গলাকাটা ডিউটি ক্যাডেট

২০০৬ সাল, অগাস্ট মাসের আটাশ তারিখ। তিনটা মিষ্টি আর দুইটা কোকের লোভে ডিউটি ক্যাডেট হতে রাজি হলাম আমি এক বন্ধুর প্রস্তাবে। এমন কিবা কাজ ডিউটি ক্যাডেটের! সবগুলো ফলিনের ঘন্টা বাজানো আর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠার আর রাতে লাইটস অফের ঘন্টা দেয়া! ক্যাডেট কলেজের এত পরিশ্রমের মাঝে এই দুইটা অতিরিক্ত বেল দিয়ে পিটি গেমস আর বোরিং ক্লাসগুলো থেকে রেহাই পাওয়া তো ভালোই… তার উপর যদি কেউ মিষ্টি আর কোক ফ্রী দেয় তাহলে তো কথাই নেই!

আগেরদিন সাতাশ তারিখ জানলাম ১৯৮০ এর দিকে কোন এক ভোরবেলায় নাকি আগেকার দিনের বিশালাকার ঘন্টা বাজাতে গিয়ে ভেঙ্গে পরে সেই ঘন্টা সেদিনের সেই ডিউটি ক্যাডেটের উপর… দ্বিখণ্ডিত হয় তার গর্দান। এরকম ঘটনা বিশ্বাস করার মানুষ আমি না। তাই বয়স্ক এক হাউস বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলাম যাচাই করতে, ঘটনা সত্য। এবং শুধু তাই না, সেই ডিউটি ক্যাডেট নাকি মাঝেমাঝেই ফিরে চলে আসে বছরঘুরে ওই আটাশ আগস্ট। বুঝলাম, বন্ধু আমার কেন নিজের ডিউটি ক্যাডেট এতো সস্তায় বিক্রি করলো, কাল তো সেই আটাশি তারিখ! একবার ভাবলাম বলে আসি… আমি পারবোনা। তারপর আবার মনে হয়… যাহ! ভুতটুত দুনিয়ায় আছে নাকি!

আটাশ তারিখ ভোর পৌনে পাঁচটার সময় আমি ভয়ে ভয়ে বেল দিতে যাচ্ছিলাম। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আসলো…ধরলো পেছন থেকে! এরকম পা টিপে টিপে এগুতে এগুতে বেলের কাছে চলে আসি। বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করি, কখন সুর্যের আলো ফুটবে, তারপর যাব। সুর্য উঠে.. আমিও চলে যাই বীরদর্পে। সবাইকে বলি….”কই তোদের ভুত? কিছুই নাই.. সব বকওয়াজ! ” হঠাৎ বুঝলাম কেউ এ ব্যাপারে আলোচনা করতে চায়না…ব্যাপারটা নাকি ট্যাবুর মতো। এটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে নাকি আরো বেশি করে হয়!

আমি অবশ্য আর পাত্তা দেই না.. ধুর! কি হবে! সারাদিন সেই গলাকাটা ডিউটি ক্যাডেট নিয়ে হাসিতামাশা করি। দিন পেরিয়ে রাত হয়…ঘড়ির কাটায় এগারোটা বাজলো বলে। ঘুমানোর বেল দিতে যেতে হবে।

স্লীপিংসুট গায়ে চাপিয়েই চলে যাই ঘন্টা দিতে। কিছুদুর যাবার পর মনে হলো কেউ যেন হাটছে আমার পেছন পেছন। আমি পেছনে ফিরে তাকাই… নাহ কেউ নেই তো! দূরে হাউসের লাইটগুলো নিভু নিভু জ্বলছে, ক্যাডেটরা এখনো হাঁটাচলা করছে। আবার সামনে ফিরে চলা শুরু করি.. কিন্তু হঠাৎই কেমন যেন অচেনা লাগে সবকিছু। এগিয়ে যেতে থাকি…কিন্তু অতিপরিচিত একশগজের রাস্তাটারই কোন শেষ দেখা যাচ্ছেনা। হঠাৎ আবার কেমন যেন সুগন্ধির গন্ধ আসে… চারিদিকটা এই গরমের মাঝেও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যায়।

আমার আবার সেই বয়স্ক হাউসবেয়ারার বলা কথাগুলো মনে হয়…প্রচন্ড ভয় লাগে হঠাৎ। ভাবি…বেলটা নাহয় আজ নাই দিলাম! উল্টো ঘুরে হাউসের দিকে পা বাড়াই… কিন্তু কোথায় আমার হাউস? নাকি লাইট নিভিয়ে দিয়েছে বলে দেখা যাচ্ছেনা!

