বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংস্কৃতি সম্ভবত দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। অবশ্য এখন ভাগ হয়েছে বলাটা ঠিক হবে না। স্বাধীন দেশে ১৯৮০-র দশকের শুরুতেই এটা হয়েছে। এক সময় দেশের সবাই প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখতো। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত কেউ বাদ ছিল না। কিন্তু, অন্য অনেক দেশের মতো এদেশেও যখন মধ্যবিত্ত সমাজের প্রভাব বাড়তে শুরু করে তখন এটার সাথে তাল মিলিয়ে একটি চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বেড়ে উঠতে পারে নি। প্রেক্ষাগৃহে মধ্যবিত্তের চাহিদা কমতে কমতে এক সময় শূন্যে পোঁছেছে। এফডিসি ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। তারা সিনেমা স্পষ্ট দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। আমার যা মনে হয় নিম্নবিত্তরা সিনেমার কাছে খুব বেশি কিছু দাবী করে না, বা তাদেরকে দাবী করতে দেয়া হয় না। নিম্নবিত্তরা এখনও আগের মতোই সিনেমা দেখতে যায়, কিন্তু তারা পরিচালক বা প্রযোজকের কাছ থেকে নতুন কিছু দাবী করে না, কোন পরিবর্তন চায় না। আমার মনে হয়, নিম্নবিত্তের জন্য রুটি-রুজির ব্যবস্থা করাই এতো কঠিন হয়ে পড়েছে যে, সারাদিনের খাটুনি শেষে সিনেমা দেখে তা নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবার ধৈর্য্যটা তাদের আর থাকে না, তারা কোন অভিনবত্বের মাধ্যমে আঘাত পেতে চায় না।
এফডিসি মধ্যবিত্তহীন চলচ্চিত্র জগৎকে একটি মাছের বাজারে পরিণত করে ঠিক এই সুযোগটারই সদ্ব্যবহার করেছে। যার ফলে প্রেক্ষাগৃহ হয়ে গেছে নিম্নবিত্তের, মধ্যবিত্তরা টেলিভিশনের অশুভ থাবায় বন্দী হয়েছে বা বন্দী হওয়ার ভান করেছে। এর ফলে একদিকে যেমন চলচ্চিত্র পুরো দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে, অন্যদিকে তেমনি সমাজে উঁচু-নিচু ইত্যাদি ভেদাভেদকে স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। সামাজিক রুচি বলে যদি আদৌ কিছু থেকে থাকে তবে বলতে হয়, এফডিসি এই রুচিটাকেও দুই ভাগে ভেঙে ফেলেছে। মধ্যবিত্তরা নিম্নবিত্তের প্রেক্ষাগৃহ ভ্রমণকে কুরুচি ভেবে সিনেমার পর্দায় সিনেমা দেখার বাসনা একেবারে বিসর্জনই দিয়ে ফেলেছে। সকল বাঙালির মধ্যে সাধারণ ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা চেতনাকে জাগ্রত করার কোন চেষ্টা করা হয় নি। এটা খুব স্বাভাবিক, কারণ বাজারে লাভ করাটাই আসল কথা, কিভাবে করলাম সেটা মুখ্য না।
২০০০-এর দশকে নতুন প্রজন্ম আবার সিনেমা দেখতে চাইছে। বিদেশী সিনেমার প্রভাব এর একটা বড় কারণ। কিন্তু এই দেখার মধ্যে কোন অভিনব চেতনা বা নতুনত্ব নেই। যারা নিয়মিত হিন্দি সিনেমা দেখে অভ্যস্ত তারা চাচ্ছে এদেশে হিন্দি সিনেমার মতো এন্টারটেইনিং মিউজিকসমৃদ্ধ (নাচানাচিটা বাদ দিয়ে) সিনেমা হোক, এক্সপ্লয়টেশন ঘরানার কথোপকথনের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক, ক্ষেত্রবিশেষে সোজা সাপ্টা সামাজিক বাস্তবতার কথাও