৮ জানুয়ারি ২০২৩
১। ৪৭ পার করলাম, ৪৮ শুরু হলো। মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে কতদিন বাঁচে? সেই হিসেবে জীবনের পিক স্টেজটা তো পার হয়েই গেল। এখন প্রায়ই মনে হয়, কিছুই তো করা হলো না। শরীরের বয়স বেড়েই চলেছে; অনেক চেষ্টায়, বলা চলে কিছুটা জোর করেই, মনের বয়সটাকে টিন এইজেই ধরে রাখার চেষ্টা করছি। যাই করি, ভালবেসে করি; আর তাতেই মেলে জীবন। তবে শিক্ষকতায় থেকে একটাই ঝামেলা, যতই দিন যায়, মনে হয় যেন ঠিকভাবে কিছুই শেখা হলো না।
২। আরিশা কদিন ধরেই তার বাপের জন্মদিনের জন্য গ্লিটার শিটে ডিজাইন করে সেগুলোকে কেটে কুটে কিছু একটা বানাচ্ছিল। নানান রকমের মিউজিক্যাল সাইন বানিয়েছিল। আর আমার অনেক অনিচ্ছা সত্বেও মনি একটা মিউজিক্যাল ডিজাইনের কেক আনিয়েছিল। মা-মেয়ের মন রক্ষার্থে গতরাতে আমাকে সেই কেক কাটতে হলো; ছবিও তোলা হলো। তবে আরিশার আনাড়ি হাতের “হ্যাপি বার্থডে ট্যু ইউ” বাজানোটা অনেক ভাল লেগেছে। দোতালা থেকে আমার বাবা, মা আর ছোট বোনকে তিনতলায় ডেকে আনা হলো। সবাই মিলে গল্প চলল অনেক্ষণ; সেই মুহূর্তটা অনেক ভাল লাগছিল। আমি কি-বোর্ডে টুং-টাং করছিলাম। বাবা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন; এক পর্যায়ে রাত বারটার দিকে ঘরোয়া আড্ডার ইতি টানতে হলো; সকালে আবার যার যার মত কাজ।
৩। জন্মদিনের সকালটা বেশ দৌড়ের উপরেই শুরু হলো। ঘুম থেকে জেগেই দেখি অফিসের কোন এক হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে কিছু কাজ/মিটিং-এর লিস্ট। অফিসিয়াল ইমেইল খুলে দেখি কাজের আরেকটা ফর্দ। ক্লাসও ছিল আজ; আন্ডারগ্র্যাডের ফাইনাল সেমিস্টারের সাথে। সেইসাথে আমাকেও দুপুরের দিকে ডিপার্টমেন্টের গুলশান ক্যাম্পাসের ফ্যাকাল্টিদের নিয়ে একটা জরুরি মিটিং কল করতে হলো। আবার দুপুরের ঠিক পরপরই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টের জরুরি মিটিং। সেখানেও ট্রাস্টিদের রিসিভ করার জন্য সব ডিপার্টমেন্ট হেডদেরকে দায়িত্ব পালন করতে হলো। বিকেলের পরে সন্ধ্যা নাগাদ বাসা। বাচ্চাকে ওর দাদু, দাদী আর ফুপির কাছে রেখে বৌ সহ বেরুলাম। বৌ ডিনার করালো। মন্দ নয় বিষয়টা। দিনটা পেরুলো। রাতে বাসায় ফিরেই আবার পরদিনের কাজের প্রস্তুতি শুরু হলো।
৪। আমি মানুষ হিসেবে কেমন, তা মাঝে মাঝে যেন নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আর শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের কাছে তো কখনোই জনপ্রিয় ছিলাম না। তবে মজার বিষয় হলো, প্রাক্তন ছাত্রদের অনেকের সাথেই আমার সম্পর্ক খুবই সাবলীল। আজ তিনজন পুরোনো স্টুডেন্ট তাদের ঘর-সংসার এবং চাকরি ম্যানেজ করে ক্যাম্পাসে এসেছিল শুধুমাত্র আমার সাথে দেখা করতে। দুজন আবার কেকও নিয়ে এসেছিল; তাদের একজন তো নাকি আজকের দিনটার জন্য অনেক আগেই অফিসে আধাবেলা ছুটি নিয়েছিল। ডিপার্ট্মেন্টের কয়েকজন জুনিয়র কলিগের উদ্যোগে অফিসে লাঞ্চ করা হলো। অন্য ডিপার্টমেন্টের এক বন্ধুস্থানীয় কলিগ কিছু গিফট নিয়ে আমার রুমে এসে হাজির। বেশ অকওয়ার্ড লাগছিল; তবে ভালও লেগেছে। আর দিন শেষে আরেক পুরোনো স্টুডেন্ট ম্যাসেঞ্জারে মনে দাগ কাটার মতন কিছু কিছু কথা লিখে পাঠালো। হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপে আমার ক্যাডেট নম্বর ট্যাগ করে ক্যাডেট কলেজের বন্ধুরাও ম্যাসেজে ভাসিয়ে দিল। দুয়েকজন ফোন করেও উইশ করল; তবে এই বয়সে আসলে উইশের চেয়ে খোঁজখবরই যেন বেশি দেয়া-নেয়া হয়ে যায়। সব মিলে জীবনের আরেকটা দিন পেরিয়েই গেল।
৫। আমি জনপ্রিয়তাকে বেশ ভয় পাই; তবে স্বস্তির বিষয় হলো, আমি আমার পরিসরে মোটেও জনপ্রিয় নই। আর ভয়ের কারন হলো, আমার কাছে মনে হয়, এ বড়ই ভয়ঙ্কর জিনিস; এ যে কেবল একটা মানুষকে কিছুটা সময় মোহাবিশষ্ট করে রাখে তাই নয়, বরং অচিরেই জনপ্রিয়তার আসন থেকে আছাড় দিয়েও ফেলে দেয়। আমার হিসেবে জনপ্রিয়তা আর রাগ, এই দুয়েরই প্রকাশ অনেক তীব্র, আর দুটোই নেহায়েতই ক্ষণস্থয়ী। তবে ভালবাসা এবং গ্রহনযোগ্যতা বড়ই অমূল্য; সবার ভাগ্যে জোটে না। ভালবাসা আর ঘৃণা মানুষ মনে হয় সহজে প্রকাশও করে না, তবে তা বোঝা যায় ঠিকই, আর এ দুটোই দীর্ঘস্থায়ী, হয়তো চিরস্থায়ীও। আমার আসেপাশের সামান্য কিছু মানুষের অসামান্য ভালবাসায় সিক্ত হতে পেরে আমি সত্যিই ধন্য; হয়ত এতটা আমি ডিজার্ভ করি না।
লেট হ্যাপি বার্থডে, ভাই!
আপনার লেখা পড়ে আপনাকে অনেক সংবেদনশীল মনের মানুষ মনে হয়। মধ্য তিরিশে এসে অর্থ,বিত্ত কিংবা ক্ষমতার চেয়ে একটু ঝঞ্জাটহীন কর্মজীবন আর কাছাকাছি কিছু সমমনা মানুষের সঙ্গ সবচে বেশি আকাঙ্খিত মনে হয়।
সময় তো সবারই ফুরোবে, আগে আর পরে। সময়টুকু উপভোগ করুন, ভালো থাকুন।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই