বঙ্গসন্তানের ইউরোপ আগমনকে অকাল বৈধব্যের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। কেননা – স্বদেশের নিমিত্তে দীর্ঘশ্বাস ক্ষেপনের কোন ইয়ত্তা থাকে না। যাহাই সামনে আসুক না কেন, স্বদেশের প্রেক্ষাপটে উহা কী রূপে করা যাইত – তাহা ভাবিয়া কালক্ষেপণ করা নিত্যকর্ম হইয়া যায়। নরেন্দ্রর অবস্থা হইয়াছে ঠিক তদ্রুপ। শ্বেত-শুভ্র তুষারের উপর দিয়া হাটিতে যতটা না পুলক অনুভূত হয়, তাহার চাইতে টিনের চালে বৃষ্টির সহিত ব্যাঙের ডাক শুনিবার তৃষ্ণা প্রকট হইয়া মাথায় ঘুরপাক খাইতে থাকে।
যাহা হউক, ইহার মাঝেও কৃতবিদ্য হইবার অভিপ্রায়ে দৌড়-ঝাপ করিতে হয়। ক্লাশের পড়াগুলিকে দেয়ালে চক-খড়িতে আঁকা বিদঘুটে আর কাল্পনিক ভিনগ্রহের ভাষা মনে হয়, বুঝিবার চেষ্টা করিলে উহারা মাথার উপর দিয়া উড়িয়া চলিয়া যায়। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা – ক্ষুধা লাগে ! আনাড়ি হাতে মায়ের দেয়া মশলার ডিব্বা লইয়া রন্ধনকর্ম বিপুল উৎসাহে শুরু হইলেও পেয়াজের ঝাঁঝে তাহা উবিয়া যাইতে সময় বেশি লাগে না। ঘর-কন্যার এই সুবিশাল আয়োজন চলে মাঝরাত-অব্দি। গলিত-প্রায় ভাত, আধপোড়া ডিম ভাজি আর গোটা দশেক লঙ্কা দেয়া ভর্তা দিয়া উদরপূর্তি করিয়া নরেন্দ্র বিছানার উপর এলাইয়া পড়ে। গভীর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখিয়া স্বভাব সুলভ ডাক দিয়া বসে – মা!
ছুটির দিনের অর্ধেক কাটে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব আর দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনের সহিত কথা বলিয়া; প্রযুক্তি আজ তাহাদের কাছে আনিয়া দিয়াছে। যদিও বাকি অর্ধেক কাটানো দূরহ হইয়া পড়ে, বাধ্য হইয়া নূতন ফন্দি-ফিকির করিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলিয়া সকল সাধারণ-পরিবহন বিনামূল্যে পাইয়া ঘুরিবার নেশা ধরিয়া যায়। তাহার আগে বলিয়া লই – নরেন্দ্রর জায়গা মিলিয়াছে আল্পস পর্বতমালার মধ্যিখানে – ত্রেন্ত নামক ছোট্ট এক শহরে। আশেপাশের গ্রামগুলি পাহাড় আর পর্বতের ফাঁকে ফাঁকে – একেকটা গিরিখাদের মাঝে। শহর হইতে গ্রামের উদ্দশ্যে মোটর ছাড়িয়া যায়। দূর হইতে পাহাড়ের গায়ে জড়াইয়া থাকা পথকে মৃত সর্প বলিয়া ভ্রম হয়, উহার ওপর দিয়া পোকার মতন মোটর চলিয়া গেলে ভ্রম আরও পাকাপোক্ত হয়।
তো এমনই এক তুষার-স্নাত সকালে নরেন্দ্র আস্তিনে কিছু পাউরুটি গুঁজিয়া চাপিয়া বসিল মোটরে, উদ্দেশ্য – ভবঘুরে। আল্পসের এই শাখার নাম ডলোমিটি। যতই বিতৃষ্ণা থাকুক না কেন, তুষারের টুপি-পড়া সুউচ্চ পর্বত আর নয়নাভিরাম বরফ-গলা পানির ঝর্ণা দেহ-মনে নাড়া দিতে বাধ্য। যদিও ভাল লাগার এই অনুভূতি ভীতিতে রূপান্তরিত হইতে সময় লাগে না নিচের দিকে তাকাইলে। পর্বতের খাড়া ঢাল ধরিয়া গোঁ গোঁ করিয়া মোটর চলিতে থাকে আর নরেন জপিতে থাকে – ভগবানের কিরে, এইপথে আর পা মাড়াচ্ছি নে। অবশেষে পথের শেষ প্রান্তে মোটর থামিল, মাটিতে পা দিয়াই নরেন গ্রামের গন্ধ পাইল। ইহাকে শব্দজালে আটকানো দুঃসাধ্য – গবাদি পশুপাখি, চাষের জমি, হরেক রকম ফসল আর হাজারো বুনো লতার ঘ্রাণ মিলিয়া মিশিয়া একাকার। কিছু জায়গায় এখনো শুভ্র বরফ চকচক করিতেছে, রৌদ্রের প্রতিফলনে কিয়ৎক্ষণ পরে চোখ ধাধাইয়া যায়। ঘন্টা-খানিক হাঁটাহাঁটি করিয়া হাঁফ ধরিয়া গেল, নরেন পথের ধারে বসিয়া আস্তিন হইতে নেতাইয়া যাওয়া রুটি বাহির করিয়া চিবাইতেছিল। সহসাই লাঠি হাতে এক অশিথিপর বৃদ্ধের আগমন। আসিয়াই এক গাল হাসিয়া নরেনকে কী সব বলা শুরু করিল। বলাই বাহুল্য – নরেন ইতালিয়ান ভাষায় ক অক্ষর গো-মাংস, একটি মাত্র বাক্য বলিতে পারে সেঃ “আমি ইতালিয়ান বলিতে পারি না।”
বৃদ্ধ যেন এইবার আরও উৎসাহ পাইয়া গেল, বিপুল বিক্রমে সে হাত পা নাড়িয়া-কুদিয়া, চক্ষু উল্টাইয়া বলিয়া চলিল। ইতালিয়ান ভাষার এই এক মহিমা – ভাষা বোঝ না, আজ বুঝাইয়া ছাড়িব। বাচনভঙ্গি আর মূকাভিনয়ের মিশেল হইল ইতালিয়ান ভাষার অপরিহার্য অংগ। মুখে বলিবার সহিত শারীর এবং মুখ-ভঙ্গিমা দিয়া বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করিতে ইহাদের চাইতে পারঙ্গম আর কাউকে পাইবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বৃদ্ধের অভিনয় দেখিয়া নরেন বাধ্য হইল উহার মর্ম উদ্ধার করিতে – “নাম কি হে বাপু তোমার? এহেন বাদামি বাবু তুমি, এই অজ পাড়াগাঁয়ে এলেই বা কোথা হইতে? আর আগমনের হেতুই বা কি হে তোমার? কোন ভাষায় কথা বল তোমরা?” এইবার শুরু হইল খেলা – বৃদ্ধের অনুরূপ ভঙ্গিমায় উত্তর দেয়া শুরু করিল নরেন। ক্ষণিক পরেই আবিষ্কার হইল বৃদ্ধ কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ জানে – ল্যাটিনেরই কোন এক দূঃসম্পর্কের মামাত বোন কিনা এই ইংরেজি। তদুপরি কৈশরে এই বৃদ্ধ নাকি আমেরিকান সৈন্যদের ছাউনিতে কাজ করিয়াছে। নরেন যেন কথা বলিবার মওকা খুঁজিতেছিল। সে তাহার এতদিনের পুঞ্জিভূত অভিযোগ সমূহ, ভয়াবহ একাকীত্ব আর দুর্বিসহ দিনাতিপাতের বর্ণনা দিতে লাগিল। বৃদ্ধ ভাঙ্গা ইংরেজি আর ইটালিয়ানের সংমিশ্রণে অকৃত্রিম কৌতূহল প্রকাশ করিল।
: আরে বাপু, এত ঠান্ডা কেন হে তোমাদের এই মড়ার দেশে? নিঃশ্বাস নিলে কলিজা পর্যন্ত হিম হইয়া যায়। আর খাবার-দাবারের কি বলিহারি! পিজা-পাস্তা ছাড়া আর কিছু তোমাদের মুখে রোচে না বুঝি? আর সব কিছুতেই টমেটো দেওয়া চাইই চাই। সব মানলাম, সব ঠিক আছে; কিন্তু প্রবাসীদের জন্যে যে অফিস বানিয়েছ, তাহার মধ্যে দুই-একজন ইংরেজি জানা লোক রাখিতে ত পার, নাকি? তা তুমিই চাকুরিটা লও না হে!
জবাবে বৃদ্ধ তাহার ফোকলা মাড়ি দেখাইয়া হাসিল, একটু যেন বিভ্রান্ত দেখাইল সেই হাসি। আধো আধো বোল ফোটা শিশু যেমন বুঝিতে চায় না কেন বাবাকে আপিসে যাইতে হইবে, বিভ্রান্ত হাসি ছাড়া বাবা উত্তরে আর কিছু খুজিয়া পায় না। জগতের নিয়ম – পেটপূজো আর বেঁচে থাকার নিয়মের ব্যাখ্যা কেবল বিভ্রান্তিরই সৃষ্টি করে। সহসাই এক চিৎকার – এক মা তাহার নবজাতককে ছোট্ট ঠেলাগাড়িতে চাপাইয়া প্রাতঃভ্রমণে বাহির হইয়াছে আর শিশুটি তারস্বরে চিৎকার জুড়িয়া দিয়াছে। এইবার বৃদ্ধের মুখে স্মিত হাসির রেখা – জীবনের বাঁকে সঞ্চিত জ্ঞান খুঁজিয়া পাওয়ার প্রশান্তির হাসি।
: দেখ বৎস, বুঝিলাম তোমার এহেন ভিনদেশে বড়ই কষ্ট হইতেছে। কিন্তু ইহার মূল কারণ কিন্তু তোমার দৃষ্টিভঙ্গি। তুমি সব কিছুতেই পার্থক্য দেখিতে পাও এবং ইহাতে মিল খুঁজিয়া না পাইলে মনঃক্ষুণ্ণ হও। আমি আমার সর্বস্ব বাজি ধরিয়া বলিতে পারি – ঐ শিশু তোমার মাতৃ ভাষায় কাঁদিতেছে। আমরা আদতে সবাই এক, তোমাদের মতই হাসি-কাঁদি আর বেঁচে থাকার সংগ্রাম করি। যাহা পার্থক্য ভাবিতেছ, ইহার নাম বৈচিত্র্য! ইহাকে গ্রহণ করিয়া লও, অনেক সমস্যা সহজ হইয়া যাইবে। যতই ভাষা, ধর্ম, বর্ণ আরও নাম না জানা পার্থক্য খুঁজিয়া পাইতেছ, সবই মেকি আর ভেজাল। তোমাতে-আমাতে মিল কি জান? চামড়ার নিচে গাঢ় লাল রঙের মিল। আমরা এই মিলটাই ভুলিয়া যাই। ছোট্ট পার্থক্যের জন্যে এই বড় মিলটাকে বিষর্জন দিই – রক্ত ঝরাই।
প্যা অ্যা অ্যা অ্যা প। মোটরের ভেঁপুতে দুই জনেরই সম্বিত ফেরে। খুবই সংক্ষিপ্ত বিদায় – কোন রকমে করমর্দন করিয়াই দৌড়। বৃদ্ধের কথাগুলো নরেনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, ভুলিয়া যায় রোমহর্ষক পাহাড়ি ঢালের কথা। এই যা, নামটাই যে জানা হইল না!
