বিষন্ন বিরিওজা – ২
—————————- ডঃ রমিত আজাদ
কার চুল এটা? কে এই মেয়েটি? এই রূমেই কি থাকত মেয়েটি? নাকি কারো বান্ধবী ছিল? স্মৃতি হিসাবে চুলটি রেখে দিয়েছে? কি জানি! এরপর একটা ভয়াল ধারনা আমাকে ঘিরে ধরল, মেয়েটি কি বেঁচে আছে?
রূমে আমি একাই থাকি। বেশ ভয় ভয় করতে লাগলো। রাতটা কাটাবো কি করে তাই ভাবছি। ভয় কাটানোর জন্য রূমের বাইরে করিডোরে বেরিয়ে এলাম। এখন রাত বারোটার মত। কিন্তু ডরমিটরিতে এটা কোন রাত না। করিডোরে লোক চলাচল আছে। মিনি স্কার্ট পরিহিতা একটি মেয়েকে হেটে যেতে দেখলাম। বেশ সাজগোজ করেছে। এখানকার মেয়েরা সবাই খুব ফ্যাশনেবল, অতিরিক্ত সাজগোজটা স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়েটাকে পরিচিত মনে হলোনা। আমাদের হোস্টেলের হলে চিনতাম। হোস্টেলে কারো কাছে এসেছে বোধহয়। সাজগোজ দেখে মনে হচ্ছে ডেটিং-এ এসেছে।
কিছুক্ষণ করিডোরে থেকে ভয় কিছুটা কাটলো। রূমে ফিরে গেলাম। টিভি সেট অন করাই ছিল। মিস্তিকা ছবিটি এখনও চলছে – একটি মেয়ে একটি অচেনা শহরে হারিয়ে গিয়েছে, সেখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে, এই নিয়ে ছবিটি। মনের এই অবস্থা নিয়ে ছবিটি আর দেখতে ভালো লাগছিল না। চ্যানেল চেইন্জ করলে হয়। নাহ্ একবারে সেটটি বন্ধই করে দিলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, ঘোর অন্ধকার। প্রথম পারমাণবিক পাওয়ার প্লান্ট প্রতিষ্ঠাকারী এই দেশটায়, বিদ্যুৎের সমস্যা হয়না। বরং রাশিয়ানরাই ইউরোপে বিদ্যুৎ রপ্তানী করে। ইউক্রেন বিদ্যুৎ রপ্তানী না করলেও তাদের নিজস্ব চাহিদা বেশ ভালোই মেটে। আমার জানালার বাইরে অন্ধকার থাকার কারণ ভিন্ন। বাইরে কিছুদূর পর্যন্ত কোন বিল্ডিং নেই। ঘন গাছপালা। তারা মধ্যে বিরিওজাই বেশি। আমার ঠিক জানালা বরাবরই সাত-আটটা বিরিওজা আছে।
আমি এম্নিতে সিগারেট খাইনা। মনের অস্বস্তিটা কাটানোর জন্য একটা সিগারেট খাব ঠিক করলাম। আলমারী খুলে মার্লবোরো সিগারেটের প্যকেটটা বের করলাম। এই সিগারেটটি এখানে খুব জনপ্রিয়। কিনে রেখেছি এক প্যকেট। হঠাৎ হঠাৎ খাই। সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখলাম লাইটারটা খুঁজে পাচ্ছিনা। কি করা যায়? কিচেনে গিয়ে দেখি। চুলা জ্বালানো থাকলে সিগারেট ধরানো যাবে।
ফ্লোরে দুটা কিচেন আছে। আমার রূমের কাছের কিচেনটির দিকে গেলাম। কিচেনে ঢুকেই একটা ধাক্কা খেলাম। কিছুক্ষণ আগে দেখা মিনিস্কার্ট পরিহিতা মেয়েটি ওখানে আরেকটি ছেলের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায়। একে অপরের অধরসুধা পান করছে। ছেলেটি আমাদের ফ্যাকাল্টিরই থার্ড ইয়ারের ছাত্র – ইভান। সেই মুহুর্তে ওরা দুজন গভীর আবেগে একে অপরের সান্নিধ্য উপভোগ করছিল। এসময় আমার ওখানে থাকা মানে ওদের প্রাইভেসি নষ্ট করা। সিগারেট না ধরিয়েই বেরিয়ে এলাম।