থাকুক। যারা হলিউডের সিনেমা দেখে অভ্যস্ত তারা চাচ্ছে, তথাকথিত মডার্ন সিনেমা বাজারে আসুক, হলিউড স্টাইলের এডিটিং, অ্যাকশন ও অস্থিরতা না থাকলে এই দলকে প্রেক্ষাগৃহে আনা অসম্ভব। ইউরোপীয় সিনেমার দর্শকরা চাচ্ছে সামান্য শৈল্পিক সৌন্দর্য্য, বেশি হলে আবার বদহজম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই যে বিভিন্ন ধারার দর্শক সমাজ, এদের চাহিদা মেটানোর জন্য পরিচালকেরও জন্ম হয়েছে। তারা যেসব সিনেমা করছেন এগুলোকে এক সেন্সে এক্সপ্লয়টেশন সিনেমাও বলা যায়। কারণ তারা নির্দিষ্ট একটি দর্শক শ্রেণীর দুর্বলতা (!) পুঁজি করে অর্থ কামানোর ধান্ধা করছেন। সার্বিকভাবে বলা যায়, সম্পূর্ণ নিজেদের একটি দর্শক বা নির্মাতা সমাজ হওয়ার মত অবস্থা বাংলাদেশে এখনও আসে নি। একটা বড় কারণ, দেশে উপযুক্ত চলচ্চিত্র সমালোচক এবং চলচ্চিত্র চর্চার অভাব। আর চর্চাটাকে একটু পরিচিত করে তোলা তো প্রায় অসম্ভব।
এতো সব না-র মাঝেও কাজ করে যাচ্ছে অনেকে। সবার কাজকেই অ্যাপ্রিশিয়েট করি আমি। কিন্তু অ্যাপ্রিসিয়েশন টা অবশ্যই সমালোচনামূলক হওয়া উচিত, কখনও লাগাম ছেড়ে দিতে নেই।
আজকের লেখাটা এই অ্যাপ্রিসিয়েশন বা সমঝদারি ঘরানারই। বিষয়:
একাদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ১৪ – ২২ জানুয়ারি, ২০১০
রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি যে সেই ১৯৯২ সাল থেকে নিয়মিত বা অনিয়মিত ভাবে হলেও একটা চলচ্চিত্র উৎসব করে আসছে সেটা আগেই জানতাম। কিন্তু কোন ফাঁকে একাদশ উৎসব শুরু হয়ে গেছে টের পাই নি। গতকালের পত্রিকা থেকেই জানলাম, ১৪ জানুয়ারি একাদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করেছে শেখ হাসিনা। সেখানে আবার হাসিনা দেশী সিনেমাকে নতুন পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, পৃথক ফিল্ম সোসাইটির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের আর্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। এর অধিকাংশই যে বাস্তবায়ন হবে না সেটা আমরা সবাই জানি। তাই সেদিকে না গিয়ে বরং সিনেমার পানে তাকাই:
আজকে প্রায় সারাদিনই উৎসব চত্বরে কাটালাম। ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যার শোগুলোও দেখব, কিন্তু দুর্বলতা এসে ভর করল বিকেলের পরই। ভাবলাম রাত ১০ টা না বাজিয়ে বরং বাসায় গিয়ে একটা ব্লগ লিখে ফেলি, আগামী কাল আবার আসা যাবে। এটাই আজকের লেখার প্রেক্ষাপট। তবে লেখা শুরুর আগে উৎসবের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে নিচ্ছি যাতে কেউ লেখাটা না পড়েও উৎসব সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা পেতে পারেন এবং অংশ নেবেন কি নেবেন না সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
একাদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
তারিখ: ১৪ – ২২ জানুয়ারি
ভেন্যু: জাতীয় জাদুঘর এবং পাবলিক লাইব্রেরি, শাহবাগ, ঢাকা
