আপাতত রাতুল বসে আছে ফার্মগেট ওভারব্রিজে। বসার জায়গা নাই। প্রচুর মানুষের আনাগোনা। তার মধ্যেও সিঁড়ির এককোণায় জায়গা করে নিয়ে বসে আছে। দশটাকার বাদাম কিনেছিল একটু আগে। সেটাই চাবাচ্ছে। হঠাৎ করে রাতুলকে দেখলে মনে হবে বিধ্বস্ত। যেন রাজ্যের টেনশন ওর উপর ভর করে আছে। রাতুল ভিতরে ভিতরে আসলেও বিধ্বস্ত। মনে অনেক হিসাব নিকাশ। আচ্ছা ঠিক তের দিন আগে যাওয়া যাক।
হঠাৎ করেই এক ফ্রেন্ড ফোন দিয়ে বলল “টিউশনি করাবি? উত্তরায়। তিন দিন যাবি। সাত হাজারের মত দিবে।চলবে?” রাতুল তখন কেবল বাসায় ফিরছিল। বৃষ্টিও হচ্ছে। অন্য কোন কথা বললে হয়ত ঝাড়ি দিত। কিন্তু অফার শুনে এই রাতেও চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল।
– চলবে মানে? দৌড়াবে??? কবে থেকে যাব সেটা বল।
– আচ্ছা আমি তোকে নাম্বার পাঠায় দিচ্ছি। কথা বলে নিস।
– আচ্ছা। আচ্ছা। থ্যাংকস দোস্ত।
– হু। ট্রীট দিস।
– শিওর ??
এই বৃষ্টির মধ্যেও চট করে রাতুলের মাথায় অংক খেলে গেল। ছোটবেলা থেকেই রাতুল অংকে খুব ভাল। সবসময় লেটার মার্ক পেয়ে এসেছে।
– ৩০*২*১২= ৭২০
সাথে এককাপ চা আর একটা গোল্ডলিফ (৫+৮)*১২=১৫৬
৭২০+১৫৬=৮৭৬
আচ্ছা রাউন্ড ফিগার করব ৯০০ ই ধরলাম। তাও হাতে থাকে ৬১০০???
রাতুলের যেন আর আনন্দ ধরে না। বৃষ্টি হচ্ছে। নাহ। আজকে একটু খিচুড়ি খেতে পারলে বেশ জমত। টাকা পয়সা তেমন নাই সাথে। যা আছে তাতে হয়ে যাবে আজকে খিচুড়ি খাওয়া। কাজ তো পেয়েই গেছি। টাকা আসবে। একাউন্টিং এর ভাষায় এটাকে বলে revenue earning. এই সেমিস্টারে একাউন্টিং এর একটা কোর্স আছে। তার সুবাদে কিছু একাউন্টিং টার্মস ও জানা হয়ে গেছে। কোপায়ে ভুনা খিচুড়ি আর গরুর কালা ভুনা খেয়ে বাসায় ফিরল রাতুল। মনে অনেক সুখ। টাকা আসছে। টাকা।
সেদিন ফোন দিয়ে টিউশন টা কনফার্ম করে ফেলল রাতুল। এক তারিখে যেতে বলেছে। রাতুলে আর সুখ ধরে না। আবার অংক করতে বসল। এখন একটা টিউশন করায় সে। পায় পাচ হাজারের মত। বাসা থেকেও দেয় ছয়/সাড়ে ছয়। এখন এটা শুরু করলে আরো সাত। মাস শেষে আঠারো হাজার টাকা ?? সুখ! সুখ! কিটা দিন বেশ ভালই গেল রাতুলের। সবার আগে যেটা করল পরিচিত এক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা ধার করল। আরে টাকা তো আসছেই। দিয়ে দিব। এখন একটু ভালভাবে চলি। ভার্সিটি সেদিনই জুনিয়র মেয়েটার সাথে দেখা হলো। মেয়েটা হাসি দিয়ে বলে “ভাইয়া একদিনও ট্রীট দিলেন না!”
