The Land of the Thunder Dragon – পুণ্য ভূমিতে ভ্রমন কাহিনী

ভ্রমন সময়কাল অক্টোবর ২০১৬

পরিচিত কয়েকজনের ভূটান ভ্রমনের ছবি দেখে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে এবার ছেলেমেয়েদের স্কুলের পূজার ছুটির সময় ভূটানে যাবো। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। গতবছর এক আত্মীয় ভূটান যেতে চাইলো কিন্তু বিমানের টিকেট না পাবার কারনে তারা শেষ পর্যন্ত যেতে পারে নি। এজেন্টের বক্তব্য – আগামী একমাস পর্যন্ত সব টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। সেটা মাথায় রেখেই যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস আগে ড্রুক এয়ারলাইন্সের এজেন্ট এর সাথে যোগাযোগ করলাম। কবে যেতে চাই শুনে জানালো যে সেসময় পূজার কারনে টুরিস্ট দের অনেক ভিড় থাকে, কাজেই এখনি টিকেট করে ফেলতে হবে। আত্মীয়ের অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে যাবার আড়াই মাস আগেই টিকেট করে ফেললাম।

এখানে মনে রাখা ভালো যে ভূটানে যেতে বাংলাদেশীদের কোনো ভিসা প্রয়োজন নেই বিধায় ও বর্তমানে বাঙ্গালী মধ্যবর্তী পরিবারের ভ্রমনের মাত্রা বাড়ায়, ভূটান, শুধু ভূটান কেন, এমনকি দেশের ভিতরেও কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে একটু আগেভাগেই পরিকল্পনা করা ভালো। বিশেষ করে যারা পরিবার পরিজন নিয়ে যেতে চান।

এগোডা আর বুকিং ডট কম চষে ফেলেও কোনো হোটেলের হদিস করতে পারলামনা। যে হোটেল পছন্দ হয়, সেই হোটেলে রুম নেই, আর যেখানে রুম পাই, সেই হোটেল পছন্দ হয় না। অতএব, আবারো ড্রুক এয়ারের এজেন্টের দ্বারস্হ হলাম। ওরা গোল্ড প্যাকেজ ম্যানেজ করে দিলো। জানালো, থিম্পুতে উপযুক্ত হোটেল পাওয়া যাছছে না। মত দিলাম, যা পাওয়া যাছ্ছে, তাই নিন।

সাত রাত আট দিনের ভ্রমন, তার উপর ইয়াহু ওয়েদার এ তাপমাত্রার পারদ ক্রমাগত নিম্নমুখি, সময় সময় মাইনাস তাপমাত্রা দেখে ঠান্ডার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। ফলে লাগেজ ভারি হল। যদিও ভূটানে পৌছে বুঝলাম এতো এতো শীতের কাপড় চোপড় না আনলেও চলতো। অক্টোবর মাসে দিনের তাপমাত্রা আরামদায়ক, শীতবস্ত্র প্রয়োজন কখনো কখনো রাতে। যাক, এযাত্রা ঠেকে শিখলাম।

যথাসময়ে যাত্রা শুরু। বিমান ছাড়ার সময় সকাল নয়টা, এয়ারপোর্টে রিপোর্টিং আরো আগে। তাই আই এফ আই সি ব্যাংকের বলাকা লাউঞ্জ ও এমেক্স কার্ডের এমেক্স লাউঞ্জের ভরসায় ভোরে বের হলাম বাসা থেকে। পরিবারের সবার পছন্দ এমেক্স লাউঞ্জ, সেখানেই প্রাতরাশ সেরে নিলাম। প্লেন যথাসময়েই ছাড়লো। এখন পর্যন্ত বিমান ভ্রমনে আমাকে কখনো বিলম্বিত ফ্লাইট এর মুখামুখি হতে হয়নি, ভাগ্য আমার কপালের মতই প্রশস্ত এই ক্ষেত্রে।

ছেলেমেয়েদের কারনে পরিবার সহ ভ্রমনে কখনোই বিমানে জানালার কাছে বসার ভাগ্য হয়না, এবারেও তাই। তবে ভূটানের আকাশ সীমায় পৌঁছানোর পর ফাঁকে ফাঁকে যে ল্যান্ডস্কেপ দেখতে পেলাম, তাতেই আমি মুগ্ধ। অবশেষে পারো এয়ারপোর্টের সীমানায়; পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে প্লেন যত মাটির নিকটবর্তী, মুগ্ধতার মাত্রা তত উর্ধমুখি। প্লেন কয়েকবার ডানে বামে একেবেকে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। প্লেনের দরজায় এসে পাহাড়ি সৌন্দর্যে আবারো বিমোহিত। এর আগে কখনো যা করিনি, এবার বিমান থেকে নেমে তাই করলাম, রানওয়েতে দাড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম।

 

দেশটাকে যত সুন্দর ভেবেছিলাম, বাস্তবে তারচেয়ে বেশিই সুন্দর মনে হল। এখানকার মানুষও তাদের দেশের মতই, শান্ত, ভদ্র, সৌম্য। নিজের সাথে ওদের তুলনামূলক বিশ্লেষনে নিজেই লজ্জিত হলাম। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাইরে আসতেই নামগিল (নাঙে) এসে রিসিভ করে গাড়িতে লাগেজ উঠিয়ে রওনা দিলো হোটেল অভিমুখে। বিমান বন্দরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদি, পারো, স্হানীয় নাম পাচু। নদীর একপাড়ে বিমান বন্দর, অপর পাড়ে পাহাড়। বিমান বন্দরের দিকের পাড় পাথর আর শক্ত নেটের সমন্বয়ে বাঁধানো।

হোটেল অভিমুখে চলার পথে টুকটাক প্রয়োজনিয় তথ্য নিছ্ছিলাম নাঙ্গের কাছ থেকে। চমৎকার ইংরেজি বলে। “এতো সুন্দর ইংরেজি কোথায় শিখেছেন?” জানতে চাইলাম। স্কুলে, নামগিলের উত্তর। আরো জানালো, এদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসা ফ্রি। হাইস্কুল, মানে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত সবাইকে বাধ্যতামূলেক স্কুলে যেতে হয়। ইংরেজির ভিত্তি সেখানেই গড়ে দেয়া হয়।

সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনাও অবৈতনিক, তবে সবাই সেখানে পড়ার সুযোগ পায় না। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য একটা ন্যূনতম মান নির্ধারণ করা আছে, যারা সেটাতে কৃতকার্য হয়, তাঁরাই পড়ার সুযোগ পায়। তাই হাইস্কুলের পর অনেকেই ঝরে পরে। বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিস্ঠান আছে, তবে অত্যন্ত ব্যয় বহুল বলে সাধারনের নাগালের বাইরে। চিকিৎসা সম্পুর্ণ ফ্রি। নাগরিকের চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশে পাঠাতে হলেও সেই খরচ সরকারই বহন করে।

কথার ফাঁকে ফাঁকে পথের দুধারে নজর বুলাছ্ছি। পাহাড়ী এলাকা, গাছপালার আধিক্য, বেশীর ভাগ গাছই হল উইলো আর পাইন। কখনো কখনো বিক্ষিপ্ত আপেল গাছ। তবে নামগিল জানালো, বসতি এলাকায় আপেল বাগান ভরা। তবে এখন সব আপেল পারা হয়ে গেছে, বাগান অত সুন্দর লাগবে না দেখতে। শুনে আক্ষেপ করলেন আমার উনি। তার খুব শখ ছিলো আপেল ভর্তি গাছের সাথে আপেল হাতে ছবি তুলবে। মনে হয় তাঁর এই শখ মিটানোর জন্য হলেও আরেকবার আসতে হবে।

