টেক্সাসের উঁচানো আঙ্গুলের মত আংশ, যাকে বলে প্যানহ্যান্ডেল অর্থাৎ কিনা কড়াই হাতা, তার ঠিক গোড়ায় ছোট্ট শহর লাবক। বাসিন্দা লাখ দুই, বড় কারবারের মধ্যে তুলো আর গবাদি ব্যাবসা। আমেরিকার প্রাচুর্যের প্রতীক যেসব বড় বড় ঝকমকে শহর যেমন নিউইয়র্ক শিকাগো লস এঞ্জেলেস লাস ভেগাস- এসবের সাথে মোটেই মেলানো যাবে না। বিশাল বিজন প্রান্তরের মাঝে হঠাৎ একফোঁটা আলোর ঝলকানি। এখানেই টেক্সাস টেক ইউনিভারসিটি, এর জন্যই এখানে যত প্রানের স্পন্দন। হাজার পঁচিশেক ছাত্রছাত্রী, ছবির মত সাজানো গোছানো বিশাল ক্যাম্পাস, আমার মত আরো অনেক ভীনদেশী ছাত্রছাত্রীর অস্থায়ী ঠিকানা। চীন ভারতবর্ষ ইরান তুরান তুর্কি লাতিন মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকা-জাতি সঙ্ঘের ছোটখাটো একখানা সংস্করন যেন। পড়াশোনা তো আছেই, আরো আছে হাজারটা কাজ যেমন রান্নাবান্না হাটবাজার খেলাধূলো আর ধুন্ধুমার আড্ডা। আর আছে বেড়ানো। সু্যোগ পেলেই দল বেঁধে বেরিয়ে পড়া দূরে কোথাও। এখান থেকে সবকটা বড় শহরই নিদেন পক্ষে ছ’ঘন্টার পথ- ডালাস, অস্টিন, ওক্লাহোমা সিটি কিংবা আলবুকারকি। ঘন্টার দুরত্বে আছে লাবকের মতই ছোট দুটি জনপদ- উত্তরে অ্যামারিলো, দক্ষিনে মিডল্যান্ড, প্রায় সমান দূরে।
এই শহরে আসলে দেখার মত তেমন কিছু নেই, আশেপাশেও তেমনি। স্পেনিশ বিজেতারা এই এলাকার নাম রেখেছিলো ইয়ানো এস্তাকাদো, ইংরেজীতে দাঁড়ায় হাই প্লেইনস বা উচ্চ সমভূমি। সমুদ্রতল থেকে বেশ উঁচু কিন্তু পাহাড়ি এলাকা নয়, বরং যতদূর চোখ যায় কেবল লালচে বাদামী রংয়ের চষা জমি, সেখানে তুলোর চাষ হয়। জেনে খানিক বিস্মিত হয়েছিলাম যে, এটা নাকি বিশ্বের প্রধান তুলোর কেন্দ্র গুলোর মধ্যে একটি, এবং বাংলেদেশের বড় ব্যাবসায়ীদের কেউ কেউ অনেক আগে থেকেই এখানে আসা যাওয়া করছেন। আর আছে ঘেসো জমি, সেখানে বিশাল শিং অলা গরুর পাল মনের সুখে চরে বেড়ায়। বৃষ্টি কম, বড় গাছপালাও কম। রুক্ষ শুকনো বটে কিন্তু ঠিক মরুভূমি নয়। আসল মরুভূমি শুরু হয়েছে আরো পশ্চিমে নিউ মেক্সিকো থেকে।
তবে প্রকৃতি কখনো বৈচিত্রহীন হয়না। টেক্সাসের এক বিরাট এলাকা জুড়ে আছে ক্যানিয়ন, যা ঠিক পাহাড় নয়। লাবক থেকে কিছুটা পূবে গেলেই এরকম পরিবেশ পাওয়া যায়। সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে পলোডুরো, সেটা অ্যামারিলোর কাছেই। ক্যানিয়ন এক বিচিত্র প্রাকৃতিক ব্যাপার, দেখতে পাহাড়ি এলাকা মনে হলেও আসলে সম্পূর্ন ভিন্ন এর ইতিহাস। বিজ্ঞানীরা বলেন, এটা নদী থেকে হয়। উঁচু জমিনের উপর দিয়ে বয়ে চলা নদীর খাত ক্রমশঃ গভীর থেকে আরো গভীর হতে থাকে, রুটির উপর ছুরি চালালে যেমন হয় আরকি। এভাবে নদীর খাত এতোই নীচে নেমে যায় যে নদী থেকে দেখলে দুপাড় পাহাড়ের মত দেখায়। আবার নদী কখনো সখনো তার গতি পথটাই বদলে ফেলে, আবার