাত দেখবো। গরম কফিতে একটি চুমুক দিয়ে আমি আবার স্মৃতি রোমন্থনে ফিরে গেলাম।
এইচ, এস, সি, পরীক্ষার আগে সময় বলতে তেমন কিছু ছিলনা। পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বেশি। একটু টেলিভিশন দেখারও ফুরসৎ হয়নি। এরমধ্যে বাড়ীতে আবার ভি,সি,আর, কেনা হয়েছে। সেই সময় খুব কম বাড়িতেই এই অত্যাধুনিক দামী যন্ত্রটি ছিলো। সেখানে সবাই মূলতঃ হিন্দি বলিউড মুভিই দেখতো। ওহ্, কি এক্সাইটিং সব নায়ক-নায়িকা! অমিতাভ বচ্চন-জীতেন্দ্র-ধর্মেন্দ্র-শ্রীদেবী-জয়া প্রদা-রেখার ঝলমলে সব সিনেমা দেখার কি যে সুযোগ! আগে সিনেমা দেখতে চাইলে সিনেমা হলে যেতে হতো, আর এখন বাড়ীটাই একটা মিনি সিনেমা হল। কিন্তু আমার জন্য সবই বৃথা। এইচ, এস, সি, পরীক্ষা এই সময় ভি,সি,আর, দেখা হারাম। মাকে বললাম, “মা, তুমি আর সময় পেলেনা, একেবারে আমার পরীক্ষার আগে আগে ভি,সি,আর, কিনলে?” মা বললেন, “থাক বাবা, মাত্র তো আর কটা দিন, পরীক্ষা শেষ হলেই যত খুশী তত ভি,সি,আর দেখবি।”
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর কিছুটা রিলিফ হলেও ১০০% ফ্রী হইনি। এস, এস, সি, পরীক্ষার পর তিনমাস যেমন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়েছি, এইচ, এস, সি, পরীক্ষার পর আর সেটা সম্ভব হয়নি। ভর্তি যুদ্ধটা তখন বাংলাদেশে ছিলো প্রবল। এইচ, এস, সি, পরীক্ষার পর আবার নতুন করে পড়ালেখা শুরু করতে হতো, কোথাও চান্স পাওয়ার জন্য। লক্ষ লক্ষ ছাত্র পাশ করে বেরিয়েছে কিন্তু উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সীট আছে মাত্র কয়েক হাজার। সেই কয়েক হাজারের মধ্যে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে, করতে হয় যুদ্ধ।
তাই পরীক্ষার পর পড়ালেখা কিছু কমালাম না, বরং ভর্তি হয়ে গেলাম একটি কোচিং সেন্টারে। পাশাপাশি একটা টিউশানি জুটিয়ে নিলাম। টিউশানির টাকায় হাতখরচটা উঠে যায়। বাবা বলেছিলেন, “টুউশানিটা না করলেও পারিস। হাত খরচার টাকা যা লাগে আমার কাছ থেকে নিস।” মা বলেছিলেন, “না, টিউশানি করলে সময়টা লেখাপড়ার মধ্যেই কাটে, আবার নিজের উপার্জনের টাকা নিজে স্বাধীনভাবে খরচ করা যায়, মেরুদন্ডটাও সোজা থাকে।” কোচিং-এ পড়ালেখা হয়। নতুন বন্ধুদের সাথে সময় কাটে। বিকেলটা ওখানেই কাটে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে ঘরে ফিরি।
আজ কোচিং ছিলোনা। বিকাল চারটার দিকে বাইরে বেরুলাম। ভাবলাম বেইলি রোড হয়ে রমনার গ্রীনে একটু হেটে আসবো। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতেই দেখি কাজল ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।
কাজল ভাইঃ আরে, শিশির তুমি?
আমিঃ জ্বী।
কাজল ভাইঃ কোথায় যাও?
আমিঃ এই তো, একটু বেইলী রোড দিয়ে হেটে আসি।
কাজল ভাইঃ আরে ধুর বেইলি রোডে কি যাবে! এখানেই হাটি এসো।
কাজল ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে গত মাসে। ছোটখাটো গড়নের মানুষটি বেশ অমায়িক। বয়সে আমার চাইতে বছর দুয়েকের বড় হবেন। তারপরেও ভালো খাতির হয়ে গেছে।
আমিঃ এখানে হেটে কি হবে? ছোট্ট এ্যপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স!
কাজল ভাইঃ আরে এইখানেই বেশী মজা।
আমিঃ কি মজা?
কাজল ভাইঃ খিল্লি খাই।
আমিঃ ‘খিল্লি খাই’ – মানে কি?
কাজল ভাইঃ ভালো করে দেখো।
আমিঃ এখন মাত্র দুপুর শেষ হয়ে বিকেল শুরু হলো। আশেপাশে তো আমি আর আপনি ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা ।
কাজল ভাইঃ আরে ঐ দিকে দেখো।
কাজল ভাইয়ের নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাইকেলের উপর একটি মেয়ে বসে আছে।
আমিঃ ও আচ্ছা, এই ব্যপার! (মুচকি হেসে বললাম আমি।)
কাজল ভাইও মুচকি হাসলেন।
আমি মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকালাম। শ্যামবর্ণের মোটামুটি সুন্দরী এই মেয়েটির বয়স ষোল খুব বেশী হলে সতের বছর হবে। এই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে একমাত্র ঐ মেয়েটিই সাইকেল চালায়। অল্প বয়সের কারণে একটা স্নিগ্ধতা সবসময়ই থাকে তার উপর মেয়েটি সাইকেল চালায় বলে কিছুটা হলেও আকর্ষণীয়া।
আমিঃ আপনার পছন্দের প্রশংসা না করে পারলাম না কাজল ভাই।
কাজল ভাই লাজুক হাসলেন।
আমিঃ মেয়েটি আপনার সাথে কি করে বললেন?
কাজল ভাইঃ খিল্লি খায়।
আমিঃ মানে কি?
কাজল ভাইঃ বুঝলা না?
আমিঃ টাংকি মারে?
কাজল ভাইঃ হ্যাঁ।
আমি একগাল হাসি হেসে বললাম
আমিঃ বুঝলাম।
কাজল ভাইঃ আচ্ছা শিশির, ‘টাংকি মারা’ কথাটা আসলো কি করে?
আমিঃ ছাদের পানির টাংকি-র উপর দাঁড়িয়ে এ ওর দিকে তাকায়, ইশারা দেয়, এটা ওটা বলে, সেই থেকে ‘টাংকি মারা’ কথাটা এসেছে।
কাজল ভাইঃ ও। আর ‘ফিল্ডিং মারা’?
আমিঃ ছাদ টাংকি এগুলো তো বেশীদিন হয়নি এসেছে। বহুতল ভবন আসার পর এসেছে। এর আগে ইশারা-টিশারা দেয়া তো ফিল্ডে বসেই হতো। সেখান থেকেই ‘ফিল্ডিং মারা’ কথাটি প্রচলিত হয়েছে।
কাজল ভাই দুগাল হাসলেন
কাজল ভাইঃ তার মানে মানুষ যুগে যুগে খিল্লি খেত?
আমিঃ তাই তো বুঝি, আজকালকার কথা তো না, সেই পৌরানিক যুগেই প্যরিসের সাথে হেলেনের সম্পর্কের কারণে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিলো। দ্রৌপদীকে নিয়ে প্রতিযোগীতা, সীতার কারণে রাম-রাবণ সংঘাত, এই সব পৃথিবী কাঁপানো ঘটনা তো ঘটেছে।
কাজল ভাইঃ ভাই ঠিক বলেছ, ইদানিং ঘটছে এরশাদ আর মেরি এরশাদকে নিয়ে।
আমিঃ জীনাতের কথাও তো শোনা যায়।
কাজল ভাইঃ এরশাদ কাকু একখান চীজ!
আমিঃ হ্যাঁ, এই সিন্দাবাদের ভুত যে কবে আমাদের ঘাড় থেকে নামবে!
আমরা দুজন হাটতে শুরু করলাম । পুরো কমপ্লেক্স জুড়ে এদিক-ওদিক হাটি, নানা গল্প করি। আস্তে আস্তে লোক জমতে শুরু করলো। পড়ন্ত বিকেলে হাটা গল্প করাটা সব বয়সের মানুষই খুব পছন্দ করে বোধহয়। আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা অনেকেই বাইরে হাটছে গল্প করছে। সাইকেলওয়ালা মেয়েটি সাইকেল চালিয়ে কয়েকবার ঘুরে গেলো। আরেকটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম, কাজল ভাই একা নয়, অনেকেই খিল্লি খায়।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মাঝখানের একটি জায়গা দখল করে, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। তাদের চিৎকার চেচামেচি আনন্দ উল্লাসে সবকিছুই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি মেয়েকে লক্ষ্য করলাম, বাচ্চাদের কাছাকাছি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সরে গেলো। মেয়েটি আমাদের বিল্ডিং-এই চারতলায় থাকে। মেয়েটিকে গত দেড় বছর ধরেই দেখছি। তবে একটা পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। বছর দেড়েক আগে মেয়েটি ছিলো চঞ্চলা কিশোরী। ঐ বাচ্চাগুলোর সাথেই খেলতো। এখন আর ওকে কিশোরী মনে হয়না। সদ্য যৌবন প্রাপ্তা তরুণী মনে হয়। তখন ওর বয়স খুব সম্ভবত চৌদ্দ ছিলো, তাহলে এখন সাড়ে পনের অথবা ষোল ছুঁয়ে ফেলেছে।
আমি মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকালাম। বাঁশপাতা রংয়ের একটা সালোয়ার-কামিসের সেট পড়েছে। সাথে কোন বান্ধবী বা কেউ নেই। খুব আনমনা একা দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো। মনে মনে কৌতুক অনুভব করলাম। একটা মেয়ে আমাকে দেখে লজ্জ্বা পেয়ে গেলো! আবার ভাবলাম আমাকে দেখে নাও হতে পারে। এটা হয়তো মেয়েদের স্বভাবসুলভ।
কফির কাপটিতে চুমুক দিয়ে অনুভব করলাম, কফি শেষ। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে খুব বেশী আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। কোন ফাঁকে যে কফি শেষ হয়ে গেলো খেয়ালই করিনি। আরেক কাপ কফি খাবো কিনা ভাবছি। নাকি ঘুমুতে যাবো? না থাক কাল স্যটারডে- উইকএন্ড, আজ দেরী করে ঘুমালেও কোন অসুবিধা নেই। নাতাশাকে নিয়ে ছুটির দিনটা ভালো কাটানো যাবে। কোথায় যাওয়া যায়? বিশ্বখ্যাত ‘বালশোই থিয়েটার’-এ একটা ভালো অপেরা চলছে। ওখানে যাওয়া যায়। খুব ঠান্ডা পড়লে কোথাও যাবোনা ঘরেই সময় কাটাবো।
কফিই খাই আরেক কাপ। ভালোই লাগছে এই ন্যচারাল বিনের কফি, জানালার বাইরে তুষারপাত, সেই পুরাতন স্মৃতি রোমন্থন। কিচেনে গিয়ে আরেক কাপ কফি বানিয়ে জানালার সামনে চেয়ারটিতে বসতে যাবো, এমন সময় মোবাইল টেলিফোনে কল এলো। এতো রাতে কল! কার কল? ধুমায়িত কাপটি ছোট টেবিলের উপর রেখে ফোনটা রিসিভ করলাম। মনিটরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কে ফোন করেছে। কিন্তু আমি তা নাকরেই, গ্রীন বাটনটা অন করলাম, “হ্যালো, শিশির, কেমন আছিস?”
আমিঃ জ্বী ভালো আছি, কে বলছিলেন?
” কি কে বলছিলেন? আরে আমি, আমি রাকিব বলছি, কানাডা থেকে”।
আমিঃ ও আচ্ছা।
রাকিবঃ কেন তোর টেলিফোনে আমার নাম্বার সেইভ করা নাই?
আমিঃ আছে, আমি চট করে ফোনটা ধরে ফেললাম তাই।
রাকিবঃ তোর এই ওলট-পালট আর গেলনা! যাহোক কেমন চলছে?
আমিঃ ভালোই চলছে। বাইরে খুব স্নো ফল হচ্ছে এই যা।
রাকিবঃ স্নো ফল? বেশতো! আমাদের এখানেও তো স্নো ফল হচ্ছে।
আমিঃ হু! দুটোই তো ঠান্ডা দেশ স্নো ফল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা এতো রাতে কি মনে করে?
রাকিবঃ টাইম ডিফারেন্স আছে তো। যাহোক তুই তো ব্যাচেলর মানুষ, তোর কাছে আবার দিন রাত কি?
আমিঃ হু! খোটা দেয়া হচ্ছে!
রাকিবঃ আরে না, খোটা না। তুই ই ভালো আছিস। আমরা বিয়ে করে হাত-পা বাঁধা হয়ে গিয়েছি।
আমিঃ হা হা হা! তখন তো প্রেমের পাগল পারা ছিলি, ওকে না হলে বাঁচবি না। এখন আবার ভিন্ন কথা বলছিস কেন?
