মাকে মনে পড়ে

[এই লকডাউনে সিসিবিতে আমার চলমান দিনলিপি “করোনার দিনগুলি”-র ১৪তম পর্বে এই লেখাটা ছেপেছিলাম। সেখানে এক শ্রদ্ধেয় এক্স-ক্যাডেট লেখক বড় ভাইয়ের মন্তব্য ছিল, এটাকে আমি আলাদাভাবে একটা ব্লগ আকারে রাখতে পারতাম। সেই চিন্তা থেকেই এই লেখাটাকে আলাদা একটা ব্লগ হিসেবে ছাপানোর ইচ্ছে হলো। অবশ্য এই লেখাটা ফেসবুক ভিত্তিক ইদানিংকালের বেশ জনপ্রিয় ক্রিয়েটিভ প্লাটফর্ম “পেন্সিল” গ্রুপেও ছেপেছিল। কিন্তু যেহেতু এই লেখাটা একটু পুরোনো, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার টাইমলাইনে প্রথমবার ২১শে এপ্রিল ২০২০ তারিখে লিখেছিলাম, তাই এই ডিস্ক্লেইমারটা দিয়ে রাখছি।]

আমি ছোটবেলায় প্রচুর মার খেয়েছি। ফ্যামিলিতে এবং পাড়ায় রেকর্ড ছিল আমার মার খাওয়ার। একমাত্র সন্তান হওয়া স্বত্বেও কোন ছাড় পাইনি। আমি তো আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের প্রায়ই বলি, “আমি খুব ছোটবেলাতেই যে পরিমান মার খেয়েছি, তোমদের সবার কপালে একত্রে সারাজীবনের সম্মিলিতভাবে তার সিকিভাগও জোটেনি।” মা-ই বেশি পেটাতেন। বাবা পেটাতেন কম, তবে বাবা যেদিন ধরতেন, খবর করে ছেড়ে দিতেন। মায়ের কাছে খাওয়া মারগুলোই বেশি মনে পড়ে, কিল, চড়, চিরুনি, হাতপাখা, ডালঘুটনি, মাঝে-মাঝে স্যাণ্ডেল, অর্থাৎ তাঁর হাতের নাগালের মধ্যে যেটাই থাকত, এগুলোর সাথে অনেক ছোটবেলাতেই আমার বিশেষভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এমনকি ক্যাডেট কলেজ থেকে ছুটিতে এসেও মার খেয়েছি। সর্বশেষ যেটা মনে পড়ে, সেটা ছিল ১৯৯২ সালে, এসএসসি পরীক্ষার পরের সেই দীর্ঘ ছুটিতে। ওহ! হোয়াট এ লাইফ!

