লাবকের কড়চা-১। আন্তর্জাতিক সপ্তাহ

সেই যে এক শীতের রাতে, উত্তুরে বাতাসে কেঁপে ঝেপে এসে হাজির হয়েছিলাম টেক্সাস কড়াই হাতার একেবারে মধ্যিখানে এই ছোট্ট শহরে, তারপর নানা চমকের ভেতর দিয়ে কোথায় যে কেটে গেছে মাস দুয়েক, বুঝতেই পারিনি। এদেশে সপ্তাহে মাত্র দু’দিন– উইক ডে এবং উইক এন্ড। তাই দিন যায় উল্কার বেগে। এমনি সময়ে এল আন্তর্জাতিক সপ্তাহ– দেশি-বিদেশি ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে বেশ জাঁকালো আয়োজন। খেলাধূলো, নাচগান, ফ্যাশন শো- এরকম নানা ব্যাপার। আরো থাকবে সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী। নানা দেশের জন্য বরাদ্দ ষ্টলে নিজ দেশকে তুলে ধরতে প্রাকৃতিক দৃশ্য, পোষাক-আশাক, হস্তশিল্প এসব সাজিয়ে রাখা, কৌতূহলী দর্শকের জন্য। দুদিন বাদে হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সবার শেষে আন্তর্জাতিক খাদ্য মেলা, বোঝাই যাচ্ছে ব্যপার গুরুতর।

তা, বিদেশি ছাত্র ছাত্রী এখানে নেহায়েৎ কম নয়, যেমনটা হয়ে থাকে আমেরিকার প্রায় সব স্কুলেই। দলে ভারী চীনা, এর পরই ভারতীয়। তৃতীয় দলটিকে আমি এক ঝুড়িতে ফেলে বলছি লাতিন। মেক্সিকো থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা- বেশ ক’টি দেশের ছেলেমেয়ে এই দলে। এখানকার স্থানীয় লোকদের একটা বড়ো অংশ একই জাতের বলে ওদের আলাদা ভাবে চেনা যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু ছাড়াও আছে ইরানী ও তুর্কি। আছে আফ্রিকার নানা দেশ থেকে আসা ছাত্ররা। আমরা বাংলাদেশের আছি সব মিলিয়ে জনা ত্রিশেক। “ইন্ডিয়ান” বা “এশিয়ান” বলে কোন বড়ো গোষ্ঠির ভেতর যেন বিলীন না হয়ে যাই, সে ব্যাপারে আমরা বেশ সচেতন। তাই, নিজেদের পরিচয়টা ঠিক ভাবে তুলে ধরার এইতো সু্যোগ!

প্রথমে বলি মেলার কথা। ষ্টল সাজাবার জন্য ঘরে ঘরে হানা দিয়ে ঘটি-বাটি-কম্বল যা পাই তুলে এনেছি। মনে হল দেশের মানুষের সার্বিক জীবন যাত্রা তুলে ধরতে এসব যথেষ্ট নয়। তাই নৌকা, গরুর গাড়ী, রিকশা, পালকি, বাউলের একতারা, ঢেঁকিঘর সমেত গ্রামীন গেরস্তবাড়ি- এসবের মডেল বানানো হল। “মীট বাংলাদেশ” নামে একখানা সুন্দর ছবির বই পাওয়া গেলো। রাত জেগে এসব যোগাড় যন্তর হচ্ছে, আর ওদিকে আরেক দল গানের মহড়া দিচ্ছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য। কেউ মজা করছে, টিপ্পনি কাটা থেকে ঝগড়া সবই চলছে। রাত পোহালেই অনেকের পরীক্ষা, কিন্তু তা নিয়ে কারো খুব একটা দুঃশ্চিন্তা নেই। হাওয়ায় বেশ একটা মেলার ভাব। একজন আবার মডেল গুলোতে আতি সুন্দর কারুকাজ করে দিয়েছেন। যে সময়ের কথা বলছি সেটা প্রাক-আন্তরজালিক প্রাক মুঠোফোনের যুগ। কাজেই এসব যোগাড় যন্তর মোটেই সহজ ছিলো না।