রাকিবঃ তখন বুঝতে পারিনি রে। এখন কুয়ায় পড়ে গেছি।
আমি আরেক দফা হাসলাম।
রাকিবঃ যা হোক, কাজের কথায় আসি।
আমিঃ বল
রাকিবঃ তোর কাজিন, ঐ যে শুভ্র।
আমিঃ হ্যাঁ, শুভ্র, এ্যামেরিকায় থাকে। কি হয়েছে?
রাকিবঃ ফোন করেছিলো আমাকে, কানাডায় আসতে চায়।
আমিঃ ও তো এ্যামেরিকায় ভালোই আছে, কানাডায় যেতে চায় কেন?
রাকিবঃ আরে না, ভালো নেই। ওর তো কোন কাগজ-পত্র ঠিক নেই, ইল্লিগাল এলিয়েন হিসাবে থাকে।
আমিঃ সেটা তো জানতাম না। আমার তো ধারনা ছিলো ও এ্যামেরিকার সিটিজেন, বেশ ভালো আছে।
রাকিবঃ দূর থেকে ওরকম অনেক কিছুই মনে হয়। ওরাও বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছুই বলে। ওগুলো কিছু না। বাদ দে। তুই এখন বল, ওকে কি হেল্প করতে পারি?
আমিঃ শুভ্র এ্যামেরিকায় কি করে?
রাকিবঃ একটা গীর্জায় ছোটখাটো কোন একটা কাজ করে।
আমিঃ দেখ অবস্থা! আমি এতোকাল জানতাম ও ইন্জিনীয়ার।
রাকিবঃ ও ইন্জিনীয়ারিং পড়া শুরু করেছিলো কিন্তু শেষ করতে পারেনি।
আমিঃ আচ্ছা যাহোক। জানিনা কি করবি। আসলে, শুভ্র শত হলেও আমার কাজিন, আমি ওর ভালোই চাই।
রাকিবঃ আরে তোর কাজিন বলেই তো আমার সফট কর্ণার আছে। এজন্যই তো ফোন করলাম
আমিঃ দেখ যদি কোনভাবে সাহায্য করতে পারিস।
রাকিবঃ ওকে দোস্ত, দেখি কি করতে পারি। রাখি তাহলে।
আমিঃ থ্যংকস ফর কলিং।
কফির কাপটা আবার হাতে নিলাম। শুভ্রর কথা ভেবে মটা খারাপ হয়ে গেলো। শুভ্র আমার চাইতে বছর তিনেকের ছোট। আমার মেজো চাচার একমাত্র ছেলে। মেজো চাচা ডাক্তার, আবার ঢাকায় একটা ক্লিনিকও আছে। অর্থনৈতিকভাবে আমার বাবার চাইতে বেশী স্বচ্ছল। সখ করে শুভ্রকে এ্যমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন পড়তে। আমি জানতাম ও ওখানে পাশ করে ইন্জিনিয়ারিং পেশায় বেশ ভালো চাকরী করছে। এখন যা শুনলাম তাতে তো খারাপই লাগলো। ওর বড় বোনটা ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করেছে। তারপর এক আর্মি অফিসারের সাথে বিয়ে হয়ে দেশেই আছে। এদিকে শুভ্র বকলম রয়ে গেলো!
শুভ্রর বড় বোন আর রাকিবের বড় বোন আবার একসাথে মেডিকেল কলেজে পড়েছে। তাই রাকিব ওকে কাছ থেকেই চেনে। আমি এইচ, এস, সি-র পর পড়ালেখার জন্য মস্কো চলে আসি। রাকিব দেশেই ছিলো, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্স পাশ করেছে। তারপর ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডা চলে যায়। ওখানে ভালোই আছে। আমি আর রাকিব একই স্কুলে পড়েছি। এইচ, এস, সি, পাশের পর আমি আর রাকিব একই সাথে কোচিং করেছিলাম। ও থাকতো আমাদের বাসার কাছাকাছিই। সময় পেলেই আমাদের বাসায় চলে আসতো। দুজনে জমিয়ে আড্ডা দিতাম।
কফির ধোঁয়ায় আবার হারিয়ে গেলাম। একদিন বিকালে ঝট করে রাকিব উপস্থিত। ওকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম।
আমিঃ আরে দোস্ত তুই।
রাকিবঃ হ্যাঁরে দোস্ত আমি।
আমিঃ খুব ভালো হয়েছে, তুই এসেছিস জমিয়ে আড্ডা দেব।
রাকিবঃ চল বাইরে যাই।
আমিঃ আগে চা খা।
রাকিবঃ চা? না থাক পরে খাব।
আমিঃ তাহলে?
রাকিবঃ চল নীচে গিয়ে হাটি।
আমিঃ চল।
নীচে নেমে কিছুক্ষণ হাটছি। হঠাৎ কাজল ভাইয়ের সাথে দেখা।
কাজল ভাইঃ আরে শিশির।
আমিঃ আরে কাজল ভাই কেমন আছেন?
কাজল ভাইঃ ভালো। তোমার বন্ধু?
আমিঃ জ্বী, রাকিব।
ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম।
কাজল ভাইঃ তুমি কি কর?
আমিঃ এইতো হাটছি।
কাজল ভাইঃ খিল্লি খাওয়া শুরু করছো নাকি ভাই?
আমিঃ নাহ্! খিল্লি খাওয়ার লোক নাই।
কাজল ভাইঃ আরে হয়ে যাবে, হয়ে যাবে। কিছুদিন হাটাহাটি করো, লোক পেয়ে যাবে। (কাজল ভাইয়ের মজার কথা শুনে হো হো করে হাসলাম)
কাজল ভাই চলে যাওয়ার পর রাকিব বললো,
রাকিবঃ কিসের কথা বলে রে?
আমিঃ টাংকিবাজির কথা বলে।
রাকিবঃ ও হো হো (রাকিবও হসে ফেললো)।
হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেলো কোথায় যেন।
আমিঃ কিরে, তোর কি হলো?
রাকিবঃ ঐ মেয়েটি কে রে?
আমিঃ কোন মেয়েটি?
রাকিবঃ ঐ যে তোদের গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে, পিংক কালারের কামিস পড়া।
আমি তাকিয়ে দেখলাম, চারতলার সেই মেয়েটি। আমার মনে কৌতুক হলো। ফাজলামো করে বললাম
আমিঃ হ্যাঁ, একটা মেয়ে।
রাকিবঃ একটা মেয়ে তাতো দেখতেই পাচ্ছি। (একটু তেতে উঠলো রাকিব)
আমিঃ তোর মনে ধরেছে?
এবার লজ্জা পেয়ে গেলো ও।
রাকিবঃ না মানে, এম্নিই জিজ্ঞেস করছিলাম আরকি।
আমিঃ এম্নি এম্নি তো আর যে কারো কথা জিজ্ঞেস করেনা।
রাকিবঃ চিনিস মেয়েটিকে?
আমিঃ চিনিতো।
রাকিবঃ কি নাম?
আমিঃ ফুলবানু।
আবারো তেতে উঠলো রাকিব।
রাকিবঃ ফাজলামো করছিস!
আমিঃ নাহ্, তোর সাথে ঠাট্টা করলাম। মেয়েটির নাম বিনীতা
রাকিবঃ সুন্দর নাম তো! কে মেয়েটা?
আমিঃ আমাদের বিল্ডিং-য়েই চারতলায় থাকে। পছন্দ হয়েছে?
রাকিবঃ মেয়েটা সুন্দর কিন্তু।
রাকিবের চোখে হঠাৎ এতো সুন্দর লাগলো কেন বুঝলাম না। আমার কাছে মেয়েটাকে এখনো কিশোরীই মনে হয়। আমাদের পাত্তা দেয়ার মতো কোন মেয়ে বলে মনে হয়না।
স্মৃতি রোমন্থনে এমনই ডুবে গিয়েছিলাম, খেয়াল করিনি। হথাৎ পাটা তেতে উঠলো। মস্কোতে প্রতিটি দালানেই চমৎকার সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম আছে। যা আমাদের হাঁড় কাপানো ঠান্ডা থেকে বাঁচায়। আজ একটু বেশী ঠান্ডা পড়েছে। আমি তাই এক্সট্রা ইলেকট্রিক হিটারটা চালু করেছি। অনেকক্ষণ যাবৎ চলছে হিটারটা। এখন উল্টা আরো গরম লাগছে, হিটারটির আঁচ পা পুড়ে দিচ্ছে মনে হলো। তারপরেও সরে এলাম না। মাঝে মাঝে নিজেকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে।
কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো। কাল রাতে একটু দেরিতেই ঘুমিয়েছিলাম। এম্নিতেই এখানকার শীতের সকালগুলো খুব আরামের হয়। বাইরে ঠান্ডা আর লেপের ভিতরে ওম। ভোরের স্বপ্ন ভেঙে সেই ওম ছেড়ে আর বেরোতে ইচ্ছা করেনা। ইউনিভার্সিটি লাইফে এই ঘুমের লোভে সকালের ক্লাসগুলো সবসময় মিস দিতাম। কিন্তু চাকুরী জীবনে তো আর সেটা সম্ভব নয়। ঘড়ি ধরে কাটায় কাটায় সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে হয়। উইকএন্ডগুলোতেই শুধু একটু আরাম করা যায়। আপাততঃ সেই আরাম ঠেলে ঘুম থেকে উঠতে হলো। কলিংবেল বাজছে। কে দেখতে হবে। ঘুমকাতুরে চোখে দরজার দিকে এগুলাম। যেতে যেতে খেয়াল হলো, আজ তো নাতাশার আসার কথা। আই হোল দিয়ে তাকিয়ে ফারকোট আর ভারী টুপিতে ঢাকা নারী অবয়ব দেখতে পেলাম। কে খুব একটা বোঝা গেলনা। দরজা খুলে দেখলাম, নাতাশাই দাঁড়িয়ে আছে।
যেকোন রুশ তরুণীর মতোই চোখ ঝলসানো সুন্দরী এই নাতাশা। সুন্দর ঢেউ খেলানো সোনালী চুলগুলি মসৃন পিঠের উপর চমৎকার লুটিয়ে থাকে। ওর চোখ দুটি অদ্ভুত নীল, ককেশাস পাহাড়ের উপরে একটি হ্রদ দেখেছিলাম, যার পানি ছিলো আশ্চর্য্য নীল, তার সাথে তুলনা করা যায়, কিংবা যেন আমাদের দেশের শীতের নির্মেঘ আকাশের সুনীল সস্নেহতা। অমন ধারা চোখ মন মাতায়। যেকোন শ্বেতাঙ্গিনীর মতই তুষারশুভ্র তনু। ওর মসৃন পেলব হাত দুটো যেকোন পুরুষের জন্যই প্রলুদ্ধকর।
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে ও বললো,
নাতাশাঃ অলরেডি দুপুর বারোটা বেজে গেছে, তুমি মাত্র বিছানা ছেড়ে উঠলে! কি হয়েছিলো? রাতে ঘুম ভালো হয়নি?
আমিঃ না মানে, ঘুম আসছিলো না ঠিক তা নয়। আমি ইচ্ছে করেই দেরী করে ঘুমিয়ে ছিলাম।
নাতাশাঃ ইচ্ছে করেই? কেন? কোন মুভি দেখেছ? তুমি তো মুভি দেখতে ভালোবাসো।
আমিঃ হ্যাঁ, মুভি আমি ভালোবাসি ঠিকই, তবে কাল রাতে ঠিক মুভিও দেখিনি।
নাতাশাঃ এমনি জেগে ছিলে?
তারপর ও আমার দিকে ভালো করে তাকালো।
নাতাশাঃ কোন কারণে কি তোমার মন খারাপ?
আমিঃ না না, আমার মন খারাপ হয়নি। এম্নিই রাত জেগে স্নো ফল দেখলাম।
নাতাশাঃ রাত জেগে স্নো ফল দেখা! নাহ্, তোমরা ইস্টার্নরা পারোও কাব্য করতে।
আমিঃ কাব্য করায় তোমরা রাশানরাও তো কম যাওনা।
নাতাশাঃ হ্যাঁ, তা ঠিক। ওয়েস্টার্নদের চাইতে আমাদের মনে কাব্য অনেক বেশীই আছে। তবে তোমাদের ইস্টার্নদের চাইতে কম।
আমিঃ হ্যাঁ, তোমরা একটা ইন্টারেস্টিং জাতি। ইস্টার্ন আর ওয়েস্টার্নরা অনেকটাই পরস্পর বিপরীত। কিন্তু তোমরা রাশানরা পুরোপুরি ইস্টার্নও না, আবার পুরোপুরি ওয়েস্টার্নও না।
নাতাশাঃ এজন্যই জেনারেল কুতুজোভ বলেছিলেন, “আমরা না ইউরোপ, না এশিয়া, আমরা রাশিয়া।”
আমিঃ হাঃ, হাঃ, যথার্থই বলেছেন।
এরপর নাতাশার দিকে তাকিয়ে মনে রঙ লাগিয়ে কৌতুক করে বললাম ,
আমিঃ যদি বলি কাল রাতে আমি কোন কাব্য করিনি, আমার মন খারাপ ছিলো। তাহলে তুমি করবে?
