শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে এটাই আমার প্রথম লেখা নয়। এবিষয়ে আগেও লিখেছি। তবে ডায়রি শিরনামে এবারেই প্রথম। কর্পোরেট জীবন ছেড়ে শিক্ষকতায় নাম লিখিয়েছিলাম টাইম পাস করার জন্য, এবং অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, মূলতঃ পেটের তাগিদেই। এই অমল-ধবল প্রফেশনটাকে ভালবেসে ফেলেছি বলেই অন্য কোন পথে রুটি-রুজির চিন্তা বা চেষ্টা কোনটাই আর করা হয়নি। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি যে, জনপ্রিয়তা নয়, বরং শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের আস্থা এবং ভালবাসা অর্জনটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। তবে এগুলোর সবকটাই যে কোন প্রফেশনালের জীবনেই আসতে পারে, এবং অবশ্যই কর্মনিষ্ঠা এবং সততা প্রয়োগের বা চর্চার মধ্য দিয়েই। যে কোন প্রফেশনে, তা সে শিক্ষকতাই হোক, বা অন্য যে কোন অঙ্গনেই হোক, জনপ্রিয়তা আসে ট্রিক্স থেকে, নেগেটিভলি স্বস্তা পন্থায়। এ এক আজব আকর্ষণ। এর লোভ সংবরণ করতে পারাটা এক বিরাট কঠিন কাজ। এখানে মোহ কাজ করে। কিন্তু কাজটাকে মানুষ ভালবেসে ফেললে তখন সেখানে থাকে সততা এবং নিষ্ঠা। সেখানে জনপ্রিয়তা হয়তো বা আসে না ঠিকই, কিন্তু মানুষের জন্য বিকিয়ে দেয়া ভালবাসার প্রতিদানটুকু দিনের শেষে ঠিকই অনেকগুন বেশি হয়েই রিফ্লেক্ট করে।
একাডেমিক, প্রফেশনাল এবং জীবন থেকে উপলব্ধ অভিজ্ঞতা নিয়েই আমার অধিকাংশ লেখা। আমার কাছে মনে হয়, আমার মতন যে কারো জীবনে এটাই স্বাভাবিক যে, তিনি তার নিজস্ব পরিমণ্ডলের অভিজ্ঞতার আলোকেই কোন কিছু লিখবেন। একজন মানুষের শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা, তার পারিবারিক জীবন, পরিবারের বন্ধন, স্নেহ-ভালবাসা, এসব যেমন একটা ব্যাক্তিচরিত্রকে প্রভাবিত করে, ঠিক তেমনি, যে ধরনের শিক্ষাঙ্গনে তিনি বিচরণ করেছেন বা করছেন, যে প্রফেশনে আত্মনিয়োগ করেছেন, যে সার্কেলে তিনি অভ্যস্ত এবং কম্ফোর্টেবল, যে সমস্ত প্রফেশনাল দায়িত্বে ইনভল্ভড আছেন, সেগুলোও তার নিত্যনৈমত্তিক প্রকাশভঙ্গিতে রিফ্লেক্টেড হয়। অভিজ্ঞতার ঝুলি খুললে সেই গল্পগুলোই বেশি চলে আসে। যেমন, আমার ক্ষেত্রে আসে মা-বাবার সাপোর্ট এবং অনুশাসনের সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে বড় হবার গল্প, ছোট বেলায় পিটুনি খাবার গল্প, ক্যাডেট কলেজের কড়া নিয়মানুবর্তিতার গল্প, দল বেঁধে দিনের পর দিন শাস্তি খেয়েও বন্ধুদের নাম বলে না দেবার ভাতৃত্ববোধের গল্প, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগুরুদের কাছে হাতে কলমে কাজ শেখার গল্প, আলিয়াস ফ্রঁসেজের শিক্ষাদান-পদ্ধতির গল্প, আইটি ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষকদের বিভিন্ন সময়ের আইটি বেইজড সলিউশনের