বিকেলে ইউনিভারসিটি সেন্টারের প্রকান্ড বলরুমে প্রদর্শনী শুরু হলো। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের এত উৎসাহে যেন ঠান্ডা জল পড়লো। কোথায় দর্শক কোথায় কি! অথচ ঠিক বলরুমের বাইরেই বিস্তর ছাত্রছাত্রী ঘোরাফেরা করছে, ফুডকোর্টে বসে আড্ডা দিচ্ছে! কাজেই আমারা নিজেরাই ঘুরে ফিরে অন্যদের ষ্টল দেখছি। চীনাদের ষ্টল উপচে পড়ছে নানা শিল্প সম্ভারে। জেড পাথরের ড্রাগন, রংচঙ্গে সিল্কের পোষাক থেকে শোলার তৈরি প্রাকৃতিক দৃশ্য- চৈনিক শিল্পবস্তু কম বেশি সবাই দেখেছেন। ভারতীয় ষ্টলটিও বেশ সম্বৃদ্ধ, রাজস্থানী থেকে মনিপুরী সবরকমের হস্তশিল্প উপস্থিত। লাতিনদের আছে মস্ত টুপি, বাহারে পোষাক আর বাদ্যযন্ত্র। তুর্কি ষ্টলটাও নজর কাড়ে- লম্বা নলওলা হুকা ও বিলাসী রাজরাজড়াদের জমকালো জিনিসপত্র আর এক ভাঁড় ভর্তি প্রাবাদ বাক্য। মার্কিনী ছেলেরা রখেছে গোটা দুই কাঠের বেড়া, বারবিকিউর সরঞ্জাম, প্রকান্ড একজোড়া গরুর শিং, আর কয়েকটা কাঁটাঝোপ বা টাম্বলউয়িড। পশ্চিম টেক্সাসের প্রায় নিখুঁত উপস্থাপন। তবে আমার মনে হয়েছে আমাদের কাজটা ছিল অনেকের চেয়ে ভালো, কারন শুধু বাহারে শিল্পবস্তু দিয়ে তো একটা দেশের সাংস্কৃতি বোঝানো যায়না। পরদিন কিছুটা খরা কাটলো। স্থানীয় স্কুল গুলো থেকে বাস বোঝাই ছেলেপিলে এসে হাজির। তাদের কিচির মিচির, নানা মজার প্রশ্ন, আর খাতায় কিছু লিখে দেবার বায়না, এসবের মধ্যে মেলা জমে ওঠে। বাংলাদেশের গেরস্তবাড়ির মডেলে একটা পুকুর ছিলো, সেটাকে অনেকে সুইমিং পুল ভেবেছে। আর ঢাকা জেলার বিখ্যাত নকশী পিঠে যে আসলে ডেকোরেশন পিস নয়, ওটা খাবার জিনিস, তা মানতে অনেকের বেশ কষ্ট হচ্ছিলো।

ফ্যাশন শো’র পশ্চিমা ধারনা- বিখ্যাত নক্সাকারদের বানানো পোষাকে সেজে একগুচ্ছ নারী-পুরুষের বেড়াল-হাঁটা- ওসব আমাদের দেশে তো নেই, অন্ততঃ সেকালে ছিলো না। ওরা ওদের মতন করেই করলো। তবে কিনা, টেক্সাসের ওই এলাকা বেশ রক্ষনশীল, বাইবেল বলয়ের অংশ। তাই ওদের পোষাক-আশাক সবই ছিলো সুন্দর, শালীন ও স্বাভাবিক, কোন উদ্ভট উৎকট সাজে কাউকে দেখা গেল না। আমরা কি করি! শেষে বলে কয়ে এক দম্পতিকে বিয়ের সাজে সাজিয়ে মঞ্চে তোলা হল, সাথে সানাইয়ের বাজনা। বরের পাগড়ীটা কিভাবে বানানো হয়েছিলো সে এক রহস্য। এরপর সাধারন লোকের পোষাক পাজামা-পাঞ্জাবি, ফতুয়া-লুঙ্গি, গেঞ্জি-প্যান্ট এসব। পিচবোর্ডের মাথাল ও কাস্তে হাতে, ফতুয়া গায়ে চাষী নৃত্য। মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান বেশে চারজন মঞ্চে এলো, নেপথ্যে বাজছে কবিগুরুর গান “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া…বুকের মাঝে বিশ্বজনের পাবি সাড়া”, দৃশ্যটা মনে পড়লে এখনো মোহিত হই। তবে সব ছাপিয়ে গেল বাউলের নাচ- রীতিমত একতারা হাতে, লম্বা বাবরি আর গলায় কয়েক গাছা মালা সমেত, “সাধের লাউ” এর সুরে একজন যে নাচ দেখালেন, এক কথায় অনবদ্য! অন্যদেশের ছেলেমেয়েরাও তাদের সাজগোজ দেখিয়ে গেল, ভাংড়া সালসা আফ্রোবীট চীনা মরমীয়া সবই এলো সাথে।