নাতাশাও আমার দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে বললো।
নাতাশাঃ তোমার মন-খারাপ ভালো করে দেব।
আমিঃ তাই, কিভাবে?
নাতাশা কাছে এগিয়ে এসে। আমাকে আলিঙ্গন করে, আলতো করে ঠোটে চুমু খেয়ে বললো
নাতাশাঃ এই যে, এইভাবে।
অপরূপা শ্বেতাঙ্গিনীর সূর্য-পক্ক অধর আমার বাদামী ঠোঁটে, কি মৃদু কোমল সে স্পর্শ। বেশ মিষ্টি লাগলো, মনে হলো যেন সদ্য ভাঙা বেদানার রসালো দানা ঠোটে ছুঁয়েছি। পাশাপাশি ওর বনসৌরভ মেশানো তনুর উষ্ণ আলিঙ্গন, আমার কায়ার প্রতিটি কোষে প্রীতির স্রোত বইয়ে দিলো। সত্যিই মন ভালো হয়ে গেলো।
আমার মন খারাপ ছিলো কিনা জানিনা। তবে কোন একটা বিষন্নতা ভর করেছিলো। সাধারনত গভীর ঘুমের পর, সকাল বেলায় উঠে মনটা ঝরঝরে হয়ে যায়। ঘুম গত দিনের সব দুঃখ-বেদনা-হতাশা-বিষন্নতা দূরীভুত করে। কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠেও বিষন্নতা কাটছিলো না। কিন্তু নাতাশার গরম কফির কাপের মত আলিঙ্গন এক মুহূর্তে আমার সব বিষন্নতা মুছে দিলো।
আমিঃ চলো ব্রেকফাস্ট করি।
নাতাশাঃ ব্রেকফাস্ট কি করবে! এখন তো দুপুর বারোটা। আরেকটু পরে তো লাঞ্চ টাইম হবে।
আমিঃ আমি তো মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।
নাতাশাঃ ওয়েল তুমি ব্রেকফাস্ট করে নাও। আমি তো ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি। আমি বরং ইন-দ্যা-মীনটাইম তোমাকে লাঞ্চ বানাতে হেল্প করি। তোমাদের ঐ খাবারটা আমার খুব ভালো লাগে ঐযে চাল আর ডাল একসাথে মিশিয়ে বানাও, তার সাথে ঝাল বীফ।
আমিঃ ওটাকে আমরা খিঁচুড়ি বলি। কিন্তু তুমি লাঞ্চ বানাতে হেল্প করবে মানে? বেড়াতে যাবেনা?
নাতাশা আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
নাতাশাঃ নাহ্, বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া, তুমি মাত্র ঘুম থেকে উঠেছ তাই খেয়াল করনি। বাইরে এখনো স্নো ফল হচ্ছে।
আমিঃ তাই নাকি? (আমি জানালার দিকে ছুটে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখলাম) ওরেব্বাস! তাইতো। বারো তলার এপার্টমেন্ট থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। যতদূর দৃষ্টি যায় কেবল সাদা আর সাদা। যোজনব্যাপী অদ্ভুত শুভ্রতা।
তারপর নাতাশার দিকে তাকিয়ে বললাম,
আমিঃ সমস্যা কি? স্নোফলের মধ্যেও তো বেড়ানো যায়। থিয়েটারে যাই চলো। অথবা কোডাক সিনেমা হলে গিয়ে মুভি দেখি।
নাতাশাঃ বাইরে রেস্টুরেন্টে খেয়ে তীব্র তুষার ঝরা দিনের ক্ষুধা আমার মিটবে না।
নাতাশা আবার আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো
নাতাশাঃ তুমি বুঝতে পারছো না। আমি কোথাও যেতে চাইনা। আজ আমি তোমার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে চাই।
নাতাশা আমার গার্লফ্রেন্ড। শী ইজ নট দ্যা ফার্স্ট। আমার আরও অনেক গার্লফ্রেন্ড ছিলো। হয়তো আরো অনেক হবে। পুরুষদের মন বহুমুখী, বহুগামীতায় তার আনন্দ। তাই একজন ছেড়ে আরেকজন অথবা একই সাথে কয়েকজনে তার আপত্তি নেই। মেয়েরা মনোগোমাস বা একনিষ্ঠ, তাই একেই তাদের মন নিবিষ্ট করতে চায়। অবশ্য আধুনিক যুগের সামাজিক উশৃংখলতার কারণে তারা চাইলেও সব সময় পারেনা। আমার প্রথম গার্লফ্রেন্ডটি হয়েছিলো এই দেশে আসার এক বছর পর। আমাদের ইউনিভার্সিটিরই ছাত্রী ছিলো আমার চাইতে বছর তিনেকের বড় ছিলো। একেবারে প্রথম ছিলো বলে বেশী মনে পড়ে। তবে সেটাকে প্রেম বলা যাবেনা। কি তবে ওটা? একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ। নারী-পুরুষের সেই চিরন্তন আকর্ষণ। ওর সাথে সম্পর্ক ছিলো দু’বছর। মস্কোর মেয়ে ছিলোনা। অন্য শহর, এমনকি অন্য রিপাবলিক, আর আজকের হিসাবে অন্য দেশের মেয়ে ছিলো। মেয়েটি ছিলো লাটভিয়ার রাজধানী রিগার। অপূর্ব সুন্দরী স্বর্ণকেশিনী। ইউনিভার্সিটি কমপ্লিট হয়ে যাওয়ার পর নিজের দেশে ফিরে যায়। সেই সাথে আমার সাথেও সম্পর্ক ছেদ হয়ে যায়। আমার যে খারাপ লাগেনি তা নয়। তবে বুক ভেঙে যায়নি। ওর মধ্যেও অত তোলপাড় ছিলনা। এখান থেকে বোঝা যায়, যে আমাদের সম্পর্কটাকে গভীর প্রেম বলা যাবে না।
এরপর আরও অনেক গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। কারো সাথে ছয়মাস কারো সাথে এক বছর। সংক্ষিপ্ত সব রোমান্স। এদের কাউকে কাউকে কখনো-সখনো মনে পড়ে কাউকে-কাউকে একেবারেই মনে পড়েনা। তারা কেবল এ্যালবামে ছবি হয়ে বন্দী হয়ে আছে। নাতাশার সাথে সম্পর্কটা একটু বেশীদিন হয়ে গেলো। সামনের মাসে আড়াই বছর হবে। পুরুষরা বহুগামী হলেও বিশেষ এক রূপসীর ছলাকলা বা ফাঁদে পড়তে বেশী সময় লাগেনা, প্রকৃতিগতভাবেই মেয়েরা খুব কৌশলী আর ছেলেরা বোকা। অবশ্য আমি বোকামী করে যে নাতাশার সাথে বেশিদিন আছি তা না। জাস্ট প্রথম যৌবনের সেই চাঞ্চল্য আর নেই। পুরুষরা চঞ্চল, দুরন্ত ও অবোধ, কিন্তু নারী তার স্নেহ ও স্বান্তনা দিয়ে সেই দুরন্তপনাকে সংযত, চাঞ্চল্যকে মিতশ্রী আর অবোধকে বোধ দান করে তাকে প্রজ্ঞ করে তোলে। নাতাশা পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার। মস্কোর একটা ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পাশ করেছে। আমাদের অফিসে পুরাতন ‘আদিন এস’ প্রোগ্রামটি চেন্জ করে ‘ওরাকল’ প্রোগ্রাটি সেট আপ করার প্রয়োজন দেখা দিলে, কোম্পানী প্রেসিডেন্ট (তিনিই কোম্পানীর মূল মালিক) আমাকেই দায়িত্বটা দিলেন। কয়েকটি কোম্পানির সাথে কথা বলে আমি একটিকে সিলেক্ট করি। সেই সময় ঐ কোম্পানীর পক্ষ থেকে প্রোগ্রাম সেট আপ করতে এসেছিলো নাতাশা শ্লিসেভ্স্কায়া। সেই থেকে ওর সাথে পরিচয়। কাজটা করতে ওরা তিনমাস সময় নিয়েছিলো। তারপর ঐ কোম্পানীর সাথে আমাদের এগ্রিমেন্ট শেষ হয়ে গেলেও নাতাশার সাথে আমি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। উদ্যোগটা ওর দিক থেকেই প্রথম ছিলো।
এই দেশে গার্লফ্রেন্ড খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এটাকে সমাজ স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। ইয়াং ছেলে বা মেয়ের বন্ধু বা বান্ধবী থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমাদের দেশে বিষয়টা একসময় সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য ছিলো। অন্ততপক্ষে যখন আমি দেশে ছিলাম তখন তেমনটিই দেখেছি। এখন কেমন হয়েছে জানিনা। অনেকগুলো বছর দেশের বাইরে, তাছাড়া গত পাঁচ বছর দেশেই যাওয়া হয়নি। শুনেছি সেখানে এখন অনেকটাই লিবেরাল। সমাজ বদলায়। আচ্ছা আমাদের সময়ের এত কড়াকড়িতে তারুণ্য কি বাধাগ্রস্ত হয়েছে? মানুষের শরীর ও মন কি খুব বেশী শিকল পড়া ছিলো? আবারো বিনীতার কথা মনে পড়লো।
একদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ঘুমকাতুরে আমি অত ভোরে ঘুম থেকে কমই উঠি। অবশ্য খুব ছোটবেলায় আমি একটা অদ্ভুত কাজ করতাম। খুব ভোরে মানে চারটা-সাড়ে চারটার দিকে ঘুম থেকে উঠে বাড়ীর কাউকে না জানিয়ে চুপিসারে বেড়িয়ে যেতাম। তারপর হেটে হেটে সারা ঢাকা শহর ঘুরতাম। কখনো হেটে হেটে চলে যেতাম বায়তুল মোকাররমে। কখনো চলে যেতাম নিউ মার্কেটে। অদ্ভুত লাগতো সেই ভোরের ঢাকা। সব রাস্তা-ঘাট থাকতো ফাঁকা। দোকান-পাট সব বন্ধ। হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকটা ট্রাক বা রিকসা চলে যেত। খুব আশ্চর্য্য লাগতো দিনের প্রবল কর্মব্যস্ত ঢাকা ঊষালগ্নে এতো নিশ্চুপ। মনে হতো ছেলেবেলায় পড়া রূপকথার সেই দৈত্য যেন ঘুমিয়ে আছে। যাহোক, উঠেই যখন গেলাম, ভাবলাম একটু হেটে আসি। নীচে নেমে এসে কমপ্লেক্সের রাস্তাটা ফাঁকা পাওয়ারই কথা ছিলো। কিন্তু আমাকে অবাক করে দেখলাম নীচে বিনীতা দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য ও একা নয়। ওর সাথে ওর দাদী ছিলো। হয়তো দাদীকে মর্নিং ওয়াকে হেল্প করছে। ও কি প্রতিদিনই ভোরে উঠে মর্নিং ওয়াক করে? কি জানি, আমার পক্ষে জানা সম্ভব না। আমিতো ঘুমিয়েই থাকি। বিনীতার চোখে চোখ পড়তেই ও চোখ সরিয়ে নিলো। আমার মনে কৌতুকের উর্দ্রেক হলো। ভাবলাম মজা করি, আমি আর চোখ নামালাম না। দেখি ও কি করে। একটু পরে ও আবার আমার দিকে তাকালো। ও বুঝতে পারেনি যে আমি ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। দ্বিতীয়বার আমার চোখে চোখ পড়তেই ওর পুরো গালে রক্ত ছলকে উঠলো। ফর্সা গালটি মুহুর্তেই রক্তিম হয়ে উঠলো। ও ভীষণ লজ্জ্বা পেয়ে মুখই ঘুরিয়ে নিলো। এবার আমার নিজের কাছে খারাপ লাগলো। ওকে এরকম লজ্জ্বা দেয়া ঠিক হয়নি। আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে, দ্রুত হেটে চলে গেলাম।
নাতাশাঃ আমি চাল-ডাল ধুঁয়ে দিয়েছি, অন্য সব কিছুও গুছিয়ে দিয়েছি। তুমি রান্না শুরু করো।
আমি কিচেনে গিয়ে দেখলাম, সত্যিই ও সব রেডী করে ফেলেছে। চাল-ডাল একসাথে মিশিয়ে ধুঁয়ে দিয়েছে। পিয়াঁজ কেটে রেখেছে। মুরগী ফ্রীজ থেকে বের করে ভিজিয়ে রেখেছে। খিচুরী রান্নার পুরো আয়োজন সমাপ্ত, এখন শুধু রান্নাটাই বাকী।
আমিঃ খিচুরীর সাথে আমাদের দেশে একটা মাছ খেতে খুব ভালোবাসি।
নাতাশাঃ জানি। তুমি বলেছিলে, মাছটার নাম ইলিশ। শুধু তোমাদের দেশেই হয়। গঙ্গার ইলিশ।
আমিঃ হ্যাঁ, নদীটার ইন্টারন্যাশনাল নাম গঙ্গাই তবে আমাদের দেশে ঐ নদীর নাম পদ্মা। আমরা মাছটাকে পদ্মার ইলিশ বলি।
নাতাশাঃ খুব টেস্টি, তুমি বলেছ। কই আমাকে তো খাওয়ালে না কখনো।
আমিঃ কি করে খাওয়াবো বলো? গত পাঁচ বছর যাবৎ আমার দেশেই যাওয়া হয়নি।
নাতাশাঃ এতগুলো বছর দেশের বাইরে! তোমার খারাপ লাগেনা? দেশের জন্য মন পোড়েনা?
আমিঃ প্রথম প্রথম খুব হোম সিক ফীল করতাম। তখন ঘন ঘন গিয়েছিও দেশে। তারপর কেমন যেন মায়া কেটে যেতে লাগলো। এখানকার জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
নাতাশাঃ হু, রাশান ভাষায় একটা কথা বলে, “চিলোভেক প্রিভিকায়েত কাভ সেমু (মানুষ সব কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়)”।
আমিঃ হ্যাঁ তাই হবে। আচ্ছা শোন আমি তোমার জন্য ইলিশ মাছের ব্যবস্থা করতে পারি।
নাতাশাঃ দেশেই যাওনি গত পাঁচ বছর, ইলিশ মাছ কি বালিহাঁসের মত উড়ে উড়ে এলো?
আমিঃ (হেসে হেসে) আমাদের দেশে তোমাদের দেশ থেকে বালিহাঁস উড়ে উড়ে আসে, আর আমরা ধরে খেয়ে ফেলি। আমাদের দেশ থেকে ইলিশ মাছ যদি উড়ে উড়ে আসতো, তোমরা কি ধরে খেয়ে ফেলতে?
নাতাশাঃ কি জানি! অরণ্যের প্রাণী ধরে ধরে খাওয়া আমাদের দেশে বে-আইনি। তবে তুমি মাছটির টেস্টের যা প্রশংসা করেছো, সেই টেস্টের হদিস পেলে হয়তো, খেতামই। যাহোক, তোমার ইলিশ মাছ কোথায় আছে শুনি, ফ্রীজে? কোন বন্ধু নিয়ে এসেছে, দেশ থেকে?
আমিঃ না কেউ আনেনি। আমি গতকাল কিনেছি, চেইন শপ ‘সিদমোই কন্টিনেন্ট (সপ্তম মহাদেশ)’ থেকে।
নাতাশাঃ কি বলো! ওখানে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়?
আমিঃ ঠিক ইলিশ না, ফিলিশ।
নাতাশাঃ কি ইলিশ না ফিলিশ! হেয়ালী রাখো তো।
আমিঃ স্কুমরিয়া মাছ কিনেছি।
নাতাশাঃ ও, স্কুমরিয়া। তা স্কুমরিয়ার সাথে ইলিশের সম্পর্ক কি?
আমিঃ স্কুমরিয়া দেখতে ইলিশের মতো না হলেও, টেস্টটা অনেকটাই ইলিশের মতো। তাই ইলিশ মনে করে স্কুমরিয়া খেয়ে, দুধের সাধ ঘোলে মেটানো যাবে।
নাতাশাঃ ওহো হো। ভালো বের করেছ। তা তুমি তো অনেক বছর যাবৎই দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছ।
আমার অবিবাহিত জীবনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বললো ও।
n
নাতাশা আমাকে একশো পারসেন্ট সাহায্য করলো, আমি শুধু রান্নাটা করলাম। এভাবে যৌথ সহযোগীতায় তৈরী হয়ে গেলো বাসমাতি চাল আর মুশুরীর ডালের ভুনা খিচুরী, ঝাল মুরগীর মাংস (নাতাশা বীফ খেতে চেয়েছিলো, কিন্তু বীফ ফ্রিজে ছিলোনা), আর ইলিশ ইলিশ টেস্টের স্কুমরিয়া মাছ। শশা, টমেটো, গাজর, মুলা, পিয়াজ, আর ক্যাপসিকাম কুচি কুচি করে কেটে তৈরী করলাম গ্রীন সালাদ। আমার পঞ্চাশ স্কয়ার মিটারের এ্যাপার্টমেন্টে সর্বসাকুল্যে আছে দুটা রূম। তাই ডাইনিং রূমের কোন বালাই নেই। তবে কিচেনটা অনেক বড় হওয়ায় ওখানেই ডাইনিং টেবিল পেতেছি। কিচেন-কাম-ডাইনিং মেজাজে রূমটা ভালোই লাগে। আমি ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডী করার উদ্যোগ নিতে নাতাশা বাধা দিয়ে বললো,
নাতাশাঃ ডাইনিং টেবিলে না।
আমিঃ তাহলে?
নাতাশাঃ বেড রুমে চলো। মুভি দেখতে দেখতে লাঞ্চ করি।
আমিঃ ও, হ্যাঁ, ঠিক আছে।
আমরা কিচেন থেকে ভাত বেড়ে বেডের সামনে ছোট টেবিলে প্লেট দুটি রাখলাম। দামী ম্যাংগো জুসের প্যকেট খুলে দুটি গ্লাসে ঢাললাম।
নাতাশাঃ তোমার একটা খুব ভালো দিক আছে।
আমিঃ কি সেটা?
নাতাশাঃ তুমি হার্ড ড্রিংক খাওনা।
আমিঃ ও। হ্যাঁ। আসলে আমি একজন মুসলিম, হার্ড ড্রিংক খাওয়া তো আমাদের ধর্মে নিষেধ।
নাতাশাঃ জানি। কিন্তু তোমার দেশী অন্যান্যদের দেখেছি, দেদারসে হার্ড ড্রিংক খায়।
আমিঃ আমাদের দেশে মদ্যপানের প্রচলন নেই।
নাতাশাঃ অথচ এখানে এসে তোমার দেশীরা অনায়াসেই এই খারাপ দিকটাকে গ্রহন করে ফেলে।
আমিঃ (আমি একটু লজ্জা্ পেয়ে বললাম) হ্যাঁ, যার যার ব্যাক্তিগত ব্যপার আরকি।
নাতাশাঃ সেটাই তো বলছি। তুমিও অনেকদিন এদেশে আছো, তুমিতো গ্রহণ করোনি। এটাই তোমার ভালো দিক।
আমিঃ নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোই লাগে। (তারপর একটু হেসে বললাম) প্রেমিকারা প্রশংসা করে, আর স্ত্রীরা করে গালমন্দ।
নাতাশাঃ (নাতাশাও হেসে বললো) তুমি কি এই বলতে চাও যে আমি তোমার স্ত্রী হলে আর প্রশংসা করবো না, কেবলই গালমন্দ করবো?
ওর এই প্রশ্নটি শুনে আমি চুপ করে রইলাম। বিষয়টি এড়িয়ে গেলেই ভালো হয়।
আমিঃ কি মুভি দেখবে?
নাতাশাঃ তোমাদের দেশের কোন মুভি চালাও। তোমাদের পুরণো মুভিগুলো আমার ভালো লাগে। আচ্ছা ওদের কোন নিউ মুভি আছে? ঐ যে খুব সুন্দর কাপ্ল, সাদা-কালো মুভি?
আমিঃ উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেনের কথা বলছো?
নাতাশাঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, এরকমই তো নাম। আছে?
আমিঃ আছে।
আমি উত্তম-সুচিত্রার ‘পথে হলো দেরী’ মুভিটা চালালাম।
নাতাশাঃ তোমার কাজ একটু বাড়লো। এবার ট্রান্সলেট করো।
আমিঃ ঠিক আছে করছি।
প্লেট হাতে নিয়ে বিছানায় বসলাম। নাতাশা আমার গা ঘেসে বসলো। বাইরে স্নোফল, ঘরে কৃত্রিমভাবে তৈরী না ঠান্ডা-না গরম আরামদায়ক পরিবেশে খিচুরী খেতে খেতে দুজনে মিলে মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখতে লাগলাম। আমি সিনেমাটি আগেও দেখেছি, তারপরেও ভালো লাগছিলো। কিছু কিছু জিনিস আছে যা কখনোই পুরাতন হয়না, অনেকটা ছেলেবেলার স্মৃতির মতো।
একটা উপলক্ষে আমাদের বাড়ীতে মিলাদের আয়োজন হয়েছিলো। আগের দিন রাতে মা আমাকে বললেন, “যা উপরে বিনীতাদের দাওয়াত দিয়ে আয়।” যদিও আমি জানি যে বিনীতা কে, কিন্তু মাকে তা বুঝতে দিতে চাইলাম না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম
আমিঃ বিনীতা কে মা?
মাঃ বিনীতা কে জানিস না?
আমিঃ না (আরো গোবেচারা ভাব করে বললাম)
মাঃ আমি তো জানতাম, ইয়াং ছেলেরা এলাকার সব মেয়েরই নাম জানে। তুইতো দেখছি ভিন্ন জাতের মানুষ। যাহোক, চারতলায় সাউথ সাইডের এ্যপার্টমেন্টটা।
আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। ওদের এ্যপার্টমেন্টে গিয়ে কলিং বেল টিপলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, বিনীতাই এসে দরজা খুললো। আমি দ্রুত ভিতরে ঢুকে গেলাম। আমাকে দেখে বিনীতা সভয়ে দুপা পিছিয়ে গেলো। ওর ঐ ভয় পাওয়া দেখে আমিও ভড়কে গেলাম। কয়েক মুহূর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “আমি দোতলায় থাকি, কাল আমাদের বাড়ীতে মিলাদ, আপনাদের দাওয়াত।” বিনীতা নিস্পলক তাকিয়ে রইলো, কিছু বললো না। বুঝলামনা ও কি আমকে ভয় পাচ্ছে নাকি? এরমধ্যে ওর মা বেরিয়ে এলে বেডরুম থেকে। আমাকে দেখে বললো, “ওহ, তুমি, দোতলায় থাকো না?”
আমিঃ জ্বী।
বিনীতার মাঃ তারপর বাবা কি মনে করে?
আমিঃ জ্বী, মানে, কাল বাদ আছর আমাদের বাড়ীতে মিলাদ, আপনাদের দাওয়াত।
বিনীতার মাঃ ও আচ্ছা, ঠিক আছে আমরা আসবো। ওর বাবা তো টুরে গিয়েছে, উনি থাকতে পারবেন না। তবে আমরা ঠিকই আসবো। আমাকে কাল মনে করিয়ে দিস বিনীতা।
আমি চলে এলাম। বিনীতা তখনো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলো। যতদূর মনে পড়ে বিনীতাকে এতো কাছ থেকে সেইদিনই প্রথম দেখেছিলাম।
মুভিতে সুচিত্রা সেনের সেই বিখ্যাত গানটি হচ্ছে, ‘তুমি না হয় রহিতে কাছে কিছুক্ষণ আরো নাহয় রহিতে কাছে – আরো কিছু কথা নাহয় বলিতে মোরে কিছুক্ষণ আরো নাহয় রহিতে কাছে – আরো কিছু কথা নাহয় বলিতে মোরে এই মধুক্ষণ মধুময় হয়ে নাহয় উঠিত ভরে – আরো কিছু কথা নাহয় বলিতে মোরে কিছুক্ষণ আরো নাহয় রহিতে কাছে’
নাতাশাঃ খুব রোমান্টিক গান হচ্ছে মনে হয়। ট্রান্সলেট করো।
আমি গানটি ট্রান্সলেট করতে শুরু করলাম। নাতাশা আমার গায়ের আরো কাছাকাছি ঘেসে এলো।
ফিল্মটা শেষ হওয়ার পর দেখলাম নাতাশার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, বিদেশীদের কোন প্রেম-ভালোবাসার আবেগ-অনুভূতি থাকেনা, কিন্তু কথাটা যে পুরোপুরিই ভ্রান্ত তা আমি বিদেশে কিছুদিন থাকার পরই বুঝতে পেরেছিলাম। আবেগ-অনুভূতি-ভালোবাসার চিত্র পৃথিবীর সব দেশেই একই রকম, কিছুটা উনিশ-বিশ হলেও হতে পারে।
নাতাশাঃ তোমাদের ফিল্মগুলি খুব সুন্দর! হৃদয়ের কথা বলে।
আমিঃ হ্যাঁ, বিশেষ করে পুরাতন ফিল্মগুলো এরকম।
নাতাশাঃ এখন কি আর আগের মতো নেই?
আমিঃ কি জানি, বলতে পারবো না। আমি তো অনেক দিন দেশে যাইনা। তোমাদের ফিল্মগুলোও কিন্তু খুব সন্দর। ‘ক্রেনস্ আর ফ্লাইং’ ছবিটি আমি দেশে থাকতেই দেখেছিলাম। পুরো সিনেমা হলই মুগ্ধ হয়েছিলো।
নাতাশাঃ একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের পুরাতন ছবিগুলিতেই ভাবাবেগ বেশী ছিলো। এখন এই ভাবাবেগ অনেক কমে এসেছে।
তারপর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে নাতাশা বললো।
নাতাশাঃ তোমার কি মনে হয় সত্যিই কি আমরা সব আবেগ-অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি?
