বাবা চিৎকার করে উঠলেন, টিভি চলছে না কেন? কে কোথায় আছিস?
কোনো সমস্যা হলেই বাবা বাড়ির সবাইকে ডেকে সমবেত করে ফেলেন। সবাই এসে তার সমস্যাটা শুনে যেতেই হবে। কিছু করুক না করুক তাতে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু শুনতে হবে। এবং সবাইকে না শোনানো পর্যন্ত তিনি থামবেন না।
মা চলে এসেছেন। বিরক্তি নিয়ে।
বাবার বেশিরভাগ সমস্যারই কোন সমাধান নেই, তবু সবাইকে শুনতে হবে। সবাই যখন মাথা নেড়ে বলবে, এটা একটা জটিল সমস্যা, তখন তিনি খুব খুশি হবেন। ব্যস। এটুকু হলেই তার চলে।
কাজেই পুরো বিষয়টা সবার মুখস্ত। ভাইয়া এসে কিছু না বুঝেই বলল, আহারে! কী অবস্থা!
কিসের অবস্থা? বাবা জানতে চাইলেন।
না। এই যে আপনার…
আমার শুধু! শুধু আমার! টিভি চলছে না। খবরটা শোনা হচ্ছে না।
খবরের চেয়ে আপা তার হিন্দি সিরিয়াল নিয়েই বেশি চিন্তিত। তিনি শুধু আন্তরিকভাবে বাবার সঙ্গে তাল মেলালেন, বাকিরা গা বাঁচানো, একটা আফসোস পর্ব হলো। সেটা শেষ হওয়ার পর তবেই সমস্যা সমাধানের প্রসঙ্গ আসবে, কিন্তু তার আগেই একটা মুশকিল হয়ে গেল।
আতিক মামা এসে জানালেন, তার ঘরের ফ্যানটা চলছে না।
বাবা ধমকে ওঠে বললেন, এর মধ্যে আবার ফ্যানের সমস্যা! টিভিটার বিষয়ে আগে একটা হিল্লে হোক।
এই রুমের ফ্যান তখন বন্ধ। ভাইয়া কী ভেবে ফ্যানের সুইচ দিতে গিয়ে দেখেন এই ফ্যানও চলছে না। কয়েকবার চেষ্টা করা হলো, কিন্তু লাভ নেই। চেষ্টা করতে করতে ভাইয়া নিজে ঘুরে যায়, কিন্তু ফ্যানটা আর ঘুরে না।
ফ্যান সমস্যা নিয়ে সবাই যখন ভাবিত, তখন কী ভেবে মা চলে গিয়েছিলেন তার ওয়াশিং মেশিন চেক করতে। এবং সেখানেও বিপত্তি। মা দেখেন ওয়াশিং মেশিনটাও কাজ করছে না। বুয়া আর্তচিৎকার করে জানায়, এখন কী হবে?
ভাইয়া বলল, বৈদ্যুতিক গোলযোগ নাকি?
দেখ তো!
