হঠাৎ স্বাধীনতা

খুব অস্থিরভাবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে অমি। বিকাল চারটা পঞ্চাশ বাজে। আর দশ মিনিট। মাত্র দশ মিনিট।

অমি ক্লাশ ফাইভে পড়ে। বগুড়া জিলা স্কুল। মর্নিং শিফটে। বাবা-মা বিকালে কোচিংএ দিতে চেয়েছিল। ও রাজী হয়নি। বাবা-মা কে বুঝাইছে যে বাসায় রেগুলার পড়লেই হয়। কোচিংএ যাওয়া মানেই সময় নষ্ট। কথা মনে হতে পারে পড়াশুনার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছেলে। কিন্তু ঘটনা তো অন্য জায়গায়। কোচিং চলে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত। ওখান থেকে ফিরে আর বিকালে খেলা হয় না। পাড়ার ছেলেরা প্রতিদিন ক্রিকেট খেলে। ক্রিকেট অমির প্রিয় খেলা। খুব যে ভাল খেলে তা না। তবে খেলার জন্য সবমসময় পাগল হয়ে থাকে। পাড়ার ছেলেরা বেশিরভাগই ওর বয়সী। কেউ বা ছোট, কেউ ভা দু তিন বছরের বড়। তবে সবাই মিলেমিশেই খেলে। যদিও অমির প্রায় প্রতিদিন দল পেতে সমস্যা হয়। ওরা সবাই খেলা শুরু করে বেশ আগেভাগেই। সারে চার টার পরপরই। কিন্তু অমির বের হতে হতে পাচটা বেজে যায়। অমির মার কড়া নিয়ম। বিকেল পাচটা বাজার একমিনিট আগেও বের হওয়া যাবে না। অন্যদের রেফারেন্স দিয়ে অমি বারবার আগে বের হওয়ার জেদ করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। বরং অমির মা “বাউদা,বখাটে, নষ্ট হয়ে যাওয়া” বলে বাকিদের জাত উদ্ধার করেছে। শুধু যে বিকেল পাচটায় বের হতে পারবে, তা নয়। ফিরতেও হবে প্রথম আজানের সাথে সাথেই। সেদিন দুটো আজান পরে গেছিল। ভয়ে ভয়ে দরজা নক করল। ভেতর থেকে কর্কশ কণ্ঠে ওর মা বলে উঠল
“আসতে বলছে কে বাসায়। ওখানেই থাকতি। ওদের বল আজ রাতে তোকে ভাত খাওয়াতে। আমি তোকে ঢুকতে দিব না। ”
পরে ওর বাবার হস্তক্ষেপে, বারেক একশ কান ধরে উঠাবসা করে হাজারো প্রতিজ্ঞা করে তবে ঘরে ঢোকার টিকেট পেল।

যা হোক, পাড়ায় নতুন লীগ ছেড়েছে বড় ভাইরা। অমিকেও নিয়েছে একদল। তবে নেয়ার আগে হাজারো বার জিজ্ঞাসা করেছে “তোকে নিলাম। কিন্তু সময়মত আসতে পারবি তো?” অমি অনেক জোরে মাথা নেড়েছে। অনেক খুশি সে। পাড়ার বড় ভাইদের সাথে এক লীগে খেলা, এ যে অনেক সম্মানের। লীগে ভাল করতে পারলে পাড়ায় রীতিমত হিরো বনে যাবে। অনেক এক্সাইটেড অমি।

