এইচএসসির পর কোচিং করতে আমরা যারা ফরেইনার, মানে , ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আসি, থাকার জন্যে এক টুকরো জায়গার খোঁজে আমাদের যে কি ঝককি পোহাতে হয় সে শুধু আমরাই জানি। ঐ যে বলে না, কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কীসে…., সত্যিই সে এক বিষময় যাতনা।
তো, ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা, … থুককু, বাসা নয় মেস। সেই মেস খোঁজার জন্যে আমি আর আমার বন্ধু চপল পুরো ফার্মগেট এলাকা চষে বেড়াচ্ছি। ফার্মগেট কেন? কারন কোচিং সেন্টারগুলো সব ওখানে গিয়েই উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও ভ্যাকেন্সি নাই। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করি, কিন্তু কাজ হয় না, পরে ঠিকানা টুকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। যেখানেই দেখি টু-লেট, অথবা বাসা ভাড়া দেয়া হবে, সেখানেই একবার ঢুঁ মারি। কিন্তু হায়! বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলতে গিয়ে হয় আরও আজব অভিজ্ঞতা। প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘ আপনারা কি স্টুডেন্ট?’
ঘাড় কাত করে স্টুডেন্ট হবার অপরাধ স্বিকার করি। হ্যাঁ, তাই। মেস খুঁজে বেড়াতে হয়েছে এমন ছাত্র মাত্রই জানেন ঢাকা শহরে স্টুডেন্ট হওয়া বিরাট অপরাধ!
‘ না ভাই, আমরা স্টুডেন্টদের ভাড়া দিই না।’
হতাশ হই, এবং অবাক লাগে। পৃথিবীতে এমন কোন মহামানব আছে যে স্টুডেন্ট না থেকেই সরাসরি চাকরি পেয়েছে? তবু হাল ছাড়লে তো চলবে না, খুঁজে যাই। বিচিত্র সব বাড়ি, বিচিত্র সব ব্যাপার স্যাপার।
একটা বাসায় গেলাম, টিনের ঘর ভাড়া দিবে। বাড়িওয়ালার অসীম দয়া- আমরা স্টুডেন্ট জেনেও তিনি রাজি হয়েছেন। বেশ ভালো, সবই ঠিক আছে। কিন্তু লাগোয়া কোন টয়লেট নেই। সেটা হলো ভেতর বাড়িতে। মানে বাড়িওয়ালার টয়লেট। তাতে কি? ঘর পেয়েছি এই ঢের! কিন্তু না, শর্ত আছে। তা হলো, রাত দশটার পরে সামনের গ্রিলে তালা দেয়া হবে তাই ভেতরের টয়লেটে যাওয়া যাবে না।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল! কি আচানক কথা! মানুষের টয়লেটের কি কোন ঠিকঠিকানা আছে নাকি? প্রকৃতির খেয়াল…, কখন যে সে ডাক দিবে আর কখন যে আমাদের বদনা হাতে দৌড় দিতে হবে সেটা আগে থেকে কেমন করে জানব? পেট তো আর জানে না যে রাত দশটার পরে টয়লেট বন্ধ!
তাই, ইচ্ছা নাহি হয় হায়.., তবু…..।
অন্য বাসা খুঁজতে বের হলাম।
স্টুডেন্টদের ব্যাপারে এত আপত্তি কেন? এক ঠোঁটকাটা বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিলেন, ‘ ওদের কোন গ্যারান্টি থাকে না। কখন যে টাকা না দিয়েই চলে যায় তার কোন ঠিক নেই।’
আমরা তখন তাকে তেল দেয়া শুরু করলাম। আমাদের পূর্ব ইতিহাস জানালাম, কলেজ থেকে দেয়া চারিত্রিক সনদপত্র দেখালাম, পৃথিবীর কোন প্রান্তেই যে বহু খুঁজেও আমাদের মত ভদ্্র, শান্ত ও ভালো ছেলে পাওয়া যাবে না তা-ও বোঝালাম।
এক পর্যায়ে থাকতে না পেরে চপল বলল, ‘ দরকার হলে আপনি আমাদের মেইন মার্কশীট জমা রাখেন!’
কিন্তু শিকে ছিড়লো না। মেইন মার্কশীটের মর্ম ঐ পাষান কি করে বুঝবে?
খুঁজতে খুঁজতে একদিন এক হতাশ দুপুরে এসে পৌঁছলাম একটা একতলা বাড়ির সামনে। টু-লেট লেখা দেখে গেট ধাককাতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সুবহানাল্লাহ সাক্ষাৎ এক ডানাকাটা পরী! আমাদের বুকের ভেতরের ছোট্ট হার্টদুটো ততক্ষনে টগবগে দুখানা অ্যারাবিয়ান ঘোড়া হয়ে ছুটতে শুরু করেছে!
‘কাকে চাই?’