করিডোরের অপর পাশের কিচেনটার দিকে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ উপর তলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো মেক্সিকোর খোসে। আমাকে দেখেই চিৎকার করে বলল, “আরে রিমন, কেমন আছো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? হা হা হা।” ওর কথার ধরন দেখেই বুঝলাম, মাত্রাতিরিক্ত শরাব পান করেছেন। এই খোসে এম্নিতে ভদ্রলোক, কিন্তু মদের এমনই গুন, যে ভদ্রকেও অভদ্র বানিয়ে ফেলে। এই মদখোরদের দেশে আসার পর থেকে ইসলাম ধর্মের একটি আইনের প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ তৈরী হয়েছে -‘মদ খাওয়া হারাম’। পায়ে পায়ে সরে গেলাম। খোসে সম্পর্কে প্রচলিত আছে, মাতাল অবস্থায় সে ভয়াবহ হয়ে ওঠে। একবার কার সাথে যেন বেদম মারপিট করেছিল। নাহ সিগারেট ধরানো হলোনা। রূমে ফিরে এলাম।
রাতে ভালো ঘুম এল না। ঘুমটা বারবার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। একবার ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখলাম। আবছা আবছা সব কিছু … কী একটা গাছ দেখতে পেলাম, গাছটার পাতা ছোট ছোট, সবুজ সুন্দর পাতাগুলো বাতাসে তিরতির করে কাঁপছিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম সাউন্ড স্লিপ হয়নি এমন ভাব নিয়ে। যাহোক হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তায় চা খাওয়ার পরও, আবার এককাপ গরম ব্ল্যাক কফি বানালাম। এখানকার কফির স্বাদ ভালো। রিয়েল বীন কিনতে পাওয়া যায়। আমি সেটা ভাঙিয়ে কফি বানাই। খুব সুন্দর সুঘ্রানে মন ভরে যায়। ধুমায়িত কফির কাপটি হাতে নিয়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ চোখে পড়ল জানালার বাইরে গাছগুলোর দিকে। আরে ঐতো কয়েকটি বিরিওজা গাছ! এই গাছই তো আজকে রাতে স্বপ্ন দেখেছি। প্রবল অস্বস্তি আমাকে ঘিরে ধরল। কিছু বইয়ে পড়েছিলাম, স্বপ্ন রঙিন হয়না, বরাবরই সাদাকালো। কিন্তু কথাটা আমি বিশ্বাস করিনা, আমি জীবনে বহু রঙিন স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে টকটকে লাল গোলাপ দেখেছি, হরেক রঙের বাহারী ফুল দেখেছি, নীল সাগরের ঢেউ দেখেছি, গতরাতেও তো সবুজ পাতা দেখলাম। কিন্তু বিষয়টা কি? বিরিওজা গাছ স্বপ্নে দেখব কেন? আবার ভাবলাম স্বপ্ন স্বপ্নই, কতকিছুই তো স্বপ্নে দেখা যায়। ফ্রয়েডের স্বপ্ন ব্যাখ্যার উপর একটা বই পড়েছিলাম। আমার অবচেতন মনে যা আছে সেটাই স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়। অভিজ্ঞতার বাইরে স্বপ্ন হয়না। হ্যা তাইতো, আমার জানালার বাইরে এই কয়েকদিন যাবৎ তো বিরিওজা দেখছি, তো স্বপ্নে বিরিওজা আসতেই পারে।