শুর হয় নতুন করে খাত কাটা। এভাবে সৃষ্টি হয় বিচিত্র ভূমিরূপ, একাধারে বিজ্ঞানী, অভিযাত্রী আর প্রকৃতি প্রেমিকদের পরম কৌতূহলের বস্তু। ভারতের চম্বল নদের উপত্যকায় এমন জিনিস আছে, যেটার সাথে জড়িয়ে আছে বেহড়-বাগী-বন্দুকের কাহিনী। বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত অবশ্য গ্রান্ড ক্যানিয়ন, অনেকেই নিজ চোখে বা ছবিতে দেখেছেন। সেটা আমদের শহর থেকে বেশ দূরে, অ্যারিজোনায়। পলোডুরো কে বলে টেক্সাসের গ্রান্ড ক্যানিয়ন, সাধ্যের মধ্যে দেখবার মত ব্যাপার বটে। পিকনিক ট্রেকিং ক্যাম্পিং ফটো তোলা বা নিছক গম্ভীর প্রকৃতির মাঝে মগ্ন হয়ে যাবার জন্য চমৎকার জায়গা।
স্বাভাবিক, আমরাও ছোট বড় দলে মাঝে সাজে ওদিকে যাই। আমার প্রথম ক্যানিয়ন দেখা অবশ্য একেবারেই অন্য সময়, যখন প্রথমবারের মত লাবক থেকে বেরিয়েছিলাম বাসে চেপে, আমার ক্ষুদ্র জীবনের এক আশ্চর্য ভ্রমনে। সে কথা হয়তো আরেক দিন হবে। তো, একদিন রাতভর আড্ডার মাঝে একদল ছেলেমেয়ের ইচ্ছে হল পলোডুরো যাবার। যেই বলা সেই কাজ- সকাল হতে না হতেই হৈ হৈ করে জনা পনেরো মানুষ আর চার খানা গাড়ী রেডি। তোলা হয়েছে বারবিকিঊর সরঞ্জাম, আর যা যা সচারচর নেয়া হয়- শামকোলা (কোকা কোলার বিকল্প) সহ প্রচুর পানীয়, পটাটো ও নাচো চীপসের বোন্দা ইত্যাদি ইত্যাদি। রওয়ানা হবার সময় ব্যাপক বিশৃংখলা, কে কোন গাড়ীতে উঠবে ঠিক নেই, পথটাও ভালমত কেঊ চেনে না। এই বিশৃংখলা অবশ্যি নতুন কিছু না, এটাই যেন নিয়ম এবং সম্ভবতঃ ফুর্তির অংশ। সেই প্রাক অন্তর্জালিক যুগে (কেউ বাঁকা হেসে প্রাগৈতিহাসিকও বলতে পারেন) জিপিএস নামের যাদুই রাহবারের আগমন হয়নি। র্যান্ড ম্যাককিনলীর কাগুজে ম্যাপই ভরসা। যাক, শেষমেশ গাড়ী বহর তো যাত্রা করলো, আমি কি কারনে যেন শেষ মুহূর্তে থেকে গেলাম।
ঘণ্টা দুই পরে ঘরের ফোনটা বেজে উঠে। ওপাশ থেকে পিকনিক যাত্রীদের একজনের কন্ঠ, “ঘটনা ঘটে গেছে!” ব্যাপার কি- না, একটা এক্সিডেন্ট। একটা গাড়ী রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েছে, বার কয়েক গড়ান দিয়েছে। শুনে তো আমাদের রক্ত হিম হবার জোগাড়। সবাই জানেন, ওদেশে হাইওয়ে গুলোতে গাড়ী ছোটে ষাট সত্তুর মেইল বেগে। ওই অবস্থায় গাড়ী ছিটকে পড়া যে কি ভয়ংকর ব্যাপার সেটা সবাই বোঝেন। রাস্তার পাশে ট্রাক স্টপ থেকে একজন ফোন করেছে। পড়ে যাওয়া গাড়ীর সবাই অলৌকিক ভাবেই বেঁচে গেছে। এখন ওদের ওখান থেকে আনার ব্যাবস্থা করতে হবে।
বাসায় আমার সাথে আরেক জন থেকে গিয়েছিলো। দু’জনে অনেক ভেবে চিন্তে শেষে একখানা ঝরঝরে পুরোনো গাড়ী নিয়ে সাহস করে বেরিয়ে পড়লাম। অন্য সময়ে ওই বাহন নিয়ে মহাসড়কে নামার কথা চিন্তাও করতাম না। যাহোক, প্রায় সত্তুর মাইল উজিয়ে সেই ট্রাক স্টপে পৌঁছে দেখি সেখানে জনা সাতেক মলিন মুখে হতবিহবল ভাবে বসে আছে। দুটো গাড়ীতে চেপে সবাই ফিরে গেলাম ডেরায়।
