মরণের ওপারে – ১


————————ডঃ রমিত আজাদ

মৃত্যু একটি সমাপ্তি। এর সাথে জড়িয়ে আছে ভয়, কান্না আর দুঃখ। কেউ কেউ মানসিক প্রশান্তির কথাও বলে থাকে। জানিনা। তবে এটুকু বুঝতে পারি, মৃত্যু রহস্যে ভরা। মৃত্যু কি? দেহের মৃত্যু হয় জানি, তারপর? আত্মা বলে কি কিছু আছে? দেহহীন সেই আত্মা কিভাবে টিকে থাকে? আমাদের এই অপার রহস্যময় জগতে খুব সামান্যই আলোর সন্ধান দিয়েছে বিজ্ঞান।

আমার দেখা প্রথম মৃত্যু ১৯৭৪ সালে। দেশ তখন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে। কাফনের কাপড়ও পাওয়া যায়না। সেই কাফনের কাপড়ের জন্য মিছিল হতে আমি নিজে দেখেছি। একবার তেমনি একটি মিছিলের পিছনে পিছনে গেলাম। ঐটুকু ছোট শিশু, মৃত্যু, কাফন, মৃতদেহের কিছুই বুঝিনা। শুধু দেখলাম, মাটিতে একটা গর্ত খোঁড়া ছিল, সেই গর্তে একজন মানুষের নিথর দেহটি রাখা হলো। আমি উৎসুক্য নিয়ে উঁকি-ঝুকি দিয়ে দেখতে লাগলাম, কি হয় ওখানে। প্রাণহীন দেহটির মুখ ঢাকা ছিল। একজন কাপড় সরিয়ে মুখটি দেখালো। কি কারণে জানিনা তার চোখটি খোলা ছিল। সেই নিথর খোলা চোখের তীব্র দৃষ্টি আমার এখনো মনে পড়ে।

এর কয়েক বছর পরে, শুনতে পেলাম, আমাদের কাছাকাছি এলাকার নোমান ভাই নামে একজন ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি বড় বোনকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুমের বড়ি খেলে কি হয়?” আপা বললেন, “ঘুমের বড়ি খেলে মানুষের ঘুম হয়, কিন্তু কেউ যদি খুব বেশী ওষুধ খেয়ে ফেলে, তবে সেই ঘুম আর ভাঙেনা।” ঐটুকুই বুঝলাম, এর বেশী কিছু বুঝলাম না।

তার কয়েক মাস পরে শুনতে পেলাম আরেকটি মৃত্যু সংবাদ। কাছাকাছি বাসার এক তরুণ, কলেজে পড়ত। বাসে করে কলেজে যাতায়াত ছিল। একদিন চলন্ত বাসে লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে, পা পিছলে বাসের চাকার নীচে পড়ে যায়। দুঃখজনক একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, একজন সম্ভাবনাময় তরুণের। ছ্বেলেটির মৃতদেহ যখন ঘর থেকে দাফনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আমাদের বাড়ী থেকে তখন স্পস্ট শুনতে পাচ্ছিলাম কান্নার শব্দ। আমি তখনও ছোট, মৃত্যুর প্রকৃত রূপ সম্পর্কে ধারণা নেই। এই কান্না যে তার প্রিয়জনদের কান্না তা বুঝতে পারিনি। ধরে নিয়েছিলাম মৃত মানুষই কাঁদে।

তারপর এক সময় বুঝতে শুরু করলাম, মৃত মানুষ কাঁদেনা, বরং যারা এখনো জীবিত আছে তাদেরকে কাঁদায়। মৃত্যুর স্বরূপটিই এমন যে, যিনি চলে যান কান্না তো দূরের কথা, কোন কিছু করারই তার আর কোন ক্ষমতা থাকেনা। আর যে জগতে তিনি চলে যান, সেখান থেকে তিনি আর কখনোই ফিরে আসেন না।

সত্যিই কি তাই? তারা কি চিরকালের জন্য, আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, নাকি কোন না কোন ভাবে কোন না কোন সময়ে আমাদের কাছে ফিরে আসেন? জীবিত আর মৃত মানুষদের জগতের মধ্যে কি কোন অদৃশ্য যোগসুত্র রয়েছে?