এবার নাচ গানের পালা। আমার নৃত্যশিল্প বোঝার মত রসজ্ঞান কোন কালেই ছিল না। মার্কিনীরা একদল চিয়ার লীডার নিয়ে হাজির। ওই যারা বিভিন্ন খেলার সময় মাঠের কিনারে নাচানাচি করে থাকে। আমার কাছে হাত-পা ছোঁড়ার মহড়া মনে হচ্ছিলো। ভারতীয় নাচগান হিন্দি সিনেমার কল্যাণে সবার চেনা। ওরা দেখালো বিখ্যাত কাঠি নৃত্য বা ডান্ডিয়া রাস। এক কথায় চমৎকার। এরমধ্যে আবার কারা যেন তিনজন বেলি ডান্সার নিয়ে এসেছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এ নাচের কদর। তা বিচিত্র সে নাচ চলছে, একজনের হাতে আবার দুখানা তলোয়ার, সাধে কি আর লোকে যুদ্ধবাজ ভাবে! চীনারা খানিক কারাটে-কুংফু আর লাঠিবাজিও দেখিয়ে গেল। তবে বেরসিক হওয়া সত্বেও, আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম পানামার দুটি ছেলেমেয়ের নাচে। একেবারে আলাদা, প্রানবন্ত, ছন্দময় ও সহজ আবেদনে ভরা, মনে হচ্ছিলো যেন ওরা ইচ্ছে করলে মাটিতে পা না ছুঁইয়েও নাচতে পারে!

গানের পর্বে কে কি করেছলো ঠিক মনে নেই। তবে আমরা বেশ ভাল চমক দিয়েছিলাম। পিচবোর্ডের বিরাট ময়ুরপঙ্খী নাও, তাতে জনা চারেক বসে বৈঠা চালাচ্ছে। পাশে গায়েনের দল, একে একে গেয়ে যাচ্ছে “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর…”, “কল কল ছল ছল নদী করে কল কল…” ইত্যাদি। জমে গেলো হলভরা দর্শকের হাততালিতে।

এরপরে খাদ্যমেলা। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য ষ্টল বরাদ্দ, সেই বলরুমে। প্রচুর লোক এসেছে, নানা দেশের খাবারের স্বাদ নিতে। চীনে খাবার তো সারা বিশ্বেই চলে। শুনেছি বিলেতে বাংলাদেশি হোটেল গুলো “ইন্ডিয়ান” নামের ছাতার নীচে বসে প্রবল প্রতাপে ব্যবসা করছে। ইন্ডিয়ান খাবার এখানেও যথেষ্ট জনপ্রিয়। ভারতীয়দের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরাও পসরা সাজিয়েছি। ওদের কচৌরি পাকোড়া শাগ-পনির আর “ভেজিটেবল বিরিয়ানির” সাথে সমানে সমানে চলছে আমাদের পোলাও টিকিয়া সমুচা শিঙ্গাড়া। বাংলাদেশের খাবারের যে আলাদা মজা আছে সেটা রসিকজনদের সেদিন বেশ ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।

যাহোক, বিক্রিবাট্টা শেষে, মেলা ভাঙ্গার বিষন্নতা দূর করতেই মনে হয়, কারা যেন কোথা থেকে প্রকান্ড এক মিউজিক সিস্টেম নিয়ে হাজির। মনে হয় লাতিন ছাত্রদের কাজ। এদের মত সঙ্গীত আর হুল্লোড়প্রিয় জাত আমি আর দেখিনি। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই ভাঙ্গা মেলা হয়ে উঠে “নাচেগানে ভরপুর” এক আনন্দমেলা। দেশ কাল ভুলে সবাই তাতে শামিল হয়। এখানে বলে রাখি, আমেরিকায় তখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সবারই কড়ির টানাটানি, মনে হাজারটা চিন্তা। তবু ওই সময়টুকু ছিলো নিখাদ আনন্দের। তারুন্যের জয় সর্বত্রই।

সবশেষে, এই বিরাট যজ্ঞের কুশীলবদের নাম না বলাটা অন্যায় হবে। রেঞ্জি ভাই, লিটু ভাই, টুটুল ভাই-শাওন দম্পতি, যোবায়েদ ভাই, হাবিব ভাই, কাইজার ভাই, খোকন ভাই, শাহীন ভাই, স্বপন ভাই, খলিল ভাই, মুজিব ভাই, মিঠু ভাই, আজিম ভাই ও ভাবী, দীপু ১, দীপু ২, সনি, পাপ্পু, রনি, রাফি, রওনক, কচি মামা, রাসেল…এমনি এক ঝাঁক টগবগে তরুন, আমেরিকার সেই দুর্দিনে, শুধুমাত্র প্রানের শক্তিতে, সবরকম দুঃশিন্তা আর উদ্বেগকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, গেয়েছিলো জীবনের জয়গান।

৪৭৮ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “লাবকের কড়চা-১। আন্তর্জাতিক সপ্তাহ”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    এক কথায় চমৎকার কড়চা! পড়তে পড়তে উদ্দীপ্ত হ'লাম। এটা কোন সালের ঘটনা তা পোস্টের কোথাও উল্লেখ করা থাকলে অনেক অনুমান বা ধারণা মিলিয়ে নেয়া যেত।
    লাবক কি টেক্সাস এর কোন শহরের নাম?
    সুলিখিত এই কড়চাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ, মাহবুব। কড়চা-২ এর অপেক্ষায় আছি।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।