চিঠি …(১)

সর্বশেষ কবে চিঠি লিখেছেন মনে করতে পারবেন ? ব্যাপারটা নিতান্তই সহজ কাজ হবার কথা নয়। মুঠোফোন আর ক্ষুদেবার্তার মধুর অত্যাচারে যোগাযোগের এই সনাতন পদ্ধতি অতি বিপন্নের তালিকায় ঢুকে গেছে। একটু ভুল বলে ফেললাম মনে হচ্ছে। সরকারি চিঠি পত্রের কল্যাণে চিঠি বিলিপত্রের ব্যবস্থা এখনও অটুট…:D।

চিঠি নিয়ে এই মাতামতির কারনটা খুব বেশি কিছু নয়। আজ সন্ধ্যাবেলা পুরানো এক বইয়ের মধ্যে একটা চিঠি পেলাম। ছোট নোটপ্যাড টাইপ এর পাতা। তারিখ টা ২২/০৭/২০০৫। বান্দরবন থেকে লিখা। পুরো চিঠিটা পড়তে ১ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু এর রেশটা এতটাই তীব্র ছিল যে বারবার সেই “চিঠি” যুগে ফিরে যাচ্ছিলাম।

কলেজে থাকতে হাজারটা কারনের নিকুচি করতাম। এইটা কেন নয় ওইটার কোনও দরকার ছিল…বলে শেষ করা কঠিন। চিঠির ব্যাপারটাই ধরা যাক। মোবাইল ফোনে কথা বলার অনুমতি তখনও আমাদের কাছে পৌঁছাইনি। খুব সম্ভব ক্লাস সেভেনে। হসপিটালে admit ছিলাম। শুক্রবারে চিঠি লিখা হয় নাই। চিঠি লিখা হই নাই এই জন্য আমার মধ্যে তখন সেইরকম কোন উদ্বিগ্নতা নেই।বুঝতেও পারি নি যে আমার চিঠি না পেলে আমার মা অনেক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে পারেন। শ্রদ্ধেয় ভিপি স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমাদের ওই সময়ে ক্লাস সেভেনের একটা ছেলেকে ভিপি তার রুমে ডেকে পাঠানোর ব্যাপারটা অনেকটা সপ্তম আশ্চর্য এর মত। রুমে ঢোকা মাত্র স্যার আমাকে মধুর গলায় জিজ্ঞাস করলেন আমার হাত ভাঙা নাকি। আমার পা ভাঙা নাকি। আমি তো পুরাই অবাক। শরীরের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য স্যার তো রুমে ডেকে আনার কথা না। শেষমেশ ভয়ানক ক্রুদ্ধ ভাষায় আমাকে নির্দেশ দিলেন যে এখুনি আমাকে বাসায় চিঠি লিখতে হবে। এই সপ্তাহে আমি কেন চিঠি লিখি নাই? আমার তো হাত-পা সব ঠিক আছে।(পা এর সাথে চিঠি লিখার কি সম্পর্ক এইটা একমাত্র সেই ভিপি স্যারই বলতে পারবেন!) সপ্তম শ্রেণীর একজনের পক্ষে যতটা সম্ভব তাকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে যারা hospital এ admit থাকে তারা চিঠি লিখে না। ব্যাপারটা যে তাকে মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারে নাই তার প্রমান কয়েক দিন পরেই পেলাম। নির্দেশ জারি হল যে “যারা হাসপাতালে ভর্তি থাকবে তাদের চিঠি লিখা বাধ্যতামুলক”। কোথায় যেন একবার শুনেছিলাম যে যাকে নাকি গালি দেয়া হয় সে নাকি অনেক পুণ্য অর্জন করে। 😀 যেসব সিনিয়র তখন হাসপাতাল এ ভর্তি ছিল তাদের কল্যাণে আমি নিশ্চিত অনেক পুণ্য অর্জন করেছিলাম। চিঠি লিখা ক্যাডেটদের মাঝে তখন এতটাই জনপ্রিয় ছিল :P।

