দেখে এলাম ভারতবর্ষঃ পর্ব ২

আগের পর্ব ছিলো,কলকাতা পৌঁছানো নিয়ে।পৌঁছে তো গিয়েছি,এবার আগানো যাক।

কলকাতায় নেমে সবার আগে যেখানে গেলাম আমরা,সেটা হচ্ছে ফেয়ারলি প্লেস।ফরেন কোটার যাত্রীরা এখান থেকে সারা ভারতজুড়ে ট্রেনের টিকিট অগ্রীম কাটতে পারেন।ভিতরে ঢুকে দেখি কয়েকজন সাদা চামড়া বাদে বেশিরভাগই বাংলাদেশি।নোয়াখালি,বরিশাল,সিলেট,অনেক এলাকার ভাষা কানে এল।বেশিরভাগই চিকিৎসাপ্রার্থী,যাবেন চেন্নাই অথবা অন্য কোথাও।ফর্ম পূরণ করে বসে থাকলাম সবাই।ঘণ্টা দুই পর সিরিয়াল এল আমাদের।

আমাদের প্ল্যান ছিলো,যাওয়া আসা,২বারের যেকোনো একবার,ইন্ডিয়ার বিখ্যাত ট্রেন রাজধানী এক্সপ্রেসে চড়বো।কিন্তু কপাল খারাপ,কোনদিনের টিকিটই পেলাম না,পেলেও তা এসি-টায়ার ২,যেইটা আমাদের সাধ্যের বাইরে।তো কালকা মেইলের আপ এবং দুরন্ত এক্সপ্রেসের ডাউন টিকিট কেটে ব্যাগ টানতে টানতে বের হলাম সামনের মহাসড়কে।

একে ওকে জিজ্ঞেস করে পার্ক স্ট্রীটগামী একটা ফাঁকা বাসে উঠে পড়লাম সবাই।গন্তব্য মারকুইস স্ট্রীট,যেখানে আমাদের থাকার প্ল্যান।পার্ক স্ট্রীট নেমে একে ওকে জিজ্ঞেস করে করে অনেকখানি হেঁটে পৌঁছালাম মারকুইস স্ট্রীট।কলকাতার বুকে একটুকরো বাংলাদেশ যেন।বেশিরভাগই বাংলা রেস্টুরেন্ট,আছে শ্যামলী,এসআলম,সোহাগ,সৌদিয়া বাসের কাউন্টার।

এখানে আসলে হাতে-কাঁধে ব্যাগ দেখলেই ঘিরে ধরবে দালাল।”দাদা,রুম লাগবে নাকি” “দাদা আসুন তো,ভালো রুম আচে” শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেলাম।এরপর দৃশ্যপটে আগমন জামান ভাই নামক এক দালালের।তিনি হোটেলের রুম ঠিক করে,সবাইকে সিম কিনিয়ে,খাওয়ার হোটেলে ঢুকিয়ে ১০০রুপি বকশিশ আর ২টা দেশি সিগারেট নিয়ে বিদায় নিলেন।খেয়ে দেয়ে রুমে এসে সবাই দেশে ফোন করলাম,অনলাইনে ঢুকে খোঁজ খবর নিলাম-দিলাম,সেদিনের মত ঘোরাঘুরি শেষ।

পরেরদিন সন্ধ্যায় আমাদের ট্রেন,তাই সকাল সকাল খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।প্রথম গন্তব্য “ময়দান”।ওপার বাংলার বিভিন্ন উপন্যাসে জায়গাটার নাম থাকায় দেখার অনেক ইচ্ছা ছিলো।খুব বেশি বিশেষত্ব নেই জায়গাটার।সোহরাওয়ারদী উদ্যানেরই একটা বড় ভার্সন।তবে যেটা ভালো লাগলো,সেটা হচ্ছে,এতবড় জায়গায় শুধু ক্রিকেট,ফুটবল,মরনিং ওয়াক,ঘুড়ি উড়ানো,এইসবই হতে দেখলাম।আমাদের উদ্যানের মত গাঁজায় দম দেওয়া কিংবা উদ্দাম প্রেম ছিলো না।হয়তবা সময়টা সকাল দেখেই।যাই হোক,ভালো লাগলো।

মমতা দিদির বিখ্যাত ময়দান

মমতা দিদির বিখ্যাত ময়দান

এরপরের গন্তব্য,ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালস।ময়দানের মধ্যে এক দাদাকে রাস্তা জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দিলেন,সোজা গেলেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালস।

আমাদের শরীফের আবার চা খাওয়ার বিশাল বাতিক আছে। ময়দানের বাইরে এসে দেখি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালসে ঢোকার বিশাল লাইন।শরীফ চা খেতে চাইলো।সাথে আমরা ভেলপুরি আর লিমকা নিলাম।কোনটারই টেস্ট আহামরি কিছুনা।আর চায়ের কথা কি বলবো!!!পুরো ইন্ডিয়ার মানুষ সম্ভবত চায়ের সাথে দুধ মিশিয়ে খায় না,দুধের সাথে চা মিশিয়ে খায়।এক কোথায় জঘন্য তার টেস্ট!!!