হঠাৎ চোখ পড়ল ওয়াল পেপারের গায়ে ম্যাচের কাঠি লাগানো সোনালী চুলটার দিকে। গতরাতে ভালোভাবে চোখে পড়েনি। ম্যাচের কাঠিটি ওখানে একা নয়। একটা চেয়ার টেনে ওটার উপরে উঠে, খুব কাছে গিয়ে দেখলাম, ম্যাচের কাঠিটির সাথেই খুব সুক্ষ একটা কঞ্চি, গাছের ডালের শেষ অগ্রভাগটি। ম্যাচের কাঠিটির সাইজে কেটে তার সাথে লাগানো। এটা বিরিওজা গাছের ডালের সুক্ষ কঞ্চি হতে পাড়ে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে গেলাম। ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পেলাম, এক ঝাক পায়রা বিরিওজা গাছগুলো থেকে গ্রীস্মের উজ্জ্বল নীল আকাশে উড়ে গেল। আমি চেয়ার থেকে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। আমার অস্বস্তি আরো ঘনিভুত হলো।
টুক টুক টুক। দরজায় নকের শব্দ হলো। কে আবার এলো? দরজা খুলে দেখলাম, সাশা কাস্তুচেনকা। আমার ক্লাসমেইট এই ছেলেটি খুব ভালো ও ভদ্র। কখনোই কাউকে মনে আঘাত দিয়ে কথা বলে না। আমাকে খুব পছন্দ করে। আমিও ওকে পছন্দ করি।
আমিঃ আরে আরে এসো।
আমার ডিভানটার উপরে বেশ ভদ্রভাবে বসলো সাশা।
সাশাঃ তারপরে কেমন আছো? নতুন রূমে কেমন লাগছে?
আমিঃ তুমিই তো হেল্প করলে ঐদিন, মাল টনাটানি করতে।
সাশাঃ আরে কিছুনা। বন্ধুকে যদি হেল্প করতে না পারি, তো কিসের বন্ধু।
আমিঃ তারপরেও তোমাকে আরেকবার ধন্যবাদ।
সাশাঃ বাদ দাও। তোমার কেমন কাটছে বলো? গতকাল একবার এসেছিলাম বিকালের দিকে। তুমি ছিলেনা বোধহয়।
আমিঃ না, ছিলাম না। ৎেসলিনা গ্রাদস্কায়ায় গিয়েছিলাম।
সাশাঃ তোমার বান্ধবীর কাছে?
আমিঃ আরে আরে আমার বান্ধবীর কাছে না, এ্যাংগোলার বংফিমের বান্ধবীর কাছে। আমার বন্ধু বলতে পারো।
সাশাঃ ওতো তোমার দেশী, তাই না?
আমিঃ না ঠিক দেশী নয়। ইন্ডিয়ান, আমি তো বাংলাদেশের।
সাশাঃ তোমরা একই ভাষায় কথা বলো দেখলাম!
আমিঃ হ্যাঁ ভাষা একই, তবে দেশ ভিন্ন।
সাশাঃ বুঝতে পেরেছি, ও ওয়েস্ট বেঙ্গলের তাইনা?
আমিঃ ঠিক ধরেছ।
সাশাঃ কি যেন নাম?
আমিঃ নীলিমা।
সাশাঃ মানে আছে কোন?
আমিঃ নীল আকাশ।
সাশাঃ সুন্দর নাম তো! মেয়েটা কিন্তু অত সুন্দর নয়। তবে বেশ স্মার্ট।
আমিঃ পছন্দ হয়েছে নাকি?
সাশাঃ নাহ। আমি ভাই তোমার মতই কাঠখোট্টা। কোন গার্ল ফ্রেন্ড-ট্রেন্ড নাই।
আমিঃ নাই কেন? রাশানদের মধ্যে এটা আনইউজুয়াল।
সাশাঃ আসলো না তো কেউ।
আমিঃ তুমি চ্যাম্পিয়ন ওয়েট লিফটার। পেটা শরীর, আলমারীর মত বিশাল, তোমার কাছেই তো আসার কথা।
সাশাঃ কি জানি হয়তো উল্টা ভয় পায়।
এরপর সাশা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।
সাশাঃ তোমার সব ঠিক আছে তো?
আমিঃ কেন?