মা ছিলেন পার্ফেক্ট এক্সাম্পল অফ এ ফ্যামিলি ডিক্টেটর। তাঁর বাপের বাড়ি, শ্বশুর-বাড়ি, দুপক্ষই তাকে সমঝে চলত। সকল কাজেই তাঁর পার্ফেকশন থাকতেই হবে। আর আসেপাশের মানুষগুলোকেও সেই পার্ফেকশন আনুযায়িই চলতে হবে। বাসায় মেহমান এলে তাকেও সকাল-সকাল সময়মত ঘুম থেকে উঠে নিখুঁতভাবে নিজের মশারি নিজেকেই গুছাতে হবে, এবং টানটান করে তার নিজের বিছানা-বালিশও গুছাতে হবে, এবং তারপরে সবার সাথে একসাথে নাস্তার টেবিলে বসতে হবে। আমার নানুর-বাড়ি তো অনেক দূরের কথা, দাদু-বাড়ির কোন ধূমপায়ী মুরুব্বী আত্মীয়েরও সাহস ছিল না আমাদের বাসায় বেড়াতে এলে বাসার ত্রিসীমানায় স্মোক করার। এমনই ছিল আমার মায়ের পার্সোনালিটি। ঘাড়ত্যাড়া কিংবা অকর্মণ্য বা সাদা-সিধা টাইপের কোন আত্মীয়-স্বজনদের কেউ আমার মায়ের কাছে কিছুদিন থেকেছে/থেকেছেন, অথচ সোজা মানুষ হয়ে যায়নি/যাননি বা কিছুই শেখেনি/শেখেননি, এমনটার কোন স্বাক্ষ্যপ্রমান নেই। বাসায় যেই আসুক, খাওয়ার পরে তার নিজের প্লেট তাকেই ধুতে হতো, সেইসাথে কোন একটা খাবারের পাত্র সেই মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে গেলে সেটাও। ধোয়ার সময় আবার বেসিন/সিঙ্কের আসেপাশে পানি পড়া চলবে না, পড়লে সেটাও তাকেই মুছতে হবে। বাসার ময়লা খুব সুন্দর করে প্যাকেট করতেন, যেন বোঝাই না যায় সেটা একটা ময়লার প্যাকেট। যে যখন বাসার বাইরে যাবে, ময়লার প্যাকেট সুন্দর ভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে, তা সে আমি, কিংবা বাবা, কিংবা বাসায় দুচারদিনের জন্য বেড়াতে আসা কোন মেহমানই হোক। অনেক দিন তো এমন গেছে যে, বাবা কলেজে/অফিসে যাওয়ার পথে ডাস্টবিনে ময়লার প্যাকেটটা ফেলে তারপরে গেছেন। আর মজার কথা হলো, আমাদের বাসায় কেউ বেড়াতে এলেও এসবে মাইন্ড করেছেন বলে আমার মনে হয়নি, কারন সবাই জানতেন, এই বাসায় সবাই এভাবেই থাকে, এভাবেই এখানে থাকতে হবে। তবে আন্তরিকতার ঘটতি কখোনই ছিল না, মা সবার জন্য করতেন প্রচুর, হৃদয়ের ভালবাসা নিংড়েই করতেন। একারনেই বেড়াতে আসা মেহমানরা এসব মেনে নিত/নিতেন। মহিলা কেউ বেড়াতে আসলে অলস বসে থাকার সুযোগ ছিল না। বাইরে কোন কাজে বা কোথাও ঘুরতে না গেলে বাসায় থাকার মুহূর্তটাতে মায়ের সাথে ঘরের কাজে বা তরকারি কুটাবাছায় তাদেরকেও হাত দিতে হতো। তবে রান্নাটা সামলাতেন মা একা হাতে। সম্ভবত ওই পার্ফেকশন-প্রিয়তার কারনেই এই একটা কাজ তিনি অন্যের হাতে ছাড়তেন না।

আমি যখন অনেক ছোট, ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় কিংবা হয়তো তার কিছু আগে-পরে, তখন থেকেই বাসার অনেক কাজই আমাকে করতে হতো। বিছানা-মশারি গুছানো তো নস্যি, স্কুল থেকে নিয়ে এসে, বাসায় সেই মুহূর্তে যে খাবারই থাকত, মা আমাকে পেট ভরে খাইয়ে দিয়ে হাতে একটা ন্যাকড়া ধরিয়ে দিতেন, পুরো বাসার যাবতীয় ফার্নিচার মোছার দায়িত্ব ছিল আমার। পরে আবার সেসবের ইন্সপেকশন হতো; ফার্নিচারের কোনায়-চিপায় অসম্ভব সব জায়গাতে আঙ্গুল দিয়ে টেনে দেখতেন, হাতে ধুলা লাগে কি না, অর্থাৎ আমি ঠিকমত দায়িত্ব পালন করেছি কিনা। মেহমান এলে নাস্তা দেয়া, চা বানানো, তাদের আপ্যায়নের পরে বাসন ধুয়ে-মুছে গুছিয়ে রাখার দায়িত্বও ছিল আমারই। কালের প্রবাহে ঘর ঝাড়া-মোছা, নিজের কাপড় ধোয়া, এসবও আমার ঘাড়েই এসে বর্তায়।

