অতসীর ফুটবল খেলা দেখা

ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলাটা আমার খুবই প্রিয় ছিলো। সেই ক্লাস ৫ এ ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ের গোড়ালি মচকিয়েছিলাম; তারপর মা পিটাবে, ঐ ভয়ে সারাদিন বাসায় যাইনি। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি, সন্ধ্যাবেলা যখন ঠিকই পা ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিলো আর শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো, তখন মা’র বসকিছু বুঝতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার পর খেলাধুলার জন্য অনেক সুযোগ পেলাম, কিন্তু সেই ক্লাস ১০এ পা ভাঙ্গার পর ফুটবলটা আর আগের মত খেলা হয়ে উঠেনি। ক্যাডেট লাইফে ফুটবল থেকে বাস্কেটবল আর ভলিবলটা ঢের বেশী খেলা হয়েছে আমার। খেলা বাদ দিলেও ফুটবল খেলাটা সবসময়ই দেখা হত, স্পেশালি বিশ্বকাপের সময়টুকু আমি খেলা ছাড়া কিছুই বুঝতাম না (এবং এখনও একই অবস্থা আমার)।

 

কিন্তু এই বিশ্বকাপের টাইমটাতে অতসীর সাথে আমার “কোল্ড ওয়্যার” শুরু হয়ে গেছে। একেই খেলাগুলো শুরু হয় রাত ১০ টা থেকে, চলে সারারাত……আর আমি এমনেই ইনসমনিয়ার রোগী হওয়াতে মাঝে মাঝে ইচ্ছা না থাকলেও একদিনে গ্রুপ পর্বের ৩ টা ম্যাচ দেখাও হয়ে যায়। আর আমার খেলা দেখা মানে দুনিয়ার সবখান থেকে আমি বিচ্ছিন্ন, আমার দুনিয়ায় থাকবো তখন আমি আর আমার সামনের টিভি সেট; অন্য কেউ-ই নয়, এমনকি আমার পেয়ারের মোবাইল ফোনও না। ফলে দেখা যায় যে, রাত সাড়ে ৯ টার দিকেই আমি অতসীকে ফোন দেই, “দেখো, একটূ পর খেলা শুরু হবে, খেলার মাঝের ব্রেকে ফোন দিবো আমি……তুমি থাকো, পড়াশুনা করো।” বেচারী এমনেই সারাদিন মেডিক্যালের ক্লাস-টাস করে টায়ার্ড থাকে, তারপর রাতের এই টাইমটা ছাড়া তার সাথেও আমার অতো কথা হয় না সে ব্যস্ত থাকে বলে। সুতরাং, যা হওয়ার তাই হলো……“এতদিন একা ছিলাম, ভালোই ছিলাম……এখন না চাইতেই কোনখান থেকে ফুটবল নামে একটা আলাদা সতীন এসে জুটেছে আমার……।” প্রায়ই এই ধরনের কথা শুনতে হয় আমাকে।

 

আমি যেরকম ফুটবল পাগল, অতসী তার ঠিক উলটো। আমি শিউর যে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে সে ওটাও বলতে পারবে না যে ফুটবল খেলায় কয়টা টিম খেলে, অথবা লাইনের বাইরে বল গেলে কি আউট হয়, নাকি ছক্কা হয়! ঐদিন ফোনে সে বলছে, “আমি না ফুটবল খেলার কিছুই বুঝি না, নেক্সট টাইম আমার সাথে দেখা হলে বুঝিয়ে দিবা, ঠিক আছে”? আমি খুশী হলাম……যাক, এবার খেলা দেখে কারো সাথে মন ভরে তর্ক করা যাবে, রাগারাগি করা যাবে। কিন্তু এর আগেই এমন একটা ঘটনা ঘটে গেলো, যার পরে ওকে আমি আর ফুটবল খেলার নিয়ম শিখানোর সাহস পাবো না।

 

