উত্তাল সাগর, উদ্বেল নদী, সোনার মাটি, প্রাণের দেশ
———————————— ডঃ রমিত আজাদ
বিশ্বের উচ্চতম অবিচল পর্বতমালা হিমালয় থেকে, বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত কয়েক শত নদীর তরঙ্গভঙ্গে উদ্বেল এই অদ্ভুত সুন্দর সবুজ সোনার মাটির জীবন কাহিনী তার ক্ষেত্রফলের মত ছোট নয়। যদিও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে অর্থাৎ সময়ের বিচারে এই সেদিন, কিন্তু তার ইতিহাস মূলতঃ কয়েক হাজার বছরের পুরাতন। ১৯৭১-এর পূর্বে ১৯৪৭ সাল তক প্রায় সিকি শতাব্দী তার রাজনৈতিক নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও তার আগে দীর্ঘ ১৯০ বৎসর সে ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের (ভারতের নয়) অংশবিশেষ। তার পূর্বে এই দেশ বেশীরভাগ সময়ই ছিল স্বাধীন, মাঝে মাঝে আগ্রাসী শক্তির অধীন, দুয়েক সময় ভিনদেশী রাজার দ্বারা শাসিত, আবার কখনো বা বাংলার ভূমিপুত্র রাজারাই আশেপাশের রাজ্য জয় করে বাংলার রাজনৈতিক সীমারেখাকে বিস্তৃত করেছে।
আজ অর্থনীতি, মানব-সম্পদের দক্ষতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামরিক শক্তি, ইত্যাদি যেকোন বিচারেই বাংলাদেশ একটি দরিদ্র, পশ্চাদপদ রাস্ট্র। কিন্তু এমন কি সবসময়ই ছিল? প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, আরামদায়ক জলবায়ুর এই দেশটির দরিদ্র থাকার কথা নয়। ছিলও না, বরং ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, বরাবরই এই দেশ ছিল সম্পদশালী, সমৃদ্ব, ধনী ও উন্নত জীবনযাত্রাসম্পন্ন। অথচ চায়ের দোকান, খেলার মাঠ, শিক্ষাঙ্গনের করিডোর, লাউন্জের টেবিল, ইত্যাদি দৈনন্দিন আড্ডায় ভিন্ন কথা শোনা যায়। অনেকেই ভাবে বাংলাদেশ চিরকালেরই হতদরিদ্র। কেন এই ভ্রান্ত ধারণা? আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, প্রাইমারী স্কুল থেকে শুরু করে, শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে শক্ত ও সৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে দেশের ইতিহাস পাঠদান বরাবরই অবহেলিত হয়ে এসেছে। ফলে স্বদেশের ইতিহাস তথা সত্যিকার পরিচয় আমাদের কাছে বরাবরই অস্পষ্ট থেকে গেছে।
আমার জন্ম স্বাধীনতার মাত্র এক বৎসর আগে। আমাদের জাতির আনন্দ বেদনার মহাকাব্য ‘৭১-এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গৌরবান্বিত বিজয় আমি জ্ঞানতঃ দেখিনি। তবে এখনো আমি প্রায়শঃই রাতের স্বপ্নে যুদ্ধ দেখি, সারি সারি ট্যংকের চলাচল দেখি। কখনো কখনো মনে হয় আমার অবচেতন মনে কোথাও যুদ্ধের কোন স্মৃতি থেকে গেছে হয়তো। যখন জ্ঞান হলো তখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখি, দেশের পা ধু্যে দেয়া বঙ্গোপসাগরের মতই উত্তাল এই দেশ ও এ দেশের মানুষ। উপযোগী সেই কবিতা, ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি ক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি’।
ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অনেকেই চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে ও যাচ্ছে। বেঁচেছি, দেশ ছেড়েছি, ঔ হতচ্ছাড়া দেশে আর ফিরব না, এমনটি মনোভাব। অনেকেই প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কি করে বাইরের দেশের একটা ভিসা জোগাড় করা যায়, আবার অনেকের পিতা-মাতারাই সন্তানকে ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তারপরেও দু’একজন আছে যারা বিদেশের সব রকম সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছে সোনার মাটির টানে, নিজের প্রাণের দেশে। আমিও সেই অধমদের একজন।
শত হলেও সে আমার জন্মভূমি। জননী ও জন্মভূমিকে বাছাই করা যায়না। যেটা পেয়েছি সেটাকেই মেনে নিতে হয়। যেকোন ভূমিরই সবলতা থাকে দুর্বলতা থাকে। আমার জন্মভূমির দুর্বলতা অনেক বেশী, জানি। একটু চেষ্টা করিনা, ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে সেই দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে। একবার এক অস্ট্রেলিয়ান আমাকে বলেছিল, “Bangladesh cannot utilize you. I understand your position, but I should say, one man cannot change the situation”। উনার কথার মর্মার্থ আমি বুঝি। তারপরেও মনে হয়, প্রিয়জনের বিপদের সময় তাকে সাহায্য করতে না পারলেও, অন্ততপক্ষে তার পাশে থাকা উচিৎ।
ঐ যে বলেছিলাম, আমাদের ইতিহাস, এমনকি আমাদের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও আমাদের ধারণা অস্পষ্ট। নিজের দেশকে জানতে ও বুঝতে হলে, এবং তাকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে, এই অস্পষ্টতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমার এই সিরিজে আমি চেষ্টা করব আমাদের ইতিহাস, আমার জীবনে দেখা এই দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ও চলমান পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করতে।
সম্মানিত পাঠকদের অনুরোধ করব, গঠনমুলক সমালোচনা করতে। আমার দেয়া তথ্যে কোথাও কোন ত্রুটি থাকলে অনুগ্রহপূর্বক তা সংশোধন করে দেবেন। পাঠকদের মতামত ও সহযোগীতা আমার একান্ত কাম্য।
(চলবে)
:clap:
ধন্যবাদ।