সেই তুলনায় ক্যাডেট কলেজটা আমার কাছে অনেক আরামের জায়গা ছিল। একবার আমি পঞ্চগড়ে আমার ছোট চাচার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম; তাঁকে আমি বাবুজি ডাকি। কবে সেটা সঠিক মনে নেই, ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় কোন এক ছুটিতে, কিংবা ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার পরপরই হয়তোবা। ছোট চাচা বর্তমানে পেট্রোবাংলার গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা; তবে সেসময় তিনি আরেকটা জবে ছিলেন, পোস্টিং ছিল পঞ্চগড়ে, তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়েছেন জিওলজি এণ্ড মাইনিং-এ প্রথম শ্রেনীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করে। সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন ব্যাচেলর। থাকতেন থানা লেভেলের সমবয়সী কয়েকজন অফিসিয়ালের সাথে একটা বাসা ভাড়া করে। ছুটা বুয়া এসে তাঁদের রান্না করে দিয়ে যেত। আমিও সেদিন তাঁদের সাথে লাঞ্চের পার্টনার। জেলা শহরের উঠোন সহ একতলা বাসার টানা-বারান্দায় একটা সাধারন মানের কাঠের টেবিল, সেটাতেই রান্না করা খাবার ঢাকা দেয়া, সেদিন ছিল মুরগির রান্না। আমি খাওয়ার মাঝখানেই খাওয়া থামিয়ে মুরগির হাড় চিবিয়ে হাতে নিয়ে বসে আছি, হাতের ময়লাটা ফেলার জন্য বোন্স-প্লেট খুঁছিলাম। চাচা আমার অবস্থা দেখে বললেন, “তোর যেখানে খুশি ফেলে দে; এখানে তোর মা নাই।” এই ঘটনাটা চাচার মনে আছে কিনা জানিনা, কিন্তু আমার যখনই মনে পড়ে হাসি আটকাতে পারি না। আমার জন্মের সময় আমার এই চাচা নাকি ক্লাস সিক্সে পড়তেন, এবং সবচেয়ে ছোট দেবর হিসেবে আমার মায়ের সাথে তাঁর খুব সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। আমার এই চাচা এইচএসসি-তে পড়ার সময় আমাদের বাসায় থেকেছেন, এবং বলাবাহুল্য আমার মায়ের কঠোর শাসনের চ্যাপ্টারে তাঁকেও থাকতে হয়েছিল। হা হা হা … তবে একটা কথা না বললে, লেখার এই অংশটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; আমার মায়ের শেষ জীবনে হাস্পাতালের সময়গুলোতে ছোট চাচা আমার মায়ের সুযোগ্য সন্তানের মতই দায়িত্ব পালন করেছেন।

মায়ের জন্ম তারিখ আমার জানা নেই। উনি মারা যান ২রা সেপ্টেম্বরে, ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪১/৪২ বছর বয়সে। বাবাও কম যান না। বাবাও আগের থেকেই মায়ের মতনই ছিলেন। কেমন করে যেন এই দুজন অতি খুঁতখুঁতে পার্ফেকশন-প্রিয় মানুষের এ্যারেঞ্জড ম্যারেজ হয়েছিল কোন এক ১৩ই নভেম্বরে। মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা যেন দুইজনের দায়িত্ব একাই নিলেন, শুরু হলো “একলা চলো রে” অভিযান, দুজন মানুষের কালেক্টিভ খুঁতখুঁতানি সহ। ক্যান ইউ ইমাজিন? হা হা হা … আমাদের পরিবারে আমার দ্বিতীয় মায়ের আগমনের পরে আমার গৃহস্থালির কাজে হাত বাটানোতে আমার ছোট-মা মনে হয় প্রথম দিকে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যান। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমার ছোট-মা মনে হয় তাঁর এই হঠাৎ পাওয়া ছেলেটার কাছে এতটা সাহায্য নিতে প্রথম দিকে বেশ আনকফর্টেবল ছিলেন। আমার একমাত্র ছোট বোনটার জন্মের সময় আমার বয়স ২২ বছর। সে-ও বাসায় সেই একই নিয়মেই চলছে। আমাদের বিয়ের সময় সে ক্লাস ফোর-এ পড়ত, এবং সেই বয়সেই তার ছোটখাট কাজগুলোকে গুছিয়ে করার প্রবণতা দেখে আমার বৌ-ও তখন বেশ অবাক হতো। আমাদের ছোট্ট মেয়েটা যখন মাত্র দুছরের মতন বয়স, সে-ও বাথরুমে যাবার আগে তার খেলনাগুলো গুছিয়ে তারপরে বাথরুমে যেত। হা হা হা … জেনেটিক্স বোধহয় একেই বলে।

