প্রাপ্তি শূণ্য

আজকাল আমি বদলাতে শুরু করেছি ।হঠাত্‍ করেই বদলাতে শুরু করেছি !নাকের নিচে গোঁফের রেখাটা ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে ।আমার এখন পাখি হয়ে উড়তে ইচ্ছে করে , বন্ধুদের সাথে এডাল্ট গল্প করতে ইচ্ছে করে , ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতে ইচ্ছে করে । কিন্তু আমার ইচ্ছেগুলো শুধু ইচ্ছেই রয় ।মায়ের কঠিন শাসনের কারণে আমার কিছু করা হয় না ।

আমার মাকে আয়রন লেডী বললেও কম বলা হবে ।শুনেছি চাকুরীজীবী মা রা নাকি বাচ্চাদের সময় দিতে পারে না । অথচ আমার মা যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ আমার পিছেই লেগে থাকে।সারাক্ষণ এটা কোরোনা , ওটা কোরোনা , এটা খেওনা , ওখানে যেওনা করতেই থাকে । বিধি নিষেধের দেয়াল তুলে আমার জীবনটাকে দূর্বিষহ করে তুলেছে ।তার কথার একটু এদিক সেদিক হলেই শুরু হয় তীব্র বকুনি ! তবে আজকাল এসব আমি থোড়াই কেয়ার করি ।আমি নিজের মত চলি ।এইতো সেদিন মাসুদ ভাইয়ের টং দোকান থেকে সিগারেট মাত্র কিনেছি , কোথা থেকে মা এসে আমাকে এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড় মারতে থাকে !রাস্তায় এতো লোকের সামনে কি আমাকে মারা ঠিক হয়েছে ? আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না এলাকায় ? তাই আমিও রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকে আমি অনেক উল্টাপাল্টা বলেছি ।তারপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মার সামনে দিয়ে চলে গেছি ।মা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল !বিস্ময়ে পাথর হয়ে গিয়েছিল !

সেদিনের পর আমার গম্ভীর মা আরো গম্ভীর হয়ে গেছে ।অবশ্য আমিও তাকে আর পাত্তা দেই না ।আমি আমার মত চলি ।মা তারপর ও আমাকে শাসন করার চেষ্টা করেছে ।কিন্তু পারেনি ! আচ্ছা আমি তো বখে যাইনি । নিয়মিত স্কুলে যাই , ক্লাসের পড়া পারি ।তাহলে কেন এতো শাসন ? আসলে মার স্বভাবটাই এমন ।তার জন্য ই বাবা রাগ করে চলে গেছে ।বাবা যখন রাতে দেরি করে ফিরত মা তাকে হাজারটা প্রশ্ন করত ।বাবা ও রাগ করে উল্টাপাল্টা বলত , মাঝে মাঝে মারধোর ও করত !

মা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে ।রাত জেগে মা তার ডায়রীটাতে কি জানি লেখে !
সেদিন দুপুরে স্কুল আগেই ছুটি হয়েছে ।আমার ব্যাগে বাসার একটা চাবি থাকে ।আগে আগে চলে গেলাম বাসায় ! দরজা আটকে আলমারি থেকে মার ডায়েরীটা খুঁজে বের করলাম ।ডায়েরী খুলতেই একটা চিঠি পেলাম ।চিঠির ভাঁজ খুলেই আমি অবাক ! বাবাকে লিখেছে চিঠিটা !

প্রিয় অভি ,
কেমন আছো ? আশা করি তোমার আমেরিকা প্রবাসী ব্উয়ের সাথে ভালোই আছো ।আমি কখনো ভাবিনি তোমাকে চিঠি লিখব !কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস , তোমার মত ছোটলোককেও আমার চিঠি লিখতে হয় !

অভি , তুমি কি ভেবেছ আমি তোমার কাছে টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছি ? না অভি , না ।আমি তোমার মত ভীরু ন্ই ।আমি মরে যাবো কিন্তু কারো কাছে হাত পাতব না । তোমাকে ভালোবেসেছিলাম ।তোমার হাত ধরে বাবার অর্থ বৈভব ছেড়ে একটা সুখের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম , তোমার মত চালচুলাহীন লোককে বিয়ে করেছিলাম ।সেদিন কি বোঝনি একবারো , সুমি ভালোবাসার কাঙাল , টাকার না ? অবশ্য বুঝবেই বা কি করে ? তুমি তো আমার বাবার টাকা দেখেই আমাকে বিয়ে করেছিলে ! বিয়ের ছয়মাসের মাথায় আমি আবিষ্কার করি আমার মায়ের গহনা বিক্রি টাকা তুমি ব্যবসার নাম করে উড়াও ! কি ছোটলোক তুমি !সেদিন বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল আমার ! তোমার মত একটা পশুকে ভালোবেসেছিলাম ।

ছয়মাসের গর্ভবতী আমাকে বাবার কাছে জোর করে পাঠাতে চেয়েছ টাকার জন্য !যাইনি বলে আমার গায়েও হাত তুলেছ ! যে সুমির গায়ে তার বাবা মা কোনদিন ফুলের টোকা লাগতে দেয় নি সেই সুমির গায়ে তুমি হাত তুলেছিলে ! দিন দিন তোমার অত্যাচার বাড়ছিল । আমি সহ্য করে গেছি এই আশায় হয়ত একদিন তুমি বুঝবে ! আমার সে আশায় গুড়েঁ বালি । একদিন শুনলাম আমার কাছ থেকে টাকা পয়সার যোগান না পেয়ে এক আমেরিকা প্রবাসী মেয়েকে বিয়ে করেছ !

জানো অভি , মেয়েরা সব পারে ।কিন্তু নিজের ভালোবাসার মানুষটার ভাগ কাউকে দিতে পারে না ! তাই যেদিন শুনলাম তুমি বিয়ে করেছে তার এক সপ্তাহের মধ্যে তোমাকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেই ।

আমি নাজিমকে তোমার মত অমানুষ বানাতে চাইনি । ও যেন একটু ভালোভাবে থাকতে পারে তাই একটা চাকরি করি , সাথে টিউশনি করি ।ওকে নিয়েই আমি বাঁচতে চেয়েছি । তুমি চলে যাওয়ার পর ওই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা ! অভি , তুমি তো জানোই আমি দৃঢ় চরিত্রের মানুষ ।আমি ছেলেকে আমার মতো বানাতে চেয়েছি , তোমার মত কাপুরুষ না ।ওকে আমি আদর করি , ভুল হলে বকা দেই । কিন্তু ও আমার শাসনটাই দেখে । আমার আদর ওর চোখে পড়ে না ।

জানো অভি , তোমার ছেলেকে আজকাল আমাকে দেখিয়ে সিগারেট খায় , আমার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে , বখাটে ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয় ।দেখেছ অভি , তোমার রক্ত ঠিক চিনে ফেলেছে তোমাকে !

বলতে পারো অভি , এই জীবনে কি পেলাম আমি ? বাবা মাকে ছেড়ে যে মানুষটাকে ভালোবাসতাম তাকেই বিয়ে করলাম অথচ ঘর বাঁধা হল ক্ই ? একটু ভালোবাসাও তো পেলাম না । তাকেই পাঠাতে হলো ডিভোর্স লেটার ! নিজের পেটের ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইলাম হাইস্কুল পড়ুয়া সেও আমার সাথে দাসী বাঁদীর মত ব্যবহার করে ! এত বড় ব্যর্থ জীবনটা নিয়ে কি করব বলো তো ?

ঠিক করেছি নাজিমকে সিমলা পাঠিয়ে দিবো ।ওখানেই পড়ালেখা করবে ।যদি কথনো দেশে আসো একবার দেখা কোরো !অনেকদিন তোমাকে দেখিনা ।

ইতি
সুমী

কলিংবেল বাজছে ।চিঠিটা পড়তে পড়তে কখন যে দুগাল জলে ভিজে গেছে টের ও পাইনি ।চোখ মুছে ডায়রী আর চিঠি আগের মত রেখে আমি দরজাটা খুলে দিলাম ! আমার এতো ভালো মা টাকে আমি এতো কষ্ট দেই ! দরজার দাঁড়ানো মাকে দেখে আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠি । মা হকচকিয়ে যায় ।আমাকে জড়িযে ধরে জানতে চায় কেন কাঁদছি ! আমি শুধু বলি

আমি সরি মা , আমি সরি । আমি তোমাকে আর কাঁদাব না !

৬,২১৩ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “প্রাপ্তি শূণ্য”

মওন্তব্য করুন : রেজা (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।