গল্প, ভাষা-ভাষাতত্ব-সাহিত্যের ক্লাসের গল্প, পিএইচডি কোর্স-ওয়ার্কের বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষক এবং সিনয়র কোর্সমেটদের কাছে শেখা বিভিন্ন একাডেমিক এবং প্রফেশনাল গল্প। আর এখন যোগ হয়েছে আমার ছোট্ট মেয়েটার বেড়ে ওঠার মুহূর্তগুলোতে তিল তিল করে আমাদের নিজেদের (আমার স্ত্রীর এবং আমার) মা-বাবা হবার গল্প। প্রাসঙ্গিকভাবেই লিখতে হচ্ছে, আজ নিজেই আমি যে গবেষণা বা পড়াশুনার কাজ করছি, সেটা তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে, যার হাতেখড়ি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের ক্লাসরুমে। স্যার আজ পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তিনি তাঁর ছাত্রদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। সিলেবাসের টেক্সটের সাথে সিলেবাস বহির্ভূত টেক্সট নিয়ে তিনি তুলনামূলক আলোচনার কাজ করাতেন। এমনকি ইংরেজির সাথে বাংলা টেক্সটের তুলনামূলক আলোচনাও বাদ যেত না। এতদিন বাদে ঠিকই টের পাই যে, মাথায় এই পোকাটা আমার তখনই ঢুকেছিল।
কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক নাম গোপন করে গিয়েছি। আমার মতে, কাউকে এক্সপোজ বা ফোকাস করার চেয়ে নিজের অভিজ্ঞতাই একটা লেখার মূল উপজীব্য। এমনকি কিছু লেখায় হয়তো আমি আমার কোন নেগেটিভ অভিজ্ঞতাকে লিখতে গিয়ে শব্দচয়নে অনেক বেশি সচেতন হয়েছি, যাতে করে সন্দেহের বশেও পরিচিত মহলে কোন ব্যাক্তিকে হেয় প্রতিপন্য করা না হয়ে যায়, কারন সেটা তো আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। একাডেমিক এবং প্রফেশনাল ইস্যুতে আরেকটা বিষয়ে এক্ষেত্রে লিখতেই হচ্ছেঃ দিনের শেষে যে কোন অভিজ্ঞতাই অভিজ্ঞতা, পজেটিভ আর নেগেটিভ কেবল সময়ের আপেক্ষিকতায় আমাদের চিন্তার দুটো দিক মাত্র। চূড়ান্ত বিচারে, যে কোন অভিজ্ঞতাই মানুষকে সমৃদ্ধ করে, জীবন-উপলব্ধ দর্শনকে আরো একধাপ সামনে নিয়ে যায়। কাজেই সেহিসেবে, একান্ত আমার মতে, এখানে সবকিছুই পজেটিভলি কন্ট্রিবিউটিভ।
আমার এক জুনিয়র কলিগ কোন এক সময় তাঁর কোন এক গবেষণা বা কোর্স-প্ল্যানিং-এর জন্য আমার সাথে আলোচনা করছিলেন। বিষয়টা সম্ভবত ছিল ক্লাসরুমে ছাত্রদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সংক্রান্ত মোটিভেশনাল ফ্যাক্টর্স নিয়ে। আমি তাঁকে বলেছিলাম, তিনি যেন নিজের জীবনের সাক্সেস স্টোরির চেয়ে ফেইলিয়র স্টোরিগুলোতে বেশি হাইলাইট করেন। আমার যুক্তি ছিল, সাক্সেসের গল্প বলতে অনেক মজা। অনেকটা নিজের ঢোল নিজেই পেটানোর মতন। কিন্তু তিল-তিল করে ব্যার্থতার মধ্য দিয়ে কষ্ট করে গড়ে ওঠা যে প্রফেশনাল ব্যাক্তিটিকে ছাত্ররা তাদের সামনে দেখছে, তাঁর জীবনেও যে কত রকমের ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাত গেছে বা আছে, সেটা ছাত্রদের সামনে নিয়ে আসা