সাশাঃ তোমাকে কেমন যেন মনে হচ্ছে। রাতে ঘুম ঠিকমতো হয়েছে তো?
আমি কিছুটা সময় চুপ করে থাকলাম। বুঝতে পারছি না কি বলব। আদৌ কিছু বলব কিনা। পাগল ঠাওরায় যদি।
সাশাঃ আরে সমস্যা হলে বল। বন্ধুর যদি কোন কাজে লাগতে পারি, আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।
আমি একটু দ্বিধা নিয়ে আস্তে আস্তে ওকে সব খুলে বললাম। সব কিছু শুনে ওও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি তখন ভাবছি ও কি বলবে। এই কিছুদিন আগেও এদেশের মানুষজন সব নাস্তিক ছিল। এসব অতিপ্রাকৃত-ফ্রাকৃততে ওদের কোন বিশ্বাস ছিল না। যদিও এখন হুল্লোড় করে একের পর এক গীর্জা গড়ে তুলছে, তারপরেও কিছুটা রেশ তো রয়েই গেছে।
সাশাঃ অতিপ্রাকৃত কিছু হতে পারে।
আমিঃ তুমি অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস কর? তোমাদের দেশের মানুষ তো নাস্তিক ছিল।
সাশাঃ না, আমাদের দেশের মানুষ নাস্তিক ছিল না। আমাদের সরকার নাস্তিক ছিল। কম্যুনিস্টরা নাস্তিক হয়। প্রতিটি দেশের সরকারই তাদের নীতিটিকে জনগণের ঘাড়ে চাপাতে চায়। আমাদের দেশেও তাই ঘটেছিল। এর দ্বারা কেউ প্রভাবিত হয়েছিল, কেউ হয়নি।
আমিঃ তুমি কি বিশ্বাস কর?
সাশাঃ আমি একজন খ্রীস্টান। ভাববাদী দর্শনে বিশ্বাসী। আমি ব্যাক্তিগতভাবে মনে করি, প্রকৃতি যেমন আছে, তেমনি অতিপ্রাকৃতও রয়েছে।
আমিঃ এখন আমার বিষয়টার কি হবে তাই বলো?
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সাশা বলল।
সাশাঃ দেখি কি করা যায়। বাদ দাও। চলো বেড়াতে যাই।
আমিঃ কোথায় যাবে?
সাশাঃ গ্রীস্মকালে বেড়ানোর একটা ভালো জায়গা আছে।
আমিঃ কি নাম জায়গাটার?
সাশাঃ নামটা কিছু না, জায়গাটার কথা বলছি।
আমিঃ কি জায়গা?
সাশাঃ প্লায়াঝ।
প্লায়াঝ-এর সরাসরি ইংরেজী মিনিংটা বীচ। যেকোন জলাধারের তীর যেখানে গ্রীস্মকালে মানুষ সানবাথ করে, বেড়ায়, ইত্যাদি।
আমিঃ প্লায়াঝ-এ, যাবে?
সাশাঃ আরে সুন্দরী মেয়েদের টু-পিসে দেখতে পাবে, এর চাইতে মজা আর কিসে আছে!
আমিঃ ভুল বলোনাই। চলো যাই।
আমরা দুজনে সাঁতারের পোষাক-আষাক সরন্জাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
আমাদের ডরমিটরি থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে একটা লেক আছে। সেখানেই প্লায়াঝ। আমরা প্রথমে ট্রামে চড়লাম। তারপর নির্দিষ্ট স্টপেজে নেমে, কিছুদূর হাটতে হলো। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। এদিকটায় বিল্ডিং-টিল্ডিং কিছু নেই। একটা ফরেস্ট পার্কের ভিতর লেক। তারপরেও দুটা বাংলো টাইপ বাড়ী দেখলাম। একটার সামনে চেরী গাছে টসটসে চেরী ফল ধরে আছে। একটু রসনা তৃপ্তির প্রয়োজন অনুভব করলাম।
আমিঃ সাশা, দাঁড়াও।
সাশাঃ কি?
