শিক্ষকের ডায়রি: পর্ব-১২

এবছরের দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি পরীক্ষায় সামনের দিকের পজিশনগুলোতে ক্যাডেটদের অবস্থান করা না করা নিয়ে কমিউনিটিতে বেশ আলোচনা চলছে। আমার কাছে তো মনে হয়, কোন কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় ক্যাডেট কমিউনিটিকে প্লেস করতেই হবে, এই চিন্তাটা সঠিক হচ্ছে না।

এক্স ক্যাডেট কমিউনিটির ৯৫% (আমার নিতান্তই স্বল্পজ্ঞানের পরিসংখ্যানের ভাষায়) যদি জীবনে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে ক্যাডেটদের সফলতা আছে, এটা ধরে নেয়া যেতে পারে। আমার তো মনে হচ্ছে, সেই হিসাবে এখানে সফলতা আছে।

তবে ইচ্ছা বা স্বপ্ন অনুযায়ী জায়গায় সুযোগ না পেলে কেউ ফ্রাস্ট্রেটেড হলে, সেটাকে আমার কাছে কমিউনিটির চেয়ে ব্যাক্তিগত পর্যায়ের হিসাবের কোন বিষয় বলেই মনে হয়। সাক্সেস বা হ্যাপিনেসের ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে একেক রকমের। কাজেই এটাকে কমিউনিটির প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবে না নেয়াই মনে হয় স্বস্তিদায়ক।

আমার কাছে বরং এটা বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয় যে, ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা ব্যাবস্থার উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব, সেটা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। আগে যেটার মান ছিল ১০০, আজকের এই সময়ে এসে সেটাকে আর হয়তো ১০০ ভাবার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে আপগ্রেড করার চিন্তা থাকা দরকার।

গত রিইউনয়নে কলেজে গিয়ে অনেক কিছুই নতুন দেখেছি; আমার কাছে ভাল লেগেছে। আর যারা সনাতন পদ্ধতি অনুসরণ করতে চাইবেন, তাদের কাছে এসব আবার ভাল নাও লাগতে পারে।

তবে আরো ভাল কিভাবে করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। আজ যেটুকু এগিয়েছে, সেটাই শেষ নয়। সমাজের এবং চারপাশের অগ্রগতির সাথে ক্যাডেট কলেজের পাঠদান এবং ক্যাডেটদের বাস্তবমুখী এবং সময়োপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য সামনে নিশ্চয়ই আরো অনেক পরিবর্তন/উন্নয়ন প্রয়োজন হবে, এবং সেই অনুযায়ী পরিবর্তন-পরিমার্জন এসব চলতেই থাকবে। আর এটাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

শিক্ষকেরা হচ্ছেন শিক্ষাব্যাবস্থার মধ্যে অনেক বড় একটা বিষয়। এখানে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক-স্টাফ-কর্মকর্তা-কর্মচারি সকলের সময়োপযোগী বেতন-ভাতাদি, রেসিডেন্সিয়াল পারিপার্শ্বিক সুবাধাদি (বিশেষ করে তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য), এসব দিক নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

“শিক্ষকতা অমল-ধবল পেশা” – এই মিষ্টি কথায় আসলে যোগ্য ব্যাক্তিকে তুলনামূলকভাবে কম সামাজিক সুবিধা দিয়ে আর শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। অন্যান্য পেশার সাথে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সহ সামাজিক মানোন্নয়নের বিষয়ে নজর না দিলে শিক্ষকতায় সুযোগ্যরা সামনের দিনগুলিতে আরো অনাগ্রহী হতে পারে।

সকলের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই লিখছি: যে কোন চাকুরির প্রযোগিতায় যারা এ্যাপ্লাই করবেন, তাদের মধ্য থেকেই নিয়োগ সম্পন্ন হবে। এ্যাপ্লাই যারা করেন, তারা তো সার্কুলারের মাপকাঠিতেই যাচাই-বাছাইয়ে সিকেক্টেড হয়ে আসেন। কিন্তু একটা বড় আনসিন অংশ (যারা এ্যাপ্লাই করেননি, এবং যারা হয়তোবা আরো বেশি মানসম্মত হতে পারতেন) হয়তোবা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের দিকগুলোকে (আর্থিক এবং সামাজিক সুবিধার বিচারে) এক্সপ্লোর করছেন। তারা শিক্ষকতায় কম আগ্রহী হচ্ছেন।