নূরুল,
দিনমজুর @লামুডি,
বার্লিন থেকে।
পথচিহ্ন কিছু রহিয়া যায় মনে কিছু ধূলায় বিমলিন হয় সময়ের স্রোতে। বিলাসী মানুষ ধূপছায়া সন্ধ্যায় সেইসব বিলিয়মান সুখস্মৃতি মনে করিয়া সিসিবিতে যখন আসেন তখন বিমলানন্দ হয়! সর্পিল যে পথটির কথা তুমি বলিয়াছো তাহা যেন আমাদের চাহা পাহাড়ের তলদেশের পথ। মাথার ওপরে মেঘমেদুর আকাশ, ক্ষীণকায়া পাথুরে পথের বাঁকে বাঁকে মৃতপ্রায় সবুজাভ রং। চোখ মেলিয়া নীচে তাকাইলে আদারে বাদাড়ে ঘনঘোর বনরাজি ব্যতীত আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয়না। একদিকে পর্বতজয়ের আনন্দ অপরদিকে অচেনাকে জানিবার বিপুল বাসনা বোধকরি মৃত্যুভয়কেও হার মানায়!
নরেন্দ্রর সহিত পরিচিত হইয়া মনে হইল সে আমাদেরই নিকটতম জন যে নেতাইয়া পড়া রুটি মুখে লইয়া জগৎসংসারের রূপসুধা দেখিতে বাহির হইয়াছে।
তোমার লেখাটি পড়িয়া প্রভূত আনন্দ হইল, ভাইজান। তোমাকে আমাদিগের আবাসে নিয়মিত দেখিতে ইচ্ছাপোষণ করি 🙂
আসন্ন উৎসবের শুভেচ্ছা জানিও 😀
::salute::
নরেন্দ্র'র একজন জ্ঞাতি বোন এর এইরূপ অসাধারণ একখানি মন্তব্য পড়িয়া আমি বড়ই বিমোহিত হইলাম। খুবই সুন্দর এবং উপভোগ্য হইয়াছে!
ভারি সুন্দর লেখা তো! এদ্দিন কোথায় ছিলে? আরো চাই, আরো।
:salute:
ভাল লাগল।
আশা করি নিয়মিত থাকবে।
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
::salute::
উৎকৃষ্ট ব্লগ।
শুধু ভাল না, খুব ভাল লাগলো।
এখন থেকে "নুরুল" দেখলেই মনে মনে "নরেন"-কে খুজবো...
নিয়ে এসো ওকে মাঝে মাঝে আমাদের এই আঙ্গিনায়...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
::salute::
পড়লাম আর অজানা অচেনা সেই পথ, নরেনের আসিনে ন্যাতানো রুটি ...
বৃদ্ধের সাথে গল্পের খুনসুটি ...
পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়াবার উহ্য আকুতি ...
সব মিলিয়ে ভালো লাগবার মতোন।
আর ভাষা ও উপস্থাপনার আঙ্গিকে এক ভিন্ন স্বাদও নিয়ে এলো ।
বার্লিন থেকে ছোঁড়া চাই এমন অনেক তীর ...
নরেন্দ্র'র ভ্রমণ কাহিনী শুনিয়া বড়ই মুগ্ধ হইলাম। বিশেষ করিয়া "পথের ধারে বসিয়া আস্তিন হইতে নেতাইয়া যাওয়া রুটি বাহির করিয়া চিবানো" নরেন্দ্রকে বড়ই চেনা চেনা মনে হইলো। আর তার জ্ঞাতি বোন সাবিনা চৌ এর অসাধারণ একখানি মন্তব্য পড়িয়া বড়ই বিমোহিত হইলাম। এইরূপ গল্প আরো শুনিতে চাই। আশাকরি বার্লিনের দিনমজুরের প্রশস্ত ঝুলিতে এইরূপ আরো চমকপ্রদ কাহিনী জমা হইয়া আছে, যথাসময়ে আত্মপ্রকাশের তাগিদে তাহারা উসখুস করিতেছে!