আমিঃ আসো চেরী খাই।
সাশাঃ এটা অন্য মানুষের গাছ।
আমিঃ কিসের অন্য মানুষের। দেখোনা রাস্তার উপরে।
সাশাঃ রাস্তার উপরে ঠিক আছে, তারপরেও মালিক থাকতে পারে। এই বাড়ীর সামনে যেহেতু, ওরাই হয়তো মালিক।
আমি ভালো করে আশপাশ দেখে নিলাম। নাহ্ কেউ নাই। থাকুক মালিক, আমরা এই সুযোগে চেরী খাব। কিশোর বয়সে পেয়ারা চুরীর মত একটা এ্যাডভেঞ্চার মাথায় চাপল। বেচারা সাশা অনিচ্ছা সত্বেও চেরী পারতে শুরু করল। দুজনে মিলে গাছ থেকে পারি আর খাই। টসটসে চেরীগুলো বেশ মজার। পাঁচ-ছয় মিনিট চেরী খেয়েছি, এমন সময় দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। এবার সাশা একটু অস্থির হয়ে গেল।
সাশাঃ চলো চলো তাড়াতাড়ি পালাই। কেউ এদিকে আসছে মনে হয়।
আমরা দ্রুত পা চালিয়ে। ওখান থেকে সরে পড়লাম। মুখে রয়ে গেল তাজা চেরীর স্বাদ।
প্লায়াঝে গিয়ে দেখলাম অনেক পরীর মেলা। কেউ ব্রুনেট, কেউ ব্লন্ড, কেউ রুসী। কেউ দীর্ঘাঙ্গী, কেউ মাঝারী গড়নের।বিস্ময়কর সুন্দরীরা টু-পিস পড়ে তাদের প্রগলভা ফিগার প্রদর্শন করছে প্লায়াঝে। অবশ্য প্রদর্শন করার উদ্দেশ্য তারা এখানে এসেছে এমন নয়। তারা এসেছে তুহীন শীতের পর গ্রীস্মের উজ্জ্বল দিনগুলিতে সোনারোদের উষ্ণতায় পুরো শরীর ভরিয়ে দিতে। এই সোনারোদের আদর পরশে তাদের শুভ্রতনু ধীরে ধীরে তাম্রবর্ণ ধারন করেবে। টুপি বা রূমাল দিয়ে মুখ ঢেকে অনকে পুরো শরীর বিছিয়ে দিয়েছে তপ্ত বালুর উপর। অনেকেই ঝাপিয়ে পড়ছে লেকের জলে। দাপাদাপি করে লেকের শান্ত নির্জন জল অস্থির করে তুলছে।
আমিঃ লেকটা মোটামুটি বড়, কোনদিকে যাব বলতো?
সাশাঃ হাটতে শুরু করি। হাটতে হাটতে যেখানে সবচাইতে সুন্দরী মেয়েদের দেখব, সেখানে থেমে যাব।
আমিঃ হা হা হা, ভালো বলেছ। পুরুষ মানুষের মনের কথা।
দুতিন ঘন্টা সাঁতার কেটে আর সানবাথ করে। ব্যাগ গুছিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম, ডরমিটরির উদ্দেশ্যে। ট্রামে উঠে আমি আর সাশা পাশাপাশি সীটে বসলাম। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছি, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমাদের দুই সীট পরে আমাদের ডরমিটরির ইলেকট্রিসিয়ান ভাসিয়া বসে আছে। ভাসিয়া আমাদের ফ্যাকালটি থেকেই পাশ করছে। যখন পড়ত তখন আমাদের ডরমিটরিতেই থাকত। তারপর পাশ করার পর ডরমিটরির ইলেকট্রিসিয়ান হিসাবে থেকে যায়। একটা রূম পেয়েছে, ওখানেই থাকে বিয়ে-টিয়ে করেনি। বিশ বছর যাবৎ ডরমিটরিতে আছে।
সাশাঃ ট্রাম ফাঁকা আছে, চল ভাসিয়ার পাশে গিয়ে বসি।
আমিঃ ভাসিয়ার পাশে বসার দরকার কি?
