আমার শহরে…

রীতিমতন কাকভেজা হয়ে গেছি, পেছন থেকে মামা তাড়া দিচ্ছিল তাড়াতাড়ি ঢুকে যেতে ঘরে, তবু দরজার সামনে পৌঁছে আনমনে দাঁড়িয়ে গেলাম হঠাৎ।
বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে অবিরল, মাথা মৃদু ঝাঁকিয়ে খানিকটা বৃষ্টি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি আমি, কিছু ক্লান্তিও ঝরে পড়ে সাথে। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে অবশেষে বাসার দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ি ভেতরে, বহুবার দেখা সিনেমার ছবিদের মতন পরিচিত ঘরদোর সব।
ডান হাতের ভারি ব্যাগটা বাহুল্যের মত জড়িয়ে ছিল যেন এতক্ষণ, সেটা নামিয়ে রেখে ধীর পায়ে আম্মার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াই আমি।
কেউ একজন এসে ইতিমধ্যেই বলে গেছে যে আমি এসেছি, আম্মা তাই তাকিয়েই ছিল এদিকে। আমি এসেছি বলে জ্বলজ্বল করছে তার চোখ দুটা। মুখে হাসির মত একটা ভঙ্গি করা, আমি দেখতে পাই তবু অনেক যন্ত্রণা মিশে আছে তাতে।
তোমার ছেলে ফিরে এসেছে আম্মা। কেউ বলে না, তবু মনে মনে শুনতে পাই আমি বলছি যেন ফিসফিসিয়ে, ফিরে এসেছে তোমার ছেলে, আম্মা।
গত কুড়ি বছর ধরে এভাবে বার বার ফিরে আসা আম্মার কাছে। কখনো কিছু মাসের বিরতিতে, কখনো কিছু দিনের, আর ইদানীং সেটা গড়িয়েছে কিছু বছরে। এই ফিরে আসার অনুভূতি তবু কখনও পুরনো হয় না।

হাসিমুখ থেকেই আচমকা কান্না বেরিয়ে আসে তার। আমি পাশে বসে আম্মার বাম হাত আমার মুঠোতে পুরে নিই, ডান হাত বাড়িয়ে আমার মুখ ছোঁয়ার চেষ্টা করে আম্মা, কিন্তু ভুলে গেছে যে সে হাতে অত শক্তি অবশিষ্ট নেই তার আর। আমি নিজেই হাত বাড়িয়ে পড়ে যেতে থাকা ডান হাতটাও ধরে ফেলি, নিয়ে আমার গালে চেপে ধরি জোরে।
হাসি আর কান্নায় মাখামাখি আধো আধো বোলে কী যেন বলে ওঠে আম্মা, আমি বুক ভরে আমার শৈশবের ঘ্রাণ নিতে থাকি তার হাত থেকে, আমার সেসব কথা আর শোনা হয় না।
*
কুমিল্লার রাস্তাগুলো ছোট হয়ে গেছে যেন, অথবা আমার দেখার চোখ হয়তো বুড়ো হয়ে গেছে।
রাস্তায় তাকিয়ে জিলা স্কুলের সাদা ইউনিফর্ম পরা আমাকে দেখতে পাই এখানে ওখানে, খুলে যাওয়া জুতা এক হাতে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরছি যেন আমি। আবার দুই হাত ছেড়ে দিয়ে সাইকেল চালাতে থাকা আমাকেও দেখতে পেলাম কয়েকবার, আনন্দে হই হই করছি মুখ দিয়ে।