প্রাইমারি শিক্ষার স্তরটিকে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আর এর ঠিক পরের নিম্ন-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, এবং উচ্চ-মাধ্যমিক এই তিন স্তর নিয়েই যেহেতু ক্যাডেট কলেজগুলোর শিক্ষা ব্যাবস্থা, কাজেই এখানে চাকুরির জন্য, সময়ের চাহিদা আনুযায়ি, সামনের দিনগুলোতে, আরো বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন এবং ডেডিকেটেড ক্যান্ডিডেটদের কিভাবে আকৃষ্ট করা যায়, সেটার দিকে সংশ্লিষ্টদের আরো ফোকাস থাকা দরকার বলে মনে করছি।

সমালোচনা, যুক্তি, পাল্টা-যুক্তি, এসব তো থাকবেই। কিন্তু সমালোচনা হোক প্রব্লেম সলভ করার জন্য। সমালোচনার মধ্য দিয়ে কিছু প্রগ্রেসিভ রাস্তা সামনে আসুক। কেবলমাত্র ফেসবুকের মোমেন্টারি ইমোশোনাল কমেন্ট টাইপের সমালোচনায় কার কতখানি লাভ হচ্ছে বা হবে, সেটাও ভাবা দরকার। আমার লেখায় ভুল থাকলে আমিও সেটা শুধরে নিতে রাজি আছি।

আরেকটা কথা, ক্যাডেট কলেজ আসলে এক ধরনের মিলিটারি ফিডার প্রতিষ্ঠান। কাজেই সামরিক বাহিনীর কর্মক্ষেত্রের প্রতি এখানে উৎসাহ দেয়া হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর সেই অনুযায়ী এখানে পড়াশুনা এবং শারীরিক অনুশীলন চলবে, সেটাও স্বাভাবিক। কাউকেই তো আর এখানে জোর করে ভর্তি করানো হয় না। কাজেই যিনি তার বাচ্চাকে ক্যাডেট কলেজে পড়াবেন, এসব তার মেনে নেয়াই উচিত। (কমিউনিটির মধ্যে কিছু লেখায় কিছু মন্তব্য এবং কিছু রেফারেন্সের কারনে এটা লিখলাম।)

তবে হ্যাঁ, যেহেতু একটা বিশেষ ধরণের দীর্ঘ সিলেকশনের মধ্য দিয়ে ক্যাডেট কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়, সেদিক থেকে মোটামুটিভাবে প্রস্পেক্টিভ বাচ্চাদেরকেই এখানে সিলেক্ট করা হয়। আর এই বাচ্চারা পরবর্তী জীবনে শুধুই সামরিক ক্যারিয়ার করবে, তা কিন্তু নয়। কাজেই এই সিলেক্টেড বাচ্চাদের বড় একটা অংশ যেন অন্যান্য ফিল্ডেও ভাল করে, সামাজিক এবং প্রফেশনাল সেই লিডারশিপ কিভাবে সময়ের সাথে সাথে আরো উন্নত এবং পরিশীলিত করা যায়, সেটার সময়োপযোগী পরামর্শ আসতেই পারে।

এখানে আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা দরকার, এধরণের আলোচনা ক্যাডেট কলেজ কমিউনিটির জন্য অনেক সেন্সিটিভ একটা ইস্যু। আবার এই কমিউনিটিতে দাদা-নাতির বয়সের ব্যাবধানের সদস্যরা আছেন। সবার জীবন-দর্শন-পার্সেপশন-অভিজ্ঞতা আলাদা। কাজেই সমালোচনা হোক গঠনমূলক এবং অন্ততঃ ৯৫% উন্নয়নের টার্গেট নিয়ে। যেটা চলছে সেখান থেকে ড্রাস্টিক্যালি বেরিয়ে এসে যেন আবার “ফ্রাইং প্যান ট্যু ওভেন” না হয়ে যায়।

সবার জন্য শুভকামনা!
লং লিভ ক্যাডেট ফ্রাটার্নিটি!

Ahmad Mahbub-ul-Alam
Ex-Cadet, Rangpur Cadet College (CCR), 14th Intake (1988-1994)
Life Member and Former Organizing Secretary, Rangpur Old Cadets’ Association (ROCA)
PhD Research Fellow, Center for Higher Studies and Research (CHSR), Bangladesh University of Professionals (BUP)
Associate Professor & Head of English, and Proctor (In-charge), Manarat International University (MIU)

৬৩ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।