‘অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে‘ – দেহের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু হয়না। এটি গীতার বাণী হলেও, এমন কথা সব ধর্মগ্রন্থেই বলা আছে।
আমার পিতা ছিলেন আমার দাদার শেষ বয়সের সন্তান। ফলে আমি বাবার বড় সন্তান হলেও দাদার অনেক ছোট নাতি। দাদা ছিলেন নামজাদা আইনজীবি ও রাজনীতিবিদ। বৃটিশ ও পাকিস্তান দুটো বিরোধী রাজনীতিই তিনি করেছেন। তার মেধা ও সামাজিক অবস্থানের কারণে বংশের সকলেই তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা ও সমীহ করত। খুব কড়া মেজাজের ছিলেন বলে অনেকে ভয়ও করত। আমি খুব ছোট বয়সে ওনাকে দেখেছি। আমরা থাকতাম ঢাকায় আর তিনি থাকতেন অন্য শহরে। তাই দাদা বাড়ী না গেলে উনার সাথে দেখাও হতোনা। সেই সময় উনার সাথে কথাবার্তা কিছু হয়েছিল কিনা, আমার মনে পড়ে না। কিন্তু আমার যখন সাত বছর বয়স দাদা ঢাকায় এলেন, চিকিৎসার জন্য। সেই সময় উনার সাথে আমার সামান্য ইন্টারএ্যকশন হয়েছিল। মেধাবী ব্যক্তি তাই আমার সাথে শিশুসুলভ দু’একটি কথার পরই আমার মেধার পরীক্ষা নিতে শুরু করলেন। স্কুলে পড়ালেখা কেমন চলছে, ইংরেজী কেমন জানি, গরু ইংরেজী কি? গাড়ী ইংরেজী কি? ইত্যাদি। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম, কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। ভয় হলো, মেজাজী ব্যক্তি, আবার না ধমক দিয়ে বসেন। কিন্তু না, তেমন কিছুই না। মোলায়েম স্বরে, সেই সব প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসারত থাকা অবস্থায় উনাকে দেখতে গেলাম। উনার জন্য রাখা হুইল চেয়ারটার প্রতি আগ্রহ হলো। তিনি শিশুর মনের কথা বুঝতে পারলেন। ভৃত্যকে বললেন, “ওকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে, পুরো করিডোর ঘুরিয়ে নিয়ে আয়”। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি নিজের বাড়ি ফিরে গেলেন। এর সম্ভবতঃ মাস ছয়েক পরে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

যেহেতু আমি খুব ছোট ছিলাম এবং দাদার সাথে ইন্টারএ্যকশনও কম হয়েছিল, তাই উনার মৃত্যু সংবাদ আমার শিশু মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্ত ঘটনা তারপরেও ঘটল। একদিন রাতে দাদাকে স্বপ্নে দেখলাম। দোতলায় যাবার সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে তিনি স্বভাবসুলভ কঠোর ভঙ্গিতে আমাকে কিছু উপদেশ দিলেন। আর আমি সুবোধ শিশু তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে অপলক সব শুনলাম। ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নের মাহাত্ম কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু স্বপ্নের স্মৃতিটি অম্লান হয়ে রইল। তারপর বড় হয়ে মনে হলো। এমন কি হতে পারে? দাদা তার শেষ বয়েসের নাতি, বংশের প্রদীপটির জন্য উপদেশ জমিয়ে রেখেছিলেন, সময়মতো দেবেন বলে। কিন্তু তার আগেই তিনি দেহত্যাগ করেন বলে, তার অতৃপ্ত আত্মা আসেন আমার কাছে, জমিয়ে রাখা উপদেশগুলো শুনিয়ে যেতে।

