অশনি সংকেত

আমি একদিন উপলব্ধি করলাম, আমি এমন একটি দেশের নাগরিক যে দেশে প্রতিনিয়ত কোন না কোন সংকট লেগেই থাকে। সেটি হোক প্রাকৃতিক বা নাগরিক সৃষ্ট, প্রতিবেশী সৃষ্ট কিংবা বিশ্বের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের বানানো – ঘটনা যাই হোক না কেন, আমরা বার বার সংকটে ঘুরপাক খাই। একেবারে ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ বলা যায়। হয়তো সব দেশই সংকটে ঘুরপাক খায়। অনেক দেশ আছে আমাদের চেয়ে আরো অনেক বেশি সংকটময়। কিন্তু বাংলাদেশটা যে আমার দেশ তাই আমার গায়ে লাগে খুব। আর লাগে অন্তরে। এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, সে খুব সচেতনভাবে বাংলাদেশের সংবাদপত্র এড়িয়ে চলে। ব্যাপারটা আমার ভালও লেগেছিল। সত্যিই তো, পত্রিকা না পড়লে কি হয়। কিছুই হয় না। আমিও বাদ দিলাম। তারপর দুদিন যেতে না যেতেই বুঝলাম, কদিন আগডুম-বাগডুম খাবার খেয়ে পার করলে যেমন ডাল/ঝোল দিয়ে ভাতের একটা খিধে পায় তেমন পত্রিকা না পড়লে তেমন এক অনুভূতি হতে শুরু করে। বুঝলাম আমাকে দিয়ে এই কাজটি সহজে হবে না। আবার একদিন সেই বন্ধু বললো, সে হলো মহা-আন্তর্জাতিক, রাষ্ট্রের ধ্যান-ধারণা বা সীমানা দিয়ে তার জীবন আবদ্ধ নয়। শুনেই কথাটা ব্যাপক অভিনব লেগেছিল – আরে আমার তো এমন কথা কোনদিন মাথায়ই আসেনি, চিন্তা তো অনেক পরের কথা। পরে দেখি সে প্রত্যেক সামার ঠিকই কড়ায়-গণ্ডায় ঢাকায় কাটিয়ে আসে। মনে মনে হাসলাম। ভালই। এমনটাই হয়।

আমাদের দেশটি কিন্তু বেশ অদ্ভুত। দুর্নীতির ধারণা সূচকে যেমন তলানি তেমনি আবার সুখের ধারণা সূচকে দোর্দণ্ডপ্রতাপে প্রথমসারিতে। অবশ্য দুর্নীতির ধারণাসূচক সারাদেশের সব মানুষ দুর্নীতিবাজ তা অর্থ করে না, শুধু প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং সাথে সম্পৃক্ত মানুষের ক্ষমতার অপব্যবহারকে বুঝায় কিন্তু সুখের ধারণা সূচকে দেশের জনগণের জীবনের পরিতৃপ্তিকে বুঝায়। অবশ্য ওয়েবারিয়ান মডেলে, যে যৌক্তিক রাষ্ট্রের কাঠামোর কথা চিন্তা করা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে কাঠামোতে ভাবা হয়, এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে রাষ্ট্রের ও জনগণের যে যৌক্তিক এ্যালাইনমেন্ট এবং সম্পর্ক, তার বিপরীতে যদি মানুষের জীবনকে ডিসকারসিভ ফরম্যাটে দেখা হয় তাহলে কেমন যেন দুর্নীতি বা সুখের সূচকগুলো খেলো হয়ে যায়। মানে আইডিয়ালিস্টিক জীবন আর প্রাত্যহিক জীবন – এই দুইটা যদি পাশাপাশি তুলনা করা হয় তাহলে আইডিয়ালিষ্টিক জীবন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, সংসদ এবং গণতন্ত্র কার্যকর হবে, পুলিশ মানুষের বন্ধু হবে, ব্লাহ ব্লাহ হবে ওয়েবারিয়ান মডেল। আর হাড়িতে ভাত নাই; পেটে ব্যথা; সদু চাচা যে ডালপুরি খায় সেইটার ভিতরে ডালের পরিবর্তে আলু বেশি; সদু চাচারে দেখলে আমি সিগারেট পিছনে লুকাই; রাইতে ঘুম আসে না; ঘরে মশা আর জানালা দিয়ে ঢোকে দুর্গন্ধ; শওকত মেম্বারের বাড়ি গেলে মাঝে মাঝে এক কাপ চা জোটে কিন্তু সেইটা নামেই চা আসলে চিনি আর গরম পানির শরবত; জুতার ভেতর প্রজাপতি, সদু চাচার আবার আমার ছোট বোনের দিকে চোখ লাগায় – এটা হলো ডিসকারসিভ ফরম্যাট। আমাদের আশেপাশে মানে সাউথ এশিয়ায় নাকি ভুটানে দুর্নীতি কম, সুখী মানুষও বেশি। ভুটানে জিএনপি নেই, আছে GNH – গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস। কি মজার‍! তাই না? কিন্তু কথা হলো, সুখ আসলে একটা মিথ। তাইলে? উত্তর জানিনা।