আমিঃ (কিছু সময়ের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলাম) প্রশ্নটা আমাকেও ভাবায়। আধুনিক যুগের আমরা বোধহয় বড় বেশী যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছি। বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য বই যাযাবরের দৃষ্টিপাতে একটা কথা পড়েছিলাম, ‘আধুনিক প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’
নাতাশাঃ টাকা-স্বার্থ-ক্যরিয়ার এই সব হিসাব বোধহয় আমরা আজকাল খুব বেশী করি, তাইনা? আমরা এখন বুঝিনা প্রেম কিংবা ভালোবাসা কতটা গভীর। কতটা মূল্য একেকটি সম্পর্কের। আমাদের কাছে ক্রাশ খাওয়া, প্রপোজ, ব্রেক আপ, লিভ টুগেদার, সেক্স অত্যন্ত সস্তা বিষয়। এই যদি হয় আধুনিকতা। তবে সে আধুনিকতা দরকার নেই। যে গভীর মমত্বে গড়ে ওঠে সহস্র বছরের আবেগী ভালোবাসার বন্ধন, পারিবারিক সম্পর্ক সেই সম্পর্ক যুগ যুগ ধরে অটুট থাকুক। কি হবে এই ধ্বংসাত্মক আধুনিকতা দিয়ে বলতো?
কঠিন প্রশ্ন। এই প্রশ্নটি আমাকেও কাঁদায়। কিন্তু সবকিছু ভুলে তথাকথিত আধুনিক আমি কি করে এই প্রশ্নের উত্তর দেব? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি আবার অতীতে হারিয়ে গেলাম। আমি বিদেশে পড়ালেখা করতে যাবো এমন হিসাব আমার ছিলোনা। আমি এইচ, এস, সি পাশের পর দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্ত আমাকে হঠাৎ অবাক করে দিয়ে বাবা একদিন বললেন,” তোর সার্টিফিকেট মার্কশীট ইত্যাদি যাবতীয় কাগজ-পত্রের একটা সেট রেডী কর”
আমিঃ কেন বাবা?
বাবাঃ প্রশ্ন না করলে ভালো লাগেনা না? তোকে যেটা বলছি সেটা কর।
বাবা এম্নিতে খুব ভালো মানুষ। তবে হঠাৎ হঠাৎ বিনা কারণেই চটে যান।
আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে, একটা সেট তৈরী করে বাবার হাতে দিয়ে দিলাম। কিছুদিন পর বাবা বললেন, “তোর সেটটা এডুকেশন মিনিস্ট্রিতে দিয়ে আসবো। একটা স্কলারশীপের জন্য। তোকে একটা ফর্ম ফিল আপ করতে হবে। স্কলারশীপের কথা শুনে আমার মনটা নেচে উঠলো। বাবা কি আমাকে বিদেশে পড়াতে চাচ্ছেন? বাহ্ বেশতো!
আমিঃ কোন দেশের স্কলারশীপ বাবা?
বাবাঃ রাশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন।
আমিঃ এতো দেশ থাকতে রাশিয়া কেন বাবা?
বাবাঃ এ্যমেরিকা যেতে চাস?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। বাবা একটু নরম সুরে বললেন
বাবাঃ রাশিয়ায় আন্ডারগ্রেড লেভেলে স্কলারশীপ আছে, আমেরিকায় নাই। আমাদের এই মুহূর্তে ব্যবসা ভালো আছে। তোকে চাইলে আমি আমেরিকা পাঠাতে পারি। কিন্তু বাবা, আমি তোরা এখন ভালো থাকলেও, একট কথা বুঝতে হবে, আমি বড় হয়েছি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাই তোদের মত বিলাসী চিন্তাভাবনা আমার নাই। আমি অনেক হিসাব করে ভেবে-চিন্তে ডিসিশান নেয়ার চেস্টা করি।
আমিঃ এ্যমেরিকা কি রাশিয়ার চাইতে ভালো হবে না?
বাবাঃ ভালো মন্দ বিষয়টা আপেক্ষিক। একটু চিন্তা কর, আমেরিকায় গেলি, দুয়েক বছর পর আমাদের ব্যবসা খারাপ হয়ে গেলো, অথবা আমি মরেই গেলাম। তখন তোর কি হবে? পড়ার খরচ কি করে যোগাবী? তার চাইতে একবারে স্কলারশীপ নিয়ে যা, মাস্টার্স পর্যন্ত নিশ্চিন্তে পড়ালেখা করতে পারবি।
আমিঃ পড়ালেখার মান বাবা?
বাবাঃ আমি জানতাম তুই এই প্রশ্নটি করবি। আমি যথেস্ট খোঁজ নিয়েছি, রাশিয়ার পড়ালেখার মান আমেরিকার চাইতে কোন অংশেই খারাপ নয়। একটু ভেবে দেখতো, যে দেশের রকেট চাঁদে যায়, মঙ্গল গ্রহে যায় শুক্র গ্রহে যায় তাদের পড়ালেখা খারাপ হতে পারে? রাশিয়া গণিতে দুর্দান্ত। ‘পাওয়ার অব ম্যাথমেটিক্স বলে একটা কথা আছে’, যে জাতি গণিতে যত ভালো সেই দেশ তত উন্নত।
এবার আর আমি কিছু বলতে পারলাম না। বাবার যুক্তিটা অকাট্য। এভাবে ভেবে দেখিনি।
তারপর বাধ্য ছেলের মত বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী স্কলারশীপের জন্য দরখাস্ত জমা দিয়ে দিলাম। বাবা বললেন, “কাউকে বলিস না কিন্তু”।
আমিঃ কেন বাবা?
বাবাঃ প্রথমতঃ তুই সবাইকে বলে বেড়ালি যে এ্যপ্লাই করেছিস আর তারপর হলোনা তখন দেখবি টিপ্পনী কাটার লোকের অভাব হবেনা। দ্বিতীয়তঃ আধুনিক যুগের লোকজন বিশ্বাস করেনা, কিন্তু আমি করি, খারাপ লোকদের কূনজর পড়তে পারে।
আমার আধুনিক বাবার এমন গোঁড়ামী কথা সেদিন আমর পছন্দ হয়েছিলো না, কিন্তু অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম বাবা সেদিন ঠিকই বলেছিলেন।
নাতাশাঃ তুমি কফি খাবে?
আমিঃ দাও, ভালোই লাগবে।
নাতাশা কিচেনে চলে গেলো কফি বানাতে। আমার মনে পড়লো, এক সময় নাতাশা শ্যাম্পেন খুব পছন্দ করতো। আমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর, আমি ওসব খাইনা জেনে ছেড়ে দিয়েছে। বলেছে, “দরকার নাই ওসবের তুমিই আমার সবচাইতে বড় নেশা।”একটু পরে নাতাশা ন্যাচারাল বীনের সুবাশ ভরা কফি নিয়ে হাজির হলো সাথে মজার জিনিস ভারিনিয়ে। জ্যামকে এদেশে ভারিনিয়ে বলে সামারে এখানে বিভিন্ন ধরনের ফল পাওয়া যায়, তখন সেইসব ন্যাচারাল ফল থেকে ওরা জ্যাম তৈরী করে তুলে রাখে। তারপর পুরো শীতটা চলে ঐ ভারিনিয়ে দিয়ে। নাতাশা ট্রেতে সাজিয়ে এনেছে ধুমায়িত কফির দুটি কাপ, বাটি ভরা ভারিনিয়ে আর স্লাইস ব্রেড।
আমিঃ ভারিনিয়ে তো ফ্রীজে ছিলো না, তুমি কোথায় পেলে?
নাতাশাঃ কোথাও পাইনি, আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। আমি তো জানি তুমি ভারিনিয়ে খুব পছন্দ করো।
আমিঃ এ যে দেখছি ক্লুবনিকা ভারিনিয়ে (স্ট্রবেরী জ্যাম)! আমার প্রিয়।
নাতাশাঃ জানি, এ জন্যই তো এনেছি।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ধীরে ধীরে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেলাম ওদের কালচারে। এখনকার আমার সাথে ওদের খুব একটা পার্থক্য করা যাবেনা। অথচ এখানে আসার আগে কি বলেছিলাম! আবারো স্মৃতি রোমন্থনে শুরু হলো।
মস্কো যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় সব কিছু গোছগাছ করছি, হঠাৎ মনে হলো বাংলা গানের কিছু ক্যাসেট নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। ওখানে তো আর পাওয়া যাবেনা। বাংলা গান না শুনে কি থাকা যায়? পাঁচটি ক্যাসেট বেছে নিলাম। তারপর আবার খেয়াল হলো ওয়েটের কথা, ওয়েট ২০ কেজির বেশী নেয়া যাবেনা। তাহলে? দি আইডিয়া, একটাই ক্যাসেট নেব, তবে বেছে বেছে সব ভালো গান রেকর্ড করে নেব। মা বললেন, “চারতলার ভাবি খুব গানের সমঝদার, উনার কাছে ভালো গানের ক্যাসেট থাকতে পারে, নিয়ে আয়, রেকর্ড করে ফেরৎ দিয়ে দিস, আর উনার কাছ থেকে বিদায়টাও নিয়ে আয়।” ভালো প্রস্তাব। দ্রুত উপরে চলে গেলাম।
আমিঃ স্লামালাইকুম।
বিনীতার মাঃ ওয়া আলাইকুম।
আমিঃ আন্টি আপনার কাছে বাংলা গানের ক্যাসেট হবে? আমি রেকর্ড করে ফিরিয়ে দিতাম।
বিনীতার মাঃ (আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন) বাংলা গান? না তো, আমি তো ইংলিশ গান শুনি। বাংলা গান আমি একদম শুনিনা।
আশ্চর্য্য! উনাকে দেখে আমার কখনোই মনে হয়নি যে, উনি ইংলিশ গানের সমঝদার। এ যুগের মানুষ হয়ে আমি ইংলিশ গান পছন্দ করিনা, আর উনি সে যুগের মানুষ হয়ে ইংলিশ গানের ভক্ত!
বিনীতার মাঃ ওর বাবা বাংলা গান শোনেন। উনি তো এখন বাসায় নেই, তুমি বাবা কাল সময় করে এসো, উনি বেছে দেবেন।
আমিঃ জ্বী, মানে, কাল আর আসা হবে না।
বিনীতার মাঃ মানে।
আমিঃ মানে, আমিতো কাল বিদেশে চলে যাচ্ছি।
বিনীতার মাঃ বিদেশে? পড়তে?
আমিঃ জ্বী।
বিনীতার মাঃ ও, কই আমি তো জানতাম না।
আমিঃ জ্বী, খুব দ্রুত সব হয়ে গেলো কাউকে জানানোর সময় পাইনি।
বিনীতার মাঃ কোন দেশে যাচ্ছ?
আমিঃ রাশিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন।
বিনীতার মাঃ ও! যাও বাবা, দোয়া করি, আরতো দেখা হবে না।
আমিঃ একথা কেন বলছেন?
বিনীতার মাঃ বিদেশে গেলে আর তো কেউ ফিরে আসেনা।
আমিঃ আমি ফিরে আসবো। আমার দেশে আমি অবশ্যই ফিরে আসবো।
বিনীতার মাঃ (জোরে হেসে ফেলে বললেন) সবাইই যাওয়ার আগে এই কথাটা বলে। কিন্তু শেষমেশ কেউই আসেনা।
আমিঃ কি যে বলেন, নিজের দেশে আসবে না কেন?
বিনীতার মাঃ কি আর বলবো, আমার নিজের ভাইটাই ফিরে এলোনা (আক্ষেপের সুর ঝরে পড়লো উনার কথায়)
আমিঃ জ্বী, আপনার নিজের ভাই?
বিনীতার মাঃ হ্যাঁ, আমার নিজের ভাই। এ্যমেরিকায় গেলো আর ফিরে এলোনা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছিলো, এ্যমেরিকায় চলে গেলো। যাওয়ার আগে আমরা ভেবেছিলাম, দেশে বিয়ে দিয়ে দেব, তাও হলোনা।
আমিঃ জ্বী, বুঝলাম না।
বিনীতার মাঃ সে তো ওখানে এ্যমেরিকান মেয়ে বিয়ে করেছে। বাঙালী মেয়ে তো সে বিয়ে করলো না।
আমিঃ (আমার মন খারাপ হয়ে গেলো, মনে মনে ভাবলাম, না আমি ফিরে আসবোই) আচ্ছা আমি যাই তাহলে।
বিনীতার মাঃ তোমার ক্যাসেট তো দিতে পারলাম না বাবা।
আমিঃ থাক, সমস্যা নেই।
বিনীতাঃ আমি দিচ্ছি মা।
কোন ফাঁকে যে উনার একমাত্র মেয়ে বিনীতা এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি।
বিনীতার মাঃ তোর কাছে আছে?
