একটু পরেই সূর্যগ্রহণ

আকাশ জিনিসটা আসলেই বিস্ময়কর। প্রাচীনকালের মানুষদের মত বললাম আর কি। সে সময় তো মানুষ আকাশকে একটা জিনিসই মনে করতো। সকল পৌরাণিক কাহিনী এবং ধর্মগ্রন্থেই তার প্রমাণ আছে। এই সেদিন আমরা আকাশের বাস্তব রূপ আবিষ্কার করেছি। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে যে পুরাণ আর প্রাক-ইতিহাস জড়িয়ে আছে তা মাঝে মাঝেই ফিরে আসে। সেটা হয়ত আমাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করে না, কারণ আমরা জানি সেসবের কোন অর্থ নেই। কিন্তু শুনতে বা পড়তে খুব মজা লাগে।

১৯৯৯ সালের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ

এক গ্রহণ নিয়েই কত পুরাণ আছে, আছে কত ধর্মকথা আর কত গল্প-উপন্যাস। একেবারে প্রথমদিককার একটি কল্পবিজ্ঞান গল্পের কথা শুনেছিলাম। গল্পের লেখক ইয়োহানেস কেপলার। তখনও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে জ্যোতিষ শাস্ত্রের পার্থক্য সূচিত হয়নি। তাই কেপলারের মত বিজ্ঞানীরাও প্রেত চর্চায় আগ্রহ পেতেন। কেপলারের একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প অনেকটা এরকম ছিল: মর্তের মানুষকে ডাইনী বুড়ি চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদে নিয়ে যায়। যাওয়ার পদ্ধতিও তিনি লিখেছিলেন। গ্রহণের সময় চাঁদের ছায়া পৃথিবীতে পড়ে, সেই ছায়া বেয়ে বেয়েই ডাইনী বুড়ি তাকে নিয়ে গিয়েছিল।

এসব গল্পকথা পড়তে আমাদের এখনও ভাল লাগে, ভবিষ্যতেও ভাল লাগবে। সেই আগ্রহ আর ইতিহাস-প্রেমের কারণেই বোধহয় আমরা সূর্য আর চন্দ্রগ্রহণের কথা বলি, এখনও। প্রেমিকার কলঙ্ক দেখতে কি কারও ভাল লাগে, মনে হয় না। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে সূর্যের শৌর্য্য আর চন্দ্রের কৌমার্য্যকে ভালবাসা সত্ত্বেও আমরা তাদের কলঙ্ক দেখতে ভালবাসি। কোন বস্তু আর তার কলঙ্ককে কি একসাথে ভালবাসা যায়? জানি না। কেউ জানলে জানাবেন আশাকরি।

ভাবের কথা ছেড়ে এখন কাজের কথায় আসি। আর একটু পরেই অর্থাৎ আর মাত্র দেড় ঘণ্টা পরই আংশিক সূর্যগ্রহণ শুরু হতে যাচ্ছে। ভারত উপমহাদেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এটা দেখে যাবে। আমরাও সেই দক্ষিণাঞ্চলে পরি। তাই বাংলাদেশ থেকেও দেখা যাবে। আকাশে মেঘ নেই। কুয়াশাও অনেক আগে কেটে গেছে। তাই স্পষ্টই দেখা যাওয়ার কথা। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন ঢাকাস্থ “রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্র”-এ সূর্যগ্রহণ দেখার আয়োজন করেছে। ৫০০ টাকা ফিস দিয়ে যারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে তাদেরকে একটি করে বিশেষ চশমা দেয়া হয়েছে। সেই চশমা দিয়ে সরাসরি সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে।

আমি অবশ্য যেতে পারিনি। কারণ ক্লাস-ল্যাব সবই আছে। তারপরও ভাবছি ল্যাব শেষে এসে এক পলক দেখে নেব। সূর্যগ্রহণ দেখার কয়েকটা সহজ পদ্ধতিও আছে। সেই পদ্ধতিগুলোই থেকেই একটা কাজে লাগাবো। মিস করার কি দরকার। দেখতে যখন ইন্টারেস্টিং লাগে তখন কোন কারণ ছাড়াই জীবনের একটা ইন্টারেস্ট ত্যাগ করার তো কোন মানে হয় না।

