সাত দিনের পথ – বিষাদ পর্ব

একাডেমি ব্লকের সামনে বিশাল গোলচত্বর। তার একেবারে মাথায় লেখা “শিক্ষা ভবন”। এটাকে জিরো পয়েন্ট ধরছি। সাত দিনের পথের দূরত্ব মাপার জন্য। ইলেভেনের এক্সকারশন, যাত্রা শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। ফিরেও এসেছি এখানে। মাঝখানে সাতটা দিন, সরণ শূন্য, কাজ শূন্য, কিন্তু অনুভূতি অসীম। সেই অসীম শূন্যতার কথা লিখতে বসেছি। সেই অনুভূতির কথা যার জন্য ক্লাস সেভেন থেকে ইলেভেন পর্যন্ত পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছি, যেটা শেষ হয়ে যাবার পর মনে হয়েছে কলেজ ছেড়ে অচিরেই চলে যেতে হবে।

কলেজে এমন অনেক কিছু ঘটেছিল ছিল যা এখন মনে হলে হাসি পায়, মনে হয় কি ছেলেমানুষই না ছিলাম। এক্সকারশন শুরু হয়েছিল এমনই একটা ঘটনা দিয়ে। এখন খুব ব্যাঙ্গ করছি, তখন কিন্তু মনে হয়েছিল এই মহাযজ্ঞ সফল না হলে কলেজ জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

ঘটানাটা বাসে সিট রাখা নিয়ে। সাত দিন সকাল-সন্ধ্যা যে বাসে বসে থাকতে হবে তাতে ভাল একটা সিট না পেলে চলে নাকি। এই ফিলিংস যে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম তা নয়, উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছি। বাসে সিট রাখার অভিযানে নামা কলেজের বহু পুরনো ট্রেডিশন। সেই ট্রেডিশন রক্ষার্থে বৃহস্পতিবার থেকেই আমাদের পরিকল্পনা শুরু হয়ে গেল। পরিকল্পনাটা ব্যক্তি ছাড়িয়ে হাউজ ফিলিংসে রূপ নিল। শুক্রবার বিকেলে লোড করার জন্য বাস গ্যারেজ থেকে বের করা হবে। তার আগেই সিট রাখতে হবে। পিছনের সিটগুলোই সবার পছন্দ। মোট পঞ্চাশের মধ্যে পিছনে আর কতই ছিল, হয়তো ২০-২৫ টা সিট। সেখানেই সবাই বসতে চায়, ভবিষ্যৎ যে বিভীষিকাময় বোঝাই যাচ্ছিল। হার-জিত নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত। আমারও বার বার মনে হচ্ছিল, পিছনের দিকে ভাল একটা সিট না পেলে ক্যাম্নে কি হবে? এক্সকারশন সারভাইভ করে ফিরে আসা সম্ভব হবে তো! যেন জীবন মরণের প্রশ্ন।

আমাদের হাউজ (নজরুল হাউজ) সবার পেছনে। হাউজের পরেই গ্যারেজ, সে হিসেবে সুবিধা আমাদেরই বেশি। জুম্মার নামাজের পর থেকেই ওত পেতে থাকতে হবে। ৩টার মধ্যে গ্যারেজে ঢুকে পিছনের সবগুলো সিট হাউজের পোলাপানের জন্য বুক করে ফেলতে হবে, “কাগজ” দিয়ে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের হলে সবাই দেখবে, সবচেয়ে চালাক নজরুলিয়ানরাই। পরিকল্পনামাফিক সব হল। প্যারেন্ট্‌স ডে শেষ হল, জুম্মার নামাজ শেষে সবাই পজিশন নিল। কেউ কেউ হাউজের জানালা দিয়ে গ্যারেজের উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখতে লাগল। টহলের পাশাপাশি কেউ কেউ কাগজ বানাতে লাগল। আমি ছিলাম নিষ্কর্মার দলে।