গরীবের বউ সবার ভাবী!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে তখন সবে চাকরি করি। এর মধ্যেই সেটা গত দশকের কথা হয়ে গেলো। লাঞ্চ টাইমে বাইরে খেতে যাই। এলাকার নাম গুলশান। তিন চারজন কলিগ একসাথে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন খাবার দোকানে এক একদিন খেতাম। ঘুরে ফিরে প্রায় সব জায়গায় একই মানুষের সাথে দেখা হয়। কারণ অফিসগুলো নির্দিষ্ট আর খাবার দোকানও আনুপাতিক হারে বাড়ে না। আমাদের অফিসে তেমন কোন ড্রেস কোড ছিলো না। অবশ্য তাই বলে কাউকে কোনদিন লুঙ্গি পরে আসতে দেখিনি। আচ্ছা, আমরা কেন লুঙ্গি পরি না? কেন এই জিনিসটারে জাতীয়ভাবে খ্যাত পোশাক বানানো হলো? আমি নিজেও পরি না, বাসায়ও না। কিন্তু আমার এক আমেরিকান বড়ভাই-কাম-গাইড-কাম-মেনটোর আছে, নাম ডেভিড পিটারসন। ডার্থমাউথ কলেজের লিঙ্গুইস্টিকসের প্রফেসর। সে কিন্তু বাংলাদেশে এসেই লুঙ্গিটারে ঠিকই পিক করে নিয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল – রাব্বী, লুঙ্গি হলো পৃথিবীর মোস্ট কমফোর্টেবল মেইল লোয়ার আউটার ওয়্যার। ডেভিড থাকে বোস্টনে, সামারে নাকি সে লুঙ্গি পরে বাসায়। নিয়মিত পরে কিনা জানিনা তবে পরে। বাংলাদেশে আসলে অবশ্যই পরে। যাই হোক, আমার অফিসে একটা ক্যাজুয়াল ব্যাপার ছিলো, অনেকেই ফতুয়া-পাঞ্জাবি-জিন্স পড়তো। মেয়ে এবং ছেলে নির্বিশেষে।

মূলকথা আমাদের পোশাকে তেমন ঠাটবাট ছিল না, বরং স্বাচ্ছন্দ্যের প্রাধান্য ছিলো (কারণ মনে হয় বেতন কম ছিল আর ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি হবার কারণে কর্পোরেট কালচারের চাপ কম ছিল, কিংবা খ্যাত লোকজনের আধিক্য ছিল। হবে কিছু একটা)। কিন্তু অন্য অফিসের যাদের সাথে নিয়মিত দেখা হতো তারা খুব কেতাদুরস্ত ছিল। তখন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর এবং তার হেয়ার ড্রেসার হাবিব সাহেবের বদৌলতে চুলের জেল জিনিসটা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে ফেলেছে। আশেপাশে অনেককেই দেখতাম সেইরকম ভুমভাম। তাদের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ইটে চাঁপা ঘাস’। ফিটফাট, ছেলেদের চুলে জেল, একেবারে ইয়ো; মেয়েদের চুলে নানারকম কাট – নয়তো রঙ,  হাঁটলে টকাস টকাস শব্দ। তো আমরা ঘুরে ঘুরে সেই একই ‘ইটে চাঁপা ঘাস’ দেখি। শুধু ঘাস দেখেছি তা জোর গলায় বলা যাবে না, ঘাসিনী দেখলে যে চোখ বন্ধ করে রাখতাম তা কিন্তু নয় (ঘাসের তো স্ত্রীলিঙ্গ থাকার কথা না, তাইনা।)। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গেল যে সন্ধ্যায় বাসায় না ফিরে কলিগরা মিলে ‘টাইম আউটে’ বসে আড্ডা পেটাই। বাসায় ফিরি নিয়মিত রাত করে। এরকম করতে করতে আমি যখন প্রায় ‘আউট’ হবার পর্যায়ে, তখন আমার কলিগ কাম বন্ধু রুবায়েত আর মিল্টন একদিন জানালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে এবং বিয়ামের পেটের ভিতর একটি স্পেশালাইজড কলেজ হচ্ছে এবং নাম – সিভিল সার্ভিস কলেজ। তাদের প্রথম ইনটেক নিবে। মূলত: ব্যুরোক্র্যাটদের জন্য, আর সামান্য কিছু ছাত্র বাইরে থেকে। যাইহোক, কেমনে কেমনে চামে এডমিশন হয়ে গেলো। সব ডাকসাইটে ফ্যাকাল্টি মেম্বারস। ড. ফখরুদ্দিন আহমদ, ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম, ড. আকবর আলী খান, প্রফেসর মোহাব্বত খান থেকে শুরু করে সব হাই প্রোফাইল লোকজন। নাম বলতেও গলা শুকায় যায় আরকি।