এরপর এলাম সবাই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালসে।দাদাবাবুদের কিপ্টেমির আরেক নমুনা দেখলাম।দুই ধরনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে।শুধু বাইরের বাগান দেখার জন্য ১০রুপির টিকিট,মেমোরিয়ালসে ঢুকতে চাইলে ২০রুপির টিকিট!!!ফরেইনারদের টিকিটের দাম আরো বেশি।আমাদের কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি,তো আমরাও কিছুনা বলে ২০ রুপি দিয়ে টিকিট কিনে ঢুকে পড়লাম।

ভিতরে ঢুকতেই পড়লো  সুন্দর বাগান,মনুমেন্ট আর নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তা।সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল।জায়গাটায় যত্নের ছাপ স্পষ্ট।কোথাও ময়লা বা অসুন্দর কিছু চোখে পড়লো না।আশে পাশে দাদা-দিদিদের কিউট বাংলা একসেন্ট শুনতে শুনতে মেমোরিয়ালসের ভিতরে পা বাড়ালাম।কুইন ভিক্টোরিয়ার আগমন উপলক্ষে সম্ভবত বানানো হয়েছিলো মেমোরিয়ালসটি।এইটার স্ট্রাকচারে ইউরোপিয়ান টাচ আছে বলে মনে হোল।মুভিতে দেখা স্ট্রাকচারগুলোর মত থাম,কারুকাজ করা দেয়াল।ভিতরে বেশিরভাগই পেইন্টিং।ছবি দিয়ে বিভিন্ন ঘটনাকে তুলে ধরার চেষ্টা ছিলো।বেশিরভাগ ছবির আঁকিয়েও ব্রিটিশ ভদ্রলোকরা।

আমাদের যদিও হিস্ট্রি নিয়ে আগ্রহ কম,সুন্দরী দিদি দেখায় আগ্রহ বেশি,তাই খুব বেশি জ্ঞান আত্মস্থ করতে পারছিলাম না।সাপের ডিজাইনে করা একটা বেতের চেয়ার দেখে সবাইকে ডাকলাম,”দেখ স্লিদারিন হাউজের চেয়ার”,পরে দেখলাম পাশে লেখা,চেয়ারটা আসলে হাতির দাঁতের তৈরি।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালস

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালস

ভিতরে ছবি তোলার নিয়ম নেই।অনেকগুলা পুলিশ ছিলো,তাই ক্যামেরা অন করিনি।বাইরে বেরিয়ে বুঝলাম ১০রুপির টিকিটের মাজেজা।অনেকেই সুন্দর করে কাটা ঘাসের উপর শুয়ে পড়েছেন,পাশে বাচ্চারা খেলছে,সাথে করে এনেছে হটপট।ফ্যামিলি পিকনিক বলা যায়।দূরে কিছু বেঞ্চে কয়েকজোড়া কপোত-কপোতীকে চুম্বনরত অবস্থায়ও দেখা গেল।

সেইখানে কিছুক্ষন বসলাম।সবাই যার যার প্রেয়সী এবং ফেসবুকবাসীদের নিজেদের খবরাখবর এবং স্থিরচিত্র প্রেরণ করার মহান দায়িত্ব সম্পাদন করলো।সাথে একগাদা প্রেমিক ও ফেসবুক সেলিব্রিটি নিয়ে গেলে যা হয় আর কি!এরপর বের হয়ে গেলাম বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম।কিন্তু কপাল মন্দ,মেইন্টেন্যান্সের কাজ চলছে।এদিক-সেদিক ঘুরলাম।বাংলা আকাদেমি,শিশু সদন এইসব দেখলাম,মাটির ভাঁড়ের চা খেলাম।দুপুরের কিছুপরে ফিরে আসলাম মারকুইস স্ট্রীট,দুপুরের খাবার খেয়ে রেডি হতে হবে,সন্ধ্যার ট্রেন ধরার জন্য।

কলকাতায় আমাদের স্টে ছিলো দুই ভাগের।প্রথমবার একদিন,পরেরবার,ঢাকা ফেরত আসার আগে,দুইদিন।প্রথম ধাপের সমাপ্তি শেষে সবাইকে কয়েকটা তথ্য জানাতে চাই।

১. দুইবেলা গরু খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে মারকুইস স্ট্রীট আসার দরকার নেই।শিয়ালদা স্টেশানের পাশেই প্রচুর হোটেল-গেস্ট হাউজ আছে,ভাড়া মারকুইস স্ট্রীটের তুলনায় অনেক কম,পরিবেশও ভালো।

২.জায়গা চিনবেন না,এটাই স্বাভাবিক।দাদাবাবুদের জিজ্ঞাসা না করে পুলিশকে করুন।দে আর হেল্পফুল।

৩.কিপ ফার ফার অ্যাওয়ে ফ্রম দালাল!