আমরা অপেক্ষা করছিলাম, কখন বাস পরিষ্কার করার জন্য গ্যারেজের দরজা খুলবে। কিন্তু ফজলুল হক হাউজের পোলাপান আরও কাবিল। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে দু’জন পিছনের ছোট্ট দরজার সিঁধ কেটে সুড়সুড় করে গ্যারেজে ঢুকে পড়ল। আর পায় কে। আমাদের হাউজ থেকেও কয়েকজন দৌড় লাগাল। ওরা দুই জনে মাত্র ৪ মিনিটের মধ্যে আর কজনের সিট ই বা রাখতে পারবে। কিন্তু কি আশ্চর্য, গিয়ে দেখি পিছনের সবগুলো সিট ফজলুলিয়ানদের দখলে চলে গেছে। আমি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, এই দুজনের মধ্যে একজন নিশ্চয়ই সুপারম্যান। নাইলে এতো তাড়াতাড়ি করলো কিভাবে। কিন্তু ঘিলুওয়ালা নজরুলিয়ানরা ঠিকই বুঝে গেল, অনেক আগেই ফজলুলিয়ানরা এসে সিট রেখে গেছে। এই দুইজন এসেছে শো হিসেবে। বোঝানোর জন্য যে, তারা এখনই সিট রেখেছে। কারণ, এতো আগে সিট রাখা আবার ট্রেডিশন বিরুদ্ধ। কিন্তু ওদের দুর্ভাগ্য, যেটুকু সময় পেলে ওরা বোঝাতে পারতো যে তখনই সিট রেখেছে সেটুকু সময় তাদের ভাগ্য জোটেনি।

হতভাগা সোহ্‌রাওয়ার্দি হাউজের অবস্থাটা একবার চিন্তা করুন। ফজলুলিয়ানদের কাছে হেরে যাওয়া নজরুলিয়ান আর সোহরাওয়ার্দিয়ানরা এবার জোট পাকাল। প্রথমেই তদন্ত করতে হবে। কিভাবে এবং কখন তারা গ্যারেজে ঢুকল। কি এমন ঘিলু আছে তাদের মাথায়। ক্যাডেটের মাথায় ঘিলুর অভাব যেহেতু নেই, সেহেতু ২০ মিনিটের মধ্যেই সত্য বেরিয়ে এল। নিশ্চয়ই প্যারেন্ট্‌স ডে’র সময় সিট রেখে গেছে ওরা, আমরা যখন বাপ-মা’র সামনে বসে বিভিন্ন পদ গলঃধকরণ করছিলাম। রহস্যের সমাধান হতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো দুই হাউজে। নজরুল আর সোহরাওয়ার্দি হাউজ পাশাপাশি, ফজলুল হক বেশ দূরে। তারা জানতেও পারলো না আমাদের দূরভিসন্ধির কথা। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ফজলুলিয়ানদের সব সিট উঠিয়ে দেয়া হবে। যুক্তি খুবই নরমাল, তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

যেই কথা সেই কাজ। দুই হাউজীয় ঐক্যজোটের নেতারা গ্যারেজে গেল। ফজলুলিয়ানদের সিট রাখার সব কাগজ ফেলে দেয়া হল। আর সিদ্ধান্ত হল, বাস লোড করার জন্য যখন বের করবে, তখন দৌড়ে গিয়ে সিট ধরতে হবে।

বিকেলে যথাসময়ে বাস বেরুল। জোটবদ্ধ দুই হাউজের সবাই দৌড়ে গিয়ে পিছনের সব সিট বুক করে ফেলল। ফজলুলিয়ানদের কোন চিন্তা নেই। গায়ে বাতাস লাগাতে লাগাতে বাসে উঠল তারা। উঠে দেখে, হায় হায়। কোন সিট নাই। কাগজের কোন চিহ্নও নাই। নিজেদের অতি সাধের কাগজগুলোকে বাসের মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে দেখে একজন চেচিয়ে বলে উঠল, “কাগঅঅঅঅঅজ দেখছিস, কাগঅঅঅঅঅঅঅজ।” সেই হাউজের সবার টনক নড়ল এবার। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ, কিচ্ছু করার নেই। দুই হাউজের প্রতিরোধর মুখে কিছুই করতে পারল না তারা। কাজের কাজ যেটা হল, এই কাগঅঅঅঅজ উক্তিটা জনপ্রিয় হয়ে গেল।

পরদিন ভোরে বাসে উঠলাম সবাই। ফজলুল হকের সবাই সামনে। অন্য দুই হাউজ পিছনে। সবার মুখ গম্ভীর। অতি উৎসাহী কয়েকজন পরিবেশ হাল্কা করার চেষ্টা করছে। তিন হাউজ থেকেই কিছু উচ্ছল ছেলেপেলে এই উদ্যোগ নিল। তারপরও এক পাল বিমর্ষ ক্যাডেট নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হল কলেজ বাসের। কত আশা আর উদ্দীপনার এই এক্সকারশন। আমাদের সেই সাধের ভ্রমণ এভাবেই শুরু হল। বিমর্ষ বদনে কেউ কেউ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, সবুজ রং দেখে মানসিক শান্তি লাভের আশায় বোধহয়। হাউজ, জোট, ব্যক্তি নির্বিশেষে সবার মনে তখন একটাই প্রশ্ন: সামনের দিনগুলো উপভোগ্য হবে তো?