আহ! এইকি রাতুল চেয়েছিল। মেয়েটার উপর থেকে এমনিতেও রাতুল চোখ ফিরাতে পারে না। তার উপর কি সুন্দর করে ভাইয়া ডেকে ট্রীট চাইল। নাহ। আজ ট্রীট না দিলে ভীষণ অন্যায় হয়ে যাবে। আগে না হয় রাতুলের টাকা ছিল না। এখনতো আছে। revenue earned হয়ে গেছে না। রাতুল আর দেরী করল না।
– চলো। আজ তোমাকে ট্রীট দিব।
বাসা চেঞ্জ করার কথা সামনের মাসে রাতুলের। দেখাও হয়েছে। ভাল লেগেছে। আরেকজনের সাথে একরুমে ওঠার কথা। রাতুল ঠিক করল সে কোন রুমমেট নেবে না। একাই এক রুম নেবে। ভাড়াটা একটু বেশি পড়বে। তাতে কি! রাতুলের এখন অনেক টাকা। revenue earned হয়ে গেছে।
বাসা ভাড়া এডভান্স দিয়ে রাতুলের ধারের টাকাও শেষ। রুম সাজাতে অনেক কিছু কিনতে হবে। রাতুল আবার ধার করল। আরে এখন তার ধার শোধ করা কোন ব্যাপারই না। অনেক টাকা তার। revenue earned.
সবই হলো। অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ। চটপট প্লান করে রাতুল একটা ট্যুর রেডী করে ফেলল। খরচ হবে প্রায় দুই হাজারের মত। তাতে কি। এত টাকা রাতুলের। দুই হাজার খরচ করে একটা ট্যুর দিতেই পারে।
সবই ঠিকঠাক চলছিল। ট্যুর দিয়ে এসে রাতুলওও এখন অনেক ফ্রেশ। অনেক সুখী। এর মাঝেই ঘটনাটা ঘটল। সেই ফ্রেন্ডের ফোন।
– দোস্ত, একটা ব্যাড নিউজ আছে।
– কি?
– দোস্ত ওই ছেলে প্রাইভেট পড়তে চাচ্ছে না। বলছে শুধু কোচিং এ পড়বে।
( একটা ধাক্কা খেল রাতুল ভেতরে। না। এ হতে পারে না। কত স্বপ্ন। কয় আশা! না। এভাবে ভেঙে যেতে পারে না। কিন্তু কিছু প্রকাশ করল না।)
– আচ্ছা দোস্ত। পেরা নাই। পরে আর পাইলে জানাস।
– শিওর দোস্ত।
মাথায় আবার অংক কষতে বসল রাতুল। এখনকার টিউশনির পাচ। বললে এমাস থেকে একটু বাড়ায় দেয়ার কথা। আচ্ছা চলে যাবে কোনরকমে। পেরা নাই। অংক কষতে কষতেই রাতুল চলল টিউশনে। আর সেখানে আরেক ধাক্কা। পড়ানো শেষে গার্জিয়ান হাসি মুখে টাকা হাতে ধরায় দিল। রাতুলের তো চোখ বড় বড়। বলল,
– এমাসে বাড়ায় চেয়েছিলে। ছয় দিয়েছি।
মুহূর্তেই সব দুঃখ উধাও। ঠিক করে ফেলল, এখান থেকে বের হয়েই একটা স্ট্যাটাস দিবে
“মেয়ে তুমি কি টিউশনির টাকা! দেখলে এত ভালো লাগে ক্যান! ”
আর তারপরেই আসল ঘটনা। আংকেল হাসি হাসি মুখে বলে,
– বাবা আমরা বাসা চেঞ্জ করছি। একটু দূরে। তোমার নেক্সট মাস থেকে আসার দরকার নাই।
( ব্যাকগ্রাউন্ডে বিজলি চমকানোর আওয়াজ হবে)
রাতুল বিধ্বস্ত।
আপাতত রাতুল ফার্মগেটের ওভারব্রিজে বসে বাদাম চাবাচ্ছে। মাথা অনেক অংক। কিন্তু কোনটাই মিলছে না। নিজেকে অংকে এতটা কাচা আগে কখনো মনে হয়নি। সবই তো ঠিক ছিল। revenue earn ও হয়েছিল। কিন্তু এখন সবই bad debt expense. ?