এবারে ঘটনার বিবরন। এখানে বলে রাখি, আমরা প্রায় সবাই গাড়ী চালানো শিখেছি এদেশে এসে, তাই চালানোর রীতি রেওয়াজ মার্কিনী। একজন ছিল যে কিনা ওই বিদ্যা দেশেই রপ্ত করে এসেছে, সাথে দেশী ড্রাইভারদের বদ অভ্যাসগুলিও। সে ছিল গাড়ী বহরের সবচেয়ে পেছনে, তা বেশীক্ষন সেটা ওর ভালো লাগবে কেন! তাই শুরু করলো ওভারটেক করা, অনেকটা দেশী কায়দায়, লেন দূরত্ব ইন্ডিকেটর এসবের নিয়ম তেমন না মেনেই। এভাবে একটাকে ছাড়িয়ে তার পরেরটাকেও পেরোনোর জন্য সে ছোটে, এবং অনেকটা বিপদজনক ভাবে বামে চেপে আসে। দেশে অবশ্য এটা নিতান্ত সাধারন ব্যাপার, কিন্তু আমাদের তো অভ্যাস নেই। তাই, পরের গাড়ীর চালক হঠাৎ চমকে গিয়ে আচমকা বাঁয়ে গাড়ী ঘুরিয়ে দেয়। এবং টাল সামলাতে না পেরে গাড়ী রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে বার কয়েক গড়ান দিয়ে অবশেষে দুই লেনের মাঝে ফাঁকা জমিতে থিতু হয়। ভয়ংকর সেই ঘটনা দেখে দুই লেনেরই প্রায় সব গাড়ী থেমে গেছে, ওদের কেউ পুলিশে জানিয়েছে হয়তো। খানিক পরেই জরুরী সেবার দল এসে পড়ে, এবং দূর্ঘটনার শিকার গাড়ীর ভেতর থেকে সবাইকে বের করে। একেবারে অলৌকিক ভাবে সবাই বেঁচে আছে! ওদের নিয়ে যাওয়া হয় কাছের হাসপাতালে। সবাই কম বেশী চোট পেলেও তেমন মারাত্মক কিছু নয়।তাই প্রাথমিক চিকিৎসা দেবার পর ওদেরকে সেই ট্রাক স্টপে নামিয়ে দিয়ে গেছে। সেই গাড়ীটা অবশ্য দেখতে পাইনি, তবে অনুমান করতে পারি ওটার অবস্থা বেশ খারাপই হয়েছিলো।
আশ্চর্য ব্যাপার, যার বেপরোয়া চলনে এমন ভয়ানক ব্যাপার ঘটলো, সে বা ওই গাড়ীর যাত্রীরা কেউ কিছুই টের পেলনা। ওরা, এবং সবার সামনে থাকা গাড়ীটা নিশ্চিন্ত মনে পলোডুরো ক্যানিয়নে চলে যায়। সারা দিন ওখানে কাটিয়ে সন্ধ্যের পর ফিরে আসে। অন্য গাড়ী দুটোর কি হলো, সারাদিনেও কেন তারা পলোডুরোতে পৌঁছুতে পারলো না, এসব প্রশ্ন তাদের মনে হয়তো জেগেছিলো, কিন্তু বিশেষ ভাবনায় ফেলেনি। তখন অবশ্য কারো কাছে মুঠোফোন ছিলো না। তবে ধারে কাছে কোন কয়েন টেলিফোন থেকে একটা খোঁজ তো নেয়া যেতো। যাহোক, ফিরে এসে সব শুনে তো ওরা অবাক! কঠিন ভর্ৎসনার পরও ওদের বিশেষ বিচলিত মনে হলো না। বিশেষতঃ ওই বাহাদুর চালককে, যে কিনা জোর গলায় দাবী করে যে, সে খুব সুন্দর ভাবে নিয়ম কানুন মেনেই গাড়ী চালিয়েছে। তবে এনিয়ে কারো সাথে ওর সম্পর্ক নষ্ট হয়নি, খুব সহজেই ব্যাপারটা সবাই ভুলে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়। আমার ভারতীয় বন্ধু উমেশ একাকী ওই পথে যাচ্ছিলো, প্রায় একই জায়গাতে এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় সে মারা যায়।
যাহোক, এই কান্ডের পরে, দল বেঁধে গাড়ীতে ঘোরাঘুরি প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলাম।