লাইকার জন্য ভালবাসা

১৯৫৪ সালে জন্ম মেয়েটির। মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াতো। মেয়েদের পক্ষে ভবঘুরে হওয়া অতোটা সোজা নয়। কিন্তু লাইকার জন্য তা আসলেই সোজা ছিল। কারণ তার জন্ম কোন মানুষের ঘরে হয়নি। হয়েছে এক কুকুরের ঘরে। মানব সমাজে লিঙ্গভেদ থাকলেও আমার জানামতে কুকুর সমাজে তা খুব একটা নেই। নানা দিক দিয়ে বরং মেয়ে কুকুরেরাই বেশী সুবিধাভোগী।

সুখ-দুঃখ মিলিয়ে ভালই কাটছিলো লাইকার দিনগুলো। তাকে তখন কেউ লাইকা নামে ডাকতো না। নিজ পরিবার ও প্রতিবেশীদের কাছে তার এমন কোন নাম ছিল যা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতেও জানা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ লাইকা অন্যান্য সব কুকুরের মতই ছিল। খুব সম্ভ্রান্ত কোন ঘরে তার জন্ম হয়নি। সাধারণ মনগ্রেল বংশেই হয়ত, সাথে হাস্কি বা টেরিয়ার জাতের কিছু মিশ্রণ থাকতে পারে। বংশ নিয়ে তার খুব একটা চিন্তা ছিল না। ভবঘুরে লাইকার অন্তর ছিল বিশুদ্ধ যা তার স্বভাবে প্রকাশ পেতো। এই স্বভাবই তার কাল হলো কি-না জানি না, জানি না ঠিক কি কারণে বন্দি হলো সে। শুধু জানি বন্দি লাইকার মানসিক অবস্থাটাও বোঝার সৌভাগ্য হয়নি আমাদের। এই যুগ হলে আরও অনেক কিছু জানতে পারতাম। কারণ এখন প্রাণী অধিকার বিষয়ে আগের থেকে বেশী সচেতন আমরা।

লাইকাকে বন্দি না বলে অতিথি বললে বেশী ভাল লাগত। কিন্তু গল্পের শেষটা আমাদের সে কথা ভাবতে দেয় না। বন্দি দশা থেকেই গল্পের শুরু।

১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর স্পুটনিক ১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশ যুগের উদ্বোধন করলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আসছে ৭ই নভেম্বর বলশেভিক বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তি। এই দিনের আগেই স্পুটনিক ২ মহাকাশে নিক্ষেপ করতে চাইলেন তৎকালীন সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান। অগত্যা মাত্র ৪ সপ্তাহ সময় সামনে রেখে বেশ নড়বড়ে এবং সাধারণ একটি নভোযান তৈরীর কাজ শুরু হল। মস্কোর রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা হলো তিনটি কুকুরকে: আলবিনা, মুশকা এবং লাইকা। এভাবেই বন্দি হলো আমাদের লাইকা।

বন্দিশালায় এসে চোখ ঝলসে গেল লাইকার। খুব বেশী অতিথিপরায়ণ সবাই। কুকুর তিনজনকে বিজ্ঞানী ওলেগের সামনে হাজির করা হলো। ওলেগ কেন জানি বেছে নিলেন লাইকাকে। এরপর থেকে আতিথেয়তায় যেন ভাটা পড়লো। লাইকা খুশি মনেই মেনে নিয়েছিল। এতো সুখের জীবন, খানিকটা কষ্টে দোষ কি? কিন্তু অচিরেই তার স্বাভাবিক খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তাকে খেতে দেওয়া হল জেলের মত আঠা আঠা কি যেন। এতেও বেজার হলো না সে। পেট ভরলেই হলো। একমাত্র তখনই তার কষ্ট হতো যখন নিম্ন তাপমাত্রা এবং উচ্চ চাপে তার হার্টবিট বাড়ানোর চেষ্টা করতেন ওলেগ। আরেকটা কষ্ট ছিল ছোট্ট একটা খুপরির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা। আটকে থাকার সময় তার শরীরে কি কি যেন লাগানো হতো, খেতেও দেয়া হতো। নির্ভেজাল জেলে মজা পেলেও খুপরিতে আটকে এতো শত ঠঙ করার কোন অর্থ করতে পারতো না সে। এ সময়ই পিচঢালা রাস্তার স্মৃতি ফিরে ফিরে আসতো।

আজ ৩০শে অক্টোবর। গত রাতটা সে বন্দিশালায় কাটায় নি। যে লোকটা সবসময় তার দিকে মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে থাকতো সে-ই তাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ছোট ছোট কয়েকটা মানুষ তার সাথে অনেক মজা করেছিল। জীবনে কখনও এরকম পরিবেশ দেখেনি লাইকা, রাস্তার নিষ্ঠুর পথচারীদের থেকে এরা একেবারেই অন্যরকম। স্বাধীন রাস্তা জীবনের দুঃখ ভুলে গেল ক্ষণিকের জন্য। সকালে খুশী মনে বন্দিশালায় ফেরার পরপরই তাকে সেই ছোট্ট খুপরিতে ঢুকিয়ে দেয়া হল। এরপর তিনটি দিন কেটে গেল। তাকে খুপরি থেকে বের করা হল না। একদমই ভাল লাগছিল না তার।

আজ ৩রা নভেম্বর। বন্দিশালার সবাই আগের থেকে অনেক বেশী ব্যস্ত। এদিক সেদিক ছুটোছুটি। তাকে বিশাল মাঠের মত একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল, খুপরিসহ। বাইকনুর উৎক্ষপণ কেন্দ্রের মঞ্চে খুপরিসহ বসানো হল তাকে। চূড়ান্ত মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিল। সে তা প্রকাশ করতে পারেনি। কারণ ভাব দেখে মনে হচ্ছিলো সবাই যেন তাকে কুর্ণিশ করছে। মায়া মায়া চোখের সেই লোকটাও। সবার আশিবার্দ নিয়ে নড়েচড়ে বসলো লাইকা। কোন সন্দেহ নেই, মহান কোন কাজ করতে যাচ্ছে সে; যার জন্য এই সবকিছু, সেই বন্দিদশা, এই আশির্বাদ, ছোট্ট মানুষগুলোর সেই উচ্ছ্বাস আর মায়া মায়া চোখের লোকটার এই মায়াভরা চোখ, সব। হঠাৎ তীব্র বেগে কোন দিকে যেতে শুরু করলো। একটা রকেট যে স্পুটনিক ২ নভোযানকে নিয়ে অসীম আকাশের পানে ছুটে চলেছে এটা লাইকা বোঝেনি, সে যে পৃথিবীর প্রভাব সীমার একেবারে প্রান্ত স্পর্শকারী প্রথম জীব হতে চলেছে এটাও বোঝেনি। শুধু বুঝতে পারছে, তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। জীবনে কখনও এতোটা কষ্ট হয়নি তার। কিন্তু তার মনে এখনও একটা প্রশান্তি আছে। হার্টবিট ১০২ থেকে বেড়ে ২৪০ হয়ে যাওয়ার পরও সে টিকে আছে এই প্রশান্তির কারণে।

উৎক্ষেপণের প্রায় ২ ঘণ্টা পর পৃথিবীর উচ্চ কক্ষপথে প্রবেশ করল স্পুটনিক ২। লাইকা ধরেই নিয়েছে সামনে তার জন্য এমন কিছু আসছে যা এতোক্ষণের সব কষ্ট দূর করে দেবে। আসার পথে রকেটের অপ্রয়োজনীয় সব অংশগুলোই স্পুটনিক ২ থেকে খসে পড়লো। কিন্তু একেবারে শেষ রকেট প্রচালকটা বিচ্ছিন্ন হতে পারলো না। লাইকা বোঝেনি, কিন্তু রকেট প্রচালকের প্রভাবে তখনই তার ছোট্ট খুপরির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।

আরও তিনটি ঘণ্টা কেটে গেল। লাইকার হার্টবিট ২৪০ থেকে কমতে কমতে আবার ১২০ অর্থাৎ স্বাভাবিকে ফিরে এলো। আসন্ন পুরস্কার গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল লাইকা। সংযুক্ত নল থেকে কিছু খেয়ে নিল। আপন মনে কিছু কথা বলল। পৃথিবীর কমান্ড থেকে ঘেউঘেউ শব্দটা যান্ত্রিক সংকেতের মত শুনতে পেল মানুষেরা। সমগ্র সোভিয়েত জাতি মার্কিনীদের হারিয়ে দেয়ার আনন্দে মেতে উঠলো। যুক্তরাজ্যের পশু অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা পথে নামলো। নাসা এবং জাপানের মহাকাশ সংস্থা মহাকাশে স্পুটনিক ২ এর অস্তিত্ব চিহ্নিত করলো। এগুলোই কি লাইকার পুরস্কার, যার জন্য পৃথিবীর শেষ সীমায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সে? এগুলো পুরস্কার হতে পারতো যদি কোন উপায়ে লাইকাকে বোঝানো যেত এই সব কিছু। বোঝানো তো দূরের কথা তাকে ফিরিয়ে আনাই এখন সম্ভব না।

সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা সবাই জানতেন লাইকাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। কারণ ফিরতি নভোযানকে নিরাপদে গ্রহণ করার মত প্রযুক্তি তখন ছিল না। কিন্তু এতো দূর যাওয়ার প্রয়োজন পড়লো না। মাত্র ৭ ঘণ্টার মধ্যেই স্পুটনিক ২ এর তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেল। অভাগী লাইকা সুখের আশায়ই মৃত্যুর দুঃখকে বরণ করে নিল। তার মৃতদেহ বুকে নিয়ে কমলালেবুর মত পৃথিবীটাকে উন্মাদের মত চক্কর দিতে থাকল স্পুটনিক ২। গাড়িতে করে মহান কোন ব্যক্তির শবদেহ যেমন সকল ভক্তের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঠিক তেমনি। পৃথিবীর সবাইকে না দেখিয়ে থামতেই চাইল না স্পুটনিক নামের গাড়িটা। ১৬৩ দিনে মোট ২,৩৭০ বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ শেষে সে ভাবল এবার ফেরার সময় হয়েছে। অনেক শ্রদ্ধাঞ্জলী মাখা দেহটার সৎকারের ব্যবস্থা তো করতে হবে!
পুনঃপ্রবেশের সময় বায়ুমণ্ডলের সাথে তীব্র ঘর্ষণের কারণে পুরে ছাই হয়ে গেল স্পুটনিক ২। সনাতন সংস্কারের নিয়মে পুড়িয়েই সৎকার হল লাইকার। ছাইগুলো ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবীরই আকাশে।

লাইকা চলে গেল সোভিয়েত প্রশাসনের তাড়াহুড়া এবং হৃদয়হীনতার কারণে। কিন্তু তার এই অভিযান বৃথা যায়নি। এখনও সবাই তাকে সম্মান করে। অনেক স্মৃতিসৌধেই বিখ্যাত নভোচারীদের সাথে তার নাম দেখা যায়। আরেকটু দেরী করলে হয়তো এই নভোচারীকে বাঁচানো যেত, পরবর্তীতে প্রায় সবাইকেই যেমন বাঁচানো গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ প্রতিযোগিতা আমাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু এই হৃদয়বিদারক ঘটনার মত নেতিবাচক অনেক কিছুরও কারণ এই প্রতিযোগিতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রচার করেছিল, প্রায় ১ সপ্তাহ বেঁচে ছিল লাইকা। ৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। দীর্ঘ ৪৫ বছর পর ২০০২ সালে রুশ বিজ্ঞানীরা স্বীকার করে যে, মাত্র ৫-৭ ঘণ্টার মাথায় লাইকা মারা গিয়েছিল।

যতদিন পৃথিবীতে মহাকাশ যুগ উদ্বোধনের বর্ষপূর্তি পালিত হবে ততদিনই লাইকাকে সবাই স্মরণ করবে। তাকে দেয়ার কিছুই থাকবে না, শুধু ভালবাসা ছাড়া।


ঘোড়ার সাজের মত স্পেস স্যুট পরিহিত লাইকা

ঘোড়ার সাজের মত স্পেস স্যুট পরিহিত লাইকা

স্পুটনিক ২ এর ছোট্ট খুপরির ভেতরে প্রস্তুত লাইকা

স্পুটনিক ২ এর ছোট্ট খুপরির ভেতরে প্রস্তুত লাইকা

লাইকার স্মরণে একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প

লাইকার স্মরণে একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প


লেখাটি পূর্বে প্রকাশিত

লাইকার আরও ছবি দেখতে হলে এখানে যান…

৩,০৩৬ বার দেখা হয়েছে

৩২ টি মন্তব্য : “লাইকার জন্য ভালবাসা”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    মুহাম্মদ, তোমার লেখাগুলোর মধ্যে সেরাটা বেছে নিতে বললে আমি এটাকেই বেছে নিব। অসাধারণ লেখনী আর বর্ণনাভঙ্গী।
    এইরকম আরো কিছু লেখা লিখে ফেল। খুব ভাল লেগেছে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।