অসুখের দিনলিপি-

ঘাড়ের ব্যাথায় কাতর হয়ে দু’দিন ধরে বাসায় শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছি। একদিক দিয়ে ভালই হলো, অনেকদিন ছুটি নেয়া হচ্ছিলো না জগৎ-সংসার থেকে, মহামতি ঘাড়-ব্যথা আমাকে তাই বাধ্যতামূলক ছুটির ব্যবস্থা করে দিলো!
ছুটির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে পুরো দমে ব্লগিং করে চলছি।

কলেজে অসুখ বিসুখ বাধিয়ে ফেলাটা দস্তুরমতন সুখকর ছিলো। বেশ কয়েকদিনের জন্যে পিটি-প্যারেড-গেমস থেকে মুক্তি, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?
পক্স বাধিয়ে একবার এইরকম লম্বা আরামে ছিলাম, একবার না খেয়ে খেয়ে হিমোগ্লোবিন কমিয়ে ফেলেছিলাম অনেক, শেষে ড্রাকুলা হয়ে ক্লাসমেটদের কাছ থেকে রক্ত খেয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম।

একদিনের কত্থা মনে আছে, কোন এক গরমের সকাল। পিটি শেষে গোসল করে রুমে ফিরেছি, আমার সিট ছিলো জানালার পাশে। রাতে জানলা লাগিয়ে ঘুমিয়েছিলাম, এখন ব্রেকফাস্টে যাবার তাড়াহুড়োয় খুলতে গিয়ে দেখি জানলাটা এঁটে বসে আছে টাইট হয়ে, কোনমতেই খুলছে না। রাগের মাথায় কাঁচের উপর দিলাম এক ঘুষি, জানালা খুললো, সেই সাথে কাঁচ গেলো ভেঙে, আর অবধারিতভাবে আমার হাতও কেটে গেলো! আমার রুমমেটরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে (একজন এই ব্লগেই উপস্থিত, তানভীর )গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে, এক্ষুণি হাসপাতালে দৌড়াতে হবে, আমি তখনো টাওয়েল পড়া। কোনমতে হাফপ্যান্ট গলিয়ে হাত চেপে ধরে দে ছুট! সোজা হাসপাতালে!

হাসপাতালে তখন ছিলেন সঞ্জুদা। ভাল নাম সঞ্জয়। উনি আমাকে দেখে দিলেন এক চিৎকার। আশ্চর্যভাবে উনি কেন জানি সারাক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ করতেন। আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের কেবিনে। ডেটল লাগিয়ে রক্ত মুছছেন, আমি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেই উনি আমার চেয়েও জোরে চেচিয়ে ওঠেন ‘আল্লা আল্লা আল্লা’ করে, আমি যাই নার্ভাস হয়ে!

রক্ত থামছে না দেখে উনি সিদ্ধান্ত নিলেন, স্টিচ দিতে হবে। বাঁকানো একটা ভয়ংকর দর্শন সুঁই নিয়ে হাজির, সাথে আজিব কিসিমের সুতো। হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র মুহী ভাই, আমার চিৎকার শুনে তিনিও ততক্ষণে চলে এসেছেন।

আমি ভাবলাম, সেলাই করবে, নিশ্চয়ই আগে এনেস্থেশিয়া দিয়ে নিবে। কিন্তু কীয়ের কি, সঞ্জুদা মুহী ভাইরে বললেন, ‘তারেকের হাত চাইপা ধরো!’ আমার কাছে উনারে মনে হলো কুরবানীর হুজুর! ছুরি হাতে উদ্যত যেন! সেই সাথে উনার মুখের সার্বক্ষণিক আল্লা আল্লা কুরবানীর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে বাজা শুরু করলো।

তো মুহী ভাই শক্ত করে হাত চেপে ধরলেন। সঞ্জুদা সেই বিকটদর্শন সুঁই নিয়ে আমার হাতের চামড়ায় দিলেন খোঁচা! ব্যথায় আমি দিলাম চিৎকার, আর উনি আমার চেয়েও জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন, আল্লা আল্লা আল্লা! কি মুশকিল! জুৎমতন চেঁচাতেও পারি না!