কান্দিরপাড়ে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে আকাশ দেখি, পুরনো আকাশ দেখে মন ভাল লাগে। এ শহরে হঠাৎ করে কোথা থেকে এত মানুষ এলো কে জানে। এসেছ, থাকো, কিন্তু তোমরা সবাই একে ভালো বাসো তো? কে জানে!
এ পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ দেখি কেবল। রাস্তা পার হওয়া দরকার, ও পাশ থেকে রিকশা নিতে হবে, দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি, সামনের লোকেরা সরে গেলেই রাস্তা পার হবো। মানুষ দেখতে দেখতে এক সময় টের পাই, মানুষের সারি শেষ হবার নয়, আমাকে এরা জায়গা দিবে না আসলে আমার শহরে। টের পেতেই কেমন অস্থির হয়ে উঠি, বিহ্বল হয়ে উঠি, তারপরে হঠাৎই কাঁধ ঝাঁকিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি, ভিড় ঠেলে ঠেলে পার হয়ে যাই রাস্তা, পার হয়ে মন ভাল লাগে, আহা, আমার শহর!

রিকশায় যেতে যেতে দীঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বাদামওয়ালার সাথে চোখাচোখি হলে আমরা দুজনেই চমকে উঠি। বাদাম মাপবার নিক্তি নড়ে ওঠে তার, আমাকে চিনবার চেষ্টায় চোখ ছোট করেছে দেখে আমি চেনা মানুষের মত হাসি একটু। চিনেছি আমি আমার শৈশবের ‘মাই এইম ইন লাইফ’-কে! পেছন ফিরে দেখি সে হাসি ফিরে এসেছে আমার কাছে, বড় ভাল লাগে তখন। আহা, আমার শহর।
*
বহুদিন গরম আর বৃষ্টি এ দুটোকে এক সাথে পাই না। অনভ্যস্ত গরমে অস্থির লাগে যখন, বৃষ্টির ছোঁয়া এসে শান্তি দিয়ে যায় অবলীলায়।
মাথার ওপরে আহ্নিক গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ঘুরতে থাকে ফ্যান, দোতলার জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি, কাঁঠাল গাছের ডালে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বিরক্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে একটা চড়ুই। তুমি কে হে? আগে দেখিনি তো?- আমাকে জিজ্ঞেস করলো সে ব্যাটা। জবাবে শুধু একটু হাসলাম কেবল আমি, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চড়ুইয়ের কাছ থেকে অল্প কিছু ভাগ নিতে চাইলাম বৃষ্টির ফোঁটার, বিরক্ত মুখ করেই অভিশাপ দিতে দিতে উড়ে চলে গেলো সে।

চড়ুই জানে না, আমাদের ডানায় মেখে থাকে কত কত মায়া আর স্মৃতির ওজন, বারে বারে তারাই তো ফিরিয়ে নিয়ে আসে আমাকে এইখানে, আম্মার কাছে, আমার শহরে।

৩,৮৩৫ বার দেখা হয়েছে

৩১ টি মন্তব্য : “আমার শহরে…”

  1. সাদাত (৯১-৯৭)

    অসাধারণ। দিন, মাস, বছর ঘুরে আর মায়ের কাছে ফেরা হয়না আমার এবং আরও অনেকের, ফেরা হবেও না আর কোনোদিন। সৃতির শহর কিংবা গ্রামের গন্ধ মেখে নিতে ছুটে যাই মাঝে মাঝে। প্রতিবারে সেই গন্ধ পরিবর্তন হয়, ভেজাল ঢুকে গেছে শৈশবের গন্ধেও। বৃষ্টির ফোঁটা মুঠোয় পুরে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা মানুষও কমে গেছে অনেকই.........

    জবাব দিন
  2. রেজা শাওন (০১-০৭)

    সবার নিজের শহরের একটা ছবি থাকে। আমার যে ছবিটা আছে, সেটার সাথে আপনার ছবির হয়তো চিলতে খানিক পার্থক্য। জয়পুরহাট দেখে গেলাম আপনার লেখায়। কী অসাধারণ লেখেন ভাই আপনি! (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    তোমার লেখা সিসিবিতে আগে পড়েছি বলে মনে পড়েনা, ভাইয়া! তাই ভাবছিলাম, সুস্বাগতম টম কিছু লিখে তোমায় ওয়েলকাম করি। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার বাড়ি ইনভেইড করতে গিয়ে দেখি, তোমার কাছে আমি নেহাৎ শিশু এই ব্লগে। পুরান পাপী না বলে প্রাচীনতম পাপী বললেও তোমায় কম বলা হবে যে!