ধুমধাম ওরিয়েন্টেশনের পর শুরু হলো ক্লাস। ক্লাসমেট সব উরাধুরা – হয় ‘উপ’ নাহলে ‘সহকারী’ মানে উপ-সচিব আর সহকারী জজ। সেইরকম ভুমভাম ক্লাস। এদের মধ্যে আমরা তিন নাদান শিশু। শুরু হলো আমার মাস্টারস অব পাবলিক এ্যাডমিনিসট্রেশন ইন গর্ভানেন্স এন্ড পাবলিক পলিসি। একেবারে গালভরা নাম। সপ্তাহে তিন/চারটি কোর্সের ক্লাস। দুটি করে এক একটি কোর্সের ক্লাস, মোট ছয়/আটটি ক্লাস। সারাদিন অফিস, তারপর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ক্লাস। একদম চিপায় পড়ে গেলাম। ক্লাস যে টপিকে শুরু হোক না কেন – শেষ হয় ডিসি অফিসের মিটিঙের মতো করে। হাইরারকি মেনে ক্লাসে কথা বলে লোকজন। প্রথমে জয়েন্ট সেক্রেটারি, তারপর ডেপুটি সেক্রেটারি, এরপর সিনিয়র এ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি, এবং সবশেষে এ্যাসিসটান্ট সেক্রেটারি। সেক্রেটারি দলের কাছে আবার জজ দল পাত্তা পায় না। আমার জজদের জন্য দুঃখই লাগতো। খালি মোহাব্বত স্যারের ক্লাসে কারো কোন চুদুরবুদুর চলতো না। উনি খ্যাপাতে ধরনের মানুষ, কোন ডিসি-জজ পোঁছেন না। ক্লাসের তাবৎ ডিসি-জজরা আমাদের ভাই হয়ে গেলেন দুই সপ্তাহের মধ্যে। নরসিংদীর এডিসি রেভিনিউ সাহেব(নাম মনে নাই এখন)খাতির করে একদম ভাই-বেরাদার বানিয়ে ফেললেন। কারণ পরে বুঝলাম, নিয়মিত ক্লাসে আসতে পারবেন না তাই ক্লাসনোট এবং চোথা যাতে পান তার ফন্দিফিকির। নরসিংদী যাবার দাওয়াত দিয়ে বসলেন। কিন্তু যাওয়া হয় নাই। তো সেখানে কোর্সের একটি ছিল ‘পোর্ভাটি এলিভিয়েশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’, তার শিক্ষক ছিলেন ড. শাহাদত হোসেন, ডেপুটি সেক্রেটারি, পোস্টিং মহামান্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয়। সরাসরি বঙ্গভবন থেকে এসে ক্লাস নেন উনি, এই সাংঘাতিক ঘটনায় নিজেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত মনে করা শুরু করলাম। তো শাহদাত স্যার (শিক্ষক অর্থে স্যার) যাই পড়ান না কেন, হোক সেটি পোর্ভাটি মেজারমেন্ট টেকনিকস, জিডিপি/জিএনপি, জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট, পিআরএসপি, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস, হাংগার এন্ড ফেমিন থেকে শুরু করে নেপচুন, প্লুটো যাই পড়াক, শেষ করতেন ‘গরীবের বউ সবার ভাবী’ বলে। আমরাও কোর্সের নাম পালটে ফেললাম ‘গরীবের বউ সবার ভাবী’। গরীবের ঘরে নাকি সুন্দরী বউ থাকতে নাই। স্যার আসলে কথাটা বাংলাদেশ অর্থে বোঝাতেন। বলতেন, দ্যাখেন না আমেরিকা, ব্রিটেন, চায়না, ইন্ডিয়া, সবাই বাংলাদেশে ফুচকি মারে। কথাটা আমার মনে গেঁথে আছে সেই থেকে।যাইহোক, প্রথম সেমিস্টার শেষ হবার আগেই আমি ড্রপ আউট হয়ে গেলাম সেই মাস্টারস প্রোগাম থেকে। আমি শিক্ষিত হতে পারলাম না, তাই আমার জীবনের গতিপ্রকৃতি পাল্টে গেল ‘গর্ভানেন্স এন্ড পাবলিক পলিসি’ থেকে ‘সেলফ গর্ভানেন্স এন্ড প্রাইভেট পলিসিতে’ মনোনিবেশ করলাম। কাহাতক আর বোরিং ক্লাস করা যায়! যাইহোক, সিলেটের কোন একটি জায়গার বেশ কিছু একর জায়গা নাকি বিএসএফ ভারতীয় চাষি নিয়ে দখল করে নিয়েছে এবং ফেরত দিবে না কারণ সেই মাটির নিচে আছে ইউরেনিয়াম। খবরটি জেনেছি অসমর্থিত সূত্র থেকে। কেউ কিছু জানেন নাকি? সত্যতা আছে?

মাইক্রোফাইনান্সের এখন গ্রহণের কাল

বাংলাদেশের নাম এতদিন যে দুটি বড়ো কারণে পজিটিভ অর্থে ধ্বনিত হয়ে আসছে বা হয় তাদের উত্থান প্রায় সমসাময়িক। মাইক্রোফাইনান্স এবং ক্রিকেট। ক্রিকেটে অনেকের নাম। কিন্তু মাইক্রোফাইনান্সে অনেক মানুষ থাকলেও শুধুই ড. মুহম্মদ ইউনুসের নাম। পক্ষ-বিপক্ষ কোনটাই না নিয়েও জানার জন্য, জ্ঞানের জন্য মাইক্রোফাইনান্স নিয়ে কথা তো বলা যাইতে পারে, নাকি? আমি নিজে ড. ইউনুসের কথা সামনাসামনি শোনার সুযোগ পেয়েছি একবার। ড. ইউনুসকে মনে হয়েছে ক্যারিসম্যাটিক এবং স্মার্ট একজন ব্যক্তি। আমি যদি বলি উনি আমার দেখা গণ্ডিতে বাংলাদেশি মানুষদের মাঝে আন্তর্জাতিক মহলে সবথেকে স্মার্ট, তাহলে আমার সীমিত দেখার মধ্যে সেটি ভুল হবে না বোধহয়। অবশ্য আমি ঠিক সিওর না আইরিন খান ওনার চেয়ে স্মার্ট কিনা। বক্তৃতা দিয়ে বিচার করলে প্রায় সমানেসমান। আর বাঙ্গালি ধরলে, ওনাদের আগে আসবে অমর্ত্য সেন এবং অমিতাভ ঘোষ। পরের দু’জনের ব্যাপারে আমার খানিকটা পক্ষপাতিত্ব আছে। যাইহোক, ড. ইউনুসকে দেখেছি মারকুটে বিদেশী প্রফেসর/ছাত্রদের সামনে একজন অপ্রতিরোধ্য তুখোড় বক্তা হিসাবে, কিন্তু বাংলাদেশিদের সামনে বরং খানিকটা কম সাবলীল। উনি নোবেল শান্তি প্রাইজ পাবার পর আমার এক সহকর্মী মজা করে বলেছিলেন, ড. ইউনুস হাটহাজারীর মানুষ, ওখানে দাদন ব্যবসার খুব চল। উনি শুধু ওল্ড ওয়াইন ইন দ্য নিউ বোটল করেছেন। সো, আইডিয়া কামস ফ্রম দ্য বটম। কথায় যুক্তি ছিল। ফেলা যায়নি। যাইহোক, ওল্ড ওয়াইন নিউ বোটলে ভরে আর ক’জন কামিয়াব হয়। তবে আমার অল্প বোঝায়, ড. ইউনুস যে কাজটি সাফল্যের সাথে করেছেন তাহলো কনভেনশনাল ব্যাংঙ্কিং প্রাকটিসের মাইন্ডসেটসটি ভেঙ্গে দিয়েছেন। পুরা বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছেন। যে কোন গরীব মানুষ লোন পেতে পারে এবং সেটি কোন কোল্যাটারাল ছাড়াই(যদিও বিষয়টা তারপরও কিছুটা ট্রিকি, আসলে সবাই লোন পায় থিওর‌্যাটিক্যালি, কিন্তু বাস্তবে না)। ড. ইউনুসের ব্যক্তি মানুষ সম্পর্কে আমি খুব কম জানি তাই ওদিক নিয়ে তেমন কিছু বলার নাই।

