বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ দিন

 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ দিন
————– ডঃ রমিত আজাদ

দিনটিকে মেঘাচ্ছন্ন বা রৌদ্রজ্জ্বল কোনটাই বলা যাবেনা,
একটু উষ্ণ অথচ মৃদু বাতাস বইছে
আর আমরা একদল তরুণ-তরুণী
অনেকটাই বিমর্ষ চোখে দাঁড়িয়ে আছি
প্রাচীন চিত্রকরদের আঁকা ছবির মত
বিশ্ববিদ্যালয়ের দালানের সামনে,
সবুজ চত্বরের অপূর্ব দৃশ্যপটে।

এই জ্ঞানের তীর্থস্থানে আমাদের সময় শেষ,
বলতে গেলে সমস্ত শিক্ষাজীবনেরই সমাপ্তি হল আজ
ক্যাম্পাসটা ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটাই আজ বড় বেশী
সামনে আরো ভালো কিছুর হাতছানি হয়তো আছে,
তারপরেও এই কটা বছরের আবেদন
বাকিটা জীবনের চাইতে অনেক অনেক বেশি ।

একদিন মহা পরাক্রমে এই চত্বরে প্রবেশ করেছি,
মনের আকাশে কল্পনা দিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়েছি,
তারপর দোর্দন্ড প্রতাপে দাপিয়ে বেড়িয়েছি
সমস্ত পথ-ঘাট, দালান-কোঠা,
চায়ের কাপে ঝড় তোলা ক্যান্টিন,
বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি, গানের অডিটোরিয়াম,
জ্ঞানের ক্লাশরূম, স্যারের অফিস,
সব সবকিছু।

কখনো বেদনার কখনো আনন্দের উচ্ছসিত যৌবন,
রূপোলি রোদের দুপুর,
সোনালী রঙের বিকেল,
গোধুলি আলোর সন্ধ্যা,
ফিনিক ফোটা জোৎস্না,
চন্দ্রভুক অমাবশ্যা,
মোহ, খেলা, বাঁধন, মুক্তি
সব সবকিছু এখানে ছিল

হঠাৎ ক্ষেপে ওঠা বন্ধুকে শান্ত করা,
সহসা ডুকরে কেঁদে ওঠা বান্ধবীর মান ভাঙানো,
সহপাঠিনীর চুলে রৌদ্রের খেলা,
ফল ও ফুলেল নির্জনতা,
রূপালী জলের প্রভা,
বৃষ্টিস্নাত মাটির সৌরভে উড়িয়েছি রঙিন ফানুস

“নাহ্‌, আর ভালো লাগেনা এই অনন্ত ছাত্রজীবন,
কবে যে পাশ করে প্রোফেশনে ঢুকব!”
দীর্ঘ পাঠজীবনের একঘেয়েমীতে অতিষ্ঠ হয়ে
মাঝে মাঝে বলে বসতাম ঐ ক্ষেদের কথাগুলো,
আর এখন বেশ বুঝতে পারছি,
ওটাই ছিল শ্রেষ্ঠ সময়।

দিনটিকে মেঘাচ্ছন্ন বা রৌদ্রজ্জ্বল কোনটাই বলা যাবেনা,
আরেকটি নতুন ঋতু এলো এলো বলে,
আর আমরা একদল তরুণ-তরুণী
অনেকটাই বিমর্ষ চোখে দাঁড়িয়ে আছি
আগামী ভোর হবে এই ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরে
শুধু রয়ে যাবে স্মৃতি, একদিন আমরা এই ক্যাম্পাসে ছিলাম।

একজন বৃদ্ধ শিক্ষককে মনে পড়ল,
যিনি হঠাৎ চলে গিয়েছিলেন,
একজন বন্ধুকে মনে পড়ল যে হঠাৎ কঠিন অসুখে পড়ে
আর ক্লাসে এলোনা,
অভিমান করে আত্মহত্যা করল যেই বান্ধবীটি,
ও বেঁচে থাকলে আজ আমাদেরই মতো বিমর্ষ হতো।
এখানে আমাদের সময় শেষ, শুধু শুধুই দাঁড়িয়ে আছি,
চলো চলো বাড়ি ফিরে যাই।

আরেকটু থেকে যেতে চাই, নিদেনপক্ষে সুর্যাস্ত পর্যন্ত,
আরেকটু স্মৃতি হাতড়াতে চাই,
সেই গ্রীস্মের রোদে পোড়া দিনগুলো,
বৃষ্টি ঝড়া দিনে জলে ভিজে লুটোপুটি,
আবার ভেসে গিয়েছি বসন্তের মাতাল বাতাসে,
আমরা একদল তরুণ-তরুণী
ঐ রংধনুকে ধরব বলে।

“নাহ্‌, আর ভালো লাগেনা এই অনন্ত ছাত্রজীবন,
কবে যে পাশ করে প্রফেশনে ঢুকব!”
দীর্ঘ পাঠজীবনের একঘেয়েমীতে অতিষ্ঠ হয়ে
কত অধীর প্রতিক্ষা করেছি এমন দিনের জন্য,
আর আজ মনে হচ্ছে এই দিনটি না এলেই ভালো হতো।

গোধুলীর ম্লান আলোয়,
ফুলেল নির্জনতা ছাপিয়ে
বৃষ্টির কান্নার মতো সন্ধ্যা নামে,
জীবনের সবচাইতে সুন্দর মুহুর্তগুলো অতীত হয়ে যায়,
হেরাক্লিটাস আপনি যথার্থই বলেছেন,
“একই নদীতে দুবার অবগাহন করা যায়না”।

অজস্র মিলন প্রহর পেরিয়ে আজ বিচ্ছেদের দিন
সব বন্ধুরা মিলে হাত ধরাধরি করে ক্যাম্পাসে চলারও শেষ দিন,
একটি ছন্দময় জীবনের সুরের মূর্ছনা হারাবার একেবারেই শেষ দিন।

২,৩৭৫ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ দিন”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।