পথ ক্রমশ উপরের দিকে উঠেছে। একস্থানে এসে নামগিল জানালো, এখান থেকে পারো বিমানবন্দর একনজরে দেখা যায়। চাইলে নামতে পারি। গাড়ী থামিয়ে নেমে পড়লাম। সুন্দর দৃশ্য। চটপট কিছু ছবি তুলে ফেললাম। ততক্ষনে দেখি আরো দুই গাড়ী পর্যটক হাজির সেখানে। ছবিপর্ব শেষ করে আবার চলা শুরু।

দূর থেকেই চোখে পরলো পারো শহর, ছোট্ট, ছিমছাম, চমৎকার সাজানো গোছানো, ছবির মত। অভিভূত হলাম। শহরের ভিতর দিয়ে এগিয়ে তাকে পিছনে ফেলে এগুলাম, আমাদের হোটেল এর দিকে। মান্দালা রিসোর্ট, ছোট টিলার উপড়ে। দুর থেকে দেখেই পছন্দ হলো। হোটেলে পৌছে নির্ধারিত কটেজে চলে গেলাম। কটেজ থেকে ভিউ চমৎকার, সম্পূর্ন পারো শহর ও ভ্যালি নজরে আসে।

নামগিল আমাদের এক ঘন্টা সময় দিয়েছে, ফ্রেশ হয়ে সামান্য রেস্ট নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে যাবার জন্য। আজ সে আমাদের এই হোটেলে নয়, বাহিরে অন্য এক রেস্তোরায় খাওয়াবে। সামান্য রেস্ট নিয়ে নেমে আসলাম, নামগিল তৈরী ছিলো, আমাদের দেখে গাড়ী স্টার্ট দিলো। যেপথে এসেছিলাম, সেপথে শহরে ফিরে, শহরকে পিছনে ফেলে সামনে এগুলাম মিনিট দশেক, পৌছে গেলাম রেঁস্তোরায়। সেখান থেকে আমাদের রিসোর্ট দেখা যায়।

ব্যুফে লান্চ, তবে প্রথম দিন বলে অতিরিক্ত ব্যবস্হা রেখেছে আমাদের ট্যুর অপারেটর। টেবিলে বসতেই দিলো মিষ্টি কুমড়ার স্যুপ আর ডিশ ভর্তি ভেজিটেবল মোমো। সাথে ভূটানীজ মরিচের এক সুস্বাদু সস। সবাই খেলাম, নাফে, সবচেয়ে বেশী, মোমোতেই তার লান্চ শেষ। মোমো কিন্তু আদি ভূটানীজ খাবার নয়। এরপর ব্যুফের বাদবাদি খাবার চেখে দেখলাম, সব লোকাল ডিশ, ভালোই খেলাম। যেকোনো কারনেই হোক, আমরা বাইরে গেলে সবসময় স্হানীয় খাবারই খাওয়ার চেষ্টা করি, ভাতের অভাবে আমাদের কারোরই কোনো কষ্ট হয়না, এমনকি আমাদের প্রায় চার বছর বয়সী ছেলেরও।

খাওয়ার মধ্যেই সহধর্মিনী ওয়েটারের মাধ্যমে পাঁচকের কাছ থেকে ঐ মরিচের সস বানানোর রেসিপি শুনে নিলো। পরবর্তিতে ভূটান থেকে চলে আসার আগের সন্ধ্যায় একগাঁদা ভূটানীজ শুকনো মরিচ কিনেছে, এই সস বানানোর আশায়। দেশে ফিরে আমি এখনো অপেক্ষায় আছি।

খাওয়া পর্ব শেষে শুরু হলো আমাদের ভূটান দর্শন। প্রথম গন্তব্য, Kichu Lhakhang, শহর থেকে বিশ-পঁচিশ মিনিট দূরত্বে। এটা পারো জেলার Lango Gewog এলাকায় পারো শহরেরে উত্তরে অবস্হিত ভূটানের অন্যতম প্রধান ও সবচেয়ে সুন্দর বৌদ্ধমন্দির। তৎকালীন তিব্বতীয় রাজা Songsten Gampo নির্মান করেন ৬৫৯ সালে। রাজা Sogsten Gampo যে একশত আটটি বৌদ্ধমন্দির তৈরী করেন, তারমধ্যে বারটি প্রধান মন্দির ছিলো, Kichu Lhakhang সেই বারটি প্রধান মন্দিরের একটি। বৌদ্ধগুরু Dilgo Khyentse Rinpoche এর দেহভস্ম এখানে রক্ষিত আছে। সপ্তম শতকে নির্মিত Jowo Sakyamuni র মূর্তিও এখানে আছে।

কিচু লাখাং দেখা শেষে বের হলাম পারো নদী দেখতে। নদীর পাশে সমান্তরালে রাস্তা চলে গেছে। পাহাড়ী নদীর সৌন্দর্য বর্ননা করা কঠিন। নদী আপাত শান্ত, কিন্তু স্রোতশীল। একজায়গায় নেমে নদীর শীতল জলের স্পর্শ নিলাম। নদীর মাঝে পাথরের মাঝে হাঁটতে গিয়ে মুহূর্তের অসরকতায় পিছলে পড়েছিলাম, কপাল ভালো, পাথর থেকে পানিতে পড়িনি। জুতায় ভাল গ্রীপ না থাকলে ভিজা পাথরে না নামাই ভাল। নদীর পাড়ে বেশ কিছু আপেল বাগান চোখে পড়লো, কিন্তু ফল ও পাতাবিহীন গাছগুলোকে নগ্ন দেখাছ্ছিলো, তাই আর ছবি তুললামনা। একই রাস্তায় শহরে ফিরে এলাম, মাঝে একটা পার্কে কিছুক্ষন সময় কাটালাম। অত:পর শহর দর্শন। পুরো শহর জুরেই স্যুভেনিরশপ, নিত্য প্রয়োজনীয় দোকানপাটতো আছেই। বোঝা যায়, ব্যাবসা মূলত পর্যটন কেন্দ্রিক।

গর্ব হোল যখন দেখলাম আমাদের বাংলাদেশের গার্মেন্ট এর বিশেষ কদর এখানে। দোকানের বাহিরে বিশেষ ভাবে লেখা “Dhaka Garments”, আর বাংলাদেশী মেলামাইন পণ্যের সমারোহ। কিন্ত অবাক হলাম এটা জেনে যে এই মেলামাইন পণ্য তারা বাংলাদেশ থেকে নেয় না, নেয় ভারত থেকে, বিশেষত ফুল্টসলিং থেকে।

কিছু ভুটানিজ স্যুভেনির দরদাম করলাম, তবে কিনলাম না। বলে রাখা ভাল, ভূটান কিন্ত বেশ ব্যয় বহুল একটি দেশ। স্যুভেনিরের দাম শুনে চোখ কপালে উঠে গেলে নামগিল, আমাদের গাইড আশ্বস্ত করলো, মোটামুটি কমদামে কেনার স্ট্রীট মার্কেট আছে, টাইগার নেস্ট এর বেস এ। পারো শহরের চেয়ে অর্ধেক দামে সেখান থেকে একই জিনিষ কেনা যাবে।

একটি কফি শপে কফি আর হাল্কা নাস্তা করে বিল দিলাম হাজার রুপি..!!! এরপর থেকে কফির শখ হোটেলে বসেই মিটিয়েছি। কোথাও ঘুরতে গেলে আমি সবসময় কিছু ইন্সট্যান্ট কফি সাথেই রাখি, যা বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে আমি সচরাচর দেশের বাইরে থেকে আনাই, নিজেও আনি, সহধর্মিনী ও কাজে বাইরে গেলে আমার জন্য নিয়ে আসে।