আরেকটি ঘটনা আমি নিজে দেখিনি, কিন্তু শুনেছি। আমার এক ফুপু ডাক্তার। তিনি মেডিক্যাল কলেজে যখন প্রথম দিন এ্যনাটমি করেন, একটি মৃতদেহের পায়ের একটা অংশ কাটতে হয়েছিল। তখন তরুণ বয়স, কিছুটা হলেও ভীতি ছিল মনে। শংকিত মনে রাতে ঘুমাতে গেলেন। যেরকম আশংকা করেছিলেন, সেরকমই হলো। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন। সেই লোকটি ফুপুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, “কিরে আমার পা কেটেছিলি না? এই দেখ আমার পা কাটা”। ফুপু তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সত্যিই পায়ের ঐ যায়গাটা কাটা। ভয়ে তার আত্মা কেপে উঠল। তিনি চাদর মুরি দিয়ে মুখ ঢাকলেন। এরপর সেই লোকটি ফুপুর গায়ের চাদর ধরে টানতে লাগল। ফুপু প্রচন্ড শক্ত করে চাদর ধরে রাখলেন। লোকটিও তার সর্বশক্তি দিয়ে টানতে লাগল। এ পর্যায়ে ফুপু চিৎকার দিয়ে ঘুম ভেঙে উঠলেন। হৃদস্পন্দন ভীষণ বেড়ে গিয়েছে, সমস্ত শরীর ঘামে ভেজা। চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। এ নিছক স্বপ্ন। তারপর ফ্লোরের দিকে চোখ গেল। উনার গায়ের চাদরটি ফ্লোরে পড়ে আছে, মুহুর্তে ভয়ার্ত চিন্তা ঘিরে ধরল, তবে কি…? শীতল স্রোত বয়ে গেল ফুপুর মেরুদন্ড দিয়ে।