মাইক্রোফাইনান্সের এখন গ্রহণের কাল। এর আগে মাইক্রোফাইনান্সকে কখনো দেশে-বিদেশে এতো সমালোচনায় এবং সংকটে পড়তে হয়নি। গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনুস নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচনা নতুন কিছু না, আগে থেকেই আছে। আমি নিজেও মাইক্রোফাইনান্সের বিষয়ে সমালোচকের ভূমিকা নিই সাধারণত। কিন্তু দেখলাম এই সমালোচনার ধরণ প্রকৃতি পাল্টাতে শুরু করে টম হেইনম্যানের ডকুমেন্টারি ‘কট ইন দ্য ডেট’ নরওয়েজিয়ান টেলিভিশনে রিলিজ পাবার পর থেকে যেখানে মাইক্রোফাইনান্সের কারণে যে মানুষ সফল না বরং উল্টোটি হচ্ছে সেটি দেখানো হয় এবং বের করে আনে গ্রামীণ ব্যাংক একসময় ডেভেলপমেন্ট ফান্ড স্থানান্তর করেছিল। ধারণা করা হয়, বড় তহবিলের কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ট্যাক্স মওকুফ উঠে যেতে পারে সেই শঙ্কায় এটি করা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটি চাউর হয় এমনভাবে যে ড. ইউনুস গ্রামীণ থেকে ফান্ড মেরে দিয়েছেন। অবশ্য তার আগে থেকেই ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে কিছু আত্মহত্যার ঘটনায় মাইক্রোফাইনান্স চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আন্তর্জাতিকভাবে। গ্রামীণ ব্যাংকে যদি ফান্ড অব্যবস্হাপনা হয়ে থাকে তার জন্য ড. ইউনুস বা বোর্ড দায়ী হবেন (তদন্ত করলেই বোঝা যাবে), সেই কারণে মাইক্রোফাইনান্স দায়ী নয়। মাইক্রোফাইনান্সের নিজেরই অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। তারপর আছে সোশ্যাল বিজনেস টপিক! তবে এটাও একটা বিবেচ্য বিষয় যে ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের ব্যবহারে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন বা স্থানান্তর সব বড় উন্নয়ন সংস্থাতে হয়ে থাকে। এমনকি এটা সরকারেও করা হয়। ব্যাপারটা ন্যয়সংগত কিনা জানিনা, তবে মনে হয় একটা ট্রিকি ফ্যাক্টর। তাই বলে ব্যাপারটা গুরুতর অসংগতি হলে জায়েজ করে নিচ্ছি না। বাস্তবতা বললাম। তবে একটা প্রশ্ন থাকে যে অডিটিংয়ে কি দেখানো হয়েছে এবং গ্রামীণের বোর্ডে যে সরকারের দুজন সদস্য থাকেন তারা কি মতামত দিয়েছিলেন। আবার, খবরে পড়লাম গ্রামীণের ফান্ড নাকি ড. ইউনুসের পারিবারিক প্রিন্টিং ব্যবসার কারখানায় বিনিয়োগ করা হয়েছিল। এটা একদম লেটেস্ট ধাক্কা। গ্রামীণ ব্যাংক অবশ্য বলছে যে ঘটনাগুলো যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে বাস্তবতা সেটি ছিল না।

মাইক্রোফাইনান্স দুনিয়াব্যাপি অনেক খ্যাতি কুড়িয়েছে এবং ড. ইউনুস সাফল্যের সাথে মিডিয়াকে ব্যবহার করেছেন। মাইক্রোফাইনান্সকে একটি তেলেসমাতি ব্যাপার হিসেবে প্রচার করা হয়। কিন্তু সব সমস্যার মুশকিল আছান তো আর মাইক্রোফাইনান্স হতে পারে না। আমি যদি টাকা ধার নিই, ধরলাম মাইক্রোক্রেডিটই নিয়েছি, তাহলে সেটি খাটিয়ে তারপর আয় করে সেই টাকা সপ্তাহে সপ্তাহে ফেরত দেওয়া লাগবে – ব্যাপারটির সাথে বিনিয়োগ, উৎপাদন, বিক্রয়, লাভ, ক্ষতি সবকিছু জড়িত। তার মানে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা জড়িত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হাঁস-মুরগী চুরি যাওয়া, রোগ-শোক, পঙ্গপালের আক্রমণ কত কিছু হতে পারে। অবশ্য ড. ইউনুসের এক প্রশ্নের উত্তরে শুনেছি যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ‘দুর্যোগ’ ঘোষণা দিয়ে নাকি ব্যাংকের সেই শাখা বন্ধ রাখা হয়, চলতি ক্রেডিট কার্যক্রম – সাপ্তাহিক কিস্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। আবার গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা এসব চরানো এক লোকের সাথে একবার পরিচয় হয়েছিল, ঘটনাক্রমে তার নামও, ইউনুস! উনি বলেছিলেন যে কেউ ক্রেডিট নিয়ে চিপায় পড়লে তাকে আবার একটা বড় ক্রেডিট ধরিয়ে দেওয়া হয় রিকাভারির জন্য। তার কথা অনুযায়ী, মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে ১৫-২০ শতাংশের মতো সাধারণত সফল হয়, বড় একটা অংশের মানুষ শুধু সারভাইভ করে আর নাকি ১০-১৫ শতাংশের একটা দল বির্পযস্থ হয়। বিপর্যস্ত মানুষ আরো কিছু বেশি হতে পারে। আমি সেই ইউনুস ভাইকে বলেছিলাম, তাহলে লাভ কি হলো এবং কার হলো? উনি আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, এই যে এতো বড় গ্রুপ মার্জিন লাইনে সারভাইভ করে মাইক্রোক্রেডিট না থাকলে এরা না খেয়ে মারা পড়তো। আর প্রতিষ্ঠানের লাভ হলো – এটা তার ধারণা। এখন সমস্যা হলো, মাইক্রোফাইনান্সকে যতোটা প্রাতিষ্ঠানিকরন করা হয়েছে, একটি ডিসকোর্স হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার বিপরীতে এর প্রভাব নিয়ে মানে গত ত্রিশ বছরে কার কি পরিবর্তন হলো তার ব্যাপক ভিত্তিক কোন বেজলাইন ডেটা নাই। মানে আমি অন্তত: কোনদিন শুনিনি যে প্রকাশিত হার্ডডাটা আছে। তবে পিকেএসএফ বা বড় এনজিওগুলোর কাছে থাকতে পারে। যাইহোক, মাইক্রোফাইনান্স কোন অলৌকিক জাদুমন্ত্র না।