বিনীতাঃ হ্যাঁ মা।
তারপর ক্যাসেট আনতে ভিতরের রূমে চলে গেলো। সদ্য কৈশোর পেরোনি এই মেয়েটির দিকে আমি কখনোই তেমন একটা ভালো করে তাকাইনি। আসলে তেমন কোন আকর্ষণ বোধ করিনি। মেয়েটি যে অসুন্দরী তা নয়। আমার বন্ধু রাকিবতো ওকে দেখে রীতিমতো অভিভুতই হয়েছে। কিন্তু আমার ইন্টারেস্ট ছিলো না, ওকে খুব ছোট মনে হতো।
কয়েক মিনিট পরে কিশোর কুমার সহ, তিনটি গানের ক্যাসেট নিয়ে এলো বিনীতা। ওর হাত থেকে ক্যাসেটগুলো নিয়ে আমাকে দিলেন ওর মা। আমি ক্যাসেট নিয়ে ঘরে চলে এলাম। ওখানে বেশ ভালো ভালো কিছু গান ছিলো। এর মধ্যে কিশোর কুমারের দুটি গান এখনো মনে পড়ে – ১। তোমার বাড়ীর সামনে দিয়ে, আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে, তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থেকো, শেষ দেখাটা দেখতে পাবে।’ ২। ‘নয়নো সরসী কেন ভরেছে জলে কতকি রয়েছে লেখা, কাজলে কাজলে……………..।’
নাতাশাঃ কফি শেষ, ভারিনিয়ে শেষ, এবার আমার যাওয়ার পালা।
আমিঃ যাবে? আজ তো কোথাও বেড়ানো হলোনা!
নাতাশাঃ বেড়ানোর কি দরকার? আমার তো এরকমই ভালো লেগেছে। রান্না করলাম, লাঞ্চ করতে করতে ফিল্ম দেখলাম, গল্প করলাম, কফি খেলাম। আর বেড়ালে কি হতো?
আমিঃ বাইরে বেড়ানো হতো। রেস্টুরেন্টে খাওয়া হতো।
নাতাশাঃ ছাই হতো। রেস্টুরেন্টে বাইরের খাওয়া, ক্যাফেতে বাইরের কফি, ওতে কোন শান্তি আছে? নিজের ঘরেই শান্তি! কত সুন্দর সময় কাটলো!
আমার মাথায় হঠাৎ স্ট্রাইক করলো – নিজের ঘর বলতে কি বোঝাতে চাইছে নাতাশা?
নাতাশাঃ এখন তাহলে উঠি?
আমিঃ ঠিক আছে। (আমিও উঠে দাঁড়ালাম ওকে বিদায় জানাতে)
নাতাশা যখন ওভারকোট পড়ছে, তখন আমি ভাবলাম বাইরে স্নোফলের কি অবস্থা একটু দেখি। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে চাইলাম তুষারপাত কমেছে কি না, ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম কমা তো দূরের কথা সমগ্র প্রকৃতি কাঁপিয়ে শুরু হয়েছে তুষার ঝড়!
আমি নাতাশার কাছে গেলাম। ওভারকোট পড়ে ও তখন বুটও পড়ে ফেলেছে। মাফলারটা গলায় লাগাচ্ছিলো। অবিরাম তুষারপাত আর তুহীন শীতের বৈরী আভাওয়ার সাথে চিরকাল সংগ্রাম করে আসছে এই জাতি। সেই সংগ্রামের একটি অংশ এই ভারী কাপড়-চোপড় পড়া।
আমিঃ বাইরে মিতেল (তুষার ঝড়) হচ্ছে।
নাতাশাঃ কি বলো?
আমিঃ হ্যাঁ আমরা ভিতরে বসে টের পাইনি। জানালা দিয়ে দেখলাম।
নাতাশাঃ আচ্ছা থাক, কি আর করা? আমি চলে যাই
আমিঃ আমি গাড়ী চালিয়ে তোমাকে পৌছে দিতে পারি, কিন্তু তাতে কাজ হবেনা, রাস্তায় এখন প্রচন্ড জ্যাম হবে, এক ঘন্টার জায়গায় তিন ঘন্টা লেগে যাবে।
নাতাশাঃ সমস্যা নাই আমি মেট্রোতে করে চলে যাব।
আমিঃ মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত তো যেতে হবে তাও এক কিলোমিটার পথ। বাসগুলো নিঃসন্দেহে জ্যামে আটকে আছে, আর এই তুষার ঝড়ে এক কিলোমিটার হেটে যাওয়া অসম্ভব।
নাতাশাঃ দেখি কোনরকমে চেষ্টা করে চলে যাই। আমরা তো এই সব কিছুর সাথে চিরকালই সংগ্রাম করছি।
আমিঃ থাক আজ আর সংগ্রাম করতে হবেনা। অনেক দেরী হয়ে গেছে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। এখন কি করে বেরুবে? তার চাইতে তুমি বরং আজ রাতটা এখানেই থেকে যাও।
গভীর দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকালো নাতাশা, এই প্রস্তাবটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো ও। আর কথা না বাড়িয়ে রয়ে গেলো। একটি অন্তরঙ্গ রাতের পর একটি সুন্দর ভোর দেখার প্রত্যাশায়।
শয্যায় নারীর উপস্থিতি রসবোধ জাগিয়ে তোলে। বললাম, “তুমি ফলভারে নূয়ে পড়া পীচ বৃক্ষের মতো ভরা যৌবনা। তোমার তনুর প্রতিটি বাঁক এতো মনোরম! এমনটা সহজে দেখা যায়না।” ও আমার দিকে সতৃষ্ণ তাকিয়ে আছে আরো কিছু শোনার অপেক্ষায়। তোমার শ্বেতবর্ণ ত্বক এতো স্বচ্ছ এতো মসৃন যে আঙুলের স্পর্শ মাত্র সহ্য হয়না।” ও বললো, “পারোও তুমি, এতো বর্ণনা জানো!”
আমিঃ “আমি যদিও তোমাদের দেশে অনেকদিন, তারপরেও শেষমেশ আমি প্রাচ্য দেশীয়। নারীর সৌন্দর্য্যের বর্ণনা দেয়া প্রাচ্যদেশীয়দের রীতি। আমরা প্রথমে মধুবাক্য দিয়ে প্রেমাস্পদকে জাগিয়ে তুলি।”
নাতাশাঃ জানি। তোমার সাথে আজ প্রথম শয্যা নয়।
আমিঃ তারপরেও প্রতিটি ক্ষণই প্রথম ক্ষণটির মতো রঙিন করে তোলা উচিৎ।
নাতাশাঃ তোমার এই শৈলীটিই আমাকে আরো বেশী পাগোল করে।
নাতাশার রূপ-শুভ্র পেলবতা, গোলাপ তনুর পূর্ণ সমর্পন, আর আমার পুরুষালী উন্মত্ততায় আমরা হারিয়ে গেলাম হিম রজনীর তমসায়। আদিম সুখের চুম্বক আকর্ষণ ও সম্মোহন এড়াতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীর কোন যুবক-যুবতীর নেই। ঘরের বাইরে তুষার ঝড়ের আবেশে গৃহলোকে আমরাও ঝড় তুললাম। নারী-পুরুষের উদগ্র কামনা উত্তাল-তরঙ্গময় হয়ে উঠলো।
পরদিন আমার ঘুম ভাঙলো, একটু দেরীতেই। ঘুম থেকে জেগে দেখি পাশে নাতাশা নেই। চলে গেলো কি? আমাকে না বলেই! না এরকম ও করেনা। কি জানি, হতেও পারে, মেয়েদের মন মেজাজের তো কোন ঠিক নেই। অবিবাহিতা তরুনীর মনতো আরো জটিল, কি যে চায় সে নিজেও জানেনা। রান্না ঘরে আওয়াজ শুনলাম। কান খাড়া করলাম, নাতাশা কি কিচেনে? হতে পারে, কিন্তু আমার বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। জোড়ে ডাকবো নাতাশাকে, তাও ইচ্ছা করছে না। মাথার কাছে টিভির রিমোটটা খুঁজে পেলাম। বাটন টিপে অন করলাম টিভি। আজকে সানডে। খ্রীষ্ট ধর্মের পবিত্র সাপ্তাহিক দিন। রাশিয়ার ন্যাশনাল চ্যানেলে একজন পাদ্রী বক্তৃতা করছেন। এখানে আগে (কম্যুনিস্ট শাসনামলে) ধর্ম নিষিদ্ধ ছিলো ধর্মকে নিয়ে বিদ্রুপ করা হতো, আর এখন ধর্মের প্রচারই সব চাইতে বেশী। যে দেশ একসময় রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করা প্যট্রোনাইজ করেছে, সেই দেশেই এখন রাজনীতির মূল এলিমেন্ট ধর্ম। ইতিহাসের কি পরিহাস!
নাতাশাঃ তুমি উঠে গেছ?
আমিঃ হ্যাঁ,
নাতাশাঃ আমি দেখলাম তুমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তাই আর বিরক্ত করিনি।
রাশানদের অনেকগুলো ভালো দিকের একটা হলো, কাউকে ঘুম থেকে জাগাবে না। ঘুম হলো ন্যাচারাল, একজন মানুষের শরীরের জন্য যতটুকু ঘুম দরকার ঠিক ততটুকুই সে ঘুমাবে। সেই ঘুমের চাহিদা শেষ হলে তার শরীরই তাকে জাগিয়ে দেবে। তার আগে ডেকে তুললে এটা তার শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
নাতাশাঃ আমি তোমার জন্য ব্রেকফাস্ট রেডী করেছি।
আমিঃ গুড গার্ল। (ওকে টেনে কাছে এনে গভীর চুম্বন করলাম, আমার মৃদু নিস্পেষণে পুরোপুরি সমর্পিত হলো পাইন পাতার বুনোগন্ধি এক তরুণী।। ভোরের এই চুম্বনটির জন্য ও অপেক্ষা করছিলো। কয়েক মিনিট পার করলাম আরেকটি নীরব সম্মোহনে।)
নাতাশা খুব সুন্দর ব্রেকফাস্ট তৈরী করেছে। ব্রেড টোস্ট করেছে, বাটার, চিজ, ডিমের অমলেট, চিকেন ফ্রাই, ইয়োগার্ড, ফ্রুটস, র টি সব টেবিলে রেডী। পরিবেশন অতি সভ্য, সুন্দর ও রুচিশীল। ভাবলাম মেয়েটা খুব সংসারী, যার ঘরে যাবে তাকে খুব সুখী করতে পারবে।
নাতাশাঃ বাইরে চমৎকার আবহাওয়া।
আমিঃ তাই।
নাতাশাঃ হ্যাঁ, কোন স্নোফল নেই। এমনকি সূর্য মামাও উঁকি দিয়েছে।
আমিঃ তাই?
নাতাশা কিচেন কাম ডাইনিং রুমের পর্দাটা সরিয়ে দিলো। কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে সোনঝরা রোদের ঝিলিমিলি দেখছি। ঝকঝকে রোদের একাংশ আমার ঘরে এসে ঢুকলো। মনের অজান্তেই মুখ থাকে বেরিয়ে এলো, “বাহ্!”
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, টেবিলের উপর ফুলদানীতে পাঁচটি কার্ণেশন ফুল সাজানো। ঝকঝকে রোদ পড়ে ফুলগুলোকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে। ফুল আমার সবসময়ই প্রিয়। ফুল দেখলে মন ভীষণ আলোড়িত হয়ে যায়। দ্বিতীয়বারের মত আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “চমৎকার!” ফুলের ওপাশে বসা নাতাশাকে আরো বেশী সুন্দর লাগছে। বাইরে ঝিলিমিলি রোদ, ভিতরে একরাশ কার্নেশন, এই সময় দুই টাকার একটি বেলীফুলের মালা ওর সোনালী চুলে জড়িয়ে দিলে বেশ হতো।
নাতাশাঃ খুব সুন্দর তাই না?
আমিঃ বাইরে ঝকঝকে রোদ, ভিতরে সাজানো গোছানো টেবিলে একরাশ ফুল, সামনে অপরূপ রূপসী, কেবল সুন্দর না, অদ্ভুত!
নাতাশাঃ (কৌতুক করে বললো) কবিতা লিখবে?
আমিঃ কবিতা লেখার মতই পরিবেশ।
নাতাশাঃ জানো, যেদিন আমি জানতে পারলাম যে, তুমি কবিতা লেখো, সেদিন থেকে তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ আমার আরো বেড়ে গিয়েছিলো।
আমিঃ কেন, কোন কবির সংস্পর্শে এসেছো তাই? আমি তো ওমর খৈয়ামের মতো প্রতিভাবান-খ্যতিমান নই যে, তোমাকে নিয়ে কালজয়ী কবিতা লিখবো?
নাতাশাঃ কালজয়ী কবিতা লিখতে পারলে ভালোই হতো, তবে অত চাহিদা আমার নেই। আসলে কবিতা লেখা রুচীর পরিচয় বহন করে। তুমি রুচীশীল।
আমি মনে মনে ভাবলাম, আমাকে কতটুকু রুচীশীল বলা যায়। দেহের বাঁধনে জড়িয়েছি বহুবার, হৃদয়ের বন্ধনে কখনো জড়াইনি। স্কুল পড়ুয়া আমার নিস্পাপ জীবনে হেনরি মিলারের ‘টপিক অফ ক্যন্সার’ বা সমরেশ মজুমদারের ‘প্রজাপতি’ পড়ে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম, এমন কি হয়? সমাজ কি এতোই কলুষিত হয়ে গিয়েছে? পাশ্চাত্য সমাজে প্রবেশ করে তারুণ্যের উন্মাদনায় আমার নিজের জীবনও সেরকম হয়ে গিয়েছে। এটা কি রুচীশীলতার পরিচয়?