সাশাঃ কথা আছে।
গিয়ে বসলাম ভাসিয়ার কাছে। আমাদের দেখে একগাল হাসল ভাসিয়া।
ভাসিয়াঃ আরে তোমরা দেখছি! কোথায় গিয়েছিলে? প্লায়াঝে?
আমিঃ হু, আর তুমি?
ভাসিয়েঃ আমি লেক ছাড়িয়ে আরো তিন স্টপেজ সামনে, একটা দালানে গিয়েছিলাম কাজে। তোমরা কেমন সময় কাটালে?
আমিঃ ভালো।
সাশাঃ তোমার সাথে কথা আছে ভাসিলি।
ভাসিয়াঃ কি কথা?
সাশাঃ তুমি তো বিশ বছর আমাদের ডরমিটরিতে আছি তাইনা?
আমিঃ হ্যাঁ, এই ফল সিজনে একুশ বৎসর হবে। হঠাৎ এ’ প্রশ্ন কেন?
সাশাঃ না একটা বিষয় জানতে চাই। তুমি কি ৩০৫ নং রূমটা সম্পর্কে কিছু জানো?
ভাসিয়াঃ ৩০৫ নং রূমে আবার কি হলো?
সাশাঃ না মানে, ঐ রূমে কারা কারা থাকত?
ভাসিয়াঃ কারা কারা থাকত মানে? এই একুশ বৎসরে তো কত লোকেই এলো-গেলো আমি সবার নাম মুখস্থ করে রেখেছি?
আমিঃ না মানে ওখানে কি অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছিল? কোন অঘটন?
ভাসিয়া কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,
ভাসিয়াঃ ওখানে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে বলে তো মনে পড়েনা। কেউ তো বলে নি কখনো কিছু। তবে…..
সাশাঃ তবে কি?
ভাসিয়াঃ না, মানে, একটা মেয়ে..
আমিঃ একটা মেয়ে কি?
ভাসিয়াঃ আচ্ছা তোমাদের কি হয়েছে বলতো? হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
সাশাঃ রিমন কয়েকদিন হলো ঐ রূমে শিফট করেছে।
ভাসিয়াঃ রিমন শিফট করেছে তাতে কি হয়েছে?
সাশা আর আমি দুজনেই চুপ করে রইলাম। কি বলব বুঝতে পারছি না। আমার অভিজ্ঞতা যদি ওকে বলি, আর ও যদি পাগল ঠাওরায়। ভাসিয়া আবার খুব কমন ফিগার। সবার সাথে খাতির। এরপর পুরো ডরমিটরি জেনে গেলে একটা হাসাহাসি পড়ে যাবে।
একটু চুপ থেকে ভাসিয়া নিজেই বলল।
ভসিয়াঃ রিমন কোন অস্বাভাবিক কিছু কি ঘটেছে?
আমিঃ না তেমন কিছু নয়।
ভাসিয়াঃ বুঝতে পেরেছি কিছু একটা তো ঘটেছেই। না বলতে চাইলে না বলো। তবে আমি যা বলছি শোন।
আমি ও সাশা অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকালাম।
ভাসিয়াঃ বছর সাতেক আগে, ওখানে পোলিশ একটা মেয়ে থাকত। মেয়েটির নাম ছিল মাগদা।
সাশাঃ ছিল মানে? মেয়েটি কি এখন আর ইউক্রেনে নাই?