    তোমার লেখায় সাদামাটা যে চিত্রছায়া আঁকা সেটি যেন আমারই লেখা! আরো অনেক অনেক অনেক লেখা পড়তে চাই তোমার থেকে, ভাইয়া!

    জবাব দিন
    • তারেক (৯৪ - ০০)

      ধন্যবাদ সাবিনা আপা, আপনার বেশ কিছু লেখা পড়েছি, অনেক ভাল লেগেছে, সহজাত লেখার ক্ষমতা আপনার।
      হা হা হা, পুরানো পাপী বলতে পারেন আমাকে, আপাতত ডুব-সাঁতারু হয়ে গেছি, এই সিসিবি-ও আসলে আমারই শহর, তাই মাঝে মাঝে ভেসে উঠি।
      ভাল থাকবেন অনেক।


      www.tareqnurulhasan.com

      জবাব দিন
  4. জিহাদ (৯৯-০৫)

    অলস ভঙ্গিতে মাউস স্ক্রুল করতে করতে আপনার নাম দেখে একটু ভিড়মি খেলাম। চোখে ঠিকঠাক দেখছিতো? ক্লিক করে ভেতরে ঢুকে আমার চোখ এবং আপনার ডানা - দুটোই কর্মক্ষম আছে জেনে যারপরনাই আনন্দিত হলাম।

    আমার ডানা বোধহয় বেশি ভারী। অতদূর উড়ে দূরে কোথাও তাই আর চলে যাওয়া হয়ে উঠছেনা।

    আবার কয় বছর পরে আপনার দেখা পাবো তার কোন ঠিকঠিকানা নাই। ততদিন ভালো থাকেন, সুখে থাকেন, আর নিজের ডানার যত্ন নিয়েন 😀


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  5. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    তারেক ভাই, সিসিবিতে স্বাগতম। 😛

    বাবার সরকারী চাকুরির সুবাদে কয়েকবারই শহর বদলাতে হয়েছে। ছোটবেলায় কয়েকবার মন ভেঙ্গেছে...
    এ কারণে আমার নিজের কোন শহর নেই।
    ব্যাপারটা কষ্টের, আবার একদিক দিয়ে মন্দও না।
    কোন পিছুটানও নেই...

    তারেক ভাই, আপনি এত কম লেখেন কেন? 🙁


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  6. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "আমি এসেছি বলে জ্বলজ্বল করছে তার চোখ দুটা" - এ অনুভূতিটা আমিও এখনো পাই, যখন মায়ের কাছে যাই।
    লেখায় ব্যক্ত আবেগ অনুভূতি সুপরিচিত, সহজবোধ্য, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।

    জবাব দিন
  7. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    অনেকদিন পরে তোমার লেখা পড়লাম। একই রকম অদ্ভুত এখনো।
    সেদিন "কাঠের সেনাপতি" তে তোমার অটোগ্রাফটা দেখছিলাম- "ভাই, একদিন আমরা একসাথে সারা নীলক্ষেত চষে বেড়াবো"।

    হায়, আমাদের জীবন। আর আমাদের স্বপ্ন।


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  8. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    এই লেখাটা যখন পড়া শুরু করি তখন আমার মন মেজাজ কিছুটা বিক্ষিপ্ত ছিল।
    অথচ শেষ হওয়ার বেলায় এক ধরণের স্নিগ্ধ শান্তিময় আবেশ পেলাম। আমার মাথার ভিতরে একটা শহর আছে। শহর না বলে বরং উপশহর মফঃস্বল বলা যায়। বাস্তব পৃথিবীতে কালের গর্ভে বিললিন হয়েছে হয়তো বছর ১৫ কিংবা তারও আগে। সেই মফঃস্বলময় ছোট ছোট চিত্র দেখে গেলাম আপনার লেখা পড়ে।

    সালাম ভাইয়া।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।