নাতাশাঃ আজ কি আমরা কোথাও বেড়াতে যাবো?
আমিঃ (একটু ভেবে বললাম) না বোধহয়। কাল তো ওয়ার্কিং ডে। আজ দেরী হয়ে গেলে, কাল সমস্যা হতে পারে।
নাতাশাঃ (নাতাশা একটু মন খারাপ করে) আচ্ছা থাক। গতকাল তো আমরা খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছি।
আমরা দুজনে আয়েশ করে ব্রেকফাস্ট করছিলাম।ধীরে সুস্থে খেয়ে যাচ্ছে নাতাশা, আমি বহুবার মনযোগ দিয়ে দেখেছি, প্রতিটি আহার-ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা রূপসুষমা ঝরে পড়ে।”কিসের যেন একটা অভাব বোধ হচ্ছে।” বলে নাতাশা বাংলা গানের সিডি চালিয়ে দিলো। ঠিক ধরেছে, এই কখনো আনমনা কখনো সচেতনা রুশ মেয়েটি। এই মুহুর্তে একটি পটভূমী সঙ্গিতের প্রয়োজন ছিলো। চা খেতে খেতে আমি জানালা দিয়ে দূরের বেলকিনিতে একজন কিশোরীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ঠিক সে সময়ে কাকতালীয়ভাবে সিডিতে নজরুল গীতির ঐ গানটি বাজতে লাগলো, ‘মনে পড়ে, মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে বিদায়ও সন্ধ্যাবেলা, আমি দাড়ায়ে রহিনু এপারে, তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা, …………..।’
আমি আবার স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম। যেদিন প্রথম দেশ থেকে মস্কোর উদ্দেশ্যে ফ্লাই করবো। দুপুর একটার দিকে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। মা বললেন, যা বিল্ডিং-এর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আয়। আমি উপরের সবগুলো ফ্লাটে গেলাম। বিনীতাদের ফ্লাটে গিয়ে ওর মাকে বললাম, “আমি চলে যাচ্ছি”। উনি বললেন, “আমি আসছি বাবা:। অনেকেই আমাকে বিদায় জানাবার জন্য নীচে নেমে এলেন। একটু পরে বিনীতার মা নেমে এলেন তবে একা নয় বিনীতাও নেমে এলো। আমি আর এক দফা সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বাবা-মাকে সালাম করলাম, আমার বাবা-মা বরাবরই খুব শক্ত মানুষ উনারা কেউ কাঁদলেন না। কিন্তু বড় বোন কাঁদতে লাগলেন। মা বললেন, “যা বাবা, ভালো ভাবে পড়ালেখা করিস, তোর বাবার মুখ রাখতে হবে।” আমি গাড়ীতে উঠতে উঠতে অনেকে চলে গেলেন। শেষ থাকলেন বিনীতার মা। এবার তিনিও যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। বললেন, “:ভালো থেকো বাবা, দোয়া করি”। তারপর বিনীতাকে বললেন, “চল যাই”।
কিন্তু বিনীতা গেলোনা। বিনীতার মা আরেকটু সময় দাঁড়ালেন। তারপর আবার বিনীতাকে বললেন, “চল যাই”। বিনীতা তাও গেলোনা। ওর মা একটু বিব্রত হলো। এবার আমিও একটু বিব্রত হলাম। মেয়েটা যাচ্ছে না কেন? আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। বিনীতার মা উপরে উঠে গেলেন। বিনীতা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ী স্টার্ট দেয়ার জন্য রেডী হচ্ছে, বাবা আমার সাথে গাড়ীতেই ছিলেন, মামা এসেছিলেন আমাকে এয়ারপোর্টে পৌছে দিতে। তিনিও গাড়ীতে ছিলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো কেবল মা, বড় বোন আর উনাদের একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো বিনীতা। আমি একটু বিব্রত বোধ করতে লাগলাম। মনে মনে ভাবছি, মা কি ভাববেন, বড় বোন কি ভাববে, বাবা কি লক্ষ্য করেছেন? গাড়ী স্টার্ট দিয়ে ইন গেইট পর্যন্ত গেলো। বিনীতা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান গেইট খুলে দিলো গাড়ী বাইরে যাওয়ার পর গেইট ধীরে ধীরে লাগাতে লাগলো। বিনীতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। বুঝলাম গাড়ী চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ও দাঁড়িয়ে ছিলো।
নাতাশাঃ কোন কিছু ভাবছো?
আমিঃ না, তেমন কিছু না।
নাতাশাঃ এনি সুইট মেমোরী?
আমিঃ (একটু অপ্রতিভ হয়ে) না কিছুই না।
নাতাশাঃ ঐ মেয়েটিকে মনে পড়েনিতো?
আমিঃ কোন মেয়েটিকে?
নাতাশাঃ ঐযে তুমি একবার বলেছিলে, কোন একটা মেয়ে যেন, তোমার মস্কো আসার দিন, তোমাকে বিদায় দিতে এসে তোমার গাড়ী মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলো।
আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম! আমি তো সেটাই ভাবছিলাম, কিন্তু ওর মনে হঠাৎ এটা এলো কেন? কাকতালীয় ঘটনা ঘটে জানি, তাই বলে এরকম! জগৎ সত্যিই রহস্যময়।
নাতাশাঃ তুমি অনেক দিন দেশে যাওনা। তোমার বাড়ীর কথা মনে পড়েনা?
আমিঃ বাড়ী বলতে বাবা-মার সাথে টেলিফোনে তো প্রায়ই কথা হয়। মোবাইল টেলিফোন আর ইন্টারনেটের যুগে এটা তো কোন সমস্যাই না। ফেইসবুকেও বাবা এ্যকাউন্ট খুলেছেন, বড় বোনের এ্যাকাউন্ট আছে। প্রতিদিনই সবাই সবাইকে দেখি, মাঝে মাঝে ওয়েব ক্যাম ব্যবহার করি।
নাতাশাঃ তাই বোধহয় দেশে যাওয়ার চাহিদা ওভাবে আর নেই?
আমিঃ অনেকটা তাই।
নাতাশাঃ দেশ দেখতে ইচ্ছা হয়না? নিজের বাড়ী দেখতে ইচ্ছা হয়না?
আমিঃ একসময় খুব হোম সিক ফীল করতাম। এখন আর করিনা। তুমি তো জানো, সামারের ছুটিতে আমি ওয়েস্ট ইউরোপের কোথাও যাই। গত সামারে প্যারিস গিয়েছিলাম। ঢাকার চাইতে প্যারিস ভালো।
নাতাশাঃ তারপরেও আত্মীয়-স্বজন? বন্ধু-বান্ধব?
আমিঃ আত্মীয়-স্বজনদের সাথে একটা দূরত্ব তৈরী হয়েছে। পাঁচ বছর আগে যখন দেশে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছি পরিবারগুলো তো আর আগের মত নেই। কাজিনদের বিয়ে হয়ে আলাদা আলাদা সংসার হয়েছে। সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর বন্ধু-বান্ধবের বেশীরভাগের অবস্থাই আমার মত। কেউ কেউ আমার মতই স্কুল পাশ করার পরই বিদেশে পারি জমিয়েছে। আর যারা দেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়েছিলো, তারাও পরবর্তিতে বিদেশে চলে গেছে। কেউ হায়ার এডুকেশনের জন্য আর বেশীরভাগই ইমিগ্রেশন নিয়ে কানাডা, এ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইত্যাদি।
নাতাশাঃ জানো আমার যেই ঘরটায় জন্ম হয়েছে, আমি এখনোও ঐ ঘরটায়ই আছি। এই ঘরটা আমি ছাড়তে পারবো না।
আমিঃ ওহ্, আমার যেই ঘরটায় জন্ম হয়েছে ওটা বাবা বিক্রি করে দিয়েছিলেন ব্যবসা শুরু করার ইনিশিয়াল ক্যাপিটালের জন্য। পরে আমরা একটা এ্যপার্টমেন্ট কিনেছিলাম। সেটাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
নাতাশাঃ কেন আবারো টাকার জন্য?
আমিঃ না
আমি আবার পিছনে ফিরে গেলাম। সিদ্ধেশরীর ঐ এপার্টমেন্টটিতে আমার একটা নিজস্ব রূম ছিলো। ওটা আমার খুব প্রিয় ছিলো। নিজের মতো করে সাঁজিয়েছিলাম। আমার ডালিয়া ফুল খুব পছন্দ। মা একদিন ডালিয়া ফুলের একটা পেইনটিং কিনে আমার রুমের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন। ঐ ছবিটার দিকে তাকালে আমার মন ভরে যেত।
আমি বই পড়তে ভালোবাসি, মা বড় একটা বুক শেলফ আমার রুমে দিয়ে দিলেন। পুরো শেলফ ভরে বই রেখেছিলাম। আমার সেই ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে টুয়েলভ পর্যন্ত যত বই আমি পড়েছিলাম সবই ওখানে ছিলো। পাশের ডাইনিং রুমে টেলিফোনটা ছিলো। তখনতো মোবাইল ফোন ছিলো না, ল্যান্ড ফোনই সম্বল। মাকে একবার বলেছিলাম আমার রুমে একটা এক্সটেনশান দিতে। মা রাজী হননি, বলেছিলেন, টেলিফোনের এক্সটেনশান থাকলে প্রাইভেসি থাকেনা। টেলিফোনের কথা বলতে আর একটা ঘটনা মনে পড়লো। একবার আমি ভ্যাকেশনে দেশে গিয়েছি। তার দুদিন পরে, বাড়ীতে কেউ ছিলো না, হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম। আই হোল দিয়ে ঠিক বোঝা গেলনা কে ওখানে আছে। আমি দরজা খুলতে দেখলাম, বিনীতা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি একটু অবাক হলাম।
আমিঃ কি ব্যপার?
বিনীতাঃ একটা টেলিফোন করতে পারি?
আমিঃ হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
বিনীতা ভিতরে ঢুকলো। তারপর টেলিফোনে তুলে কাকে যেন ফোন করলো। আমি একটা বেতের চেয়ারে বসলাম। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। আমি ওকে দেখছিলাম। তবে সেই দেখা একটা পুরুষ যেভাবে একটা নারীকে দেখে সেরকম দেখা নয়। আসলে ওর প্রতি আমি কখনোই কোন আসক্তি অনুভব করিনি। ওর টেলিফোনে কথা বলা শেষ হলে আমি বললাম, “শেষ?”
বিনীতাঃ হ্যাঁ শেষ।
আমিঃ বসো (ভদ্রতার খাতিরে)
বিনীতাঃ (লজ্জা পেয়ে বললো) না বসবো না।
ওর মুখ হঠাৎ করে এতো রক্তিম হয়ে গেলো মনে হলো যেন প্রভাত রাগে রঞ্জিত হয়েছে, কেন বুঝলাম না। তারপর ও দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। আমি দরজা বন্ধ করার জন্যে গেলাম ও বের হলেই দরজা বন্ধ করবো। এসময় ও হঠাৎ পিছনে ফিরে লাজুক হাসি হেসে বললো, “আপনি ভালো আছেন?” ওর প্রশ্ন, সলজ্জ চাউনি ইত্যাদি দেখে আমি একটু বিব্রত হয়ে গেলাম। তারপরেও বলবো, এই সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণীর সলজ্জ্ব হাসির ছবি নির্দ্বিধায় রং-তুলির ছোঁয়ায় বাধা পড়তে পারে খ্যতিমান কোন চিত্রশিল্পির ক্যানভাসে। আমি রাফায়েল বা পিকাসো হলে তখনই বসে যেতাম রং-তুলি নিয়ে। সর্বান্তকরনে চেষ্টা করতাম ক্ষণিকের মন কাড়া দৃশ্যটিকে চিরস্থায়ী অমর করে রাখতে। শ্বাশত এই চিত্রটিকে কেবল আমি কেন সারা পৃথিবীই দেখুক। তারপরে মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, ভালো আছি;” তারপর ও অনেকটা লাজুক ভঙ্গিতে দ্রুত উপরে উঠে গেলো।
আমার মনে হঠাৎ প্রশ্ন জাগলো, বিনীতাদের নিজেদের বাড়ীতেই তো টেলিফোন আছে, তারপরেও ও হঠাৎ আমাদের বাড়ীতে এলো কেন টেলিফোন করতে? আমি ঐদিন বুঝতে পারিনি, কিন্তু পরে বুঝেছিলাম। ও ইচ্ছা করেই এটা করেছিলো, একটা অজুহাত নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলো। এমনও হতে পারে ও লক্ষ্য করেছিলো যে, বাড়ী থেকে আমি ছাড়া আর সবাই বেরিয়ে গেছে। ও এই সুযোগটাই ব্যবহার করেছিলো। হয়তো একান্তে আমাকে দেখতে চেয়েছিলো, কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো। আচ্ছা আমার কি উচিৎ ছিলো ওর সাথে কিছু সময় কথা বলা। আলতো করে অন্তত একটি চুমু খাওয়া। কিন্তু এটা আমি তখন করতে পারতাম না। সেই সময়ের রক্ষণশীল বাংলাদেশে এটা করা ঠিক হতোনা। আমি না হয় ইউরোপে থাকি ও তো বাংলাদেশীই।
নাতাশাঃ তুমি দেখছি আবার অন্যমনষ্ক হয়ে গেলে! তোমাদের বাড়ীটার কথা বললে না।
আমিঃ ও বাড়ী। না মানে বাবা ওটা বিক্রি করেছিলেন টাকার জন্য নয়, বাবা তার অফিসের কাছে একটা এ্যপার্টমেন্ট চাচ্ছিলেন তাই।
আমার স্পষ্ট মনে পড়লো বিনীতার সাথে ওটাই ছিলো আমার শেষ দেখা। তারপর তো ভ্যাকেশন শেষ হলে আমি মস্কো ফিরে আসি। নয়মাস পর আমি বাবাকে ফোন করেছিলাম। বাবা বললেন, “সিদ্ধেশরীর এ্যপার্টমেন্টটা বিক্রি করে দিয়েছি রে।”
আমিঃ কেন বাবা?
বাবাঃ ওদিকটা ঘিঞ্জি হয়ে গেছে রে। আমার অফিসটা গুলশানে শিফট করেছি, তাই গুলশানেই একটা এ্যপার্টমেন্ট কিনে ফেললাম।
এরপর আমি যতবার দেশে গিয়েছি। গুলশানের এ্যপার্টমেন্টেই উঠেছি।
দুজনে মিলে তৃপ্তি ভরে ব্রেকফাস্ট শেষ করলাম।
আমিঃ চমৎকার ব্রেকফাস্ট হয়েছে নাতাশা। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
নাতাশাঃ ওয়েল কাম। তুমি কি প্রতিদিনই এমন ব্রেকফাস্ট চাওনা?
আমিঃ অবশ্যই চাই।
নাতাশাঃ সত্যিই চাও?
আমিঃ তাহলে আমি আমার বাবা-মাকে বলি।
আমি হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম। কি বলছে ও?
আমিঃ বাবা-মাকে কি বলবে?
নাতাশাঃ বারে, তুমিই তো বললে যে, প্রতিদিনই এরকম ব্রেকফাস্ট চাও।
আমিঃ তা তো চাইই, কিন্তু বাবা-মাকে কি বলবে?
নাতাশাঃ আমাদের বিয়ের কথা।
আমিঃ কোন বিয়ের কথা? (আমি অনেকটাই হতবাক হলাম)
নাতাশাঃ আমাদের, আমাদের বিয়ের কথা। তোমার আর আমার।
এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম, ও কি বলতে চাইছে। কি বলবো ওকে? এখানে গার্লফ্রেন্ড কোন ব্যপার না। আমার অনেক গার্লফ্রেন্ডই ছিলো। তাদের সাথে এখন আর কোন যোগাযোগই নেই। নাতাশাকেও তাদের মতোই নিয়েছিলাম। হ্যাঁ ওর সাথে একটু দীর্ঘ সময় কেটেছে এটা ঠিক। কেন কেটেছে আমি নিজেও জানিনা। হ্যাঁ, নাতাশাই এর পিছনে কারণ। ও আমার প্রতি খুব আন্তরিক ছিলো। আর মেয়েটা বেশ ভালোও। আমি সব সময়ই বুঝেছি ও খুব ভালো স্ত্রী হবে, কিন্তু ও আমার স্ত্রী হবে এটা কখনো ভাবিনি।
জীবন থেকে অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেলো। পড়েছি, চাকরী করছি, জীবন চলে যাচ্ছে, চলে যেতেই দিচ্ছিলাম, এই চলার পথে বিয়ে যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এই বিষয়টা নিয়ে কখনোই ভাবিনি। জৈবিক কারণে বিয়ের কোন প্রয়োজন আমার ছিলনা। পুরো পশ্চিমা বিশ্বে এখন ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে চলছে অবাধ যৌনাচার। আমিও নির্লজ্জভাবে নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে পশ্চিমা সংস্কৃতিকেই অনুসরন করেছি। যে তাপ দিয়ে এতকাল সব নারীসঙ্গ মধুময় করে তুলেছি তার পুরোটাই কায়া সর্বস্ব ছিলো, হৃদয়ের উত্তাপ সেখানে ছিলোনা।জৈবিক কারণে এখানে বিয়ে করার প্রয়োজন পড়েনা। মনের তাড়নায় হ্যাঁ, এখন যতটুকু আছে তা মনের তাড়নায়ই হচ্ছে। এই মনের তাড়নাটুকুও চলে গেলে হয়তো পরিবারের কনসেপ্টটাই উঠে যাবে।
নাতাশার সাথে আমার মনের তাড়না কখনো হয়নি। অন্তত আমার পক্ষ থেকে হয়নি। তাহলে আর ওর সাথে ঘর কি বাধবো?
আমিঃ নাতাশা।
নাতাশাঃ বলো।
আমিঃ আমি আসলে বিয়ে করার কথা এখনো কিছু ভাবছি না।
নাতাশাঃ সেটা কি আমি বিদেশী মেয়ে বলে?
আমিঃ না, ঠিক তানয়। বিদেশী দেশী আমার কাছে এখন আর কোন তফাৎ নেই। জানোই তো আমি বহু বছরই দেশের বাইরে। আমার অনেক অনেক দিন বাংলায় কথা বলাই হয়না।
নাতাশাঃ তা হলে?
আমিঃ মানে, আমি বোধহয় খুব সিরিয়াস কোন মানুষ নই। জীবনটাকে সিরিয়াসলি নিতে পারিনি। বিবাহের বন্ধনটা দায়িত্ববান মানুষদের জন্য। আমি সেরকম নই।
নাতাশাঃ আমি তোমাকে অনেক দিন ধরেই দেখছি, আমার কিন্তু তোমাকে বেশ সৎ মনে হয়েছে।
আমিঃ সৎ আর দায়িত্ববান কিন্তু এক না।
নাতাশাঃ আমাদের বন্ধন হলে দায়িত্বটা না হয় আমি নেব। তুমি শুধু আমার পাশে থাকবে।
আমিঃ আমি সাহস করতে পারছি না।
নাতাশাঃ নাতাশা, এরকম সবার ক্ষেত্রেই হয়। আমার মা বলেছিলেন আমার বাবার ক্ষেত্রেও এমন হয়েছিলো। তারপর ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেছে।
আমি নাতাশাকে কিছুতেই বলতে পারছিনা, আমি আসলে ওকে বান্ধবী হিসাবেই বরাবর ভেবে এসেছি, বধু হিসাবে ভাবিনি। ভাবতেও চাইনা। কিন্তু আমি এটা বললে ও মনে ভীষণ কষ্ট পাবে। রুশ মেয়েরা স্বাধীন অনেক ক্ষেত্রেই লঘুপক্ষ কিন্তু প্রানবন্ত। মন যাকে চায় তাকে পেতেই চায়। আমার নাতাশা রূপবতী, সুকন্যা আবার সুগৃহিনীও। তারপরেও বিয়ে প্রসঙ্গে আমি কিছু ভাবতে পারছি না।
আমিঃ নাতাশা আমি এখনো কোন কথা দিতে পারছি না। আমাকে সময় দাও ভেবে দেখি।
নাতাশাঃ ঠিক আছে ভাবো। তবে আমাকে যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে।
এরপর আর আমাদের মধ্যে তেমন কোন কথা হলোনা। নাতাশা জামা-কাপড় পড়ে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে আলতো করে আমার কপালে চুমু খেয়ে বললো, “প্রিয়তম তোমাকে আরেকবার বলছি, আমার বিয়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, তারুণ্যের উচ্ছাস আর কতদিন? ঘরতো বাঁধতে হবে। আমার মনে হয় আমরা দুজন সুখী হতে পারবো।”
নাতাশা চলে যাবার পর আমি অনেকক্ষণ স্হবির রইলাম। কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। আমি নাতাশাকে ভালোবাসিনি, কিন্তু নাতাশা আমাকে ভালোবেসেছে (আজ সেটা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম)। যাকে ভালোবাসিনি তাকে বিয়ে করি কিভাবে, মনকে তো আর আদেশ দেয়া যায়না। নাতাশা বললো, “ঘরতো বাধতেই হবে।” এই সিরিয়াস বিষয়টা নিয়েও কখনো সিরিয়াসলি ভাবিনি। যদি হঠাৎ ভেবেই ফেলি, তাহলে বধু হিসাবে কাকে বাছাই করবো? বিদেশী মেয়ে না আমার দেশী মেয়ে? এইদেশী মেয়ে আমার সাথে সুখী হবে কতটুকু? আমি তো ওদের নই। আবার আমার দেশী মেয়েই বা আমার সাথে সুখী হবে কতটুকু আমিতো অনেকটাই বদলে গেছি, আমিতো আমার দেশীও নেই। গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে জীবন বোধহয় একটু বেশীই জটিল হয়ে গেলো!
বিনীতার কথা মনে হলো। আমি কি দেশে ফিরে যাবো? দেশে ফিরে এ্যাডজাস্ট করতে পারবো? বিনীতাতো আমাকে ভালোবাসতো, আমি কি দেশে ফিরে ওর খোঁজ নেব? পরক্ষণে নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। কি হবে খোঁজ নিয়ে? দেশে ফিরে কি ওর সাথে আর দেখা হওয়ার চান্স আছে? আর দেখা হয়েই বা কি হবে? ও হয়তো এখন কারো ঘরের ঘরণী।
তু মেরী জিন্দেগী হ্যাঁয়,
তু মেরী হরখুশী হ্যাঁয়,
তু হি পেয়ার, তু হি চাহত,
তু হি আশিকী হ্যাঁয়
তু মেরী জিন্দেগী হ্যাঁয়,
তু মেরী হরখুশী হ্যাঁয়।
পহেলী মহব্বত ক্যা এহসাস হ্যাঁয় তু,
বুঝ কে জো বুঝ না পায়ে, ভো পিয়াস হ্যাঁ তু,
তু হি মেরি পহেলী খাঁয়েশ,
তু হি আখেরী হ্যাঁয়,
তু মেরী জিন্দেগী হ্যাঁয়,
তু মেরী হরখুশী হ্যাঁয়।
হর জখম দিল ক্যা মেরা, দিল স্যা দোয়া দে,
খুশিয়া তুঝে, ঘাম সারে মুঝকো খোদা দে,
তুঝকো ভুলা না পায়ে,
মেরি বেবাসী হ্যাঁয়,
তু মেরী জিন্দেগী হ্যাঁয়,
তু মেরী হরখুশী হ্যাঁয়।
তুমিই আমার জীবন,
তুমিই আমার সব সুখ
তুমিই প্রেম, তুমিই বাসনা
তুমিই আমার প্রেম কাহিনী
তুমিই আমার জীবন,
তুমিই আমার সব সুখ
তুমিই আমার প্রথম প্রেমের অনুভূতি,
তুমি এমনই তৃষ্ণা যা কখনোই মিটানো যাবেনা,
তুমিই আমার প্রথম বাসনা,
আর তুমিই শেষ
তুমিই আমার জীবন,
তুমিই আমার সব সুখ।
আমার হৃদয় এর প্রতিটি ক্ষত যেন তোমাকে শুভাকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে দেয়
আমি এই কামনা করি যে,
খোদা সব সুখ তোমাকে দিক,
আর আমাকে দিক সব দুঃখ,
আমি তোমাকে কিছুতেই ভুলতে পারিনা
এটাই আমার সব চাইতে বড় দুর্বলতা
You are my life,
You are my every happiness,
You are my life,
You are my every happiness,
You are love,
You are my devotion/passion
You are romance (love story)
You are my life,
You are my every happiness,
You are the feeling of my first love,
You are thirst, which cannot be extinguished
You are my first desire
You are the last,
You are my life,
You are my every happiness,
My heart’s each wound gives you blessing good wishes
I wish that The God give you all the happiness and gives me all sadness
I could not forget you
That is my weakness
অনেক সময় ও ইফোর্ট দিয়ে লিখেছেন বোঝা যাচ্ছে। তাই এখন তাড়াহুড়া করে না পড়ে পরে সময় নিয়ে পড়ে জানিয়ে যাবো কেমন লেগেছে।
ধন্যবাদ নাফিস। তুমি ঠিকই ধরেছ, গল্পটা লিখতে সময় লেগেছে।
“আমরা না ইউরোপ, না এশিয়া, আমরা রাশিয়া।”
:clap: :clap: :clap:
লেখাটা বেশ বড় করে ফেলছেন রমিত ভাই।
পাঠক্দের কথাটা একটু ভাঅবেন না।
দুই দফায় পইড়াও এখনো শেষ করতে পারি নাই।
বাট লেখা :clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ধন্যবাদ রাজীব।