৪.ট্রেন স্টেশান থেকে বের হয়ে সোজাসুজি প্রি-পেইড ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়ান।আর যদি লাইন বেশি বড় হয় এবং আপনি খুবই টায়ার্ড থাকেন,একদম স্টেশানের বাইরের রাস্তায় চলে যান,সেখান থেকে ট্যাক্সিতে দরদাম করে উঠুন।স্টেশানের ভিতরের ট্যাক্সিগুলোর সাথে কথাই বলবেন না।দাম বলে মাথা ঘুরিয়ে দিবে,এবং বিভিন্ন ভয় দেখাবে,রাস্তায় এই হয়েছে,সেই হয়েছে,আজকে অমুক স্ট্রাইক ব্লা ব্লা ব্লা।

এবার কোলকাতার কয়েকটা ভালো দিক বলি-

১.ট্র্যাফিক সিগন্যাল-সবাই খুব স্ট্রিক্টলি মেনে চলে।একদম ফাঁকা রাস্তায়ও আমি দেখেছি লালবাতিতে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে।আমাদের দেশে এটা কল্পনাতীত।

২.হলুদ এম্বাসেডর ট্যাক্সি-জিনিসটা আসলেই দারুন।এর ডিকি এত বড়,আমাদের চারজনের বিশাল পেটমোটা লাগেজ একদম পারফেক্টলি এঁটে গিয়েছিলো।আর বসার জায়গা এত বেশি যে আমাদের সাইজের ৭জন সহজেই এঁটে যাবে।শিয়ালদা থেকে নিউমার্কেট আমাদের কাছে ভাড়া চেয়েছিলো মাত্র ৫০রুপি!!!ক্যান ইউ বিলিভ ইট!!! আমার জীবদ্দশায় কোন সিএনজি অটোরিকশাকেও ঢাকায় এত কম ভাড়া চাইতে শুনিনি!

৩.মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি-বিশেষ করে নারীদের ব্যাপারে ইন্ডিয়ার মানুষ অনেক বেশি উদার।আমি বান্ধবীকে নিয়ে হাঁটার সময় আমাদের দেশের রাস্তায় দেখেছি,পড়ন্ত বয়স্ক লোকগুলোর কোন চক্ষুলজ্জা নেই,সোজাসুজি মেয়েদের বুকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।অথচ ভারতে রাস্তার পাশের টিউবওয়েলে মেয়েরা গোসল করছে অথচ কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই দেখে আমি ওদের শ্রদ্ধা না করে পারিনি।যদিও ইন্ডিয়ায় প্রচুর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।তবে কুকুর আর সাধারণ মানুষের তফাত আছে,কুকুরদের জন্য আমার শ্রদ্ধা থেকে সাধারণ মানুষ কেন বঞ্চিত হবে? মুসলিম দেশ হয়েও যদি আমরা আমাদের দৃষ্টি সংযত না রাখি,তাহলে কি লাভ এই মুসলমানত্বের???

৪.জ্যাম-একদমই চোখে পড়েনি।প্রচুর ফ্লাইওভার আর অনেকগুলো রাস্তা ওয়ান-ওয়ে করে দেওয়া ওখানে।টোটাল ৪দিন ছিলাম,কখনোই খুব বেশি জ্যাম চোখে পড়েনি কোথাও।

৫.বাস-ট্রাম সার্ভিস- সুলভ ভাড়া,দ্রুতগতির।

পরের পর্বে দেখুন কিভাবে দিল্লী যেতে গিয়ে কালকা চলে গেলো ৪ বাংলাদেশী যুবক(ভিডিওছাড়া)

৩,৮৭৯ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “দেখে এলাম ভারতবর্ষঃ পর্ব ২”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমার পরিচিত বেশিরভাগ বাসাতেই প্রায় দুধের মধ্যে চা, বা একেবারে দুধের মধ্যেই চা করে।
    তাই কারো হাসায় গেলে সাধারণত চা খাই না।
    আবার কফিও গ্রাউন্ড ছাড়া খেতে পারি না।
    তাই বাধ্য হলে লাল চা খাই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    ভাল লেখা। আমকে একবার এক বোম্বের মহিলা বলেছিলেন যে তার মনে হয়েছে বোম্বের থেকে কলকাতায় মেয়েদের সম্মানটা বেশি। যে কোন নতুন শহরে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।