মাইক্রোফাইনান্সের আন্তর্জাতিক সাফল্যের মূলে ছিল যে এটা দিয়ে দারিদ্র বিমোচন হতে পারে। এটি একটি দারিদ্র বিমোচনের টুল। টাকা ধার নাও, রুজি করো, ধার ফেরত দাও, নিজে পুঁজি করো, স্বাবলম্বী হও – ভালই তো শুনতে। ড. ইউনুসকে এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিল, “কোন অবস্থায় গেলে একজনকে মাইক্রোক্রেডিট দেওয়া থামানো হবে”? উত্তরে ড. ইউনুস বললেন, “কখনোই না করা হবে না।শুধু শুরুটা আমাদের ইচ্ছায় আর শেষ হবে ক্রেডিট গ্রহীতার ইচ্ছায়। মাইক্রোসফট বা এ্যাপল এত বড় প্রতিষ্ঠান তারা কি ব্যবসার জন্য প্রয়োজনে লোন নেয় না?” তবে আমার ধারণা, এই পুরো ব্যাপারটা যে ধার নেয় এবং যে ধার দেয় কারো জন্যই সহজ নয়। তবে ধার যে নেয় তার জন্য বেশি কঠিন। উচ্চ সুদের হার এবং সপ্তাহান্তে কিস্তি ফেরত দেয়া মোটেই সহজ না। তারপরও গ্রামীণ ব্যাংক ট্রায়াল এন্ড এরোরের ভিতর দিয়ে গিয়ে মডেল হিসাবে মাইক্রোফাইনান্সকে সফল করে তোলে, মানে মডেলটি চালানোর যোগ্য তা প্রমাণ করে। আজব ব্যাপার, মাইক্রোফাইনান্সের যখন জন্ম, খোদাতালার দুনিয়ায় তখন সোশ্যালিস্ট ব্লকগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। বিশ্ব ব্যাংক এবং আইএমএফ তাদের স্টাকচারাল এ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগাম নিয়ে হাজির হয়েছিল। তারা ইনফ্যাক্ট মাইক্রোফাইনান্সের বিরোধিতাও করেছিল। কিন্তু আশির দশক যখন মাইক্রোফাইনা্ন্স সাফল্যের সাথে টিকে গেল। সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো দেখলো, বাহ বেশ তো, বেশ খানিকটা সমবায় ভাব আবার ব্যক্তি এবং স্বাধীন পুঁজির উপর নির্ভরশীল – প্রকল্পটি আবার একটি বেসরকারি উদ্যোগ। সবার জন্য একটা উইন-উইন সিচুয়েশন। আরে এটা তো একটা মোক্ষম টুল। ঠিক এই সময়ে এরকম একটি আর্থসামাজিক এজেন্টের প্রয়োজন ছিল। যে কাজটি হয়তো টম, ডিক এবং হ্যারি যে কেউ করতো সেটিই ড. ইউনুস করেছেন। সময়ের প্রয়োজন – ভুল বা সঠিক সেটি বিষয় না – চলনে-বলনে, আকারে, প্রকরণে মাইক্রোফাইনা্ন্স একটি নিও-লিবারেল এজেন্ট। তাতে কোন সন্দেহ নাই। মাইক্রোফাইনান্সে বড় মাপের যে অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে তার সবই প্রায় উদারবাদী অর্থ। উদারবাদী অর্থের সারা পৃথিবীতে ধর্ম হলো যে গিলবে একটি সময়ে এসে তার উদরাময় হওয়ানো, হয়তো মাইক্রোফাইনান্সের এখন সেই সময়। 

কিছু কিছু দেশে আবার রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনের আগে এসে তাদের নির্বাচনী এলাকার মানুষদের মাইক্রোফাইনান্সের অর্থ ফেরত দিতে মানা করেছেন। সস্তা জনপ্রিয়তা প্লাস আধিপত্যের রাজনীতি। আমাকে আমার নির্বাচনী প্রতিনিধি যদি এসে বলে যে তোমার আর আজ থেকে ব্যাংকলোন ফেরত দেয়া লাগবে না। আমার জন্য এর চাইতে খুশির ব্যাপার কমই থাকবে। আনন্দে সাড়ে তিনখানা ডিগবাজিও দিয়ে ফেলতে পারি বিছানায়। এটি ঘটেছে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে। রাজনৈতিক নেতাদের একটি সমবায়ভিত্তিক ক্রেডিট প্রোগ্রাম চালু ছিল, মার্কেটে মাইক্রোক্রেডিট নতুন প্লেয়ার হিসেবে আসায় একটা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তৈরি হয়। ওস্তাদের মাইর শেষ দানে – নেতারাও একহাত দেখে নিয়েছেন। তাছাড়া গতবছরে কিছু আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে ভারতে। এই যখন অবস্থা, অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার তখন প্রাদেশিক আইন করে মাইক্রোফাইনান্স বন্ধ ঘোষণা করেছে।