৩,১৭২ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “সাত দিনের পথ – বিষাদ পর্ব”

  1. জিহাদ (৯৯-০৫)

    এইটার কি পার্ট টু আসবে নাকি? লেখার শেষে এইরকম জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখা হইলো ক্যান?

    এক লেখায় অনেক কথা মনে করায়া দিলা। ঐ ঘটনার পর আমি ঠিক করছিলাম কয়েকটা পোলার লগে জীবনে কথা বলবোনা। আমার কোন প্রতিজ্ঞাই তিনদিনের বেশি টিকেনা। এইটা আরো আগেই ভেংগে গেল। দ্বিতীয় দিন থেকেই তো মনে হয় পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হওয়া শুরু করসিলো। তবে ব্যাপারটা মনে রাখার মতই ছিল। অনেকগুলা মানুষের মুখের ছবি তখন তুলে রাখা দরকার ছিল। আফসোস, আমার তখন ক্যামেরা ছিল বাট ফিল্ম ছিলনা...


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  2. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    ক্যাটাগরি তে মির্জাপুররে আমাদের সমান বানানোর জন্য তাড়াহুড়া করে লিখলেও এইটা তোর অন্যতম ভাল একটা লেখা। তয় শেষ করিস না। পর্ব পর্ব করে ছেড়ে দে। পিলাচ

    জবাব দিন
  3. নওরীন (৯৪-০০)

    =) আমাদের সময়ও সীট নিয়ে এরকম হইসিল। বাসের শেষ দিকের সীট নিয়ে ঝামেলা করেই শুধু আমরা ক্ষান্ত হয়নি। যেখানে যেখানে গিয়ে আমাদের রাত কাটানোর ব্যবস্থা ছিলো। সেই সব জায়গা- যেমন ফকক গেস্ট হাউসে, কক্সবাজার 'লাবণী'তে ফ্লোরিং করা হইছিল। হায়রে ঐ ফ্লোরিং নিয়েও তথাকথিত সীট দখলের সে কি পলিটিক্স! এখনো মনে হলে হাসি পায়! আমরা আবার নেভাল এ্যাকাডেমী তে গিয়েও প্ল্যানিটোরিয়ামেও সীট দখল নিয়ে্ টেনশনে ছিলাম। হায়রে ক্লাস্মেট ফ্ফিইলিংস, হাউস ফিলিংস,ফর্ম ফিলিংস,ক্যাডেট ফিলিংস এগুলো যে তখন ক-ত সিরিয়াস বিষয় ছিল পোলাপানের মত...=">

    জবাব দিন
  4. সেভেন ডে'সের সময় সীট নিয়ে আমাদের অবশ্য এতো মারামারি হয়নি।এর এক সপ্তাহ আগের থেকেই আমরা প্রেপ টাইমে শুধু এইটা নিয়েই চিন্তা করতাম কি করে সীট প্ল্যান হবে এবং রোটেসন হবে।বাসের দ্বিমাত্রিক ছবি,ত্রিমাত্রিক ছবি সবাই যে যার মত সীট প্ল্যান করতো।পরে অবশ্য আমরা ঠিক করেছিলাম যে প্রতি বার বাস থামলেই সবার সামনের গুলা পেছন চলে আসবে আর অন্যরা সবাই এক সীট করে করে আগাবে...(শান্তিপূর্ন সমাধান )

    জবাব দিন
  5. এই সীট রাখার ১অফমাইন ভিল্লিয়ান চিলাম আমি।
    আমার ম্মনে আসে।
    হাই রে ভাই......।।কিচু নরমাল জিনিশের এর জন্য কি ঝামেলাতা ই না করেচি আমরা!!!!!
    আমি ঈ বাস এর সীট এর কাগজ ফালাইসিলাম......
    তরা আমারে মাফ কইরা দিস।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।