সময়: প্রতিদিন ১০:৩০, ১:০০, ৩:০০, ৫:৩০ এবং ৭:৩০ ঘটিকায়, অর্থাৎ দৈনিক ৫ টি শো। তবে সব মিলিয়ে দৈনিক প্রায় ১৫ টি শো হয়ে যায়। কারণ একই সাথে তিনটি অডিটোরিয়ামে শো চলে-
– শহীদ জিয়া অডিটোরিয়াম, জাতীয় জাদুঘর
– সুফিয়া কামাল অডিটোরিয়াম, জাতীয় জাদুঘর
– শওকত ওসমান অডিটোরিয়াম, পাবলিক লাইব্রেরি
এটুকু তথ্য দিয়েই আমি মূল লেখায় চলে যাচ্ছি:
বেকার জীবনের প্রধান সম্বল ঘুম, সেই ঘুম কামাই দিয়ে গিয়েছিলাম সিনেমা দেখতে। ঘুম থেকে উঠেছি সেই সকাল ৯:০০ টায়। স্বয়ং ঈশ্বরকেও অবাক করে দিয়ে কোন যানজট ছাড়াই পৌঁছে গেলাম শাহবাগ, সোজা জাতীয় জাদুঘরে। জানলাম, টিকেট দেয়া হয় পাবলিক লাইব্রেরি থেকে। পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুকে দেখি আয়োজন খুব ভাল। এক পাশে তিনটা বুথ করা হয়েছে, কোথায় কি সিনেমা হচ্ছে সেটা জানতে হলে এক বুথে যেতে হবে, টিকেট কাটা এবং ম্যাগাজিন কেনার জন্য অন্য বুথগুলোতে। রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির ওয়েবসাইট থেকেই কয়েকটা সিনেমা বাছাই করে গিয়েছিলাম। সকাল সাড়ে দশটায় সুফিয়া কামাল অডিটোরিয়ামে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ও প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হবে, এটাই ছিল প্রথম টার্গেট। জাতীয় জাদুঘরের অডিটোরিয়ামের জন্য টিকেট কেটে গিয়ে দেখি, শর্ট ফিল্ম বা প্রামাণ্য চিত্রের জন্য টিকেট লাগে না। টিকেট শুধু ফিচার ফিল্মের জন্য। এই বোকামিটা ছাড়া সারাদিন বেশ ভাল কেটেছে।
আশা করি নাই যে শো ঠিক সাড়ে দশটা থেকে শুরু হবে। কর্তৃপক্ষ আমাকে আশাহত করেননি। শো শুরু করেছেন সাড়ে এগারোটায়। প্রামাণ্য চিত্র ও শর্ট ফিল্ম দেখানোর জন্য তারা যে বিশেষ আয়োজন করেননি এটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম। গিয়ে দেখি ম্যাক চালিত একটা পিসি এবং প্রজেক্টর সম্বল করে কাজ শুরুর চেষ্টা করছেন একজন। দর্শক আমি সহ ৩ জন। তবে আশাহত হবার কোন কারণ নেই ১২ টা নাগাদ নিরস প্রামাণ্য চিত্র ও শর্ট ফিল্ম দেখতেও জনা দশেক মানব-মানবী জড়ো হয়েছিলেন। গন্তব্যহীন প্যাচাল না বাড়িয়ে সরাসরি রিভিউয়ে চলে যাই:
লিভিং বিয়ান্ড ডিজাস্টার (Living Beyond Disaster) [চীন]
আমার উৎসবের শুরুটা চমৎকার হয়েছে। খুব ভাল লেগেছে ৩০ মিনিটের এই প্রামাণ্য চিত্রটা, যদিও অন্যসব প্রামাণ্য চিত্রের মতোই মূল কারণ ছিল বিষয়বস্তুর আবেদন। একজন সাদা মনের মানুষকে নিয়ে প্রামাণ্য চিত্রটি। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত এই মানুষটি জীবনের অবশিষ্ট প্রতিটি দিন ব্যয় করতে চান মানবসেবায় এবং মানবচর্চায়। এমনকি এই সামাজিকতা বোধই তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে, তিনি স্বচ্ছন্দ্য বলছেন তিনি নিঃসন্দেহে আরও ২০ বছর বাঁচবেন। চীনের সিচুয়ান প্রদেশের একটি গ্রামে অনেকদিন ছিলেন এই জার্মান। সিচুয়ানের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময় ছিলেন জার্মানিতে। ফিরে এসে তার সেই গ্রামকে আর অক্ষত পান নি, ধ্বংসস্তূপ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জিন্স হাতে নিয়ে কেঁদেছেন। তারপর সেই বিশ্বাস থেকে আবার গ্রামটিকে জাগিয়ে তোলার কাজে যোগ দিয়েছেন, যেই বিশ্বাস তাকে লিউকেমিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শিখিয়েছিল। প্রাচ্যের সংস্কৃতির মত মহান এই বিশ্বাসের পরিচয় পাই এভাবে: দুর্গম পাহাড়ের চূড়া থেকে একটি ছোট্ট ছেলে ও তার বাবা তাকে এমন একটি পাতা এনে দিয়েছিল যা খেলে নাকি মৃত্যু থেকে বাঁচা যায়। আধুনিক চিকিৎসা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেই পাতা খেয়েছেন, বাপ-ছেলেকে বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি এই পাতা খেলে আমার অবস্থা আরও ভাল হবে, কারণ আমি তোমাদেরকে বিশ্বাস করি। এজন্যই আমি ভাবি, সর্বোৎকৃষ্ট বিশ্বাস হচ্ছে মানুষে বিশ্বাস। এই প্রামাণ্যচিত্রটা দেখে হাইতি ভূমিকম্পের ভয়াবহতা ভেবে আবারও শিউরে উঠেছি।
শাউট ফ্রম দ্য প্লেইন (Shout From The Plain) [ফিনল্যান্ড]
সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত বলা সম্ভব না। এই স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাটা নিয়ে প্রথমেই একটি অপ্রীতিকর ঘটনা মনে আসছে, এটা দিয়েই তাই শুরু করবো। সিনেমাটা প্রেম নিয়ে, যদিও অদ্ভুত সে প্রেম। যেখানে প্রেম আছে সেখানে কাম না থাকা অর্থহীন। কিন্তু কামে এসেই ঘাপলাটা লাগল। আগেই বলেছি এই ছোট্ট মিলনায়তনে সিনেমা দেখানো হচ্ছিল প্রজেক্টর দিয়ে। দেখছি দেখছি, সামনে যে নর-নারীর সবচেয়ে পবিত্র কর্ম তথা রতিকর্ম আসছে সেটা না বোঝার কোন কারণই ছিল না, এবং সেই মহান কর্মটা যে চলচ্চিত্রকার খুব সুন্দরভাবে দেখাতে পারবেন তা নিয়েও কোন সংশয় ছিল না। আশাহত করেননি পরিচালক, যথারীতি প্রেমের ক্লাইমেক্সে নিয়ে আসলেন, অরগ্যাজম পর্যন্ত দেখানোর একটা সম্ভাবনাও তৈরি হল, কিন্তু কোত্থেকে এক কালো ছায়ায় ঢেকে গেল পর্দাটা। এই অপবিত্র কাজটা করাও হয়েছে বেশ ফ্যাসিস্ট প্রক্রিয়ায়, একটা কাগজ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে প্রজেক্টরের জ্বালামুখ। খুব খারাপ কাজ হয়েছে এটা। অডিটোরিয়ামে সর্বসাকুল্যে দর্শক ছিল ৬-৭ জন, কিসের তাগিদে আর্টের এহেন অবমাননা করা হল তা এখনও বোধগম্য নয় (সেন্সর বোর্ডের কারণে, পরে বুঝেছি)। তবে সবচেয়ে কুৎসিত ব্যাপারটা ছিল, চিত্র কালো করে দিলেও শব্দ কালো করে দেয়ার চিন্তাটা মাথায় আসে নি কারও। তাই সাউন্ড আসছিল। ভাগ্যিস সাথে মিউজিক ছিল, খুব সুন্দর সুর। আর বলে রাখি, সিনেমাটা ছিল ফিনল্যান্ডের একটি গ্রামের কয়েকজন যুবকের রেসলিং এবং প্রেম সাধনা নিয়ে।
লেনিন – আ শর্ট বায়োগ্রাফি (Lenin – A Short Biography) [ভারত]
কণ্ঠটা ছিল বলিষ্ঠ, সমাজতন্ত্রের স্বর্ণযুগের স্বর্ণসাফল্য প্রচারে এর বিকল্প নেই। কিন্তু প্রামাণ্য চিত্রটায় প্রোপাগান্ডার গন্ধ আছে। এটাকে খুব সহজেই প্রোপাগান্ডা ফিল্ম বলে চালিয়ে দেয়া যায়। সমাজতন্ত্র সমর্থকদের রক্ত মুহূর্তের মধ্যে গরম করে দেয়ার মত ক্ষমতা এই সিনেমার আছে। আমার যা লাভ হয়েছে সেটা হল, লেনিন সম্পর্কে বেশ কিছু জিনিস জানতে পেরেছি। সমাজতন্ত্র নিয়ে আরও জানার একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেদিক থেকে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে বোধহয় এই ছবিটাই। এটা কলকাতা থেকে হয়েছে, বাংলায়, পরিচালক অরুণাভ গাঙ্গুলী।
তবে আজকে উৎসবে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিল কিংবদন্তীর ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাক দেমি-র সিনেমা। ওয়েবসাইটে দেখলাম রেট্রোস্পেক্টিভ বিভাগে প্রতিদিন জাক দেমি-র একটি করে সিনেমা দেখানো হচ্ছে। নেটে এই সিনেমাগুলো পাওয়া যায় না, দেশে ডিভিডিও নেই। অথচ নুভেল ভাগ তথা ফরাসি নবতরঙ্গ আন্দোলনের সেরা কয়েকজন নির্মাতার একজন হলেন জাক দেমি। তাই বুঝতে দেরি হয় নি যে, এই উৎসব থেকে আমার সবচেয়ে ব্ড় পাওয়া হবে জাক দেমির সিনেমাগুলো। প্রতিদিন দুপুড় ১:০০ টা থেকে পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান অডিটোরিয়ামে দেখানো হচ্ছে জাক দেমি। সব মিলিয়ে তার ৬ টা সিনেমা থাকছে। প্রথমটা মিস করেছি, আজকে দেখলাম, দেখব পরেরগুলোও।
লা বাই দে অঁজ (La Baie des Anges – Bay of Angels) [জাক দেমি – ফ্রান্স]
অনেকদিন পর আবার ফরাসি সিনেমার স্বাদ পেলাম। ফরাসি সিনেমার সংযমী ও সিলেক্টিভ ভাবটা প্রত্যেকবারই চোখে পড়ে। ফ্রঁসোয়া ত্রুফো, জঁ লুক গদার ও জঁ রনোয়ার এর পর এবার আরেক জন ফরাসি চলচ্চিত্রকারের সাথে পরিচয় হল। সিনেমাটা পুরো দুই ঘণ্টা ধরে রেখেছিল, সাধারণ মেলোড্রামার মধ্যে গভীর জীবন দর্শনের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে ক্ষণে ক্ষণে। এই সিনেমা নিয়ে আলাদা একটা ব্লগ লেখার ইচ্ছা আছে। তাই এখানে বেশি কিছু বলব না। কেবল চুম্বক চিন্তাগুলো:
লা বাই দে অঁজ (১৯৬৩) মূলত জুয়া খেলা নিয়ে। জঁ ফুর্নিয়ে (Jean Fournier) নামক এক ব্যাংক কর্মকর্তা তার কলিগের প্ররোচনায় জুয়ার মজা পেয়ে গেছে, কারণ তার ভাগ্য বেশি ভাল। প্রথম দিনেই অনেক টাকা কামিয়ে বাসায় ফেরার পর, বাবা-মা তাকে বের হয়ে যেতে বলেছে। তল্পিতল্পা গুটিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ফ্রান্সের পথে, উদ্দেশ্য বড় কোন শহর, আর তার বড় কোন ক্যাসিনো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তার অর্থবিত্তের প্রতি বেশি আগ্রহ নেই, ভ্রমণের প্রতি সামান্য আগ্রহ থাকলেও মনের মত কারো সাথে ঘর বাঁধিয়ে বসে পড়ার আকাঙ্ক্ষাটা প্রকটতর। সিনেমার অধিকাংশ কাহিনী নিস (Nice) শহরে। এই শহরে জুয়া খেলতে গিয়ে দৈবের বশেই তার এমন এক মেয়ের সাথে পরিচয় হয় যে মনে করে ঈশ্বর আসলে একজন জুয়ারী। জঁ ইশ্বরে বিশ্বাস না করলেও জাকি (Jackie) নামের এই মেয়েটি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তার ঈশ্বর হচ্ছে জুয়ারী, আর জুয়া খেলাই তার ধর্ম। সিনেমার অর্ধেক দৃশ্যই ক্যাসিনোতে, মনে হয় ক্যাসিনো দিয়ে পুরো পৃথিবীকেই বোঝাচ্ছেন জাক দেমি, যিনি বলেছেন, “I’m trying to create a world in my films.” জাকির গ্যাম্বলিং এতো ভাল লাগার কারণ এটি হচ্ছে, “stupid mixture of poverty and luxury.” এই জগতে ৩০ লক্ষ ফ্রাংক এর মালিক হয়ে হাই লাইফ যাপন করা আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বা স্টেশনে রাত কাটানোর মধ্যে পার্থক্য খুব কম, কখনো মাত্র এক দিনের।