আসছে ২২শে জুলাই-ও সূর্যগ্রহণ হবে। সেই গ্রহণ অবশ্য আজকেরটার বাপ। আজকেরটা আংশিক, ২২শে জুলাই হবে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। আরও চমক আছে। ২২শে জুলাইয়ের সূর্যগ্রহণ হবে একবিংশ শতাব্দীর দীর্ঘতম গ্রহণ, আর বাংলাদেশ থেকে দেখা একবিংশ শতকের একমাত্র পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। সেটার প্রস্তুতি নেয়ার জন্যই আজকেরটা ভাল করে দেখে নেব ভাবছি।

নিজে কি ভাবছি না ভাবছি, কি করবো না করবো, কেবল সেটা লেখার জন্য আসিনি। সবার সুবিধার জন্য সূর্যগ্রহণ দেখার সহজ পদ্ধতিগুলো বলে দেই। অনেকেই জানেন। তারপরও আরেকবার ঝালিয়ে নেয়া আর কি। আর খালি চোখে যে সূর্যগ্রহণ দেখা যায় না সেটাও সবাই জানেন। তারপরও একবার হুশিয়ার করে দেই: খালি চোখে ভুলেও তাকাবেন না। কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না। এমনকি কোন স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

বিশেষ ধরণের চশমা

সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য বিশেষ ধরণের চশমা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন “রুশ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে” এখনও সেটা বিক্রি করছে বোধহয়। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে সে পর্যন্ত যাওয়া বোধকরি সম্ভব না।

আয়না

আয়না থাকলে তো কথাই নেই। আয়না তে সূর্য আনুন এবং সেটাকে তোন স্থির দেয়ালে ফেলুন। আয়নায় প্রতিফলিত সূর্যের আলো দেয়ালে পড়বে। দেয়ালের দিকে চোখ রাখলে কোন অসুবিধাই নেই। গ্রহণটাও দেখা যাবে। কিন্তু আবারও সাবধান, আয়নার দিকে সরাসরি তাকাবেন না।

কাগজের ফুটো দিয়ে

দুইটি কাগজ বা হার্ডবোর্ড দিয়ে গ্রহণ দেখা সম্ভব। প্রথমে একটি কাগজের মাঝখানে পেন্সিল বা সরু কাঠি দিয়ে সরু ছিদ্র করুন। এবার এই কাগজের এক বা দুই ফুট নিচে আরেকটি কাগজ রাখুন। প্রথম কাগজের ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো দ্বিতীয় কাগজে বড় হয়ে পড়বে। এই আলোর মাধ্যমে আংশিক বা পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা সম্ভব।

বাইনোকুলার

বাইনোকুলার থাকলে আরও ভাল। এক্ষেত্রেও একটি কাগজ লাগবে। কাগজটিকে বাইনোকুলারের আইপিসের ১ ফুট পেছনে স্থাপন করুন। আইপিস হয়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলো কাগজে পড়বে, ঠিক প্রজেক্টরের মত। এই আলো অনুসরণ করেই গ্রহণ দেখতে পাবেন।


পরিশিষ্ট

এই গ্রহণ শুধু ফিল্টার করা বিশেষ চশমা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই দেখা সম্ভব না। নিচের ছবিটা দেখুন, তবেই বুঝবেন:

1

পুরো সূর্যের বোধহয় মাত্র ১.৮২% ঢাকা পড়বে। এত ছোট পরিবর্তন সরাসরি তাকানো ছাড়া বোঝা সম্ভব না। এমনিতেই দেখলাম সূর্য মামা মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। তাই এনিমেশন দেখেই আশ মেটাই:

2


3

এই এনিমেশনে চাঁদের ছায়া দেখা যাচ্ছে। কোন সময় চাঁদের ছায়া কোথায় পড়বে তা দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশকে একটু ছুঁয়ে গেছে।
এখানে ধূসর ছাঁয়া যে স্থানগুলোর উপর দিয়ে যাচ্ছে সেগুলো থেকে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। আর লাল ডটটি যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেসব স্থানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। লাল পুরোটাই দেখি সমুদ্রের উপর দিয়ে গেছে। নিচের গ্লোবে বিষয়টি ভাল করে দেখানো হয়েছে:

4

এই গ্লোবের হালকা ধূসর চিহ্নিত স্থানগুলোতে আংশিক আর গাঢ় ধূসর চিহ্নিত স্থানগুলোতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে।

৭৮ টি মন্তব্য : “একটু পরেই সূর্যগ্রহণ”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    কি দেখব, কেন দেখব, কবে দেখব, কখন দেখব, ক্যাম্নে দেখব, চমৎকার সব ডিটেইলস সহ সূর্য্যদর্শনের এই চমৎকার দাওয়াতের জন্য মুহাম্মদকে অসংখ্য ধণ্যবাদ।
    তুই রিয়ালি একটা পিস ... সাবাস।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. চন্দ্রবিন্দু'র একটা গান আছে

    সুর্যের দিকে চেয়োনা
    চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে
    সুর্য গ্রহনের দিকে চেয়না
    চোখে ঝিলমিল লেগে যাবে।

    দেখি ঝিল্মিল লাগে কিনা 😉

    জবাব দিন
  3. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    সূর্যগ্রহণের নানা প্রক্রিয়ার কথা বলে সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্য সুরি 😀
    এই গ্রহণ শুধু ফিল্টার করা বিশেষ চশমা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই দেখা সম্ভব না। নিচের ছবিটা দেখুন, তবেই বুঝবেন:
    ঢাকা
    পুরো সূর্যের বোধহয় মাত্র ২০ ভাগের ১ ভাগ ঢাকা পড়বে। এত ছোট পরিবর্তন সরাসরি তাকানো ছাড়া বোঝা সম্ভব না। এমনিতেই দেখলাম সূর্য মামা মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। তাই এনিমেশন দেখেই আশ মেটাই:
    ঢাকা এনিমেশন

    জবাব দিন
  4. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    আইইউটি-র সাউথ হলের ৫১৮ নাম্বার রুমের সামনের করিডোর থেকে সূর্যগ্রহণ দেখার চেষ্টা করতেই বেরসিক মেঘটা বেঁকে বসলো। ইয়াব্বড়ো এক মেঘ পুরো সূর্য ঢেকে দিয়েছে। কিচ্ছু করার নাই। আর আমি এমনিতে একটা আয়নাও জোগাড় করতে পারি নাই। ভার্সিটির হলে এসব থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।
    ব্যাপার না, নেক্সট টাইম...

    জবাব দিন
  5. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    চাঁদের ছায়া
    এই এনিমেশনে চাঁদের ছায়া দেখা যাচ্ছে। কোন সময় চাঁদের ছায়া কোথায় পড়বে তা দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশকে একটু ছুঁয়ে গেছে।
    এখানে ধূসর ছাঁয়া যে স্থানগুলোর উপর দিয়ে যাচ্ছে সেগুলো থেকে আংশিক সূর্যগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। আর লাল ডটটি যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেসব স্থানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। লাল পুরোটাই দেখি সমুদ্রের উপর দিয়ে গেছে। নিচের গ্লোবে বিষয়টি ভাল করে দেখানো হয়েছে:
    সূর্যগ্রহণের মানচিত্র
    এই গ্লোবের হালকা ধূসর চিহ্নিত স্থানগুলোতে আংশিক আর গাঢ় ধূসর চিহ্নিত স্থানগুলোতে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে।

    জবাব দিন
  6. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    মুহাম্মদ, এইবার তো পারলাম না, পরেরবার। এক সপ্তাহ আগে থিক্কা আওয়াজ দিও।
    তুমি যেসব পদ্ধতির কথা লেখছ, ওইগুলা বুইঝ্যা প্রয়োগ করতে আবার টেকি হায়ার করতে অইবো। ওই যে আরেকটা পদ্ধতি আছে, এক্সরে ফিল্ম দিয়া দেখা? ওইডা ঠিক আছে তো?


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।