যখন ছোট ছিলাম তখন গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গেলেই সন্ধ্যার পর জমে উঠত জমপেশ ভূতের গল্প। রাতের খাবার দাবার পর্ব শেষ হবার পর হ্যারিকেনের আলোটা একটু কমিয়ে দিয়ে নিস্তব্ধ পরিবেশে মামারা যখন তাদের ভারী কণ্ঠস্বর অনেকখানি খাঁদে নামিয়ে এনে থেমে থেমে গল্প গুলো করতেন তখন সেখানকার সবকিছুই ভৌতিক মনে হত। এমনকি একা বাথরুমে যাবার ভয়ে অনেক সময় ওটা চেপেই ঘুমিয়ে পরতাম। আজকাল কর্মচঞ্চল ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ভৌতিক কোন ব্যাপার নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামায়না। আর হ্যাঁ নামটাও তো আর এখন সেরকমভাবে ব্যাবহার করা হয়না। এখন আমরা এটাকে ভুত প্রেতের গল্প বলিনা, বরং ‘অতিপ্রাকৃত’ কিছু বলি। এমন অনেক ঘটনাই অনেক সময় ঘটে যার কোন ব্যাখ্যা বিজ্ঞান বা যুক্তি দিয়ে করা যায়না। অনেকেরেই হয়তো এধরনের অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু আমার জীবনের যে অভিজ্ঞতা আজ বলতে যাচ্ছি তা বোধহয় খুব একটা স্বাভাবিক না। কেননা এটা শৈশবে আমার পুরো মনোজগতকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল এবং যা এখনও আমি বয়ে বেড়াই। যে ঘটনাটা বলতে যাচ্ছি তা বিজ্ঞান বা যুক্তি দিয়ে কিভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব আমার জানা নেই। পুরোটা শোনার পর আপনারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ। আমরা নানা বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছি। মান্দার নামক খুবই সাদাসিধে একটা গ্রামে নানাবাড়ি। গ্রামটা আর দু চারটা অন্যান্য গ্রামের মতনই। ঘরবাড়িগুলো অনেক ফাঁকা ফাঁকা এবং আশে পাশে প্রচুর গাছ পালা। ছোট বেলা থেকেই আমি আমার ছোট মামার খুব ভক্ত ছিলাম। বেশির ভাগ সময় তার কোলে নয়ত তার আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। তিনি বিভিন্ন সময়ে আমাকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে যেতেন। তখন গ্রীষ্মকাল। এক দুপুরে আমার ছোট খালা মামাকে আমাদের খেত থেকে কিছু শাক তুলে আনতে বলেন। তো মামা যাবার সময় আমাকেও কোলে করে নিয়ে যান। আমাদের সবজির খেতটা একটু দূরে ছিল। আশেপাশে তেমন কোন বাড়িঘর ছিলনা। কয়েকটা বাগান পার হয়ে যেতে হয়। খেতের আশেপাশেও তেমন কোন মানুষ জনের আনাগোনা ছিলনা । অনেকটা খোলা মাঠের মত জায়গায় বিচ্ছিন্ন এক বট গাছের নিচে মামা আমাকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে শাক তুলে আনতে গেলেন। ফিরে এসে তিনি যা দেখলেন তার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেননা। কোন এক তীব্র ভয়ে আমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে । চোখ উলটে হেঁচকি তুলছি এবং শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মামা সাথে সাথে আমাকে নিয়ে বাড়ী ফিরে আসেন। আমার অবস্থা দেখেতো সারা বাড়ীতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। অনেক পরিচর্যার পরও জ্বর কমছিলনা। সেবার সুস্থ এবং স্বাভাবিক হতে আমার এক মাসেরও বেশী সময় লেগেছিল। গ্রীষ্মের কাঠফাটা দুপুরে খোলা মাঠের মত জায়গায় আমি কি দেখে বা কেন অতটা ভয় পেয়েছিলাম আমার কিছু মনে নেই। মামাও এব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারেননি। তবে গ্রামে যা হয় আরকি, এই ঘটনার পরপরই অনেকের মনে বদ্ধমূল ধারনা হয়ে যায় যে আমার সাথে বেশ কয়েকটা জীন সার্বক্ষণিক বসবাস করে!
ছোট বেলায় আমরা কোন কিছু নিয়ে তীব্র ভয় পেলে সেটা দূর না করা পর্যন্ত সারা জীবনই মনের গভীরে সে ভয় লুকিয়ে থাকে। কোন এক লেখক বলেছিলেন ছেলেবেলার এই ভয় গুলো থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে আবার ঠিক একই পরিস্থিতিতে ওই ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। অনেকটা ভয় দিয়ে ভয় জয় করার মতন বাপার আরকি। লেখকের সাথে একমত পোষণ করে হোক বা নিজের মনকে শান্ত করতে হোক ওই জায়গাটাতে আর একবার গিয়ে আমি আমার মনের গহীনের অজানা ভয়টাকে দূর করতে চাচ্ছিলাম। সুযোগও পেয়ে যাই একসময়। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। কোন এক ছুটিতে আমরা নানা বাড়ি বেড়াতে যাই। বুঝতে পারছিলাম আমার মনের গভীরে বাস করা ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সুযোগ এটা। তখনও জানতাম-না আমার জন্য কি অপেক্ষা করে ছিল। কিন্তু মনের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে সিদ্ধান্ত নেই যে আমি যাবো, যদিও ব্যাপারটা মোটেই সহজ ছিলনা আমার জন্য। যাই হোক একদিন সন্ধ্যার আগে আগে ঠিক করি ওই জায়গাটাতে যাবো এবং একা। সাত বছর আগে গ্রামটা যেরকম ছিল তখনও প্রায় একইরকম। তেমন কোন পরিবর্তন নেই। দিনের আলো প্রায় নিভে গেছে তখন। বাগানের মধ্য দিয়ে যখন হাঁটছিলাম তখনি গা ছম ছম করতে লাগল। ধীরে ধীরে যত খেতের ওই জায়গাটার দিকে এগুচ্ছিলাম ততই হার্ট বিট বাড়তে লাগল। নিজের মনকে বুঝচ্ছিলাম যে অতিপ্রাকৃত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। যুক্তি বিহীন কিছুই ঘটেনা। অজানা একধরনের উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করলাম। ছোট বেলায় আমি যে জায়গাটাতে দাড়িয়ে ভয় পেয়েছিলাম তার কিছুটা দূরেই থমকে দাড়িয়ে পড়লাম। যে দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম তা কিভাবে বর্ণনা করব? এই সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে বট গাছের নিচে সদ্য বিবাহিত একজন পুরুষ ও নারী মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে আছেন। আমি তাদের বিয়ের পাঞ্জাবী এবং শাড়ি পরিষ্কার দেখতে পেলাম। নারী প্রতিমূর্তিটি মাথা নিচু করে আমার দিকে মুখ করে বসে আছেন । আশেপাশে আর দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। তীব্র এক অজানা ভয়ে আমি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। হৃদপিণ্ডটা ঘণ্টার মত করে বুকের মধ্যে বাড়ি মারতে শুরু করল। এক মুহূর্তে মনে হল গাছের নিচে নারী প্রতিমূর্তিটি মানুষ বা যাই হোক সে যদি একবার চোখ তুলে আমার চোখের দিকে তাকায় তাহলে আমি আর এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবনা। কেন এরকম মনে হয়েছিল আমি জানিনা। আমার সারা শরীর অসাড় হয়ে আসতে শুরু করল। পা দুটো মনে হল পাথরের মতন ভারী হয়ে আছে। আমি আমার জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওখান থেকে এক দৌড়ে চলে আসি। বাসায় ফিরে সবার কাছে খোঁজ নেই যে গত দুএক দিনে এখানে কারো বিয়ে হয়েছে কিনা। কিন্তু সবাই জানায় গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেও এখানে কারো বিয়ে হয়নি। এবং নববিবাহিত কোন দম্পতিও এই এলাকায় থাকেনা। এই ঘটনার আর কোন ব্যাখ্যা আমি দাঁড় করাতে পারিনি। আমি জানি বিজ্ঞান-মনা এবং যুক্তিবাদী অনেকই এটাকে দৃষ্টিভ্রম, হেলুসিনেসন, মানসিক চাপ, ট্রমা ইত্যাদি ইত্যাদি বলে চালিয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু আমি আমার মন থেকে জানি যা দেখেছি তা স্বাভাবিক কিছু ছিলনা এবং এখনও তা আমি অনুভব করি। এটা শুধু দেখার ব্যাপারই ছিলনা বরং পুরোটা ছিল অনুভবেরও। এরপর বিভিন্ন সময় মনে হয়েছে আমি আবার ওখানে যাই। কিন্তু কেন জানিনা কেউ একজন আমার মনের ভেতর থেকে সবসময়ই বলে যে এবার যদি যাই সেটাই হবে আমার শেষ যাওয়া ।
২ টি মন্তব্য : “অতিপ্রাকৃত”
মন্তব্য করুন
:brick:
কয়েকদিন ইটা ফালাই নাই।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর এবং ভয়ংকর । :clap: :clap: :clap: :boss: :boss: :boss: ::salute:: ::salute:: ::salute::
Coming together is a beginning; keeping together is progress; working together is success..