আবার বিদেশের কিছু গবেষণাতে পাওয়া গিয়েছে যে মাইক্রোফাইনান্স আসলে দারিদ্র বিমোচনে তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারে না – তো এই সাংঘাতিক আঘাতটি এসে পড়লো এমন সময় যখন মাইক্রোফাইনান্স দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। আবার কিছু গবেষণায় এমন ধারনা পাওয়া গিয়েছে যে মাইক্রোফাইনান্স করে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যের উন্নতি বা লেখাপড়ায় অগ্রগতি – কোনটাই তেমন কোন কাজে লাগে না। মাইক্রোফাইনান্সের আসল ট্রিকটি হলো নারীর সম্মান বা সম্ভ্রমের – আমরা জানি যে মাইক্রোক্রেডিট দেওয়া হয় নারীদেরকে – কোন বস্তুগত কোল্যাটারাল ছাড়াই – কিন্তু লামিয়া করিম দেখিয়েছেন যে নারীর সামাজিক-রাজনৈতিক সম্ভ্রম হলো মাইক্রেডিটের অদৃশ্য সামাজিক কোল্যাটারাল। এই সম্ভ্রম জিনিসটা পুরা প্রক্রিয়াটা চালু রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতে আবার মাইক্রোফাইনান্স ‘নন-প্রফিট’ মেকানিজম থেকে ‘ফর-প্রফিট’ মেকানিজমে রূপান্তরিত হয়েছে। সেখানে নিয়মকানুন আরো কড়া। ড. ভিক্রম আকুলা, যিনি ভারতে বিশাল অর্থের মালিক হয়েছেন মাইক্রোক্রেডিট থেকে – তিনি বলছেন যে মুনাফামূখী লগ্নীকারীর কার থেকে অর্থ নিয়ে মাইক্রোফাইনান্সে বিনিয়োগ করলে সেইটার ফলে তাবৎ দুনিয়ায় মাইক্রোফাইনান্স আরো দ্রুততার সাথে ছড়াবে এবং গরিব মাইনষের উপকার বেশি হবে। দেখেছেন কাণ্ডটা কি?

মাইক্রোফাইনান্স পরিস্থিতির আবার আরেকটা ডাইমেনশন আছে। যেটি আসলে ড. ইউনুসের নির্বুদ্ধিতা ছিল, কিংবা অন্যকিছু। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে এসে তার রাজনৈতিক অভিপ্রায়। যা তার গ্রহণযোগ্যতা আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনে। অনেককে বলতে শুনেছি, এক মিলিটারি সরকারের সময় উত্থান আরেক মিলিটারি সরকারের সময় পতন। ড. ইউনুস ছিলেন প্লান ‘এ’ এবং ড. ফখরুদ্দিন ছিলেন প্লান ‘বি’ – আর খেলারামরা (জি-৮) শুধু খেলে যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তো আর মসৃণ না, সুতরাং উত্থান-পতনও থাকবেই। যাইহোক, ড. ইউনুসের উপরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা খুব নাখোশ। পুরানো পাগলে ভাত পায়না, আবার নতুন পাগলের আমদানি! বামরা আগে থেকেই তার কর্মকাণ্ডে নাখোশ ছিলেন, এবার ডানরা যুক্ত হলেন। তৃতীয় শক্তির মতামত জানতে পারলে হতো। তৃতীয় পার্টির অবশ্য নিজের জোর নাই, তারা সবসময়েই কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হয়ে এসেছেন। দেখতে অন্যরকম লাগে শুধু। যাইহোক, ক্ষমতাসীন সরকার ড. ইউনুসের উপর নাখোশ। কারণ উনি ২০০৭ সালে রাজনৈতিক দল করতে চেয়েছিলেন। আবার এমন কথাও চালু আছে, যে বিএনপি যেহেতু তাঁকে পছন্দ করে তাই আওয়ামীলীগ তার উপরে রেগে আছে – এটা বাংলাদেশের গত দুই দশকের রাজনৈতিক বিভাজনের প্রবঞ্চনা, তার সাথে সত্য-মিথ্যা, কার্যকারণ কোন কিছুর সম্পর্ক না থাকলেও চলে। তারপরের যে কথাটি চালু সেটি অবশ্য আরো এককাঠি সরেস, আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও নাকি একখানা শান্তি লুবেল পাবার বহুদিনের খায়েস। গত টেনিউরেই নাকি চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সফল হয়নি। গরীবের রক্ত চুষে যদি কেউ লুবেল পায় তাহলে গরীবের জন্য হাজতখেটে কেন তা পাওয়া যাবে না? কথায় কিন্তু যুক্তি আছে! সত্যমিথ্যা জানিনা, স্তুতিকারীরা যে এমন পর্যায়ে নিতে পারে তাতে আর সন্দেহ কি! তবে, পুরষ্কার-খ্যাতি এগুলো পেতে কার না ভাল লাগে, আমার অন্তত লাগে, যদিও পাই না। কারো কারো তো বেশি ভাল লাগে – একথা আমরা সবাই জানি। এখন ড. ইউনুসকে যদি আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করা যায় তাতে নাকি দেশে আরেকটি লুবেলের সম্ভাবনা বাড়ে। এটা এখন একটি পলিটিকাল ক্যাম্পেইন। ঠিকই তো আমেরিকার এতো এতো প্রেসিডেন্ট-ভাইস প্রেসিডেন্ট লুবেল পায়। এতো দূর যাই কেন – পাশের দেশ বার্মায় অং সাং সুকি গৃহবন্দী থেকেই লুবেল পেলেন। আর আমাদের নেত্রী আর বিরোধী নেত্রীরা একটা বছর জেলের ঘানি টানলেন তারা কি কিছুই পাবেন না? এইডা কি ইনসাফ হইলো?!  

তাহলে মাইক্রোফাইনান্সের ভবিষ্যৎ কি?

মাইক্রোফাইনান্সের একটি গ্ল্যামারস পরিচিতি এবং ব্যাপ্তি তৈরি হয়েছিলো। এই ধাক্কায় সেটি হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত হবে। অনেকেই মনে করেন, মাইক্রোফাইনান্স দেশে যতো কঠিন সময় পার করছে, তার চেয়ে বেশি করছে বিদেশে। বিশেষভাবে, ভারতে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে। মাইক্রোফাইনান্সের জন্য নিয়মনীতি কড়াকড়ি হবে নিশ্চিতভাবে। অনেকেই এটি থেকে আস্থা ফিরিয়ে নেবেন তাতে সন্দেহ নাই। দাতারা বুদ্ধিমান, তাদের কাছে কে ইউনুস আর কে পাটোয়ারি সেটি বড় বিষয় নয় – নতুন ফান্ডিং কৌশল চাই। পৃথিবীতে গরীব মানুষ নিয়ে কারবার থেমে থাকবে না, হয়তো কৌশল পাল্টে যাবে – হয়তো মাইক্রোফাইনান্সের জায়গায় ন্যানোফাইনান্স চলে আসবে। তখন ঘরে বসে গরিব মানুষের ক্রেডিট কার্ড দিয়েই কাজ হয়ে যাবে। গ্লোবাল ফা্ন্ডিং গতদশকে এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকায় চলে যেতে শুরু করেছে, মাইক্রোফাইনান্সও তার পিছু ধরেছিল। সেটি ব্যাহত হতে পারে। তবে, তারপরও মাইক্রোফাইনান্স হয়তো টিকে যাবে। সামলে নেবে। মাইক্রোফাইনান্স এবং তার পরিচালনাকারী বড় প্রতিষ্ঠানসমূহের সোশ্যাল ক্যাপিটাল অনেক শক্তিশালী। তাই হেই বললেই নেই করা হয়তো সম্ভব না। তবে আগের মতো জৌলুস আর হয়তোবা নাও থাকতে পারে ভবিষ্যতে।

***

কি লিখতে কি লিখলাম। তবে অনেক লিখে ফেললাম। আচ্ছা, এমনটাই থাক। আলসেমিতে আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। কাল ভাবছিলাম বাংলাদেশ এখন কি কি নিয়ে সরগরম – পেলাম চারটি বিষয়। তিনটি হতাশাজনক এবং দুঃখের। আর একটি আনন্দের। হতাশার কথা বলি প্রথমে – বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার ইস্যু, শেয়ার বাজারে ধ্বস এবং মাইক্রোফাইনান্সের গ্রহণের কাল। আর আনন্দের বিষয়টি হলো ক্রিকেট ওর্য়াল্ডকাপ সামনে. দেশের মাটিতে, বাংলাদেশ হোস্ট কান্ট্রি। সুখ-দুঃখ আমাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসবে। শুধু ভুলে যাবো তারকাটায় ঝুলে থাকা ফেলানি’র লাশ।

৩,৩৭৬ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “অশনি সংকেত”

    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      কি কি জানতে পারলে, মাহতাব? আমি তো কিছু জানলাম না।

      অফটপিকঃ বোতল নাই তাতে কি! শিশিগুলো তো দেখি ঠিকই আনাগোনা করে যাচ্ছে। শুধু বানান ভুল আছে বললে হবে না। ঠিক করে ধরিয়ে দিতে হবে।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    অসাধারন তোমার বাক্য গঠন, অতিরিক্ত বর্ননায় মাঝে মাঝে ঝুলে গেছে, তবে তুমি যে থিসিস লিখতে লিখতে এক্সপার্টের হয়ে গেছ বুঝা যায়।

    লেখা ভালো লেগেছে। :thumbup: আমার অনুভূতিও তোমার মতই, ম্যাক্রোফাইনান্স নিয়ে। এটা টিকে থাকবে, হয়ত অন্য নামে। পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য দরিদ্রদের ব্যাংকিং এর আওয়াত আনা, পুজি বিশ্ব এ সুযোগ ছাড়বে না।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ধন্যবাদ ফয়েজ ভাই। বুঝতে পারছিলাম ঝুলে যাচ্ছে। কোন এডিট করিনি। পরবর্তীতে সতর্ক হতে হবে।

      অশনি সংকেত নাম দিয়েই লেখা শুরু করেছিলাম। হয়তো সবগুলো গ্রহণের কালকে ধরতে। হয়তো ফেলানি একটা কারণ। এই অশনি সংকেতে হয়তো দুর্ভিক্ষের কথা নেই, কিন্তু অন্য সংকটের কথা্ আছে, সেই একই মানুষদের, হয়তো তাই।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    কি আর বলবো, গরীবের ঘরের সুন্দরী বউদের অবস্থা এমনই- এক দেবরকে কোনমতে কাটিয়ে দিলেই আরেকটা এসে হাজির- উপনিবেশবাদী, সামরিক জান্তা থেকে শুরু করে উন্নয়ন-সংস্থা, কর্পোরেট ইত্যাদি ঘরের-বাইরের সব দেবর একে একে লাইনে দাঁড়ায়। কোন দেশের কত ক্ষমতাবান/ধনী/সম্মানিত দেবর এসে আমাদের দেশকে আশীর্বাদ( 😛 ) দিয়ে গেল সেইটা নিয়ে গর্ব করেই এখন আমাদের দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে, কি আর করা...... 😉