আবশ্যক, যাতে করে নিজেদের ছোট-ছোট ফেইলিয়র বা অসুবিধাগুলো তাদের (ছাত্রদের) কাছে আর তেমন একটা প্রতিবন্ধকতা মনে না হয়। আর মনের দিক থেকে তারা এই প্রতিবন্ধকতাগুলোকে জয় করতে পারলে, আমার ধারনা, নিজের একাডেমিক এবং প্রফেশনাল জায়গাগুলোতে পজেটিভলি ফোকাস করতে পারবে; একাডেমিক রেজাল্ট যাই করুক না কেন, নিজেকে জীবনে তৈরি করে নিতে পারবে, এবং প্রতিকুল অবস্থাতেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে সামলে চলতে পারবে।
ছাত্রদেরকে আমি তাদের পার্সোনাল এবং প্রফেশনাল জীবনকে আলাদাভাবে রাখার জন্য পরামর্শ দেই। যদিও বিষয়টা অতটা সহজ নয়। তাদের পার্সোনাল এবং প্রফেশনাল জীবনের ক্যালকুলেশনগুলো শেখানোর মুহূর্তগুলোতে আমার কাউন্সেলিং যে সবসময় খুব নরম সুরে ছিল বা থাকে, তা কিন্তু কখনোই নয়। আমি ইন্টেনশনালিই এটা করে থাকি; এটা আমার পলিসি। ছাত্রদের এটাও বোঝাতে চেষ্টা করি যে, তাদের সামনের শিক্ষকটিকেও তারা যেন ব্যাক্তিজীবন দিয়ে জাজ করার চেষ্টা না করে, কারন এই মানুষটাই ক্লাসরুমে একজন শিক্ষক, বন্ধুমহলে একজন আড্ডাবাজ, নিজগৃহে একজন বাবা-সন্তান-স্বামী-ভাই। একই মানুষের একেক স্তরে একেকটা আলাদা পরিচয়, দায়িত্ব, প্রেফারেন্স আছে। একটা দিয়ে আরেকটা যেমন জাজ করা যায় না, ঠিক তেমনি একটা জগত দিয়ে যেন আরেকটা জগত ডিস্টার্বড না হয়, সেটাও দেখার বিষয়। আবারো লিখতেই হচ্ছে, বিষয়টা কিন্তু ততটা সহজ নয়। একজন শিক্ষকের সাথে আমি অনেক সাবলীল হতে পারি, কিংবা হয়তো এর ঠিক উল্টোটা, তাঁর ব্যাক্তিজীবনটাকে আমার ভাল নাও লাগতে পারে। কিন্তু ক্লাসরুমে সেগুলো কতখানি বিচার্য? ক্লাসরুমের প্রকৃত বিচার্য কি এটাই নয়, তিনি কি সময় মত ক্লাসে আসছেন? তিনি কি পড়ানোর জন্য প্রস্তুত? তিনি কি ছাত্রদের একাডেমিক এবং প্রফেশনাল গ্রুমিং-এর জন্য ইফেক্টিভলি কন্ট্রিবিউট করছেন? তিনি কি ক্লাসরুমে প্রেজেন্টেবল? তাঁর একাডেমিক ডেলিভারি কি আন্ডারস্ট্যাণ্ডেবল? এই বিষয়গুলো যে শিক্ষকের বিবেচনায় থাকবে, আমার মনে হয় তিনি তাঁর প্রফেশনকে, এবং প্রফেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টরগুলোকে (যেমন ছাত্রদের) ভালবাসেন। তবে হ্যা, এটা তো আর ডোমেস্টিক বা প্রাইভেট লাইফের ভালবাসা নয়, এটা প্রফেশনাল ভালবাসা, এখানে ভালবাসার এক্সপ্রেশন, ইম্প্যাক্ট এবং ইফেক্ট গুডলুকিং বা চার্মিং নাও হতে পারে। বাট ইট মাস্ট বি প্রপার্লি ফেল্ট এ্যাণ্ড ওয়েল-আণ্ডারস্টুড বাই দ্যা রিসিভার্স। এখানে প্রকাশ্য (এক্সপ্লিসিট) কিছু নাও থাকতে পারে, এখানে প্রমান থাকবে অনুভুতিতে। আমার জানা নেই, এ বিষয়ে কোন গবেষণা হয়েছে কি না, কিন্তু সম্ভবত এমন টপিক এখন গবেষণার দাবী রাখে। এখানে বর্তমানকে গুরুত্ব দিলে চলবে না, ভবিষ্যতের রেজাল্টকে কাউণ্ট করতে হবে। আমি ছাত্রদের সব রিকুয়েস্ট এণ্টার্টেইন করে জনপ্রিয় শিক্ষক হয়ে সুন্দর সমালোচনা-বিহীন জীবন পার করে দেব, অথচ এ্যাট দ্যা এণ্ড অফ দ্যা ডে, দেশ-জাতিকে ভাল মানের প্রফেশনাল তৈরি করে দিতে পারলাম না, এ ব্যার্থতা একান্তই আমার, একান্তই শিক্ষকের।