সন্ধ্যার মধ্যে হোটেলে ফেরা। এরা খুব তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পরে আর কাকডাকা ভোরে কাজে নেমে পরে। রিসেপশন থেকে জানালো, ডিনার সাতটা থেকে শুরু হবে, নয়টায় কিচেন বন্ধ হয়ে যাবে। কটেজে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে বসলাম একটু আয়েশ করার জন্য। ব্যালকনি থেকে চমৎকার দৃশ্য অবলোকন; শহর ও উপত্যকা একত্রে। সাড়ে সাতটার ডিনার, ব্যুফে, স্হানীয় খাবার। ডিনার শেষে রুমে ফেরা, রাতের দৃশ্য অবলোকন, শুয়ে পরা, প্রথম দিনের সমাপ্তি।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে চোখ জুড়িয়ে গেলো, অপূর্ব দৃশ্য, মেঘ যেন মাটি ছুতে চায়।

লাগেজ গুছিয়ে নাস্তা করে বের হয়ে গেলাম, গন্তব্য থিম্পু। পারো থেকে থিম্পুর দূরত্ব সাতান্ন কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘন্টা। শহরের ভিতর দিয়ে, পারো এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে শহর ছাড়লাম, উঠলাম হাইওয়েতে।

পথিমধ্যে নামগিল জানালো একটু পরেই একটা স্পট আছে যেখানে পারো নদি চমৎকার দেখা যায়, চাইলে আমরা নেমে দেখতে পারি। নেমে গেলাম, দেখার জন্যই তো এসেছি। খেয়াল করলাম নদীর এপাড় ওপার সংযোগকারী এক টানা তার। এটা কি? জিজ্ঞাসা করতেই নামগিল জানালো, নদীর ওপাড়ে বসবাস করে মাত্র একটি পরিবার। সরকার ওদের নদী পারাপারের সুবিধার্থে এই তার টানা দিয়েছে। মাত্র এক পরিবারের জন্য একটি সেতু অনেক বেশী ব্যয়বহুল। তারে কপিকলের মাধ্যমে একটি বসার আসন সংযুক্ত, যে নদী পার হবে, সে ঐ আসনে বসে কপিকলের মাধ্যমে তার টেনে টেনে এপাড় ওপাড় করবে।

ছেলেকে অনেক কসরত করে নদীর পাড় থেকে আনতে সক্ষম হলাম। সে আসতেই চায় না। নামগিল তাকে নদীতে পাথর ছোড়া শিখিয়েছে, সে পাথর ছোড়া ছেড়ে আসবে না। এরই মাঝে ছেলেকে নিজের বিদ্যাও জাহির করলাম। দেখে মেয়েও অবাক। বাবা … কিভাবে করলা? মেয়ের প্রশ্ন। তাকে শিখালাম কিভাবে পানিতে পাথর ছুড়ে ব্যাঙ লাফ দেওয়ানো যায়। শহরে বড় হওয়া এই প্রজন্ম কি ভাবে বুঝবে এর মর্ম! আর জানবেই বা কিভাবে? আমরা কি ওদের জন্য কিছু রেখেছি?

পরবর্তি যাত্রাবিরতি তামচো মনাস্ট্রি, অপর নাম তাচোগ লাখাং; আরো একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। নির্মান কাল পন্চদশ শতাব্দী, পারো নদির অপর পারে ছোট পাহারের উপড়। Thantong Gyalpo, প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আর্কিটেক্ট ও ইয়োগী, সুপরিচিত Iron Chain Maker হিসাবে, এই মন্দির ও ঝুলন্ত ব্রিজ তৈরী করেন।

মন্দিরে যাবার জন্য নদি পার হতে হয়, ঝুলন্ত ব্রিজে। এখন নদি পারাপারের জন্য রয়েছে একটি আধুনিক ঝুলন্ত ব্রিজ। পাশেই রয়েছে প্রাচীন ঝুলন্ত ব্রিজ, যেটা বর্তমানে শুধুই দেখার জন্য, ব্যবহার নিষিদ্ধ। নদি পার হয়ে টিলায় উঠা শুরু করলাম, পথের মাঝে ছোট একটি গুহা পেয়ে গুহামানব হয়ে ছবি তুললাম। অত:পর মন্দিরে গমন। সেখান থেকে আশেপাশের দৃশ্যাবলী চমৎকার। ফের পথ চলা, চমৎকার পাহাড়ী পথ। আর কোন যাত্রা বিরতি ছাড়া থিম্পু অভিমুখে।

স্হানে স্হানে রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলছে। এদেশে প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাব। সিংহভাগ শ্রমিক আসে ভারত থেকে। নির্মান কাজের পুরোটাই ভারতীয়রা করছে। প্রকৃতি এদের অনেক দিয়েছে। রাস্তার কাজে যে পাথর দরকার তা অন্য কোথা থেকে আনতে হয়না। রাস্তা চওড়া করার জন্য পাহাড়ের যে অংশ কাটে, তা থেকেই দরকারী পাথরের জোগান হয়।

পথে কিছুদূর পরপর সতর্কতা মূলক সাইনবোর্ড.. কিছু কিছু সাইনবোর্ডের কথা মনে আছে.. “Speed Thrills, but it Kills”।

সবচেয়ে মজারটা এরকম … “If you are married, then divorce speed”।

দুপুর নাগাদ পৌছে গেলাম থিম্পু, সুন্দর সাজানো এক শহর।

হোটেলে পৌঁছালাম, থিম্পুর বুক চিরে বয়ে চলা নদির পাশেই ছোট টিলার উপরে হোটেলের অবস্হান। হোটেল রিভার ভিউ। হোটেলের সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে নদী, Thimphu Chu, অপর নাম Wangchu। এখান থেকেও শহরের ভিউ চমৎকার।

নিজেদের চাঙ্গা করে বের হলাম দুপুরের খাবার খেতে। এখন পর্যন্ত যেখানেই গেছি, স্বদেশীর দেখা সবখানেই, এই রেস্টুরেন্টেও তার ব্যাতিক্রম হল না। খাবার পর্ব সেরে বের হলাম থিম্পু দর্শনে। তার আগে এক লোক এসে আমার সাথে দেখা করে জানালো, সে ট্যুর অপারেটর কম্পানির লোক। প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিল পারোতে দেখা করতে না পারার কারনে। তারপর জানতে চাইলো, সব কিছু ঠিক আছে কিনা। থিম্পুর হোটেল রুম পছন্দ হয়নি জেনে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, আমরা পুনাখা থেকে ফিরে এলে নুতন রুমের ব্যবস্থা করে দিবে। সে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। ভাবলাম, আমার দেশে কি এটা হতো! থিম্পুতে প্রথমেই গেলাম Memorial Chorten। এটা নির্মিত হয়েছিলো ১৯৭৪ সালে, জিগমে দরজি ওয়াংচুক, ভুটানের তৃতীয় রাজার স্মরনে।

সেখান থেকে গেলাম বৌদ্ধ পয়েন্ট। ট্যুরিস্টদের জন্য থিম্পুর সর্বশেষ সংযোজন। Kuenselphodrang Nature Park এর এক পাহাড়ে বুদ্ধের এক মূর্তি, ৫১.৫ মিটার (১৬০ ফুট) উঁচু, সমগ্র ভূটানের সবচেয়ে উঁচু বুদ্ধ মূর্তি। ব্রোন্জের তৈরী মূর্তিতে স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া। ভিতরে মন্দির, মন্দিরের ভিতরের নকশা নজর কারে। মন্দিরের ভিতরে বুদ্ধের ১,২৫,০০০ ছোট ছোট মূর্তি থরে থরে সাজানো। ক্যামেরা বা মোবাইলে ছবি তোলা নিষেধ বলে অন্দরের ছবি নিতে পারিনি।

মূর্তির পাদদেশে দাড়ালে থিম্পু ভ্যালির দক্ষিনের প্রবেশপথের পুরোটাই গোচরীভূত হয়। মূর্তির মূল নির্মান কাজ ২০১৫ সালে শেষ হলেও এখনো ফিনিশিং এর কাজ চলছে। এই মূর্তির কাজ শুরু হয় চতুর্থ রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক এর ষাটতম বার্ষিকির উদযাপনের অংশ হিসাবে। সন্ধায় হোটেলে ফিরে খেয়াল করলাম এই বূদ্ধমূর্তি হোটেল থেকেও দৃশ্যমান। শেষ বিকালের আলো থাকতে থাকতে সেখান থেকে ফিরতি পথ ধরলাম। থিম্পু অথেনটিক ক্রাফট বাজার এ কতক্ষন সময় ক্ষেপন করে ফিরে আসলাম আমাদের হোটেলে। দ্বিতীয় দিন শেষ হল। রাতে হোটেলের ব্যালকনি থেকে শহরের সৌন্দর্য দর্শন।

আগেই ঠিক করা ছিল যে পরদিন সকাল সকাল রওনা দিব। গন্তব্য পুনাখা, থিম্পু থেকে আশি কিলোমিটার দূরে, কিন্তু রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলছে বলে যেতে প্রায় তিন ঘন্টা লাগবে। রাতেই লাগেজ গুছিয়ে রাখলাম।

ভোরে ঘুম ভাঙলো, ব্যালকনিতে দাড়াতেই থিম্পুর দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দিলো।

একেবারে ছোটজন, নাফে সকালে যথেস্ট কাল ক্ষেপন করালো নাস্তা করতে। আর এত চন্চল, সামলে রাখা দূষ্কর। যাহোক, শেষ পর্যন্ত রওনা দিতে দিতে নয়টা বেজে গেল। তৃতীয় দিনের পথচলা শুরু। Buddha point এর বূদ্ধমূর্তি সামনে রেখে SUV চলছে।

আজ আমাদের গাইড পরিবর্তন হয়েছে। আগেরদিন বিকালে নামগিল খবর পায় যে তার মা গুরুতর অসুস্থ, হাসপাতালে নিতে হবে। তার মা থাকে ভূটানের আরেক প্রান্তে, যেতে সব মিলিয়ে দুদিন লাগবে। তাই, রাতেই সে পরিচয় করিয়ে দেয় তিনজিন এর সাথে। অপেক্ষাকৃত কম বয়স, এই লাইনে অভিজ্ঞতা এক বছরের। তবে পরবর্তি দিনগুলোতে সে আমাদের মোটেও হতাশ করেনি, তার কাজ সে ভালোই বুঝে।

তো কিছুদুর এগোবার পর তিনজিন ডানদিকে ইশারা করে বলল, “উপত্যকার অপর পাশে পাহারে যে দূর্গটি দেখা যাছ্ছে, সেটা ভূটানের সবচেয়ে পুরোনো দুর্গ, নাম সিনতোখা জং (Sintokha Dzong)”। দূর্গকে ওরা বলে জং।

আমরা যত পুনাখার দিকে এগুছ্ছি, পাহারে গাছপালার পরিবর্তন তত বেশী চোখে পড়ছে। পারো আর থিম্পুতে ছিল পাইনের আধিক্য, আর এদিকে সাইপ্রাসের আধিক্য। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সর্পিল পথ চলে গেছে, ভূমি থেকে ক্রমান্বয়ে উচ্চতা বেড়ে চলেছে। মেঘের বিচরন মুগ্ধ করে.. একসময় পৌছে গেলাম বিখ্যাত দোচুলা পাস। ভূটানের হিমালয় পর্বতমালার অংশে সাগর সমতল থেকে ১০.০০০+ ফুট উচ্চতার এই চুড়ায় একসাথে একশত আটটি স্টুপার অবস্হান।

রানীমাতা আসি দরজি ওয়াংমু ওয়াংচুক এই মন্যুমেন্ট তৈরী করান সেই সব ভূটানীজ সৈনিকদের স্মরণে যারা ২০০৩ সালের যুদ্ধে নিহত হন ভারতীয় বিদ্রোহীরা ভূটানের সীমানা ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইছিলো। ভূটানের তৎকালীন রাজা জিগমে সিংহে ওয়াংচুক এই বিদ্রোহীদের দমন করেন।

এই পাস থেকে হিমালয় পর্বতমালার মোট দশটি পর্বতচুড়া দেখা যায়।

কিন্তু মেঘ, বৃষ্টি আর কুয়াশার কারনে আমরা কোনো শৃঙ্গতো দুরে থাক, পাসের আশেপাশের কিছুও দেখতে পারিনি। এই দৃশ্য দেখার জন্য সেখানে ফিরে যাবার আশা রাখি। দোচুলা পাসের আশেপাশের দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। উঁচু পাহাড়ী পথ, এই পরিস্কার পথ, এই মেঘের ভিতর ঢুকে পড়া, ঠিক বর্ননা করা কঠিন।

এখানে একটি ক্যাফেটারিয়া আছে, ইছ্ছে হলে কফি-স্ন্যাকস খেয়ে চাঙা হয়ে নিতে পারেন। পুনাখায় যেয়ে যদি rafting করার ইছ্ছা থাকে, তাহলে এখান থেকেই যোগাযোগ করা সম্ভব… তাদের সাথে যোগাযোগের ফোন নম্বর এই ক্যাফেটারিয়াতেই দেয়া আছে। যারা মোটর বাইক ভাড়া নিতে চায়, তাদের জন্যও একই ব্যাবস্থা।

মেঘ-বৃষ্টির ভিতর দিয়ে আবারো পথ চলা। যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন তাদের জন্য অত্যন্ত চমকপ্রদ এই পথচলা। শহরে শহরে ঘুরে বেড়ানো আরবান টুরিস্টদের জন্য ভূটান নয়। এখানে অপরুপ প্রকৃতি আর ধর্মীয় নিদর্শনই মুল আকর্ষন। এ্যাডভেন্চার, ট্র্যাকিং, পর্বতারোহন যাদের অপছন্দ, তাদের জন্য এই দেশ নয়।

কিছুক্ষন চলার পর দুর থেকে সুন্দর পাথুরে এক পাহারের সৌন্দর্যে ছবি তোলার জন্য মোবাইল হাতে নিতেই তিনজিন জানালো, ওখানে আমরা থামব, সুন্দর জায়গা, একটি জলপ্রপাত আছে। নাম মিনচুনা ফলস্। এখানে খানিক যাত্রা বিরতি, জলপ্রপাতের শীতলজলে মুখ ধোয়া, আগুনে পোড়া ভুট্টা ভোজন। তিনজিন জানালো, এখানে খুব ভালো মোমো পাওয়া যায়। খোঁজ নিলাম, শুধু বিফ মোমো আছে, ভেজিটেবল মোমো নেই। হালাল-হারামের দ্বিধায় মোমো খেলাম না। শুরু হল আবার পথচলা। দুধারের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে সামনে এগিয়ে যাছ্ছি। একস্থানে এসে তিনজিন পথের পাশে বাহন থামিয়ে বলল, এখান থেকে Lobesa Valley পুরোটা দেখা যায়। এই ভ্যালিতে আরেক বিখ্যাত মন্দিরের অবস্হান। নাম চিমি লাখাং। নেমে গেলাম। উপর থেকে ভ্যালি সহ মন্দির দৃশ্যমান। পথের ধারে ফুটে থাকা ক্যাকটাস ফুল হঠাৎ নজর কাড়লো। পুরো পথ জুড়েই এরকম ক্যাকটাসের ঝোপ।

চিমি লাখাং, Lobesa Valley’র মূল আকর্ষন। ছোট এক টিলার উপরে, হেঁটে যেতে মিনিট বিশেক সময় লাগে। সন্তানহীন দম্পতিদের তীর্থস্হান। Chimi Lhakhang, Chime Lhakhang নামেও পরিচিত। চৌদ্দতম প্রধান পুরোহিত, Ngawang Choegyel ১৪৯৯ সালে এই লাখাং তৈরী করেন। পরবর্তিতে এখানে Drukpa Kunley, এক ভবঘুরে যাজক আস্তানা গাড়ে, যে ‘Divine Madman’ নামে অধিক পরিচিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শিবলিঙ্গের মত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে পরম পূজনীয় ‘ফালুস’।

চিমি লাখাং থেকে বের হয়ে আসলাম স্হানীয় এক রেস্তোরায়, দুপুরের আহার। অত:পর পুনাখা অভিমুখে আবার যাত্রা। মিনিট চল্লিশেক চলার পর পৌছে গেলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেলে। একই রকম দৃশ্য, হোটেলের সামনে দিয়েই বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদী।

পুনাখার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পারো বা থিম্পুর চেয়ে বেশী। হোটেলে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম পুনাখার আকর্ষন, পুনাখা জং দেখার জন্য। পুনাখার টাউন খুবই ছোট, আমাদের দেশের মফস্বল শহরের মত, একটি মাত্র প্রধান সড়ক, তবে ভূটানের আর সব শহরেরে মতই সাজানো, ছিমছাম। অল্প গাড়ী-ঘোড়া, কিন্তু যথেষ্ট জায়গা নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। পুনাখা জেলা হলেও পুনাখা নামে কোনও শহর নেই, শহরটা অন্য নামে পরিচিত, এখন ঠিক মনে করতে পারছিনা।

হোটেল থেকে মিনিট পনের চলে পুনাখা টাউন পার হয়ে আর মিনিট দশেক চলে পৌছে গেলাম ‘Punakha Dzong’ । দূর থেকেই নজরে আসে এই জং, ঠায় দাড়িয়ে তার সকল সৌন্দর্য নিয়ে।

এই দুর্গের অবস্হান সামরিক দিক থেকে তৎকালীন ভূটানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তিব্বতীয়দের আগ্রাসন ঠেকাতে। দুই নদী, মোচু আর পোচু এর সংযোগস্হলে। ভূটানিজদের বিশ্বাস; মোচু মেয়ে আর পোচু ছেলে। মোচুর পানি ঘোলা ও অপেক্ষাকৃত ঊষ্ণ , আর পোচুর পানি পরিষ্কার ও শীতল। এখানেই তারা তিব্বতীয়দের পরাজিত করে। ছয়তলা বিশিস্ট এই জং নির্মান করেন Ngawang Namgyel, নির্মান কাল ১৬৩৭-৩৮। পরবর্তিতে ১৭৪৪ থেকে ১৭৬৩ সালের মধ্যবর্তি সময়ে এটার সম্প্রসারনের কাজ করা হয়, শেরাব ওয়াংচুক এর শাসনামলে।

এটি ভূটানের দ্বিতীয় প্রাচীন, দ্বিতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর জং। ১৯৫৫ সালে রাজধানী থিম্পুতে স্হানান্তরিত হবার আগ পর্যন্ত এটাই ছিলো ভূটানের প্রশাসনিক কেন্দ্র। এ পর্যন্ত অনেকবার এই দুর্গ আগুনে ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। বেশী অবাক হয়েছি দুর্গের ভিতরে ঢুকে দ্বোতলায় পূর্ণবয়স্ক বট গাছ দেখে। জং থেকে বের হয়ে ফিরতি পথ ধরার আগে একটা পয়েন্টে দাড়িয়ে আরো কিছু ছবি তুললাম দূর্গকে পিছনে পটভূমিতে রেখে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এখানে রাতে কিছু করার থাকেনা। তাই ফিরতি পথ ধরে হোটেলে ফিরে আসলাম। পুনাখায় আরো একরাত থাকবো, তাই লাগেজ গুছানোর কিছু নেই। ফ্রেশ হয়ে আয়েশ করে রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে আসলাম।

পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেশে যেখানে সাতটার সময়ও মনে হয় আরেকটু ঘুমাই, সেখানে এই দেশে ছয়টার আগেই প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গে যাছ্ছে, নিয়মিত। বুঝলাম, তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাবার সুফল। জানালার পর্দা সরাতেই বিস্ময়ে অভিভূত। দ্রুত মোবাইল হাতে বারান্দায় চলে এলাম। আকাশের মেঘ মর্ত্য ছুয়ে আছে। প্রকৃতির এই রুপ বর্ননাতীত।

আজ চতুর্থ দিন শুরু। বাচ্চাদের মা সহ সবাইকে ডাকলাম এই অপরূপ দৃশ্য সচক্ষে দেখার জন্য। আজ আর সকাল সকাল বের হবার তাগিদ নেই। ধিরে সুস্হে তৈরী হয়ে নাস্তা সারলাম। আজ নাফে ব্যুফের কোনো খাবার খেতে না চাওয়ায় লটবহরের সাথে আনা কোকো ক্রান্চ দুধ দিয়ে খাইয়ে দিলাম। আমরা যখনই পুরো পরিবার একসাথে বেড়াতে বের হই, দেশের ভিতরে বা বাইরে, এক স্যুটকেস ভর্তি শুকনো খাবারের স্টক সাথে নিয়ে ঘুরি, বাচ্চাদের খাবারের সমস্যা মেটে, সময় অসময়ে আমাদের ও কাজে লাগে।

সকাল পৌনে দশটায় হোটেল থেকে বের হলাম। পনের মিনিট দেরী। গন্তব্যে পৌঁছার কথা দশটায়, হোটেল থেকে আধা ঘন্টা লাগে। পৌঁছালাম সোয়া দশটায়। পুরো পথ পোচু নদি আমাদের সঙ্গী, একবার ব্রিজে তাকে পার হলাম। তিনজিন জানালো, এই নদীই এখানকার বালু সংগ্রহের একমাত্র সোর্স। কিন্তু তা কড়া সরকারি নজরদারীতে করা হয়।

কথায় কথায় জানতে চাইলাম যে এখন পর্যন্ত ভূটানে কাউকে নদীতে গোসল করতে দেখলাম না বা নদীতে একটা নৌকাও দেখতে পেলাম না কেনো? দুটোই ভূটানে নিষিদ্ধ, জানালো তিনজিন। জননিরাপত্তার জন্য। কথায় কথায় আমরা গন্তব্যে পৌছে গেলাম। গাড়ী একেবারে মোচু নদীর পারে। কাছে যেতেই দেখতে পেলাম বেশ কতগুলো rafting boat একেবারে তৈরী। হ্যা, আজ আমরা rafting করবো।

Rafting এর জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। জুতা খুলে ফেলতে হল। পকেটে যা কিছু ছিলো তা তিনজিনের হাতে দিলাম গাড়ীতে রাখার জন্য। মাটিতে ছড়িয়ে রাখা পানিরোধক জ্যাকেট পরলাম। নিরাপত্তার জন্য মাথায় হেলমেট। সহধর্মিনী ও বাচ্চারাও তাই। খালি নাফের মাপের পানিরোধক জ্যাকেট না থাকায় তাকে শুধু লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দিলো। লাইফ জ্যাকেট আমাদের সবাইকেই পড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু রোদচশমা সাথে রাখার অনুমতি পেলাম। একটা ওয়াটার প্রুফ ব্যাগে ওয়ালেট ও মোবাইল নিয়ে নিলাম। বাকি সকল জিনিস গাড়ীতে। তিনজিনের হাতে আরেক মোবাইল, যেন সে আমাদের কিছু ছবি তুলতে পারে।

নদীতে মোট বার কিলোমিটার Rafting করতে হবে। rafting এর জন্য নামগিল, প্রথম গাইড আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিল, থিম্পু থেকেই। প্যাকেজ এর অন্তরভূক্ত না থাকায় এর জন্য আলাদা করে ডলার গুনতে হয়েছে। নামগিলকে জানিয়ে ছিলাম যে আমাদের এই বিষয়ে কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই, কাজেই সেভাবে যেন সে সব এ্যারেন্জ করে। নামগিল জানালো, তাই হবে।

পোষাক আশাক পরে তৈরী হবার পর তাদের নেতা আমাদের কাছে ডেকে দ্রুত এক লেকচার দিলো। লেকচার শুনে গলা শুকিয়ে গেলো, কারন এতোক্ষনে টের পেলাম আমাদেরকেও নদীতে বৈঠা মারতে হবে, নাহলে rafting করা সম্ভব নয়। টি-হোল্ড, অল ফরোয়ার্ড আর ব্যাকওয়ার্ড ঠিকমতো বুঝে নিলাম। সতর্কবাণী- টি-হোল্ড কোনো অবস্থাতেই ছাড়া যাবেনা।

যদি পানির ধাক্কায় নদীতে পরে যাই, তাহলে কি করতে হবে তাও সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিলো। কিন্তু তাতে কি আর গলা ভিজে!!! আমাদের সাথে অভিজ্ঞ মাত্র দুইজন থাকবে. একজন পিছনে হাল ধরে, আরেকজন সামনে আমার পাশে। পিছনের সারিতে একপাশে আমার স্ত্রী, একপাশে আমার মেয়ে প্রিমা, যে এর আগে ঠি কমত নৌকাই চড়ে নাই, আর এদের মাঝে বসা নাফে, আমার পৌনে চার বছর বয়সী ছেলে।

হালধারীর নাম কারমা, অল্প বয়সী। আমার পাশে সেই রকম কমবয়সী পিমা। পিমাকে দেখে বুকে বল পেলাম। এই পিচ্চি মেয়ে যদি Rafting Expert হয়, তাহলে আমিও পারবো। শুধু ভাবছি, বারো কিলোমিটার…!!!! খালি জিজ্ঞেস করলাম, মাঝপথে বাদ দিতে চাইলে সম্ভব কিনা? জানালো, সম্ভব। আল্লাহ ভরসা বলে উঠে পড়লাম। তিনজিন গাড়ী নিয়ে চলে গেলো ড্রপ পয়েন্টের দিকে। যাবার আগে জানালো, সুবিধামত জায়গা থেকে সে আমাদের ছবি তুলবে।

নদীতে ভাসার আগে দুই/তিন মিনিট প্র্যাকটিস… অল ফরোয়ার্ড, স্টপ, অল ব্যাকওয়ার্ড, লকইন…

আল্লাহর নামে নদীতে ভাসলাম। এক মিনিটের মাথায় টের পেলাম ছেলের নিরাপত্তার জন্য তাকে ধরে রাখা জরুরি.. নাহলে ঢেউ এ উল্টে বোট থেকে পড়ে যেতে পারে। কারমা এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সহধর্মিনীকে বললাম, বৈঠা রেখে ছেলেকে ধরো। ও তাই করলো। আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই বলে ওরা আমাদের লেভেল ওয়ান Rafting রুট এ নিয়েছিলো। কিন্তু আগামীবার অবশ্যই আমি নেক্স্ট লেভেল নিবো, এটা নিশ্চিত।

ভেলায় ভেসে এগুছ্ছি.. ক্ষনে ক্ষনে অল ফরোয়ার্ড আর স্টপ …. একসময় এলো প্রথম লকইন কল। নিজে লক করার সাথে সাথে বৌ-বাচ্চাকে বললাম .. লক, পা লক কর… সামনে ঢেউ… পানি নীচে পড়ছে.. নিম্নমুখী পানির তোড় কি জিনিষ … টের পেলাম। দূর থেকে নদীকে তো কত শান্ত দেখেছিলাম .. পাহাড়ী শান্ত নদী কি জিনিষ টের পাছ্ছি এবার….

সবচেয়ে বেশী খারাপ অবস্হা আমার ছেলে নাফের, এমনিতেই তার মাপের ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট নাই, পানির ঝাঁপটায় ভিজে শেষ, ঠান্ডায় কাপছে, তার উপর এই বোটের দুলুনীতে ভারসাম্য বজায় রাখা তার জন্য বেশ কষ্টসাপেক্ষ। ভাগ্যিস তার মা তাকে ধরে রেখেছে। তবে তার সাহসের কোনো কমতি কিন্তু দেখলামনা। তাকে যে দড়িটা ধরে থাকতে দেয়া হয়েছিলো, একমুহুর্তের জন্যও সেটা সে ছাড়েনি। যখন শক্ত করে ধরতে বলেছি, তখন শক্ত করেই ধরেছে, আর যখন আরাম করতে বলেছি, তখন দড়ি হাল্কা করে ধরে রেখেছে। এই কমান্ড ফলো করাটা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

এভাবেই এগুছ্ছি, মাথা শুধু কমান্ড ফলো করছে, ফরোয়ার্ড… স্টপ… হঠাৎ মনে হল কারমা পিছনে তাকাতে বলছে; তাকাতেই দেখি তার হাতে আমার মোবাইল, সবাইকে ফিরে তাকাতে বললাম, চটপট কিছু ছবি উঠানো হলো। অবাক করে দিয়ে কারমা বললো, “সেলফি তুলবেন”, বিনা বাক্যব্যয়ে হাত বাড়ালাম, উঠে গেলো চটপট কিছু সেলফি।

কিছুদুর যেতে কারমা ডানপাশে দেখতে বলল, “পাহাড়ে মন্দির দেখতে পাচ্ছেন”, সায় দিতেই জানালো এই মন্দিরে রাজার শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান হয়। আবারো এগিয়ে চলা.. ফরোয়ার্ড… স্টপ…. লক…, নজরে আসলো পুনাখা জং, দেখি পাড়ে তিনজিন দাড়িয়ে, ছবি তুলছে। হাত নেড়ে জানালাম দেখেছি।

জং এর কাছাকাছি আসতেই কারমা আবারো কিছু ছবি তুলে ফেললো। মোচু নদীর উপড়ে পুনাখা জং এ আসা যাওয়ার যে ব্রিজ, তার কাছাকাছি আসতেই হাততালির শব্দে উপড়ে তাকিয়ে দেখি মন্দিরের লোকজন আমাদের উৎসাহ দিছ্ছে, তাদের দিকে সৌজন্য মূলক হাত নাড়ালাম। আমরা ড্রপ পয়েন্টের কাছাকাছি চলে এসেছি। মোচু আর পোচু যেখানে মিলিত হয়েছে, তার একটু আগে মোচু তে একটা ঘূর্ণী আছে., আবারো লক, এর মধ্যেই পিমা হাসতে হাসতে জানালো এটা হলো কফি পট। কেনো? শুধালাম। এই যে … এই ঘূর্ণী… এখানে পড়ে গেলে কফির পানিতে চিনি মিশানোর মত ঘুরতে থাকবেন, হাহ্ হাহ্ হাহ্, ভয়ের মাঝেও হাসি আটকাতে পারলাম না।

মোচু-পোচু মিলনস্হলে পানির রং এর তারতম্য স্পস্টতই চোখে পড়লো, মোচুর ঘোলা পানি মিশে যাছ্ছে পোচুর পরিষ্কার শীতল জলে। পোচুর জলে হাত ডুবালাম। উফস…. কি ঠান্ডারে বাবা… পড়ে গেলে লাইফ জ্যাকেট থাকলেও মারা যাবো এই ঠান্ডা পানিতে।

অবশেষে ড্রপজোন, ভেলা পাড়ে ভিড়ালাম, নেমে আড়ষ্ট হাত পা ছুড়ে আড়ষ্টতা কাটালাম। rafting gear সব কারমা-পিমাকে বুঝিয়ে দিয়ে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। সাথে এক সেলফি। ওরা ওদের ভেলা গুটাতে শুরু করলো, সবকিছু ওদের গাড়ীতে উঠিয়ে বেস এ ফিরতে হবে। আমরাও হোটেলের পথ ধরলাম, জামা কাপড় সব ভিজে শেষ… পাল্টাতে হবে।

ভিজা জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম সবাই। কিছুক্ষনের বিশ্রাম। তিনজিন সময় বেধে দিয়েছে.. একটায় লান্চ। সময় মত নেমে এলাম সবাই। গন্তব্য Lobesa Valley’র সেই রেঁস্তোরা.. পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথে চলা। রেঁস্তোরায় বসে দূরে চিমি লাখাং চোখে পড়ে। উপত্যকায় জমিতে পাকা ধান; পাখিদের ধানক্ষেতে আনাগোনা দেখা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে। আর তারই মাঝে ছেলেমেয়েকে পাখি চেনানো। ঢাকায় থেকে তো চিনেছে শুধু কাক-শালিক-কবুতর আর চড়ুই পাখি।

খাওয়া শেষে ফিরে চলা পুনাখায়। একই পথে ফিরে শহর ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম, যাবো পোচু’র উপড়ে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে। পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ… ভূটানের দীর্ঘতম সাসপেনশন ব্রিজ… তিনশত পঞ্চাশ মিটার লম্বা। গাড়ী থেকে নেমে বার/পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ।

আমাদের মত অনেকেই এসেছে ব্রিজ দেখতে। পুনাখা জং থেকে হাঁটাপথে মিনিট বিশেক দূরত্বে এই ব্রিজ, সমুদ্র সমতল থেকে ১২২৩ মিটার উচ্চতায়। এটা বেশ ভালো ভাবেই বানানো, ফলে, দুলুনি মোটেই টের পাওয়া যায় না। মূলত পুনাখা শহরবাসীর সহজে ও শর্টকার্টে পুনাখা জং এ আসার সুবিধার্তে এই ব্রিজ বানানো হয়েছে। প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী চমৎকার।

ব্রিজ দেখা শেষে ফিরতি পথ ধরলাম। পুনাখা জং পেরিয়ে পুনাখা শহরকে পাশ কাটিয়ে এগুলাম ওয়াংদু শহরের দিকে। ওয়াংদু পুনাখার পার্শ্ববর্তী জেলা ও শহর। পথে প্রচুর ছেলেমেয়ের দেখা মিললো, তিনজিন জানালো, এরা সবাই ছাত্র-ছাত্রী। এদেশে সকাল থেকে স্কুল শুরু হয়, বিকাল পর্যন্ত চলে। সবাইকে দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে হয়।

ওয়াংদুতে এখন Tschechhu Fair চলছে। Tschechhu বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। Guru Rinpoche যে মাসে জন্মেছিলেন, সেই চাঁন্দ্রমাসের দশম দিনে এটা পালন করা হয়। অবশ্য এলাকা ও মন্দির ভেদে এই উৎসব বিভিন্ন মাসে পালিত হয়। সাথে থাকে স্হানীয় মেলা। পুরো উৎসব তিনদিন ধরে চলে। আর এই সময় সকল অফিস-আদালত বন্ধ থাকে।

ওয়াংদু Tschechhu’র প্রবর্তক Zhabdrung Ngawang Namgyal। অধিক পরিচিত Taksha Mancham বা ড্যান্স অব অক্স এর জন্য। আমরা মেলায় হাজির হলাম দ্বিতীয় দিনে। মেলার বৈশিষ্ট আমাদের দেশের মতই। আমরা মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছেই পেয়ে গেলাম স্হানীয় নাচের মিছিল।

আমাদের গাইড তিনজিন এর বাড়ী এই ওয়াংদুতেই। আমাদের প্যাকেজ এর মধ্যে ওয়াংদু ছিলো না। সৌভাগ্য আমাদের যে এটা তিনজিনের এলাকা বলে সিডিউলের বাহিরে এই ঘোরাঘুরিতে সে রাজি হয়েছে, শর্ত, কাউকে বলা যাবে না, আর একটু নিরাপত্তা বজায় রেখে চলাফেরা করা। কারন যদি কিছু ঘটে যায়, তখন সকল দায় বর্তাবে তার উপর।

তার স্ত্রী এই মেলায় স্টল দিয়েছে, সাধারন খেলনা-পাতির। খুঁজে বের করে দেখা করলাম তিনজিনের পরিবারের সাথে। মেলায় কিছুক্ষন ঘুড়াঘুড়ি করে টুকটাক কিছু কেনাকাটা করলাম। এরপর এগুলাম ওয়াংদু শহরের দিকে। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর সাজানো গোছানো, ছবির মত, ভূটানের আর সব শহরের মতই। এখানেও কিছু সামান্য কেনাকাটার কাজ সারলাম। কারন থিম্পু বা পারোর চেয়ে এখানে দাম তুলনামূলক কম। অবশেষে হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম।

পুনাখা পর্ব শেষ। ভ্রমনের চতুর্থ দিন শেষ হয়ে আজ পন্চম দিনের শুরু। রাত থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে, প্রবল বর্ষন না, তবে ঝিরঝিরি বৃষ্টি সারা রাতই ছিলো। সকালে বারান্দায় দাড়াতেই নজরে পরলো একরাতের বৃষ্টিতে ফুলেফেপে উঠা নদী, স্রোতের বেগ প্রবল। আজ থিম্পু ফিরে যাবো। সকাল নয়টার মধ্যে যাত্রা শুরু করার কথা।

সহধর্মিনী আগেই উঠেছে, বাচ্চাদের ঘুম ভাঙ্গালাম। ফ্রেশ হয়ে লাগেজ গুছাতে গুছাতে সাড়ে আটটা বেজে গেলো। আমাদের অবশ্য ট্রেন / বাস ধরার বা গ্রুপের অন্যদের সাথে তাল মেলানোর ব্যাপার নেই। তাই তাড়াহুড়াও নেই। আস্তে ধিরে তৈরী হয়ে নামলাম প্রাত:রাশ সারতে। ব্যুফে ব্রেকফাস্ট… অবশ্য খুব বেশী আইটেম ও নেই। ব্রেড, বাটার জেলি, রুটি, বিনস, পরিজ, ফ্লেকস্… আর ফলের মধ্যে কলা ও তরমুজ। পছন্দ মত যে যার খাবার খেয়ে নিলাম। আয়েশ করে গরম এক কাপ কফি সবশেষে।