সাইন্সের ছাত্র হিসাবে বিদ্যুৎ এবং বৈদ্যুতিক বিষয়াদিতে তার অল্প-বিস্তর জ্ঞান আছে, সেটা প্রযোগ করা লাগল না, কারণ দেখা গেল লাইটগুলো জ্বলছে। মেইন সুইচ চেক করে কোন সমস্যা দেখা গেল না। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের বাসায় পুরো যন্ত্রবিভ্রাট ঘটে গেছে। টিভি চলছে না। ফ্যান ঘুরছে না। ওয়াশিং মেশিন অচল।
একটু পরে দেখা গেল ভাইয়া এবং বাবার মোবাইল ফোন দুটো থেকেও কল যাচ্ছে না।
মহা মুশকিল। মা বললেন, ভূতের ছায়া।
বাবা বললেন, চুপ।
বিজ্ঞানী চাচা পুরো বিষয়টা গভীর পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিতে দেখছিলেন। আমাদের বাসায় গৃহস্থালী যান্ত্রিক জিনিসপত্র নষ্ট হলে প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্ব তার। তিনি দেখে বলবেন, কোনটার বিষয়ে কী করতে হবে। তার মতামতের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হয়।
এখন সবগুলো জিনিস চলে গেল তার হাতে। নাজিম চাচার বিজ্ঞানমনস্কতাকে আতিক মামা ভালো চোখে দেখেন না, তার মতে এসব আধা-বিজ্ঞানীরাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া, না গাছের না গোড়ার, এগুলো আগাছা সব। কিন্তু এই আগাছার হাতেই এখন বাসার ভবিষ্যত। তিনি রাগ করে চলে গেলেন।
চাচার একটা পুরনো ট্রাংক আছে। সেখানে বৈজ্ঞানিক কায়কারবারের নানান জিনিসপত্র আছে, সেগুলো নিয়ে বসে গেলেন তিনি। সঙ্গী আমি। কারণ একমাত্র আমিই চাচার বৈজ্ঞানিক সত্ত্বার সমর্থক।
এদিকে মহাকাণ্ড। বাবা ঘুম থেকে উঠেই নানান চ্যানেলে খবর দেখা শুরু করেন। তার বিশ্বাস রাতের বেলা আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনই সব গুরুতর ঘটনা ঘটে, সকাল থেকে সেগুলো না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। আজ টিভি নেই। চাচা প্রাথমিক পরীক্ষা শেষে জানিয়ে দিয়েছেন, এগুলো সব সারতে পুরো একদিন লাগবে। আগামীকাল সকাল থেকে টিভি চলবে, ফ্যান ঘুরবে, মোবাইলও সচল হবে। এর মাঝখানে কেউ তাকে বিরক্ত করলে দেরিই হবে শুধু।
বাবা অনেক ভেবে কিছু করার পান না। এদিকে হাঁটেন, এদিকে ঘোরেন। বুয়ার ওপর অকারণে খুব হম্বি-তম্বি করলেন একবার।
কী ভেবে আমি গিয়ে বাবাকে বললাম, বাবা বই পড়বে একটা!
বই! আমি কি তোর মতো ক্লাস এইটে পড়ি নাকি! আমি বুড়ো হয়েছি। রিটায়ার্ড পারসন। জ্ঞান-বিজ্ঞান যা অর্জন করার সব হয়ে গেছে।
বাবা, এটা গল্পের বই।
গল্পের বই! আমি কি শিশু নাকি যে ঘুম-পাড়ানি গল্প শুনে ঘুমাব।
বইটা পড়ো না। তোমার সময় কাটবে।
বইটা রেখে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর পর উঁকি দিয়ে দেখি বইটা পড়ে আছে। বাবা তার মতো অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন।
ফ্যান না থাকায় ভীষণ সমস্যায় পড়েছেন আতিক মামা। তার রুমটা হচ্ছে পেছনের দিকে। নানান অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঘর ঠাসা, সে কারণে তার দুটো জানালাই বন্ধ। ফ্যান চলে বলে তিনি টিকে থাকতে পারেন। ফ্যান ছাড়া গরমের চোটে তার ঘরে বসাই যায় না। কাজেই সারাক্ষণ ফ্যান চলে। আজ ফ্যান নেই, চাচা তাই বেকায়দায়, প্রথমে এদিক-ওদিক ঘুরলেন, কিন্তু দুপুরের পর একটু ঘুমাতে হয়, সেই ঘুমতো আর ডায়নিং রুমে বসে হবে না। কাজেই জানালা খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। জানালা খুলতে হলে ঘর পরিষ্কার করতে হবে। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, দুপুরের আগে মামা তার ঘর পরিষ্কারে লেগে গেছেন। ময়লার স’প বেরোচ্ছে, আর ঘরটা আসে- আসে- মানুষের ঘরের চেহারা পাচ্ছে।
এবং একটু পর দেখা গেলো মা-ও বহুদিন পর হাতে কাপড় কাঁচছেন। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তবু কী করা যাবে আমাদের স্কুলের জামা-কাপড়, পরিষ্কার করতেই হবে।
এর মধ্যে ভাইয়া একবার এসে চাচাকে ঘুষের প্রস্তাব দিয়ে গেছে। তার মোবাইলটা আগে ঠিক করে দিলে, সে চাচাকে ঈদে একটা বায়নোকুলার কিনে দেবে। চাচার ক্রিকেট দেখায় খুব কাজে লাগবে।
চাচা বললেন, তোর মোবাইলের এত দরকারটা কী!
