ক্যাডেট কলেজে ভুতের সন্ধানে – 2
সিলেট ক্যাডেট কলেজ শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে। আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলে এয়ারপোর্ট। শহরের ইদানিং কিছুটা এক্সটেনশন হলেও বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান মালিনীছড়া ও অপর চা বাগান লাক্কাতুরা পেরিয়ে তারপররই সিকক। কলেজের পরও জনবসতি তেমন নেই।কলেজ ক্যাম্পাসের মাঝখান চিরে যাওয়া মেইন রোডটির শুরুর মাথায় আছে মসজিদ, প্যারেড গ্রাউন্ড শেষের মাথায় হসপিটাল। রোডের একপাশে আছে প্রশাসনিক ভবন, এ্যাকাডেমিক ব্লক, হাউস, ডাইনিং হল, আর অন্যপাশে আছে খেলার মাঠগুলো, এবং মাঠগুলো পেরোলেই টিচার্স কোয়ার্টার, ভাইস-প্রিন্সিপালের বাংলো তার পিছনে টিলার উপর প্রিন্সিপালের বাংলো ইত্যাদি। এরপর দেয়াল ঘেরা ক্যাম্পাসের সীমানা শেষ। দেয়ালের ওপাশে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোড। এয়ারপোর্ট রোডের ওপাশে বাংলাদেশ বনবিদ্যালয়, তাও টিলা আর বনে ঘেরা। সব মিলিয়ে খাঁ খাঁ পরিবেশ।
ক্লাস সেভেনে আমি থাকতাম ৩৪ নং রূমে। আমাদের রূমটি ছিল হাউসের এক প্রান্তে ডাইনিং হলের পাশেই। ১৯৮২ সালে ডাইনিং হলটি নির্মিত হয়নি, ফলে এপাশটা খালিই ছিল। আমাদের রূমের একপাশের জানালা দিয়ে দেখা যেত মাঠ, ভাইস-প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপালের বাংলো দুটি, আর অপর পাশের জানালা দি্যে দেখা যেত বিরান পাহাড়। এর ঠিক পাদদেশেই ছিল একাত্তরের গণকবর। একেবারেই আমাদের রূম বরাবর। অবশ্য ভর্তির দু’তিন মাস পর্যন্ত আমরা জানতাম না ঐ বধ্যভূমির কথা । ওখানে একটি বাঁশের মাথায় লাল পতাকা উড়তে দেখতাম। কেন ওরকম লাল পতাকা উড়ছে মনে প্রশ্ন জাগলেও সংকোচে কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি।
বাল্যের চঞ্চলতা আর কলেজের ব্যস্ত রুটিনের মধ্যে দিয়ে সারাদিন মূখর কেটে গেলেও রাত গভীর হলে চারদিক সুনসান হয়ে যেত। মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যেত না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মনে হত আমি যেন রূপকথার গল্পে পড়া কোন এক বিরান প্রাসাদে শু্যে আছি। একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে আমার খুব ভয় ভয় করতে লাগল। আমি এখনও বুঝতে পারিনা যা দেখেছিলাম তাকি স্বপ্ন ছিল না সত্যিই ঘটেছিল।
বিড়ালের মিউ মিউ কন্ঠ শুনতে পেলাম। তারপর মনে হলো বিড়ালটা আমাদের জানালায়। সেখান থেকে লাফ দিয়ে মইনুলের খাটের কিনারায় উঠল, তারপর মিউ মিউ করতে করতে আমার খাটের কিনারা ধরে হাটতে লাগল, ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কোন কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। বিড়ালটা তারপর আসিফের খাট ও রূম লিডার মশিয়ুর ভাইয়ের খাট হয়ে জানালা গলে বেড়িয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিলাম, যে কাউকে ডাকিওনি নিজেও জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে ছিলাম।
পরদিন মশিয়ুর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাইয়া এই কলেজে কি কোন ক্যাডেট মারা গিয়েছে?” আমার প্রশ্ন শুনে উনি একটু অবাক হয়ে বললেন, “না, কেন, হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?” আমি বললাম, “কিছু না, এম্নি”। এরপর মশিয়ুর ভাই একটু থেমে বললেন, “এটা একসময় রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ছিল, সেই সময় নাদিম তানভীর নামে একজন ছাত্র, ল্যবরেটরিতে একটা দুর্ঘটনায় মারা, যায়। তার নামে ল্যাবের নাম দেয়া হয়েছিল নাদিম তানভীর গবেষণাগার।” এবার আমার ভয় ঘনিভূত হলি, ঐ নাদিম তানভীরের আত্মাই বিড়াল রূপে আমার কাছে আসেনি তো? তবে আমি কাউকেই কিছু বলিনি।
ধীরে ধীরে একসময় জানতে পারলাম বধ্যভূমির কথা, কনসেনট্রশেন ক্যাম্পের কথা। আরো নানা প্রকার গা ছমছমে গল্প। তীতুমীর হাউসের ডাইনিং হলে পঞ্চাশ জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল। কলেজের বিভিন্ন ফীল্ডে মাটিতে পোতা লাশ পাওয়া গিয়েছে, এখনও রাতে অনেকেই অনেক কিছু দেখে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। শিক্ষকরা এ সমস্ত বিষয়ে কিছু বলতেন না, অহেতুক যেন আমরা ভয় না পাই। গল্প সব প্রচলিত ছিল ক্যাডেটদের ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে। তবে একটি বিষয়ে শিক্ষকরা আমাদের একটি বিষয়ে সাবধান করে দি্যেছিলান, পাহাড়ের আশেপাশে প্রচুর বোম, মাইন পোতা থাকার সম্ভাবন আছে ঐদিকে যেন ঘোরাঘুরি না করি। আর শেল জাতীয় কিছু পেলে না ধরে, যেন এডজুট্যান্ট-স্টাফদের জানাই। আমরা মনে মনে বলতাম হুঁ, হুঁ, জানাবো এডজুট্যান্টকে। সে সময় এডজুট্যান্ট ছিলেন, জেসিসি-র এক্স ক্যাডেট মেজর নুরুল্লাহ্ সিদ্দিক্কি। রিয়েল টাইগার। কথা বলা তো দূরের কথা, উনাকে দেখলে একশ হাত দূর থেকেই ভয় পাই।
ভুতের গল্প যতই শুনি ততই ভুতের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। ভুতের ভয় অস্বীকার করব না। তারপরেও মনে মনে চাইতাম জীবনে একবার হলেও ভুতের সাক্ষাৎ হওয়া প্রয়োজন। একদিন মওকা মিলে গেল। তখন পড়ি ক্লাস এইটে। আমাকে ডেকে পাঠালেন কলেজ প্রিফেক্ট ‘সা’-ভাই। “শোন রমিত, ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস আছে?’ আমি ঘুমকাতুরে মানুষ, কিন্তু সে কথা তো আর কলেজ প্রিফেক্টকে বলা যায়না। বললাম, “জ্বী আছে।” “তাহলে আজ খুব ভোরে হাউসের ছাদে যাবে, ফজরের নামাজেরও আগে, আমরা টুয়েলভের কয়েকজন থাকব, আমাদের ঘুম থেকে তুলে দেবে।” বললেন “সা” ভাই। “জ্বী, আচ্ছা”। মনে মনে কৌতুহল হচ্ছিল, ছাদে উনারা ঘুমাতে যাবেন কেন? আবার আমি উৎসাহ পেলাম এই ভেবে যে, ছাদে উঠার তো পারমিশন পাওয়া যায়না, এই তো সুযোগ। ভুতের দেখা যদি পেয়ে যাই!
(চলবে)
ভাইয়া মানসিক টর্চার কইরেন না। একবারে পুরো লেখাটা দিয়ে দেন। ধৈর্য ধরা কঠিন ব্যাপার সবসময় ই।
সুশান্ত ভাইয়া, আমার দুটো বড় সমস্যা হলো ১, সময়ের অভাব, ২, টাকার অভাব। এই দুইটা সমস্যার কারণে। বহু কাজই আটকে থাকে। দেখেছ নিশ্চয়ই অনেকগুলো লেখা একসাথে লিখছি, সময়ের অভাবে ভেঙে ভেঙে আস্তে আস্তে লিখছি। একটু ধৈর্য্য ধর, পরের পর্বটি পেয়ে যাবে।