তবে, আমার একান্ত বিচারে, ইদানিং ছাত্ররা দুটো মারাত্মক ভুল করে বসছে, যা হয়তো আমরা শিক্ষকরা সঠিক সময়ে এড্রেস করতে পারছি না, কারন বিষয়টা নিয়ে আমরা হয়তো সেভাবে ভাবছিও না। প্রথমতঃ (এটা আগেই উল্লেখ করেছি) পার্সোনাল আর প্রফেশনাল লাইফকে আলাদা ভাবে হ্যাণ্ডেল করতে শিখছে না; আর দ্বিতীয়তঃ ছাত্ররা অনুসরন আর অনুকরনের পার্থক্য ধরতে পারছে না । (আরো কিছু প্রফেশনাল ইস্যু আছে, সেগুলোতে পরে আসছি।)
দ্বিতীয়টা নিয়েই আগে লিখছিঃ ধরা যাক, আমি একজন ছাত্র। কোন একজন শিক্ষকের পার্সোনালিটি আমাকে আকর্ষণ করছে। আমি তাঁর মতন হতে চাইছি। এটাতে আমি দোষের কিছু দেখি না; এটা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু আমি মোহাবিষ্ট হয়ে সরাসরি আমার শিক্ষকের পার্সোনালিটি অনুকরন (কপি) করতে থাকলাম; এটাতেই সমস্যা। নিজের সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে কি এটা আদৌ সম্ভব কি না, ভেবে দেখার আছে। লিবারাল হিউম্যানিজম-এ আমরা পড়েছি এবং পড়াই, “ক্যারেক্টারিস্টিক্স আনচেইঞ্জেবল”; এর ডেভলাপমেণ্ট থাকবে, কিন্তু তা চেইঞ্জড হবে না। তাহলে যদি আমি অনুসরনের (ফলো) পথ না ধরে, আমার পছন্দের (ক্ষেত্রবিশেষে অবসেশনের) মানুষটাতেই পরিনত হব, সেই মোহে আবিষ্ট হই, সেক্ষেত্রে মনে হয় আমার নিজের গ্রুমিং আমি নিজেই নষ্ট করে ফেললাম। আমার বিচারে, আমি ব্যাক্তিসত্তায় যা আছি, সেখান থেকেই আমার প্রফেশনাল পার্সোনালিটির গ্রুমিংটাকে কাস্টমাইজেশনের একটা পদ্ধতি চালালে ভাল হয়। নিজেকে সম্পূর্ণ অন্য আরেকটা মানুষের রূপে নিতে গেলে তালগোল পাকিয়ে যায়। প্রফেশনালি প্রপার ডেলিভারি আসে না।
আর প্রথমটা নিয়ে এই লেখায় আগেও কিছু কথা চলে এসেছে। (পার্সোনাল এবং প্রফেশনাল লাইফকে আলাদা রাখার চেষ্টা করা নিয়ে বিষয়টা আমার ক্যাডেট কলেজের এক বন্ধু আমাকে প্রথম ধারনা দেয়।) এখানে শৈশবের কিছু স্মৃতি টেনি আনছি, অনেকের সাথেই মিলে যেতে পারে। প্রাইমারি স্কুলে অনেক শিক্ষককে ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে ব্যাক্তিগত কাজ করতে দেখেছি (যেমনঃ সোয়েটার বোনা; হাস্যকর শোনালেও এটাই আমার এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে)। আমার সকল শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই লিখছি, এটা সঠিক ছিল না। প্রফেশনাল সময়টাতে তাঁরা পার্সোনাল ইস্যুতে নিজেকে এঙ্গেইজড রেখেছিলেন। তাহলে হয়তো, তাঁদের পার্সোনাল বা পারিবারিক সময়টাতে (যেটা ছাত্রজীবনে আমরা দেখি না, বা খেয়াল করি না) তাঁরা আবার প্রফেশনাল কোন বিষয় নিয়ে