আর লিখব না বে অফ এঞ্জেলস নিয়ে। তার চেয়ে বরং উৎসবের রিভিউয়ে চলে যাই। ও আরেকটা কথা, এই সিনেমায় দর্শক অতো কম ছিল না, ২০ জনের মত হয়েছিল যদিও সবাই পুরো সময় থাকে নি। উঠবস করেছে অনেকেই।
ভারতের প্যারালাল সিনেমা জগৎ থেকে অনেক কিছুই এই উৎসবে এসেছে, এসেছে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা। এছাড়া এসেছে অস্ট্রেলিয়া, কাজাখস্তান, জর্জিয়া, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, তুরস্ক, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, জার্মানি, গ্রিস, আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইতালি, জাপান, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কম্বোডিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, জর্ডান, ইসরায়েল, উত্তর আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, আলজেরিয়া, বুরকিনা ফাসো, ক্যামেরুন, কংগো, আইভরি কোস্ট, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, নাইজেরিয়া, সাউথ আফ্রিকা, নরওয়ে, পোল্যান্ড, তিউনিসিয়া থেকে। ৯ দিনে ৬৬ টি দেশের মোট ১৯০ টি সিনেমা প্রদর্শিত হবে।
চমৎকার এই আয়োজন। আগের ১০ টাতে থাকতে পারি নি বলে দুঃখ হচ্ছে। আশাকরি ভবিষ্যতে এটা আরও সমৃদ্ধ হবে, কম্পিটিশন সেকশনটা আরও প্রতিযোগিতামূলক হবে, আরও ভাল সিনেমা উঠে আসবে। আর আমি তো প্রায় প্রতিদিনই যাচ্ছি, উৎসব তাই হারিয়ে যাচ্ছে না।
যে বিভাগগুলোতে সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে
– Australasian Competition
– Cinema Of The World
– Women Section
– Shorts and Independent
– Retrospective
– Tribute
– Focus
– Spiritual
– Bangladesh Panorama
– Special Section
– Children
কোন দিন কোন সিনেমা কোথায় কতটায় হচ্ছে জানতে হলে নিচের শিডিউলটি দেখুন:
11th Dhaka International Fim Festival – Schedule
ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ওয়েবসাইট
[চলবে…]
;;;
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
ইয়ে মানে,স্যার আপনি তো বিচারক-আমিই মনে হয় প্রথম হইছি,তাইনা স্যার? :shy:
কে গ্রেট মাস্ফ্যু নাকি? ভালো আছো? শরীর ঠিক আছে? মন? :grr: :grr: :grr:
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
:shy: স্যার আমি এই আছি আরকি আপনাদের দোয়ায়।আপনি,ভাবী,ভাতিজা উদয় সবাই ভাল আছে তো?উদয়কে আমার পক্ষ থেইকা চকলেট কিনা দিয়েন 🙂
এইবার পড়ে মন্তব্য করতে এলাম। আমার সিনেমা দেখার সাম্প্রতিক আগ্রহটা তৈরি হয়েছে মুহাম্মদ তোমার জন্য। আরো কিছুটা অবদান মাসুমের। এক সময় মাসুমেরই মূল ভূমিকা ছিল। কিন্তু এই আগ্রহ পর্যন্তই, দেখা হচ্ছে না কিছুই!!