সেদিন ব্রাজিল-চিলি ২য় রাউন্ডের খেলা। আমি সেই সন্ধ্যা থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি আজ দুনিয়া উল্টিয়ে গেলেও খেলা দেখবো আমি। আগের রুটিনমতো সাড়ে ৯ টাতেই অতসীকে ফোন দিলাম, ফোন ধরেই সে আমাকে একগাদা ঝাড়ি দিলো, “নতুন কিছু বলবে? না হলে ফোন রাখো……কথা বলতে ইচ্ছা করছে না”। আমি বুঝলাম যে আমার কপালে শনি আছে সামনে। আমি একটু রসের কথা বলার ট্রাই করলাম, কিন্তু তার কথার ঠেলাতেই আমার সব রস বাষ্প হয়ে উড়ে চলে গেলো! বুঝলাম যে, এই রাগ ভাঙ্গাতে গেলে আজ সারারাত চেষ্টা করলেও লাভ হবে না; তার থেকে চুপচাপ রণে ভঙ্গ দিয়ে খেলা দেখাই ভালো। আমি কিছুক্ষণ মিনমিন করে কথা বলে ফোন রেখে খেলা দেখতে বসে গেলাম।

 

খেলাটা বেশ জমেছিলো। ব্রাজিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দল হলেও চিলিও কম ছিলো না। প্রথমে ব্রাজিল গোল দিয়ে এগিয়ে গেলেও পরে চিলি ঠিকই সমতা আনে আবার। ৯০ মিনিটে খেলা শেষ না হওয়াতে এক্সট্রা টাইমে খেলা যায়, একদম শেষ মুহূর্তে চিলির দারুণ এক শট উপরের বারে লেগে ফিরে আসে। ১২০ মিনিটের খেলার পরেও যখন ১-১ ই থাকলো, তখন সবার মত আমারও উত্তেজনা চরমে। ট্রাইবেকার শুটআউট শুরু হতে যাবে, এমন সময় কারেন্ট চলে গেলো! বাবা সামনে বসা ছিলো, সেদিকে আমার কোন খেয়াল নাই……একগাদা গালিগালাজ বের হয়ে গেলো মুখ থেকে, কারেন্টের মা-বাপ তুলে।

 

তৎক্ষানত বুদ্ধি এলো, অতসীদের কলেজে নিশ্চয়ই কারেন্ট আছে, আর সে ফুটবল না দেখলেও তার অন্য ফ্রেন্ডরা তো দেখে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন দিলাম আমি।

–     এই, তোমাদের ওখানে কারেন্ট আছে?

–     কেন, তোমাদের ওখানে নেই?

–     আরে শালার কারেন্ট মাত্র চলে গেলো এখানে, ঐদিকে ট্রাইবেকার শুরু হয়ে গেছে।

–     ট্রাইবেকার কি?

–     (এখন তোমারে ক্যামনে বুঝাই!!) ওটা তোমার বোঝা লাগবে না……শোনো, তুমি এখন টিভি রুমে যাও, গিয়ে আমাকে একটু খেলার আপডেটটা দাও।

–     আমি তো খেলা কিচ্ছু বুঝি না।

–     বোঝার দরকার নেই……যাও আগে,আমি ওয়েট করতাছি।

–     আচ্ছা!!

 

বলে লাফাতে লাফাতে (অনুমান করলাম আর কি) সে চলে গেলো টিভি দেখতে। কিছুক্ষণ পর তার ফোন পেলাম

–     হ্যাঁ, এই যে আমি টিভি রুমের ভিতর……অনন্যা (তার ফ্রেন্ড, কট্টর ব্রাজিল সাপোর্টার) বললো যে একটু পর খেলা শুরু হবে।

–     আচ্ছা, এখন শোনো……অনন্যা হচ্ছে তোমার গোল-মিটার। সে চিল্লালে বুঝবা ব্রাজিল গোল দিছে বা আটকাইছে, আর ভাইস-ভার্সা, ওকে?

–     আচ্ছা……(কিছুক্ষণ চুপ) এই শোনো, আজ কার কার খেলা?

–     উম, ব্রাজিল আর চিলি।

–     ব্রাজিল হলুদ আর চিলি লাল না?

–     হুম, তো?

–     না মানে……কয়েকজন দেখছি সবুজ জামা পড়া, পতাকা নিয়ে দৌড়াচ্ছে……এরা কোন দল?????????????

–     (দুঃখের ঠেলায় পুরা মখা হইয়া গেলাম আমি) এরা কোন দল না, এরা রেফারী; খেলায় যাতে কেউ কাউরে আজাইরা লাত্থি না মারে, এজন্য এরা পতাকা আর বাঁশি নিয়ে মাঠের মাঝে দৌড়ায়।

–     আচ্ছা, এই তুমি এটা কিন্তু অনন্যাকে বইলো না, ঠিক আছে?

–     (আমি হাসি চাপতে চাপতে) আচ্ছা কাউকে বলবো না।

–     (একটু পরে আবার) এই আচ্ছা, এই যে এরা গোলের সামনে বসিয়ে কিক নিচ্ছে, এটাকেই তো ফ্রি কিক বলে……তাই না?

এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখেছিলাম, এবার আর পারলাম না……পুরা ঘর কাঁপিয়ে হা হা হো হো করে হাসা শুরু করলাম। অপরপাশ থেকে অতসীর কোন কথাই শুনলাম না তখন……বোধহয় আমার পাগলের মত হাসি শুনে সেও অবাক হয়ে গিয়েছিলো।

–     এত হাসির কি আছে এখানে?

–     না না, কিচ্ছু না……খেলা শুরু হইছে?

–     নাহ, মাত্র লাল দল গোলের সামনে বল বসাচ্ছে……সেটা ব্যাপার না, আগে বল এটাকে কি ফ্রি কিক বলে না?

–     না সোনা, এটা পেনাল্টি……ফ্রি কিক আরেকটা।

–     না মানে……এটা কিক করার সময় যে কিক করে, তাকে তো কেউ বাধা দেয়না, তাই মনে করলাম এটাই বুঝি ফ্রি কিক(!!!!)……এই শোন, এটাও কিন্তু তুমি অনন্যাকে বলবা না।

–     আচ্ছা আচ্ছা (বলে আবারও হাসি চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম)।

তারপরে মোটামুটি সাবলীল ভাবেই সে পুরো খেলার বর্ণনা দিয়ে গেলো, কিন্তু তার খেলার বর্ণনা শুনলে যে কেউ আরো হাসবেন……আমি নাদান বান্দা তার মন খারাপ হবে, এই ভেবে অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছি। খেলা শেষে সে বললো, “আর যাই হোক, আমি আর ফুটবল খেলা দেখছি না জীবনেও।” আমিও কম যাই না, বলে দিয়েছি, “বিয়ের পর তোমাকে জোর করে খেলা দেখানো হবে, নাইলে ঐদিন পুরা ঘরে হরতাল চলবে!!!”

 

পুনশ্চঃ পরেরদিন সকালে সে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলো, “অনিবার্য কারন বশতঃ খেলা দেখতে হল, আর খেলা দেখেই আমি ব্রাজিলের গোলকিপার ‘জুলিয়াস’ (!) সিজারের প্রেমে পরে গেলাম” – Feeling Loved ।আমি স্ট্যাটাস দেখে সাথে সাথে তাকে ফোন দিয়ে বললাম যে এটা “জুলিয়াস” সিজার হবে না, হবে “জুলিও” সিজার! যাই হোক, ফেসবুকে এখন “Edit Status” বলেও একটা অপশন থাকে……নাহলে বেচারীর এত সাধের স্ট্যাটাসটাও ডিলেট করতে হত!!!

১,৮৮৪ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “অতসীর ফুটবল খেলা দেখা”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।