    লেখা ভালো লেগেছে। তাই পাঁচতারা এবং প্রিয়তে 🙂


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      মুনজু ভাই কি আমারে কেয়ারফুলি কেয়াললেস কলেন? এসব আমি পারিনা বদ্দা। যাউগ্যা, 'ইটে চাঁপা ঘাস' দেখতে থাকেন আর কলম ছোটান বস এরচে অনেক ভাল লেখা বাইর হবে আপনার হাতে নিশ্চিত থাকেন।

      ফেলানিদের কপালে ছক্কা নেই, তাদের নিয়তি নির্মমভাবে অক্কা পাওয়া।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  3. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    একটানে পড়ে গেলাম।
    আমি আবার সদিচ্ছা আছে এমন এক্টিভিস্টদের ভালা পাই। করতে করতে ভুল হয়, ঠিক হয় এভাবেই তো পদ্ধতিটা ভালোর দিকে যাবার সুযোগ পায়। গার্মেন্টস মালিকদের অনেকেই রক্তচোষা বলবে। কিন্তু হাজার হাজার মেয়ে গার্মেন্টসে কাজ করে কিছুটা হলেও স্বনির্ভরতা পেয়েছে, অগ্যতা কাজের বুয়া হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে। একদিক দিয়ে ভালোই হলো যে জীবদ্দশাতেই ডঃ ইউনুস এই সমস্যা্র মুখোমুখী হয়েছেন। আমরা দর্শক। পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় আছি।
    বেশি ইংরেজী শদব ব্যবহার করেছো হয়তো প্রতিশব্দ ব্যবহার করতে চাওনি। খুব ভালো লেখা।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ধন্যবাদ শান্তা আপা। আমার মনে হয়, কাজের সমালোচনা থাকার খুব প্রয়োজন রয়েছে। সেটা ভাল। কিন্তু ভুলের কারণে একটা মানুষকে পুরোপুরি নাকচ করে দেয়া সমীচীন না। তাকে ডিফেন্ড করার তো একটা সুযোগ দিতে হবে।

      গার্মেন্টেসের ব্যাপারটা আমার কাছে একটু অন্যরকম মনে হয়। সস্তা শ্রম এবং উৎপাদন আ্উটসোর্সিং করতে গিয়ে এই ফেমিনাইজেশন অব লেবার-টা তৈরি হয়েছে। সামাজিক সচলতাটা দেখার মতো, কিন্তু ফলাফল অবশ্য কম আশাব্যঞ্জক। মুক্তি হয় না, সেকেন্ডারি স্ট্যাটাস এবং সাবজুগেশন আবার ফ্যাক্টরি শ্রম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূর্নউৎপাদন হয়।

      ইংরেজি শব্দ কিছু কিছু ইচ্ছে করে, আবার অনেক জায়গায় অসচেতনতাবশতঃ হয়, তাও বলতে পারেন।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
  4. তানভীর (০২-০৮)
    দাতারা বুদ্ধিমান, তাদের কাছে কে ইউনুস আর কে পাটোয়ারি সেটি বড় বিষয় নয় – নতুন ফান্ডিং কৌশল চাই। পৃথিবীতে গরীব মানুষ নিয়ে কারবার থেমে থাকবে না, হয়তো কৌশল পাল্টে যাবে – হয়তো মাইক্রোফাইনান্সের জায়গায় ন্যানোফাইনান্স চলে আসবে

    অনেক ভালো হয়েছে :clap: :boss:

    জবাব দিন
  5. জুনায়েদ (০৪-১০)

    ভারতের কৃষক আত্মহত্যা যে শুধু মাইক্রোক্রেডিট বন্ধ করলে ঠিক হয়ে যাবে,তা মনে হয় না। কারণ,ভারতে লোন ব্যবস্থা এতই কঠিন যে গত ১২ বছরে ২ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছে।
    যাই হোক, লেখা পড়ে ভাল লাগল :boss: :boss: :boss:


    জুনায়েদ

    জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      ভারতে মাইক্রোফাইনান্স অপারেশন বন্ধ করলে কৃষক আত্মহত্যা বন্ধ হবে কি হবে না, বিষয় সেটি না। ভারতে কৃষক আত্মহত্যা আগে থেকেই আছে, এটি একটি সামাজিক প্রপঞ্চ, এর পিছনে অনেকগুলো উপাদান এবং পরিস্থিতি কাজ করে। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশে মাইক্রোফাইনান্স অপারেশনের নিপীড়নমূলক আচরণ এবং কঠিন ব্যবস্থাপনা নীতি + লাভজনক ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য একত্রে কাজ করার চাপে কৃষক আত্মহত্যা করেছে বলে আর্ন্তজাতিক মিডিয়াতে এসেছে। সেই কারণে মাইক্রোক্রেডিক একটি 'দারিদ্র বিমোচন টুল' হিসাবে সমালোচনার মুখে পড়েছে। ড. ইউনুস মাইক্রোফাইনান্স ধারণার জনক হিসাবে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছেন যে ভারতে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান মাইক্রোফাইনান্সের ধারণা থেকে 'কল্যান' বিষয়টি বাদ দিয়ে 'প্রফিট ম্যাকসিমাইজেশনের' দিকে চলে যাওয়াতে এই ঘটনা ঘটেছে। এবং সেসব প্রতিষ্ঠান নাকি পুরো ব্যবস্থাটিকে শোষণমূলক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।

      মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, জুনায়েদ।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন
    • রাব্বী (৯২-৯৮)

      কইতেয়ারিনা ভায়া। খোঁজ দ্য সার্চ নিয়ে দেখতে পারো। আমি প্রোগামটা নিয়ে পুরোপুরি কনভিনসড ছিলাম না। প্লাস ভাল লাগেনি, তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম।আমার সাথে যারা ছিল তারা ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিল। এখন প্রোগ্রামটার কি অবস্থা জানিনা।


      আমার বন্ধুয়া বিহনে

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রিফাত (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।