সময় দিয়েছেন; হয়তো বা নিয়মিতই এমনটা করেছেন (আমার হিসেবে, না করার কথা না)। আমি নিজে পারতঃপক্ষে (একান্ত এমার্জেন্সি ছাড়া) অফিস আওয়ারে বাসার সাথে যোগাযোগ করি না, এবং অবসের বাসায় থাকা অবস্থায় ছাত্রদের ফোন-কল এন্টারটেইন করতে চাই না। এক্ষেত্রে আমি কিছু পলিসি মেনে চলার চেষ্টা করিঃ প্রয়োজনে অফিসে কিছুটা সময় বেশি দিয়ে হলেও অফিসের কাজকে অফিসেই শেষ করা ভাল। কাজের লিস্ট এবং প্রায়োরিটিজ ভাগ করে নিতে পারলে মনে হয় অনেকটাই এ্যাডজাস্ট করে নেয়া যায়। যদিও শিক্ষকদের জবটা আসলে অনেকটাই টুয়েণ্টিফোর-আওয়ার্স-জব; ঘুমানোর পূর্ব মুহূর্তেও পড়ার বা পড়ানোর কাজ/চিন্তা মাথায় আসতে পারে, কিন্তু কাজের প্রায়োরিটি অনুযায়ি তালিকা থাকলে, এবং সময়ের কাজ সময়ে সেরে ফেললে, আমার হিসেবে এসবের অনেকটাই ম্যানেজে করা সম্ভব। ইনিশিয়ালি কষ্টকর মনে হলেও, অসম্ভব নয়, এবং একসময় তা হয়তো অভ্যাসে পরিনত হয়। ক্যাডেট কলেজের কয়েক বছরের জনৈক সিনিয়র, যিনি আজ সুপ্রতিষ্ঠিত কর্পোরেট আইকন, তিনি একদিন সামনাসামনি আলাপে তাঁর স্বল্পসময়ে কর্মক্ষেজীবনের উন্নতির পেছনে সময়ের কাজ সময়ে সেরে ফেলার গুরুত্ব নিয়ে এই কথাগুলোই বলেছিলেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই পলিসি তো অসম্ভব কিছুই নয়, একটু ইচ্ছা এবং চেষ্টা থাকলে তা যে কোন প্রফেশনেই মেইন্টেইন করা সম্ভব।
ছোট-ছোট আরো বেশ কিছু জিনিস এখানে চলে আসে। ক্যাডেট কলেজ জীবনে আমাদের টাইম ম্যানেজম্যাণ্টের যে প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তার সুফল লেইট লতিফ টাইপের এক্স-ক্যাডেটরাও আজ অস্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। এটা একটা প্রসেস। প্রসেস চলাকালীন সময়ে তা কষ্টকর মনে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। শিক্ষকদের এটার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় ছাত্রদের এই রাস্তায় আনা প্রায় অসম্ভব। আমি নিজে ক্লাসে দেরিতে না যাবার ব্যাপারে একান্ত সচেষ্ট থাকি। কারন আমার কাছে মনে হয়, আমি যদি সময়মত ক্লাসে না যাই, আমার কোনই অধিকার নেই ছাত্রদের সময়মত ক্লাসে আসার ব্যাপারে কোনপ্রকার এক্সপেক্টেশন্স রাখার। হয়তো কোনদিন অফিসেই কোন কাজে আটকে গেছি, অন্য ফ্লোরে ক্লাস, আমার প্রথম কাজ হলো ক্লাসের সিআর-কে ফোন করে সবাইকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলা, বা তাকে ফোনে না পেলে অন্য যে কাউকে ফোনে ট্রাই করা, সেই সাথে পিয়নকেও পাঠিয়ে দেই যেন আমার সেই ক্লাসরুমে গিয়ে ম্যাসেজটা ফিজিক্যালি আমার ক্লাসের ছাত্রদের বলে আসে। এর পরেও ক্লাসে গিয়েই আমার প্রথম কাজ হলো ছাত্রদের কাছে আমার দেরীতে উপস্থিতির কারনটা জানিয়ে আনকন্ডিশনালি এ্যাপলজি চাওয়া। এটাতে শিক্ষক হিসেবে আমি কখনো ছোট হয়েছি বলে আমার মনে হয়নি।