জানালাম, বাড়িওয়ালাকে চাই।
‘ দাঁড়ান, আব্বাকে ডেকে দিচ্ছি। ‘
খানিকপর আব্বাজান এলেন। এসেই উনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘ আপনারা কি ব্যাচেলর?’
ঘোড়া নয়, হার্ট ততক্ষনে জেট ইনজিন হয়ে উড়ছে আকাশে। কি শুভক্ষনেই না এসেছি এখানে। ঘরে এত সুন্দর মেয়ে, আর উনি খুঁজছেন কি ব্যাচেলর- আমরা দুজনে সবেগে উপরে নীচে মাথা দোলাতে লাগলাম। এক মূহুর্তের জন্যে মনে হলো, ছিড়ে না যায় আবার!
বাড়িওয়ালা বললেন, স্যরি, আমি ব্যাচেলরদের ভাড়া দেই না। ‘
জেট ইনজিন ক্র্যাশ করলো, দুজনেই আবার মাটিতে ফিরে এলাম।
আর কি! আবার খোঁজা শুরু হলো। এরকম কয়েকটা জায়গায় ব্যাচেলর হবার দায়ে ভাড়া না পেয়ে ঠিক করলাম আজই বাবা-মা কে পত্র লিখব, ‘তোমাদের ছেলের জন্যে একজন পুত্রবধূ এই মূহুর্তে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত শীঘ্রই পারো …..’
অবশেষে পেলাম! না, বাবা-মা র জন্যে পুত্রবধূ না, আমাদের দুই বন্ধুর জন্যে একটা মেস। রাজাবাজারে সেটা ভূপেন আংকেলের মেস। ছয়তলা বাড়ির পাঁচতলা মেস ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। বসে বসে ইনকামের এমন সুন্দর প্রসেস আর নাই। মনে মনে নিজের এইম ইন লাইফ ঠিক করে ফেললাম। ঢাকা শহরে একটা মেস বাড়ির মালিক হতেই হবে যে করেই হোক।
মেস পেতেই আরেক বন্ধু এসে হাজির হলো, তৌহিদ। তিনবন্ধু মিলে একগাদা জিনিসপত্র কিনে রুম ঠিক করলাম। সাজিয়ে- গুছিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখি, এক বউ ছাড়া যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসই সেখানে উপস্থিত।
রুম ছিল বটে একখান। ঘুঁপচি অন্ধকার। এটা কি রোদভরা দিন নাকি অমাবস্যার রাত রুমে বসে সেটা বোঝার কোন উপায়ই নেই।
মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে ঘড়িতে ছয়টা বাজে দেখে দ্্বিধায় পড়ে যেতাম। কোন ছয়? – ভোর না সন্ধ্যা?
বারান্দা আছে অবশ্য একটা, তবে সেখানে দাঁড়ালে আকাশ নয়, পাশের বাড়ির দেয়াল দেখা যেত। আর সেটা এতই কাছে, রোদ দূরে থাক, বৃষ্টি হলেও টের পেতাম না।
তেলাপোকার ছড়াছড়ি, মেসের অখাদ্য কুখাদ্য, এসব নিয়ে তবু ভালই ছিলাম। কোচিং শেষ করে অন্ধকার হাতড়ে হাতরে রুমে এসে শুয়ে পড়তাম।
মেঝের ওপর বিছানো তোষক, তার উপর চিটচিটে চাদর, সেখানেই শুয়ে হাতটাকে বালিশ বানিয়ে, সদ্য কেনা সিলিং ফ্যানটার ঘুরতে থাকা পাখাগুলোর দিকে তাকিয়ে, তিনজনেই, কি জানি কার কথা ভেবে হেঁড়ে গলায় একসঙ্গে গেয়ে উঠতাম, ‘ চন্দন পালংকে শুয়ে , একা একা কি হবে, জীবনে তোমায় যদি পেলাম না। ‘
————————
দৈনিক যুগান্তরের ফান ম্যাগাজিন বিচ্ছুর জন্যে লেখা, বহু আগে। সম্ভবত ছয়/সাত বছর আগে।
এটা কি জমা দিছিলি? মনে পরছে না।
যাই হোক পরপর দুটি বিচ্ছুর লেখা.......ব্লগ হিট না বিচ্ছু হিট বুঝতেছি না।
আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই
হ দিছলাম, বিচ্ছুতে এইটা মনে হয় আমার সেকেন্ড বা থার্ড লেখা!