কিন্তু যতই এক্সাইটেড থাকুক, গণ্ডগোল প্রায় পেকেই যাচ্ছিল। সেদিন ম্যাচ শুরু হওয়ার কথা পৌণে পাচটায়। অমি পাচটায় দৌড়ে গিয়ে হাপাতে হাপাতে মাঠে উপস্থিত। দেখে খেলা শুরু হয়ে গেছে। অমিকে দেখে ক্যাপ্টেন পাইলট ভাই কিছুটা ক্ষেপে গেল।
– আগেই বলেছিলাম সময়মত আসতে হবে। ভাগ্য ভালো আমরা ব্যাটিং ফার্স্ট। যা ওদিকটায় বোস।
অমি তখনও হাপাচ্ছিল। তার দল ব্যাট করছে। খুব একটা ভাল অবস্থাও না। দু ওভার খেলা হয়েছে। দুজন আউট গেছে। দল নিয়ে যে অমির খুব একটা চিন্তা হচ্ছে, তা না। বরং অমি মনে মনে দোয়া করছে সবাই তাড়াতাড়ি আউট হোক। অমি ব্যাট করতে চায়। অমিকে সাধারণত একদম শেষের দিকেই নামানো হয়। তাই সবাই আউট না গেলে ব্যাটিং পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বিধাতা যেন সেদিন অমর প্রার্থনা শুনতে পেল। বারো অভারে খেলা। প্রতি দলে আটজন করে। সাত ওভার না যেতেই পাচজন আউট। এখন কেবল ক্যাপ্টেন পাইলট ভাই আর রাজিব ভাই। একজন গেলেই হয়। অমি অনেক উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখজোড়া চকচক করছে। আর বলতে বলতেই। পাইলট ভাই বেশ জোরে মেরেছিল। কিন্তু বল ডিরেক্টলি বাউন্ডারিতে লাগে। পাইলট ভাই ছক্কা মেরে আউট। এবার অমি নামবে। অমির এগিয়ে যায় ব্যাট হাতে। ফিল্ডার রা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। একজন বলে ওঠে “আরে এই পিচ্চিকে আস্তে বল দে একটা। ক্যাচ তুলে দেবে।”
পাইলট ভাই চিল্লায়ে বলে “অমি,ব্যাট সামনে। ঠেকা কোনরকমে।”
অমি সামনে তাকায়। বল হাতে শিবলি ভাই।পাড়ার অন্যতম দূধর্ষ বোলার। অমির জন্য ফিল্ডার ক্লোজ হয়ে আসে। স্লিপে দু জন। দুই শর্টে দুই জন। পয়েন্টে একজন আর একজন ডীপ স্কয়ার লেগে। অমি এবার ক্রিজে দাঁড়াল। ব্যাট করতে প্রস্তুত। শিবলি ভাই বল করলেন। ইয়োর্কার ছিল। অমি ডান পা এক স্টেম সামনে নিয়ে ব্যাট বলের লাইনে ধরল। ব্যাটের মাঝামাঝি লেগে ফাইন লেগ দিয়ে ফোর। শিবলি ভাই স্তম্ভিত। এ কি হলো। কিভাবে সম্ভব! পাইলট ভাই চিল্লায়ে বলল, “অমি রান মাত্র ৩৩। ধরে খেল।”
পরের বল রাগে ফুসলানো শিবলি ভাই একই বল করলেন। অমিও সেম শটে আরেকটা ফোর। চারদিকে তালি বাজতে লাগল। এভাবে চলতেই থাকল। কখনো গালিতে চিকি কাট, কখনো কভার ড্রাইভ, কখনো স্ট্রেট ড্রাইভ। চলতেই থাকল। দলের রানও বাড়তে থাকল। পাইলট ভাই খুশি হয়ে বললেন, আজ ওপেনিং বল অমি করবে।

সেদিন অমির দল জিতেছিল অমির তাণ্ডবে। তার দলও চলে গেল ফাইনালে। পাড়ায় সবার মাঝে মাঝে অমির প্রশংসা চলতে লাগল। রাতারাতি পাড়ার হিরো। আজ ফাইনাল। কিন্তু ফাইনাল শুরু হবে বিকেল সারে চারটায়। কিন্তু….
নাহ। অমি ব্যবস্থা করে রেখেছে। স্কুল থেকে এসেই বাসার সব ঘড়ি আধাঘণ্টা ফাস্ট কতে দিয়েছে ওর মার চোখে ফাকি দিয়ে এখন অপেক্ষার আছে অস্থির ভাবে। চারটা পঞ্চাশ বাজে। আর দশ মিনিট। অমির স্বপ্নের ফাইনাল। আর দশ মিনিট।

অমি এখন অনেক বড় হয়েছে। এখন আর মায়ের নিয়ম মত পাচটায় বের হয়ে প্রথম আজানেই ঘরে ফিরতে হয় না। ইচ্ছে করলে সারাদিনই বাইরে থাকা যায়। মাঝে মাঝে মা ফোনে বলে
“বাবা অনেকদিন হলো তো আসিস না। নেক্সট সপ্তাহে আয়। কতদিন তোকে দেখিনা।”

৫,৫৬৪ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “হঠাৎ স্বাধীনতা”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।