তবে ইদানিংকালে আরেকটা বিষয় শিখেছি, এবং সেটাও ছাত্রদের মাঝে ট্রন্সফার করার চেষ্টা করছি। কোন বিষয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে পারফেকশনের চেয়ে কম্ফোর্টেবল ফিনিশিং-এর চেষ্টা করা। এটা শিখেছি ক্যাডেট কলেজ ব্লগে লেখালেখির সূত্রে এবং পরবর্তিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত জনৈক প্রবাসী সিনিয়র এক্স-ক্যাডেটের কাছে। কারন, কাজ করার মুহূর্তটিতে নিজেকে ফ্লেক্সিবল রাখতে পারলে কাজের উপরে বা টিমের উপরে এবং ক্ষেত্রবিশেষ নিজের উপরেও কন্ট্রলটা বেটার থাকে। আগে এটা আমার মধ্যে ছিল না। কিন্তু ইদানিং চেষ্টা করছি নিজে পালন করার এবং ছাত্রদেরকেও শেখানোর। আমি শিক্ষক, তাই শুধু শিখিয়েই যাব, নিজে কিছুই শিখব না, এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা অত্যাবশ্যক। নিজের ক্রিটিসিজম (সেলফ-ক্রিটিসিজম) থাকতে হবে, এবং সেই সাথে অন্যদের দ্বারা ক্রিটিসিজমে রিএ্যাক্ট না করে, সেটার ইনস এণ্ড আউটস নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে প্রয়োজনে পলিসি চেইঞ্জ করতে হবে। তবে প্রিন্সিপলস থাকতে হবে আনকম্প্রোমাইজড। আর সেক্ষেত্রে প্রিন্সিপলস ঠিক করার আগেই ঠিকমত ভেবে চিন্তেই তা করতে হবে।
আবার ছাত্রজীবনে অনেক কিছুই ভাল নাও লাগতে পারে; এটাই স্বাভাবিক। আমাদের ছাত্রজীবনেও এমন অনেক কিছুই নিশ্চয়ই এবং অবশ্যই ছিল। তবে, আমার ভাল না লাগা, বা আমার দ্বিমত পোষণের ভাষা এবং বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ কেমন হবে, শব্দচয়ন কেমন হওয়া উচিত, তা শেখার চেষ্টা একজন ছাত্রের থাকতে হবে। আর, তা শেখানোর দায়িত্ব শিক্ষকের। এক্ষেত্রেও কিন্তু শিক্ষক একজন আইডল। সবার আগে তাঁর নিজের ভাষাগত প্রকাশ ভঙ্গিমাতেই শিল্পের ছোঁয়া থাকতে হবে। তা না হলে এই শিল্প (আর্ট অফ এক্সপ্রেশন) তিনি কোন ভাবেই ছাত্রদের শেখাতে পারবেন না। আমি আমার ছাত্রদের বলে থাকি, ইউ মাস্ট লার্ণ হাউ টু সে নো। কি-কখন-কোথায়-কিভাবে বলতে হবে, তার প্রতিনিয়ত প্র্যাক্টিক্যাল এক্সাম্পল একজন শিক্ষক নিজেই। একজন শিক্ষক (আমি নিজেও) কোন মহামানব বা ধোয়া তুলসী পাতা নন। কিন্তু চেষ্টা করলে একজন শিক্ষক আইডিয়াল পার্সোনালিটি বাই এক্সপ্রেশন্স হতে পারেন, যেটা ক্লাসে পড়ানোর এবং শেখানোর ক্ষেত্রে একটা বিশেষ জরুরি টুল। আমার হিসেবে, এটাকে ইগ্নোর করার কোন সুযোগ নেই।
