বেশ অনেকক্ষণ হলো রাতুল চায়ের দোকানটায় বসে আছে। বেশ অনেকক্ষণ। কয়েক কাপ চা খাওয়াও হয়ে গেছে। বসে আছে বলে যে কেউ কিছু বলছে তা না। আরো অনেকেই বসে আছে। আড্ডা দিচ্ছে, গল্প করছে,খাচ্ছে, যার যা খুশি তাই করছে। কারো অন্যের কিছু নিয়ে মাথা ব্যথা নাই। তবে রাতুলের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। আশে পাশে আরো কয়েকজন বসা থাকলেও রাতুল কিন্তু আসলে একা। একটু পর পর মাথা এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে। মনে হচ্ছে কাকে যেন খুজছে। বেশ অস্থির। আসলে খুজছে। রাতুল কাকে যেন খুজছে। বেশ মরিয়া হয়েই খুজছে। অনেক অস্থির।
রাতুল এখন বসে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকিতে। সামনে রবীন্দ্রভবন, পাশে লাইব্রেরি। সকাল থেকেই রাবির ক্যাম্পাস চক্কর দিচ্ছে। শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘন্টা দুয়েক হলো এখানে বসে আছে। খিদেয় পেট চো চো করছে, কিন্তু পকেটে টাকা নেই। রাতুল এসেছে সিলেট থেকে। সিলেট মেডিক্যালে পড়ে। বের হওয়ার পর বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার পথে মনে হলো তার কাছে টাকা নেই। তখন পথ পালটে ট্রেন স্টেশনে যায়। ফাক ফোকর দিয়ে স্টেশনে ঢুকে সোজা রাজশাহী। ডিরেক্ট কোন ট্রেন নাই। তাই ঢাকা হয়ে আসতে হয়েছে। মাঝে ট্রেনের টিটিকে ফাকি দিতে আরো যে কত কাহিনী!
রাতুলের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। দুচোখ যেন তন্নতন্ন করে কাকে খুজছে। সে অনেক আগে, কলেজে থাকতে একজনকে প্রপোজ করেছিল। অবশ্য তাতে সাড়া দেয়নি অপরজন। তাতে কি, রাতুল কিছু মনে করেনি। হাসি মুখে থ্যাংকস দিয়েছিল। কিন্তু ভুলতে পারেনি। গতপরশু হঠাৎ করেই তার কথা আবার মনে পড়ল। রাতুলের কে জানি মনে তাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। সেই হাসি টা। ফেসবুকে ফ্রেন্ডশিপ নাই। তবুও সার্চ দিয়ে ছবি ঘাটাঘাটি করল। কিন্তু নাহ। এ ভালবাসা যান্ত্রিক নয়। তাকে সামনা সামনিই দেখতে হবে। তাই কোনরকমে ব্যাগ কাঁধেচাপা দিয়েই বেরিয়ে পরা। আর তারপর থেকেই খোজ দ্যা সার্চ অভিযান চলছেই। কিন্তু দেখা মিলছে না। এদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকালের পথে। রাতুল হতাশ। রাতুল উঠে পড়ল। ভাবল চায়ের বিল চাইতে পারে। হাটা শুরু করল। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। প্যারিস রোড হয়ে মেইন গেটের দিকে হাটতে শুরু করল রাতুল। নাহ! এযাত্রা বোধহয় আর দেখা হলো না। এবার ফেরার হিসেব কষা যাক। হাটতে হাটতে দুপাশে বসে থাকা কাপলগুলোকে দেখে হিংসেয় আধমরা রাতুল। অংক কষতে কষতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরুলো। কেউ খেয়াল করল না। হয়ত কেবল কোন ডাল থেকে একটা কাক উড়ে গেল। আজব! তাই না? সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে নিয়েই খুশি।
মেইন গেটে এসে পাচ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল রাতুল। না দেখার হতাশা, ফেরার জটিল সমীকরণ, সব মিলিয়ে রাতুলের মাথা চুলকানো ছাড়া অন্যকিছু করার থাকল না। আরেক কাপ চা খেতে পারলে ভাল হতো। থাক। এসব দোকানে বসলে আবার বিল না দিয়ে উঠতে পারিবে না। মোবাইলের চার্জও শেষ। কাউকে ফোন করে যে কিছু টাকা পাঠাতে বলবে সে উপায়ও নেই। হতাশা!হতাশা! নাহ, এবার এগুনো যাক। মাথা থেকে হাত নামিয়ে ঘাড় সোজা করে হাটা দেবে রাতুল। এমন সময় চোখ আটকে গেল এক অটোতে। গেটের সামনে ঠিক অপজিটেই এসে থামল। নামছে। কয়েকটা মেয়ে। সবাই অনেক খুশি। হাসছে। হয়ত কে ভাড়া দেবে সেটা নিয়ে তর্কও চলছে। কিন্তু সেসবে রাতুলের মন নেই। রাতুল আটকে গেছে। সেই হাসিতে। সেই হাসি। তার সামনে। সেই রিজেক্টেড হবার দিনের হাসি। সেই হাসি যেটা দেখে, ভেবে রাতুল আনমনে হেসেছে। রাতে, দিনে, যখন মনে পরেছে তখনই। নিউটন বেচে থাকলে এখান থেকে একটা ল বের করে ফেলতে পারত। যেমন, প্রিয়মানুষ যখন হাসে পৃথিবীর সময় তখন আটকে যায়। কিংবা প্যাসকেল বলতে পারত, প্রিয়তমার হাসি আর প্রিয়তমর মনে যে চাপ সসমানুপাতিক। হতে পারত আরো অনেক কিছু হতে পারত। ভাড়া দেয়া ততক্ষণে শেষ। সবাই গেটের দিকে ফিরছে। রাতুল যেন জ্ঞান ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি মাথাটা আড়াল করল ব্যাগ দিয়ে। ক্রস করে যাওয়া পর আবার ফিরে তাকালো। যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে সে। কিন্তু হাসছে, এখনো। কবি এজন্যই হয়ত বলেছিলেন
দূর থেকে নীরবে দাঁড়িয়ে দেখা
এক চিলতে হাসির জন্য
যুগ যুগ অপেক্ষায় থাকা
একদিন ফিরে পাব-
বুকে বেধে এই আশা
হয়ত এরই নাম ভালবাসা।