মাসুদ রানা আমাদের ক্যাডেট কলেজে আমার দু’ বছরের ছোট ছিল। সংস্কৃতি বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল। বিভিন্ন কালচারাল ইভেন্টে পার্টিসিপেট করতাম। সেই সুবাদে সংস্কৃতি চর্চা করে এমন ক্যাডেটদের সাথে ঘনিস্টতা বেশী হয়েছিল। মাসুদ রানা ছিল তাদের মধ্যে একজন। সুদর্শন, সুহাস্য, শান্ত-ভদ্র এই ক্যাডেটটি কলেজে সুপরিচিত ছিল। আমি যখন ক্লাস টুয়েলভে ও তখন ক্লাস টেনে। আমি কলেজ কালচারাল প্রিফেক্ট থাকার কারণে ওদের আরো কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। আমরা কলেজ থেকে পাস আউট করে কলেজের সব ক্যাডেটদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে। তবে রানাদের ব্যাচের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম একটু আগে। যেহেতু ওরা এস,এস,সি পরীক্ষা দিয়ে, আমরা পাস আউট করার আগেই ছুটিতে চলে গিয়েছিল। সেই দিনটি এখনো মনে পড়ে, ওদের ব্যচের সাথে বিদায় নেয়ার জন্য হাউজ থেকে নীচে নেমে এসে দাঁড়ালাম। সবার সাথে হ্যান্ডশেক করার এক পর্যায়ে রানা আমার দিকে এগিয়ে এসে চমৎকার হেসে বলল “ভাইয়া, কালচারাল ইভেন্টগুলোতে আপনার সাথে কাজ করে আমার ভালো লেগেছে। আপনার যদি আগ্রহ থাকে আমি আপনাকে টেলিভিশনে পারফর্ম করার সুযোগ করে দিতে পারি। আমার বাবা বিটিভি-র কর্মকর্তা” আমি বললাম, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রানা। তোমার বাবাকে আমি চিনি, তিনি মানিক মিয়া সরকার।” (আমার বড় বোন-ও জনপ্রিয় টিভি অভিনেত্রি, সেই সুবাদে বিটিভি ভবনে অনেকবারই যাতায়াত করেছি, এবং রানার বাবাকেও দেখছি)।ঐ ছিল রানার সাথে শেষ দেখা। এরপর আমরা কলেজ জীবন শেষ করে ঢাকায় বাড়ী চলে এসেছি। এই সময়টা ক্যাডেটদের মন সাধারণত: উৎফুল্ল থাকে। বন্ধনহীন মুক্ত একটা জীবন। পাখীর মত ডানা মেলে উড়তে থাকি। আবার এইচ,এস,সি, পাশ করে বড় হয়ে গিয়েছি বলে মনে করতে থাকি। সে কি আনন্দ। যেহেতু কোথাও ভর্তি হওয়ার সময় তখনও আসেনি, তাই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়েই দিন কাটছিল। একদিন বাড়ীতে কেউ ছিল না। আমি একা। এরকম সুযোগে আমি সাধারনত ভিসিআর চালিয়ে সিনেমা দেখতাম, অথবা পছন্দমত গান শুনতাম। কিন্তু ঐ দিন কি মনে করে যেন, আমি দু’টার কোনটাই না করে টিভি দেখতে বসলাম। সে সময় চ্যানেল ছিল মাত্র একটা, বিটিভি। বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে ইন্টেরেস্টিং কোন প্রোগ্রাম হতোনা। তারপরেও আমি টিভি সেটের সামনেই বসলাম।শুরু হলো স্থানীয় সংবাদ। ন্যাশনাল নিউজ দেখতাম,  স্থানীয় সংবাদ কখনোই দেখতাম না, খুব বোরিং মনে হতো। সেই আমিই কি কারণে যেন স্থানীয় সংবাদ দেখতে লাগলাম। সংবাদের শেষে যা শুনলাম, ‘সিলেট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র মাসুদ রানা, কলেজ ক্যাম্পাসের পুকুরে সাতার কাটতে গিয়ে, পুকুরে ডুবে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে।’ সংবাদ শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এরকম দুঃসংবাদ কোনদিনও আশা করিনি। আমার ভীষণ খারাপ লাগতে লাগলো। কলেজ কালচারাল প্রিফেক্ট থাকাকালীন সময়ে আমার একটা দুর্নাম ছিল, আমি নরম হলেও কখনো কখনো খুব কঠোর। আমি কেউ গাছে উঠলে ধমক দি্যে নামিযে নিয়ে আসি, কেউ রেল লাইনের ধারে গেলে কান ধরে টেনে নিয়ে আসি, কেউ পুকুর পাড়ে গেলে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেই। আসলে আমি সবই করতাম ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। যদি গাছ থেকে পড়ে পা ভাঙে! ট্রেন আসলে ছুটোছুটি করে ট্রেনের দিকে ছুটে যায়, যদি পা পিছলে ট্রেনের নীচে পড়ে! পুকুরে সাতার কাটতে গিয়ে যদি ডুবে যায়! তাই যখন রানার মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলাম, তখন খুব অস্থির লাগছিল। কি করে ও পুকুরে গেল? কেন ওকে কেউ সরিয়ে দিলনা? ইত্যাদি নানা চিন্তা ঘিরে ধরল। তারপর মনে হলো ওর বাসায় যাওয়া দরকার। আমি ওর বাসার ঠিকানা জানতাম না। শুধু জানতাম আজিমপুর কলোনীতে থাকে। চলে গেলাম আজিমপুরে। সেখানে আমাদের ব্যাচের তানভীরের খালার বাসা ছিল। উনার কাছে গেলাম। গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করে বললাম, ওদের বাসাটা খুঁজে বের করা দরকার। তিনি বললেন দাঁড়াও। তারপর উপরতলা থেকে এক ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে এলেন। দেখে চিনতে পারলাম, বিটিভির নিয়মিত অভিনেতা। আমার কথা শুনে তিনি দুঃখিত হলেন, “মানিকের ছেলে মারা গেছে? আচ্ছা ওদের বাসাটা কাছেই।….।” তারপর উনার ডিরেকশন অনুযায়ী গিয়ে, একটা বাসার কাছে বেশ কিছু জটলা দেখতে পেলাম। আমাদের বয়সী ছেলেদের একটা জটলা দেখে ঐদিকে এগিয়ে গেলাম। বললাম,

:মানিক মিয়া সরকারের বাসাটা কোথায় বলতে পারবেন?