একটা জরুরী নোটের বিষয়ে স্যারকে ফোন করতে হবে।
ফোন না করলে কি চলে না?
না। জরুরী বিষয়।
তাহলে স্যারের বাসায় চলে যা।
বলছ কী! স্যারের বাসা কতদূর।
কোথায়?
শান্তিবাগ।
মগবাজার থেকে শান্তিবাগ দূর! ঘরে বসে বসে না তোর পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। ঘর থেকে বের হ। তোর মোবাইল এখন ঠিক হবে না। আর তুই যদি স্যারের বাসায় না যাস তাহলে কোনোদিনই ঠিক হবে না।
ভাইয়া রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। আমার হাসি পেল। ভাইয়া অদ্ভুত রকম অলস। মোবাইল কেনার পর সে আর কোথাও যায় না। এমনকি ক্লাসেও যেতে চায় না। বলে, আরে ক্লাসে গিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ কী! মুল পয়েন্টগুলো মোবাইলে জেনে নেয়া যাবে। আর যেতে আসতে সময় নষ্ট। ঐ সময়টা পড়াশোনা করলেই হয়। ভাইয়া তাই বাসা থেকে বেরোয় না। সারাদিন পড়াশোনা করে। মুঠোর মধ্যে থাকা মোবাইলই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার একমাত্র যোগাযোগের সেতু। কিছুক্ষণ পর সত্যিই দেখা গেল ভাইয়া বেরোচ্ছে। চাচা হেসে বললেন, যাক গাধাটাকে তবু ঘর থেকে বের করা গেল!
ভাইয়া বের হওয়ার পর অমি উঁকি দিয়ে দেখি বাবা বইটা হাতে নিয়েছেন। বইটা পড়ছেন, তবে বিরক্তিভরা মুখ। নাক-মুখ ভয়ংকর রকম কোঁচকানো।
বৈজ্ঞানিক চাচাকে নিয়ে আতিক মামা যতই রসিকতা করুন, তিনি কাজে দারুণ সাফল্য দেখালেন। কথা ছিল ২৪ ঘণ্টা, কিন্তু ২২ ঘণ্টার মধ্যে তিনি সব যন্ত্র সারিয়ে ফেললেন। পরদিন সকালেই সবাইকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বললেন, সব ঠিকঠাক। এখন টিভিও চলবে। মোবাইলও কাজ করবে। ফ্যানও সচল। সবার খুব খুশি হওয়ার কথা। চাচার পুরষ্কারও প্রাপ্য, কিন্তু দেখি কারো মধ্যেই বিশেষ কৃতজ্ঞতাবোধ নেই।
বাবা বললেন, ভালো করেছিস। খুব ভালো!
আমি বললাম, টিভি ছাড়ব?
বাবা বললেন, না। বইটা শেষ করি। দারুণ ইন্টারেস্টিং জায়গায় এসে থেমে গেছি।
আতিক মামা বললেন, ফ্যান ঠিক না করলেও এখন আমার চলবে। দেখো কী সুন্দর প্রাকৃতিক বাতাস। ফ্যানের বাতাসে তো কেমন একটা নকল নকল ভাব। খারাপ গন্ধও আছে।
মা বললেন, এক আধটু কাপড় ধোয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কাল দুপুরে খুব ভালো ঘুম হয়েছে।
ভাইয়া বলে, বুঝলে মাঝেমধ্যে মোবাইলবিহীন থাকা উচিত। কাল বাসা থেকে দারুণ ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা ঘটল।
সেই ঘটনার চেয়ে আসল ঘটনা আরও ইন্টারেস্টিং। সেটা জানি শুধু আমি আর চাচা।
চাচার ঘরের দরজা বন্ধ করে আমরা হাত মেলালাম। আমি চাচাকে বললাম, অভিনন্দন।
চাচা বললেন, জিনিসপত্র সময়মতো ঠিক করার জন্য?
আমি বললাম, না। পুরো একদিন নষ্ট করে রাখার জন্য!
সাবলীল লেখা.
ভাইয়া, অনেকদিন পর লিখলেন
টেকনলজি জিনিসটাই এমন, যখন ছিল না তখন কি সুন্দর চলত ...
একবার ইউজ করলেই আর সেই জিনিস ছাড়া উপায় নাই, উপায় নাই ভাব।
চমৎকার প্লট, অসাধারণ লেখা।
পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥
আগে কি সুন্দোর্দিন কাটাইতাম...
সুন্দর একটা প্লটে অসাধারণ একটা লেখা।
মামুন ভাইকে :salute: :salute: :salute:
চমৎকার প্লট, চমৎকার লেখা।
অসাধারণ লেখা ভাইজান। :clap: :clap:
টেকনো জীবনের গল্প... অনেক ভাল লাগছে। 🙂
খুবই পছন্দ হয়েছে।
এই যান্ত্রিক জীবন আমিও চাই না। 😛
মোস্তফা মামুন ভাই, আশা করছি আপনি এটাকে সিরিজ করবেন... 🙂
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
আইডিয়া তো দারুন, যান্ত্রিকতার যন্ত্রনা থেকে মুক্তি, হোক না একদিনের জন্য হলেও।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আমিও চাই যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে...থাকবে শুধু একটা ল্যাপটপ(অবশ্যই নেট সহ), টেলিভিশন(ডিশ/ডিশের সংযোগসহ), লাইট-ফ্যান আর একটা সেল ফোন(চার্জার সহ)...বাহন হিসাবে একটা বাইক...ব্যাস!!! :-B
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
এখন থেকে এমনে লিখবি
কথা শিল্পী জুনায়েদ কবীর(৯৫-০১) বলেছেন......
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
টিটো ভাই, আমি কথা শিল্পী??? আর কাউরে কইয়েন না...আমি না হয় হাসলাম না... O:-) পোলাপাইন কেমন তা তো আপনি জানেনই...মুখের উপর হো হো কইরা হাসব কইলাম! :-B
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
গাই সাইজেও ছোট হবে , ঘাস খাবে কম, আবার দুধ দিবে বেশী...সেই দুধ জ্বাল দিয়া সরও খাইতে হবে...ব্যাস এমন একটা ...
মামুন ভাই
এইরকম মাঝে মধ্যে দিলে কি হয় ভাই......
লেখালেখি তো আপনার কাছে ওয়ান টুর ব্যাপার।
একটু বেশি বেশি দেন না..............
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
মোবাইল না থাকায় আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...কেলাস বাঙ্ক মাইরা বাইরে বেড়াইতে গেলে আম্মা ফোন কইরা খোঁজ নিতে পারতনা-খোঁজ নিতে না পারায় "আম্মা আমি লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করতেছি" কইয়া পাপ কামানোও লাগত না...
আহ দিনগুলি মোর সোনা খাঁচায় রইলনা,সেই যে আমার নানা রংএর দিনগুলি...
😀 😀 😀
বহুত মজা পেলাম
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
ভালো লেগেছে মামুন। দ্রুত আরো লেখা দাও।
"মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"
লেখাটা অনেকদিন আগের। আজ দুপুরে কামরুল আবিষ্কার করেছে এবং তার কল্যাণেই এখানে। পুরনো লেখার টাটকা প্রতিক্রিয়ার মজাটা আজ বুঝলাম।
জুনায়েদের মন্তব্যটা দারুণ। সে লজ্জা পাচ্ছে কিন্তু কারো লজ্জার ভয়ে তো আমরা সত্য বলা বন্ধ করতে পারি না।
লাভলু ভাই থ্যাংকস। পড়ার কারণে। এবং এখানে নিয়মিত লেখার কারণেও।
মোস্তফা মামুন
মামুন ভাই, যথারীতি আপনার অন্যসব লেখার মতই অনবদ্য আরেকটা লেখা। প্লট টাও পুরোপুরি অন্যরকম :boss:
অনেকদিন পরে হলেও একটা দারুন লেখার জন্য আপনাকে, আর এইটা খুজে বের করার জন্য কামরুলকে :salute:
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!