এক বান্দর (কে সে আশা করি বুঝবে) আমাকে দ্বিতীয় বিধ্বযুদ্ধ নিয়ে কিছু সিনেমা দেবে বলেছিল, সেও কথা রাখেনি; তেত্রিশ বছর চলে গেল............
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
😛
আমারই তো মুভিগুলা দেয়ার কথা ছিল। :shy:
আর দেরি করা ঠিক হবে না। এইটারে সেকেন্ড ওয়ার্নিং হিসেবে নিলাম.. 😀
হ, তোমারো কিছু দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আরো একজন আছে, যে আমার ছোট বোনকে নিয়ে মাঝে-মধ্যে এসে আইসক্রিম খেয়ে বাউনিয়া বাঁধ দেখতে যায় 🙁
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
অরে দিয়া কিছু হবে না 😀
সহমত 😀
আরে! দারুণ। আমি কালকে যাবো। সকালে উঠতে পারলে সকালেই, না হলে অন্তত রেট্রোস্পেক্টটা দেখার ইচ্ছা আছে! আমি একটা খবর শুনেছিলাম, কিন্তু পরে আর খোঁজ নেয়া হয় নাই।
অনেক ধন্যবাদ মুহাম্মদ। পোস্টটা খুব ভালো হয়েছে। 🙂
আমি প্রতিদিনই আছি। আসলে আমাকে কল দিয়েন। আমার বর্তমান নাম্বার এইটা: 01825 416078
আমারো একই অবস্থা। উনাদের পোষ্ট ঘেঁটে মুভির লিস্ট জোগাড় করি; তারপর ডাউনলোড দেই।
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
🙂
গিয়ে দেখা হবে না... :no:
তোর চোখেই বরং দেখি... 😀 :thumbup:
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
😀
সিনেমা নিয়ে তোমার আগ্রহ এবং জ্ঞান- দুইটাই আমাকে মুগ্ধ করে।
তোমার চোখ দিয়েই বরং দেখি চলচ্চিত্র উৎসবটাকে। 🙂
গুড রিভিউ মুহাম্মদ :thumbup:
স্টুডেন্ট থাকাকালীন বেশ কিছু ভালো মুভি দেখা হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরীর চলচ্চিত্র উৎসবে। এখন আর যাওয়ার সময় হয়ে উঠেনা ...
আজকে দারুন একটা ফরাসী সিনেমা দেখে এলুম। নামটা আন্দালিব ভাই এসে বলবে। খুব কঠিন 😀
লে পারাপ্লেউ দ্য শেরবার্গ (Les parapluies de Cherbourg)
😀 😀
আমি কিন্তু এইরকম করছি: লে পারাপ্লুই দ্য শের্বুর 😀
হুম, ফরাসি উচ্চারণ বাংলায় লিখে বুঝানো কঠিন। তবে তোমারটা মনে হয় বেশি কাছাকাছি হইছে। 🙂