:এই তো এটাই।

: উনার ছেলেটা, ইন্তেকাল করেছে।

: জ্বী আমরা সেজন্যই এসেছি।

: লাশ, কি দফন হয়ে গেছে?

: না, লাশ এখনো ঢাকায় আসেনি।

: ও, কবে আসবে?

: এখনি আসবে, আমরা অপেক্ষা করছি।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। মিনিট বিশেক পরে লাশবাহী একটি ট্রাক এসে থামল। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন শ্রদ্ধেয় আবদুল বারী মিয়া স্যার (বর্তমানে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপাল)। আমি এগিয়ে গিয়ে স্যারকে সালাম করলাম। স্যার আমাকে দেখে অবাক হলেন, “নিউজ পেলে কোথায়?” আমি উত্তর দিলাম, “টেলিভিশনে”। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। আজিমপুর গোরস্থানে দাফন শেষ হওয়ার পর, বাড়ী ফিরে এলাম। আজ পর্যন্ত একটা প্রশ্ন আমার মনে মনে ফিরছে, কেন আমি ঐ দিন টিভি সেটের সামনে বসলাম? কেনই বা মনযোগ দিয়ে স্থানীয় সংবাদ শুনলাম (যা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ)? ঠিক ঠিক দাফনের সময়ই বা উপস্থিত হলাম কি করে? কোইনসিডেন্স বলে একটা কথা আছে আমি জানি। তাই বলে এতগুলো কোইনসিডেন্স একই সাথে!

 

অপর ঘটনাটি ঘটেছে, কয়েক বছর আগে। আমার শ্বাশুড়ী ইন্তেকাল করেছেন দেশের বাইরে। আমার শোকার্ত স্ত্রী তখন মানসিক কষ্টে আছেন। আমরা তখন ঢাকার একটি অভিজাত এলাকার একটি ছয়তলা দালানের টপ ফ্লোরে থাকতাম। বিশাল এপার্টমেন্টে আমরা থাকতাম মাত্র তিনটি প্রাণী। বাড়ীটির বৈশিষ্ট ছিল এই যে, তার তিনদিকই খোলা ছিল। পিছনের দিকে আছে সেনানিবাসের একটা অংশ। সৈন্যদের একটি ইউনিট সেখানে বসবাস করে। গাছপালা বাগান ঘেরা জায়গাটি বিশাল। আমার স্ত্রী কবরস্থান ভয় পান। তাই কবরস্থানের পাশে বাড়ী নিতে বরাবরই নারাজ। তাই আমার স্ত্রীকে আমি কখনই জানাইনি যে, সেনানিবাসের ঐ জায়গাটি পেরোলেই ছোটখাট একটি কবরস্থান আছে। ছমছমে অন্ধকার রাত্রিতে মাঝে মাঝে কুকুরগুলো অদ্ভুত শব্দ করে ডেকে উঠত। আমার স্ত্রী বলতেন পশুরা মানুষের আত্মা দেখতে পায়। আর তখন এরকম শব্দ করে। এই কথা শুনে আমার ভয় ভয় লাগত। স্ত্রী জানতেন না, কিন্তু আমি তো জানতাম, যে কাছাকাছি কবরস্থান আছে। শ্বাশুড়ী ইন্তেকালের কয়েকদিন পরের এক গভীর রাত্রিতে (রাত আনুমানিক দুইটা হবে), কান্নার শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কন্ঠস্বরটির সাথে আমার স্ত্রীর কন্ঠস্বরের মিল আছে। আমি ভাবলাম মন খারাপ তাই উনি হয়তো কাঁদছেন। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি তিনি পাশে নেই। ঘুম ঘুম অবস্থায় আমি আরেকবার কান খাড়া করলাম। কান্নার শব্দটি মশারীর পাশ থেকে আসছে, অর্থাৎ রূমের ভিতরেই। মশারীর বাইরে বেরিয়ে এলাম। নাঃ, উনি রূমেই নেই। বেলকুনির দরজাটা খোলা দেখলাম। সেই দিকে গিয়ে দেখলাম, উনি বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম, “কাঁদছো কেন?”। “আমি কাঁদছি না”, উনি উত্তর দিলেন।
:তবে যে আমি কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম?
:সেটাই তো কথা।
:বুঝলাম না।
: আমিও কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছি।
: স্ট্রেন্জ!
:কন্ঠস্বরটা আমার মায়ের কন্ঠস্বরের মত।
শীড়দারা দিয়ে শীতল স্রোত চলে গেল। আমার কাছে কন্ঠস্বরটা আমার স্ত্রীর কন্ঠস্বর মনে হয়েছিল। মা মেয়ের কন্ঠস্বরে মিল থাকারই কথা।
আমার স্ত্রী বললেন,
:আমি ভাবলাম বাইরে থেকেও কান্নার শব্দ আসতে পারে, তাই বেলকুনিতে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আমি শব্দ রূমের ভিতরে শুনলাম।
: আমিওতো রূমের ভিতরেই শব্দ শুনতে পেয়েছি।
সেই রাতে আর ভালো ঘুমাতে পারলাম না। স্ত্রী পরদিন দোয়া-কালামের ব্যবস্থা করলেন। আমি বিজ্ঞানের মানুষ। অযৌক্তিকতায় বিশ্বাস না করতে পারলে খুশী হই। কিন্তু এ যে একেবারেই আমার নিজের অভিজ্ঞতা! নিজের ইন্দ্রিয়কে অবিশ্বাস করি কি করে। আমার স্ত্রী বলছিলেন, “হয়তো মৃত মানুষদের আত্মার একটা ভিন্ন জগত আছে। সেই জগতে দূরত্ব কোন ব্যপার না। চাইলেই হাজার মাইলের দূরত্ব সহজেই পার হতে পারেন।”
(চলবে)