প্রফেশনালদের কিছু কোর্স কণ্ডাক্ট করতে গিয়ে নিজের পড়াশোনা, ক্লাসরুমের ডিসকাশন, এবং অভিজ্ঞতার আলোকে আরেকটা ব্যাতিক্রমধর্মী অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিনিয়ত অনুধাবন করছি, তা হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার প্র্যাক্টিসে লিসেনিং স্কিল ডেভলাপমেণ্টের উপরে আদৌ ফোকাস করা হয় না। যদিও কোথাও বা কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবতায় তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। যার ফলে, আমাদের ছাত্রদের মধ্যে যারা কিছুটা স্বাধীনচেতা বা বাকপটু, তারা কনভার্সেশনের সময় সামনের বক্তার স্পীচে কন্সেন্ট্রেট না করে আর্গুমেণ্টেই বেশি ইনভল্ভড হয়ে যায়, যা কি না আমাদের এই আজকের ছাত্রদের (আগামী প্রফেশনাল প্রজন্ম) জন্য মারাত্মক হূমকিস্বরূপ। একটা মানুষের লিসেনিং কিভাবে শার্প করতে হয়, ভাল এবং মন্দ শ্রোতার (গুড এণ্ড ব্যাড লিসেনার্স) কি-কি বৈশিষ্ট থাকা উচিত, কিভাবে মাল্টি-কালচারাল (সোশ্যাল/জিওগ্রাফিক্যাল/প্রফেশনাল/এডুকেশনাল) কমিউনিকেশনে রোল প্লে করতে হয়, এগুলো তারা শিখছে না। শুধুমাত্র জিপিএ-নির্ভর চিন্তা-ভাবনাই ছাত্রদের আবিষ্ট করে রাখছে। যে কোন বিষয়ের বা যে কোন কোর্সের ক্লাসেই শিক্ষকরা এই বিষয়টাকে চর্চার মধ্যে আনতে পারেন। চর্চা ক্রমাগত চলতে থাকলে একটা সময়ে গিয়ে সুফল না আসার তো কোন কারন দেখছি না।
এখন আমার এই লেখার সর্বশেষ পয়েণ্টটাতে আসছি। সনাতন শিক্ষক-মানসে আঘাত হানতে পারে জেনেও সকল শিক্ষকের কাছে আগাম ক্ষমাপ্রার্থনা করেই এই কথাগুলো লিখছি। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এক মধুর সম্পর্ক। এটা রক্তের সম্পর্ক না হওয়া স্বত্বেও আত্মিক টানের বিষয়টাকে এখানে অস্বীকার করা যায় না। ছাত্রের ভাল-মন্দ, ক্যারিয়ার-ভবিষ্যত, এসব চিন্তা একজন শিক্ষককে আবিষ্ট করে রাখতেই পারে। কিন্তু বাস্তবে ছাত্ররা কখনোই টেকেন ফর গ্রাণ্টেড নয়। আমি যা বলব, সে তাই মানতে বাধ্য, এমনটা কখনোই ভাবা উচিত নয়। ছাত্রদের চিন্তাশক্তিকে পজেটিভলি স্টিমুলেট করাই একজন শিক্ষকের কাজ। আর এটা করতে গিয়ে ইমোশনালি ইনভল্ভড হওয়াটা বোকামি। খারাপ শোনালেও এটা বোকামি। আমার ছাত্র ছিল, আমার কথাটা রাখল না কেন? – একজন শিক্ষকের এমন মানসিকতায় ছাত্রদের কাছে ব্যাক্তিজীবনে কিছু এক্সপেক্ট করাটা বেশ কিছু শিক্ষকের মাঝে আমি দেখেছি। এটা, আমার বিচারে, নিছকই একটা সো-কলড সনাতন বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। হাঁটার সময় নিজের ব্যাগটা ক্লাসের ছাত্রকে দিয়ে বহন করানো, কিংবা ক্লাসের ছাত্রদের থেকে ব্যাক্তিগতভাবে গিফট নেয়া, আধুনিক পেশাজগতে এগুলো বর্জন করাটা জরুরী। এই সনাতন বিষয়গুলোতে আনইন্টেনশনালি হলেও ভবিষ্যতের জন্য অস্বস্তি ইনভাইট করে আনা হয়। যে কোন প্রফেশনেই অস্বস্তি পরিত্যাজ্য, তা সে শিক্ষকতাই হোক, আর অন্য যে কোন বিষয়েই হোক। সর্বোপরি শিক্ষকতায় ইম্পার্শিয়াল থাকার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু পার্সোনালি ইনভল্ভড হয়ে গেলে শিক্ষকতায় ইম্পার্শিয়াল থাকা, কিংবা কখনো আবার, বটম লেভেল টিচিং (দূর্বলকে বিবেচনায় রেখে পাঠদান) ব্যহত হবার সম্ভাবনাই বেশি।