ক্লাস এইটের ঘটনা। হলুদ খামে লিখা “ক্যাডেট মুবিন-উল-হক, কলেজ নম্বর-২২৩১, হুনাইন হল…” ঠিকানা দেখেই বুঝলাম অপরিচিত কেউ লিখেছে। দুপুরের দিকে পেয়েছিলাম চিঠিটা। *mosque class* এ প্রায় সবাই চলে গেছে। আমরা কয়েক জন বাকি। তাড়াহুড়ো চলছে। আগ্রহ নিয়ে খুললাম। আমার কাছে সময় টা মনে হল স্থির হয়ে গেছে। চিঠিটা হাসানের। মাহমুদুল হাসান। “বন্ধু” শব্দটা মানুষের জীবনে কতোটা প্রভাব ফেলতে পারে ওকে ছাড়া আমি বোঝাতে পারব না। অনেক সময় আমি আমার শব্দের শূন্যতা টের পাই। এত কিছু বলতে ইচ্ছা করে যে আমার কাছে মনে হয় আমার শব্দের স্রোতে ভাটা পড়েছে। অল্প একটু বলি। ক্যাডেট ভর্তি পরীক্ষার সময় কোন একটা ভুলের জন্য ওর admit card আসে নাই। পরের দিন কোচিং এ এসে যখন শুনতে পারল যে আমার টা আমি পেয়েছি ওর থেকে নিশ্চিন্ত আমি কাউকে দেখিনি। নিজের টা আসেনি এইটা থেকে আমার টা আসছে এইটাতে ও অনেক খুশি। জীবনে যদি এরকম একজন পাওয়া যায় তাহলে তার কি কোন আক্ষেপ থাকা উচিত? আক্ষেপ আমার ছিল। সেই চিঠি টা আমার জায়গা থেকে একদম বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। তন্নতন্ন করে খুঁজেও চিঠিটার কোন হদিস পাইনি আমি। কোন ঠিকানাও বের করতে পারিনি আমি। হুমায়ুন আহমেদ স্যারের কিছু বইতে দেখা যায় যে একটা চরিত্র গায়েব হয়ে যায়। নিখাদ অল্প এই সময়ের জীবনে দারুন কিছু মুহূর্ত আছে আমার। সময়গুলো যোগ করে ওকে উৎসর্গ করতে চাই। অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি ওর সাথে। বিধি বাম। বরাবরের মত আমার দুর্ভাগ্য আমাকে সাহায্য করল।

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ক্লাসগুলোর থেকেও বোরিং ছিল চিঠি লিখার কাজটা। কিন্তু পুরো ব্যাপারটায় অন্যরকম মাত্রা যোগ করলো খালিদ। দেশের বিশিষ্ট মানুষজনের কাছে চিঠি লিখা শুরু করলো সে। জাফর ইকবাল স্যার এর কাছে থেকে চিঠির উত্তর পেয়ে তার সাহস অনেক বেড়ে গেল। খুঁজে খুঁজে সে যথাক্রমে জনাব হারধন নাগ,শাহজাহান তপন,আফসারুজ্জামান স্যারদের চিঠি পাঠাল। চিঠির উত্তর পাবার দুঃসাহস খালিদ নিজেও করে নি ;)। নাসিফ শুরু করলো star-campus এ। আমিও ভাবলাম চিঠি লিখে ফেলি একটা। তখন বালিশের নিচে মোটামুটি একটা লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছিলাম। হুমায়ুন আহমেদ স্যার বরাবর একটা চিঠি লিখে ফেললাম। (নিজের কোন কাজের উপর আমার খুব কমই সন্তুষ্টি থাকে…সেই চিঠিটা পরার পর নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছা করছিল :P) পিঠ আরেকজনও চাপড়ে দিলেন। জনৈক স্যার আমাকে এবং নাসিফকে এমন ভয়াবহ সুন্দর ভাবে তিরস্কার করলেন যে মনে হল কেউ আমাদের কাপড় খুলে রেখে কলেজ চক্কর দিতে বলেছে। L

ওই সময়কার চিঠিগুলার একটা রীতি মনে পড়ে গেল। প্রত্যেক সপ্তাহে মোবাইলে কথা বলার পর আর কিইবা লিখা যায় চিঠিতে !! চিঠি গুলা তখন এরকম রুপ নেয়া শুরু করলো “বাবা/মা, সালাম নিও…কেমন আছো…আমি ভাল…সামনে পরীক্ষা…দোয়া কর…। ইতি …।”পরীক্ষা থাকুক আর নাই থাকুক মাসের ৪ টা সপ্তাহের চিঠিতেই এটা আমাদের প্রথাগত বাক্য। সবাই জানি আমরা চিঠিতে কি লিখি। একবার কয়েকজনকে চিঠি লিখে সাহায্য করলাম। তাদের একজন আবার আমাকে চিঠি লিখে সাহায্য করলো। পরের বার ফোনে মা বললেন…বাবা, চিঠিতে কয়েকটা মাত্র লাইন লিখিস তাও আবার আরেকজনকে দিয়ে। এরকম চিঠি পাঠানোর চাইতে তো না পাঠানো ভাল। আমি এর কি উত্তর দিব !! মনে মনে বলি “মা তোমার এই কথাগুলো যদি কলেজ অথরিটি বুঝত ,আমরা বেঁচে যেতাম!! L”

তবে কলেজ অথরিটির একটা ধন্যবাদ প্রাপ্ত। চিঠি লিখার মধ্যে যে এক প্রকার নির্মল ও বিশুদ্ধ আবেগ কাজ করে তা প্রত্যেক চিঠি লেখক জানেন। যোগাযোগের মাধ্যম উন্নততর হওয়ায় আমাদের আজ চিঠি লিখার প্রয়োজন পরে না। ছোট্ট একটা হিসাব করেছি…যে মানুষটার সাথে আপনার সবচেয়ে বেশি ক্ষুদেবার্তার আদান-প্রদান হয় সেগুলো যোগ করে দেখুন…পৃথিবীর সেরা সৃষ্টির অন্যতম একটা হলেও হতে পারে ।

৮০০ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “চিঠি …(১)”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।