১,৪৬৭ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “মরণের ওপারে – ১”

  1. রমিত ভাই

    ভালো লাগছে।

    আমার কাছে বাস্তব একটা ব্যাপার গা ছমছমে মনে হয়। মানুষ মারা যাবার পর মোটামুটি ৪ ঘন্টা পর সেল ডেথ হয়। শরীরের সেলগুলোতে চলছে খাবার আর ইনফর্মেশন আদান-প্রদান কিন্তু বাস্তবে মানুষটা মৃত। কোথায় গেলো মানুষটা? সত্যিই কি অসহায় আমরা।

    পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

    জবাব দিন
    • ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

      ধন্যবাদ ফাইয়াদ। প্রশ্নটা আমার মনেও দীর্ঘদিন যাবৎ আছে।
      এমনকি জীবিত অবস্থায়, আমাদের শরীরের পুরোটা আমাদের নিয়ন্ত্রনে থাকেনা। অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধ ও কিউর করা থেকে শুরু করে অনেক কাজই, অন্য কে বা কারা যেন করে দেয়। আমি, আমার শরীর: তার মধ্যে আবার এরা কারা?
      ক্লিনিকাল ডেথ সম্পর্কে পরবর্তিতে আরেকটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে।
      ভালো থেক।

      জবাব দিন
  2. জিয়া হায়দার সোহেল (৮৯-৯৫)

    রমিত ভাই চমৎকার লেগেছে। যতই ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে আসছিল ততই গা ছমছম অনুভুতি হচ্ছিলো।
    এই ধরনের ব্যাপারগুলি বোধ হয় আমাদের অনেকের জীবনেই ঘটে। আমার ১৮ বছরের ছোট বোনের মৃত্যুর পরের এক সপ্তাহ প্রতিদিন আমি দেখতাম শেষ রাতে আমার বিছানার কার্নিশে কেউ একজন বসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। প্রায় প্রতি রাত আমি চীৎকার করে উঠতাম।

    সত্যি রহস্যজনক আমাদের এই জীবন মৃত্যুর খেলা। ধন্যবাদ চমৎকার উপস্থাপনের জন্য।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।