যাহোক, সংসারে আমার বৌ-এর শাসন তো আমার এধরনের চাইল্ডহুড ওরিয়েন্টেশনের তুলনায় কিছুই না। কাজেই, সে আমার উপরে খুব একটা ছড়ি ঘুরানোর সুযোগ পায় না। কালেভদ্রে সামান্য যা একটু ঘরের কাজে সাহায্য করি, সেটাই সম্ভবত তার কাছে অনেক বেশি মনে হয়। সে নাকি সারা জীবনে তার মা-বাবার কাছে একবারও মার খায়নি। আমি তো বলি, “তোমার জীবন তো দেখি ষোল আনাই মিছে”! কাজেই সে-হিসেবে সামান্য ঘরের কাজে হাত বাটানো, এ আমার কাছে মোটেও নতুন কিছু না। আমার মা যা ছিলেন, সেই লেভেলের ফ্যামিলি-ডিক্টেটর হতে হলে আমার বৌ-কে মহাবিশ্বের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বারবার জন্মাতে হবে, তাও তার দ্বারা তেমনটা হওয়া হবে কিনা, আমি সন্দিহান। কাজেই এই লক-ডাউনের দিনগুলোতে গৃহস্থালির সামান্য কিছু কাজে তাকে এ্যাসিস্ট করা, এতো আমার কাছে পুতুল খেলা।

এত কিছুর পরেও এই লক-ডাউনের গৃহবন্দিদশা আর ভাল লাগছে না। এখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে সকাল-সন্ধ্যা মায়ের কাছে মার খাওয়াই অনেক ভাল ছিল। তারপরেও বলি, সবাই বাসায় অবস্থান করুন; সবাই ভাল থাকুন।

পুনশ্চঃ মা-কে আমি মামনি ডাকতাম, আর বাবাকে এখনো বাপিমনি ডাকি। ছোটবেলার প্র্যাক্টিসগুলো হঠাৎ ছেড়ে দেয়া যায় না। অবশ্য ছেড়ে দিলে মনে হয় মেকি-মেকি শোনাবে। যে যেটাতে প্র্যাক্টিসড/অভ্যস্ত, সেটাই সাবলীল। আর এগুলোর জন্য ক্যাডেট কলেজের বন্ধুরা এখনো আমাকে টিজ করে। করুক! টিজ করা ছেড়ে দিলে মনে হবে আন্তরিকতা কমে গেছে। ওই ব্যাটাদের বয়স যত বাড়ছে, ফাজলামির মাত্রাটাও সমান তালে বাড়ছে। বাড়ুক! লাইফ ইজ রিয়েলি সো বিউটিফুল।

৩,৬৫৬ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “মাকে মনে পড়ে”

  1. মা তোমার প্রতি অনেক ভালোবাসা রইল। লেখন অনেক ধন্যবাদ এই ধরনের ব্লগ উপহার দেওয়ার জন্য।

    বর্তমানে করুনা কালিন অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন। এখন আউটসোর্সিং এর অনেক চাহিদা । তাই যারা অনলাইনে প্রশিক্ষন নিতে চান ভিজিট করুন- https://www.outsourcinghelp.net/

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "ওই ব্যাটাদের বয়স যত বাড়ছে, ফাজলামির মাত্রাটাও সমান তালে বাড়ছে। বাড়ুক! লাইফ ইজ রিয়েলি সো বিউটিফুল।" - আমার/আমাদের বয়সে পৌঁছলে আরও বেশি করে বুঝতে পারবে ক্যাডেট ব্যচমেটদের ফাযলামি'র মাত্রা বয়সের সাথে সাথে কিভাবে বেড়ে যায়!
    পোস্ট ভাল লেগেছে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।