আস্তে আস্তে এগুতে থাকি। সবকিছু অস্বাভাবিক। দূরে একটা সোনালি আলো চিকচিক করছে। আমি এগিয়ে যাই…আলো ক্রমশ বড় হচ্ছে। আর কিছুদুর গিয়ে বুঝলাম ওটা আসলে বিশাল এক ঘন্টা… উচ্চতায় দুইতিন তলার সমান হবে! কৌতুহলের বশে আরোও এগিয়ে যাই…হঠাৎ ভ্যাপসা একটা চাপা গন্ধ লাগে! আরেকটু আগানোর পর বুঝলাম গন্ধটা কিসের! বিশ থেকে বাইশটা খাকি ড্রেস পড়া লাশ পড়ে আছে ঘন্টার চারপাশে! আমার হাতপা অসাড় হয়ে আসে…মনকে বারবার বলি..”আলভী দৌড়াও.. দৌড়াও..!!” কিন্তু পা দুটো সাড়া দেয় না। আমি অসাড় হয়ে মরা লাশগুলো দেখি আর গুমোট কান্নার আওয়াজ শুনি!

একসময় জোর পাই পায়ে… কোনমতে পেছন ফিরে দেখি আমারই রক্ত মাখা ড্রেস পড়ে ডিউটি ক্যাডেটের বেশে দাড়িয়ে আছে মুন্ডুহীন আমি!!! …অসম্ভব ভয় পাই আমি। কোনমতে সেই গলাকাটা আমিকে ধাক্কা দিয়েই এগুতে থাকি… পেছনে আমার মতোই থপথপ শব্দ করে ধাওয়া করছে আমাকে। আমি যেন আর পারছি না! দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে যাই… তবুও দৌড়াই! হঠাৎ আবার হাউসের অবয়বটা দেখতে পেলাম। পা অসাড় হয়ে আসছে… তবুও দৌড়াই….অবশেষে ফিরে আসি, আমার হাউসে .. অক্ষত! পেছন থেকে বারবার আমায় ডাকছে… তাকাইনা আমি। এক দৌড়ে রুমে চলে আসি।

রুমের সবাই ঘুমাচ্ছে.. লুকিয়ে লাইট জ্বালাই। হঠাৎ ড্রেসটার উপর চোখ পড়ে… খেয়াল করি রুমে রেখে যাওয়া ড্রেসটাও রক্তাক্ত! আবারো ভয় পেয়ে যাই… তাড়াতাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকি।

ট্যাপ ছেড়ে বসে আছি… ড্রেসের উপর দিকটা থেকে রক্ত বের হতেই থাকে। ট্যাপের পানিতে রক্তগুলো ধুয়ে একাকার হয়ে যায়।
জানিনা এভাবে কতক্ষণ যায়…একসময় রক্তের প্রবাহ থামে। আমিও ড্রেস নিয়ে বের হয়ে আসি… ভোর হয়েছে …বেল বাজছে…বাজাচ্ছে অন্য কোন ডিউটি ক্যাডেট!

৮০৩ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “গলাকাটা ডিউটি ক্যাডেট”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমাদের কলেজে ডিউটি ক্যাডেটশীপ চেঞ্জ হত বিউগল দিয়ে ফ্ল্যাগ নামাবার সময়ে...একজন নামাতো কলেজেরটা অন্যজন দেশেরটা...তাই রিলেট করতে একটু কষ্ট হল...

    তবে লেখা ভাল হয়েছে... :thumbup:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।