ভাসিয়াঃ সেটাই বলছি। শুধু ইউক্রেনে না, মেয়েটি এই পৃথিবীতেই নেই।
ভাসিয়ার কথা শুনে আমাদের বিস্ময় আরো ঘণীভুত হলো।
ভাসিয়াঃ মাগদা পোল্যান্ড থেকে স্কলারশীপ নিয়ে এখানে পড়তে এসেছিল। দীর্ঘাঙ্গী সুশ্রী মেয়েটি ছিল স্বর্ণকেশীনী। সদালাপী হাসিখুশী এই মেয়েটি অনেকেরই চোখে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত মেয়েটির সম্পর্ক হয় মরোক্কোর আবদুর রাজ্জাকের সাথে। রাজ্জাক এখন আর নেই পাশ করে ফ্রান্সে চলে গেছে। মাগদা আর রাজ্জাক খুব সুন্দর একটা জুটি ছিল। দুজনই সুশ্রী দীর্ঘকায় আর উচ্ছল ছিল। ওরা ৩০৫ নং রূমেই লীভ টুগেদার করত। মাগ্দা বিরিওজা গাছ খুব পছন্দ করত। তাই বেছে বেছে ঐ রূমটি নিয়েছিল। লক্ষ্য করেছ নিশ্চয়ই, ঐ রূমের জানালার পাশেই কয়েকটি বিরিওজা গাছ আছে। একবার শীতের ছুটিতে মাগদা পোল্যান্ড গেল। সেখান থেকে আর ফিরে আসেনি। তারপর আমরা দুঃখজনক খবর পেলাম। মাগদা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিল আইস স্কী করতে। তারপর সেখানে হারিয়ে যায়। অনেক খুঁজেও ওকে পাওয়া যায়নি।
আমিঃ পাওয়া যায়নি মানে কি? বেমালুম গায়েব হয়ে গেল?
ভাসিয়াঃ আবদুর রাজ্জাক পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। ঐ বছর সামারে ওর পাশ করার কথা ছিল। মাগদা ছিল ওর দু’বছরের জুনিয়র। বেচারা মাগদার শোকে পরীক্ষা ঠিকমতো দিতে পারেনি। পরবর্তি সেমিস্টারে স্পেশাল ব্যবস্থা করে ওর ডিফেন্স এ্যারেন্জ করা হয়। তারপর রাজ্জাক ফ্রান্সে চলে গিয়েছে।
সাশাঃ মাগদার কি হয়েছিল?
ভাসিয়াঃ আমাদের ডরমিটরিতে আরেকটো পোলিশ মেয়ে ছিল, মাগদাদের শহরেরই। একবছর পরে ও জানিয়েছিল, উঁচু পাহাড়ে, বরফের মধ্যে মাগদার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, এক বৎসর পরে। আরেকটি স্কী টিম মৃতদেহটি আবিষ্কার করেছিল।
সাশাঃ ভয়াবহ। মানুষের জীবনে যে কখন দুর্যোগ নেমে আসে কেউ বলতে পারেনা।
আমিঃ বেচারা আবদুর রাজ্জাক! ভালোবাসার মানুষটিকে হারালো!
ভাসিয়াঃ এবার রিমনের কি হয়েছে বলো। হঠাৎ কেন এতো কিছু জানতে চাইলে?
আমি আবারও চুপ করে রইলাম। এদিকে কথা বলতে বলতে ট্রাম আমাদের স্টপেজে চলে এলো। আমি আর সাশা নামার প্রস্তুতি নিলাম। ভাসিয়া দেখলাম বসেই আছে।
আমিঃ ভাসিয়া তুমি নামবে না?
ভাসিয়াঃ না, আমি একটু বাজারের দিকে যাব।
আমিঃ ও। যাও তাহলে।
ভাসিয়াঃ তুমি কিন্তু বললে না কি হয়েছে।
আমরা নামতে নামতে ভাসিয়া বলল।
ভাসিয়াঃ ঐ ৩০৫ নং রূমে আমিও মাস তিনেক ছিলাম, পরে ছেড়ে দিয়েছি। আমি তখন ট্রামের একেবার দরজায়, নেমে যাব যাব, এই সময় ভাসিয়ার কথা শুনে ঘুরে তাকালাম।
আমিঃ কেন ছেড়ে দিলে কেন?
ভাসিয়াঃ অস্বস্তি লাগত। কি কি সব স্বপ্ন দেখতাম!
(চলবে)
:clap:
ধন্যবাদ