দ্বিতীয় বার সুঁই ফোঁটাতে গিয়ে উনি বলেন, ‘মিয়া, তোমার চামড়া এতো শক্ত ক্যান!’ আমি তো হাঁ। বলে কি এই লোক!
উনি বহু কসরৎ করে সেই শক্ত চামড়া ভেদ করে সুঁই ফোটালেন, তারপরেই দিলেন জিভে কামড়। বলেন, ‘সর্বনাশ!’ আমি ভয়ার্ত চোখে ব্যথা ভুলে তার দিকে তাকালাম, ‘কি হইছে?’ উনি জিহবা কামড়ানো অবস্থাতেই বললেন, ‘ ভুল হয়া গ্যাছে, ভুল জায়গায় ফুটা করে ফেলেছি, বের করে আবার নতুন করে করতে হবে!’

আমি তখন পাথর! কয় কি! রাগে দুঃখে বাংলা সিনেমার জসীমের মতন এক চিৎকার দিলাম, ‘ইয়াআআআআ সঞ্জুদা! ডিশুম!’
নাহ, ডিশুমটা বাস্তবে না। কিন্তু মুহী ভাই আমার হাত না ধরে থাকলে বাস্তবেও হয়ে যেত, কোন সন্দেহ নাই!

শেষমেষ উনি তিনটা সেলাই দিয়ে থেমেছিলেন।
এই এখন এই লেখা টাইপ করতে করতে বার বার চোখ চলে যাচ্ছে হাতের কাঁটা দাগটার উপরে, আর সেদিনের কথা মনে করে কেবলই হেসে ফেলছি!

২,০৮৮ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “অসুখের দিনলিপি-”

  1. ভাই, ঈমানে কইতাসি... হয় আমার মাথায় সমস্যা,না হয় আপনার মাথায়।

    আপনের অসুখের কাহিনি পইড়া হাসতেই আছি... হাসতেই আছি... আমার নন ক্যাডেট রুমমেট হা করে আমার দিকে তাকায়া আসে।কন যায়না,যে কোন টাইমে ডাক্তার ডাইকা আনতে পারে মাথার সমস্যা ভেবে। 😆

    জবাব দিন
  2. আহমেদ,
    এইটা ক্লাশ নাইনের কাহিনি সম্ভবত। ২০ নাম্বার রুমে থাকতাম আমি আর তানভীর।

    ইশতিয়াক,
    মমতাজ ভাই! আহা, কি সুন্দর সুর করে জিজ্ঞেস করতো, ভাত খাইছোওওও, না খাবাআআ!

    জিহাদ,
    তুমি তো মির্জাপুরের জানি, পাবনা গেলা কবে?

    জবাব দিন
  3. আর কি কইতাম...ইন্টার হাউস বাস্কেটবলে পড়ে গিয়ে কনুই ছিলে গেছিল...
    তখন যে শিক্ষা পাইছিলাম...এরপর আর সঞ্জয়দার কাছেও ঘেঁষতাম না...
    কিন্তু রি-ইউনিয়নে যখন হাস্পাতালে গেলাম সঞ্জয়দা দেখি আমার অসুখের কথা জিজ্ঞেস করে, আমি যে আগের যায়গা ছেড়ে চলে আসছি তাও জানে। আমি অবাক হয়ে যাই, আসলে এই মানুষগুলোকে আমরা ভুলে গেলেও তারা ভুলে যায় না।
    তারেক ভাই,
    আপনার লেখা পইড়া আমিও হাসতেই আছি, হাসতেই আছি... 😀

    জবাব দিন
  4. jedin tareq k CMH e blood deya holo r por din class faki diye hospital e bose silam...hotat dekhi taher staff eshe hajir...ami to vablam nischit mega issue hoye gesi...kinto oidin kono karone tar mood valo silo...se amar sathe khajure alap jure dilo....tareq r sickness niye tokhn college e besh hoichoi pore gesilo...so jokhn taher staff shunlo j ami ore blood disi se khub agroho niye amare kas theke tareq r khoj khobor neya suro korlo...ami shobkiso bolar por se ak oitihashik dialog diye boslo...bollo "momtaz vai and sonjoy da re sakhhi rekhe koitesi, ai chele re ami r kokhono konorokom punishment dimu na"....no wonder, taher staff sei promise rakhe nai...obosso keno rakhe nai seta ak torker bisoy...sei ghotona na hoi tareq r kas thekei shuna jak..:-))

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।