www.tareqnurulhasan.com
"মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে ঘড়িতে ছয়টা বাজে দেখে দ্্বিধায় পড়ে যেতাম। কোন ছয়? - "
=))
পেরেক।তোর লেখাটা পড়ে একটা ঘটণা মনে পড়ে গেল.........লাস্ট ইয়ার এর ঘটনা.........।এক বন্ধু হল ছাড়ার পর বাসা খুজছে...তিন ঘণ্টা হেটে বাসা খোজার পর............শেষ বাসায় আসার পর যখন বাড়ীওয়ালা এক ই কথা শুধালো...... ও জ়িজ্ঞেস করল আঙ্কেল,আপ্নার কি মেয়ে আছে?আঙ্কেল ভুরু কুচকে বল্ল .........হ্যা..।.।।......কিন্তু কেন...............ও পৃথিবির সমস্ত রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে ও বল্ল,এক কাজ কইরেন আপনি আপনার মাইয়ারে ব্যাচেলরের কাছে বিয়ে না দিয়ে বিবাহিত কারও কাছে বিয়ে দিয়েন.........চাচার মেয়ে ঠিক অই সময় পাশে এসে দাড়ায়..।.।।............ও সালাম দিয়ে চলে আস্ল.........।।চাচা মিয়া অনেক্ষন মাথা নিচু করে ওর দিকে তাকিয়েছিল.....................
তারেক ভাই জিন্দাবাদ, পর পর তিনটা লিখা দেয়ার জন্য :boss: :salute:
দুঃখিত, কারেকশন... "তিনটা সুপাঠ্য লিখা দেয়ার জন্য"
তারেক
১.
তোরে যে আমি কি দিয়া পিটামু চিন্তা কইরা পাইতেছিনা। নতুন ২/১টা লেখা বের করার সময় হয়না তোর? হালার ভাই। তবে এখানে অনেকেই এই মজার লেখা গুলি পড়ে নাই। তাই দিতে থাক। পড়তে মজাই লাগে।
২.
তোর ব্যাচেলর সমস্যার সমাধান তো অনেক আগেই হইয়া গেছে। আমরা এখনো ফেইস করতেছি। লাস্টবার যখন বাসা বদল করি তখনো প্রায় মাস খানেক ঘুরতে হইছে। তবে অনেক মজার অভিজ্ঞতাও হইছে।
অনেক খোজার পরও দেখা গেলো ফ্যামিলি ছাড়া বাসা ভাড়া দেয় না,তখন আমি মাসুদরে বললাম চল এফডিসি থেইকা আব্বা আম্মা আর বউ ভাড়া কইরা ফেলি। ৩ দিন বাপ মা আর বউ'এর চরিত্রে অভিনয় করবে, বেশি টাকা দিতে হইবো না। আমার পরিচিত কয়েকজন ভালো আর্টিস্টও ছিলো। মাসুদ,শোয়েব আর রাসেল রাজি হইলো। কিন্তু সমস্যা হইলো বউটা কার হবে এই নিয়া। দেখা গেলো সবাই জামাই হইতে চাইতেছি। এই নিয়া বাদ-বিবাদের পর প্ল্যান বাতিল হইলো।
৩.
আরেকবার বাসা ভাড়া নিতে যাওয়ার পর বাড়িওয়ালা যথারীতি জিগাইলো 'ব্যাচেলর'?
মাসুদ বলে, 'জি না, ফ্যামিলি'।
'ফ্যামিলি তো বাকি লোকজন কই'?
'বাকি লোকজন কেউ নাই। আমরা চারজনেই ফ্যামিলি'।
বাড়িওয়ালা 'ছি!' বইলা দরজা বন্ধ কইরা দিলো।
‘বাকি লোকজন কেউ নাই। আমরা চারজনেই ফ্যামিলি’।
=)) =)) =)) =))
মামু মনে পড়ে সেই এইচএসসির পর আমাগো মেস লাইফের কথা.........
"বাড়িওয়ালা বললেন, স্যরি, আমি ব্যাচেলরদের ভাড়া দেই না। ‘
জেট ইনজিন ক্র্যাশ করলো, দুজনেই আবার মাটিতে ফিরে এলাম।"
😀
ভূক্তভোগী ছাড়া এই কষ্ট আসলেই কেউ বুঝবেনা...।
তারেক,
লেখাটি খুবই সুন্দর এবং মজার হয়েছে...।
হুমমমমম...।। বিরাট প্রবলেম, ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হওয়ার পর মেস লাইফ অনেক ঝামেলার।
আমাকে অবশ্য সেই অর্থে এইটা ফেস করতে হয় নাই, বাচছি।
তারেক ভাই, পুরোনো অনেক ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমিও ফরেনার ছিলাম কিনা, তখন ঢাকা একদম ভালো লাগত না। মনে হইত কি হবে এইভাবে কষ্ট কইরা, যাইগা মমুসিং। আমারে ওইখানেই ভালো মানায়।
ইশ, কাউকেই জবাব দেয়া হয় নাই দেখা যাচ্ছে। আমি আসলে অপেক্ষা করছিলাম, এই সাইটের জবাবের অপশানটা ঠিক হলে পরে কমেন্ট করবো।
পড়ার জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ।
এই লেখাটার উপাদান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া বেশিরভাগ, আর কিছু কিছু কামরুলের গল্প থেকে মেরে দেয়া। :grr:
কামরুল মাইন্ড খাইস না। 😛
www.tareqnurulhasan.com