এদিকে এর মাঝে তিনজিন একবার ঘুরে গেছে। রিসেপশনে আসতেই তিনজিন জানালো, লাগেজ গাড়ীতে উঠে গেছে, আমরা রওনা দিতে পারি। শুরু হল ফিরতি যাত্রা। চলার পথে তিনজিন এর সাথে আলাপ চারিতায় জানতে পারলাম যে ভুমতাং হল ভূটানের সুন্দর স্থান। এটা আরেক জেলায়, ভূটানীদের কাছে তাদের সুইজারল্যান্ড। ভুমতাং আমাদের এবারের ভ্রমন প্যাকেজে নে থাকায় আফসোস করলাম। তখনি ঠিক করলাম যে ভুটানে আবার আসতে হবে, ভুমতাং দেখার জন্যে। কথাছছলে তিনজিন জানালো যে আমরা যদি তাকে আগে থেকে জানাই, তাহলে আমাদের পরবর্তী ভূটান ভ্রমনের আয়োজন সে করতে আগ্রহী। খরচ তিরিশ শতাংশ কম। সায় দিলাম, আবার আসলে জানাবো।

কিছুক্ষন চলার পর বৃষ্টি কমে আসা শুরু হল, এক সময় থেমেও গেলো। দুধারের দৃশ্যপট দেখতে দেখতে এগুছ্ছি। বুঝতে পারছি পিছনে সবাই ঝিমাছ্ছে, কখন যে নিজেও ঝিমাতে শুরু করলাম, বুঝতেই পারলামনা। ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ী থামায় জেগে উঠে সোজা হয়ে বসতে বসতেই শুনলাম তিনজিন বলছে… “Everybody go and walk in the park, you will be refreshed “।

আমরা Lamperli Royal Botanical park, Lamperi, Thimphu’র প্রবেশ মুখে। এটা রডোডেনড্রন গার্ডেন নামেও পরিচিত। দোচুলা পাসের কাছেই, পুনাখা থেকে থিম্পুভিমুখে ঘন্টা দেড়েক দূরত্বে।

জিগমে সিংহে ওয়াংচুক পার্ক ও জিগমে দরজী ওয়াংচুক পার্কের মাঝামাঝি ৪৭ বর্গ মাইল এলাকাজুড়ে এই পার্ক। গড় উচ্চতা ২১০০ মি: (৬৮৯০ ফুট), সর্বোচ্চ উচ্চতা ৩,৭৫০ মি:। ৪৭ জাতের রডোডেনড্রন এর সংগ্রহ এই পার্কের। টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। এতো বড় পার্কের পুরোটা ঘুড়ে দেখা সম্ভব না বিধায় কাছাকাছি কিছু জায়গায় ঘুড়ে দেখলাম। গেট দিয়ে ঢুকে একটু এগোলেই পাহাড়ের উপরের লেক এর দর্শন মিলে, যদিও তাতে পানির পরিমান খুবই কম, যতটুকু দেখতে পেলাম, তাতে কয়েক ফুট গভীরতা হবে বলেই মনে হলো।

কিছু বিরল অর্কিডের সংগ্রহ আছে। অল্পক্ষন পরেই বেড়িয়ে এলাম, কারন এটা আমাদের শিডিউলের বাইরে ছিলো। অত:পর আবারো দুচালা পাস। কিন্তু বিধি বাম। মেঘ আর কুয়াশার কারনে এবারো পর্বতশৃঙ্গের দেখা পেলাম না। ক্যাফেটারিয়ায় রিয়ায় হাল্কা স্ন্যাকস আর কফি খেয়ে চলা শুরু করলাম। গন্তব্য.. থিম্পু ।

থিম্পু পৌছে সরাসরি চলে গেলাম সিমতোখা জং, এদেশের সর্বপ্রথম নির্মিত জং, যেটা এর আগে দূর থেকে দেখে চলে গিয়েছিলাম পুনাখায়। নির্মানকাল ১৬২৯ সাল, নির্মান করেন Zhabdrung Ngawang Namgyal, যিনি ভূটানকে একত্রিত করেন। বর্তমানে Dzongkha ভাষাশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করছে।

সিমতোখা জং দেখা শেষে হোটেলে চেকইন করলাম। ফ্রেশ হয়ে সামান্য বিশ্রাম ও নির্ধারিত রেস্তোরায় দুপুরের আহার। সব স্হানীয় ডিশ। পাশের টেবিলে আরেক স্বদেশী পরিবার, আমাদের মতই চার সদস্যের, শুধু বয়সের পার্থক্য।

টাকিন জু (Motithang Takin Preserve), পরবর্তী গন্তব্য। টাকিন ভূটানের জাতীয় পশু, বন্য, পাহাড়ে বিচরন করে, বিলুপ্তির পথে। আমার মনে হয়েছে, মহিষ, গরু ও ছাগলের মিশ্রণ এই টাকিন। ভূটান সরকার ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড (WWF) এর যৌথ উদ্যোগে ২০০৪ সালে থিম্পু শহরের প্রান্তে এই প্রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়।

ফেরার পথে বার্ডস আই পয়েন্টে থামলাম। এখান থেকে থিম্পু ভ্যালি ও শহর এক নজরে দেখা যায়। Sangaygang পাহারের চূড়ায় এই পয়েন্ট।কিছুদুর এগিয়ে আরেক স্থানে গাড়ী থামাল তিনজিন। এখান থেকে রাজপ্রাসাদ ও রাজকার্যালয় দর্শন। দূর থেকে দেখে মন ভরলো না। তাই চললাম রাজার কার্যালয় দেখতে, অফিস সময়ের পর এটি উন্মুক্ত সকলের জন্য। আমাদের যেতে দেরী হওয়ায় প্যালেসের অন্দরে ঢুকতে পারলাম না, কিন্তু প্রাসাদ প্রাঙ্গন ঘুড়েফিরে দেখতে পারলাম।

ইচ্ছা ছিলো পোস্টাল হেডঅফিসে যাবো, কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় পারলাম না। থিম্পুচু নদীর পাড়ের পার্কে কতক্ষন ঘুড়াঘুড়ি করে হোটেলে ফিরলাম।

হোটেলে ফেরার পর থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মুষলধারে নয়, হাল্কা বৃষ্টি। বারান্দায় বসে রাস্তার গাড়ী দেখা ছাড়া আর কাজ নেই। ডিনার সেরে একটু গল্প গুজব করে লাগেজ গুছানোর কাজে হাত দিলাম। সকালে পারো ফিরে যেতে হবে। সারাদিনের ঘুরাঘুরির ক্লান্তিতে বাচ্চারা তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ে। অথচ দেশে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে রীতি মত বেগ পেতে হয়। লাগেজ গুছিয়ে বারান্দায় বসে বৃষ্টিস্নাত থিম্পুর রাতের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে নিদ্রাদেবীর আহবানে সাড়া দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লাম।

কাকডাকা ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দেখি আমার উনি আরো আগে উঠে বারান্দায় বসে আছে। কানে স্রোতের জোড়ালো শব্দে তাকিয়ে দেখি, হোটেলের সামনে দিয়ে বয়ে চলা থিম্পু চু নদী বৃষ্টিতে যৌবন ফিরে পেয়েছে। ভরা যৌবনের স্রোতশ্বিনী থিম্পু চু, পাথরে আছড়ে পরা ফেনিল জলরাশি, স্বল্পধারার বৃষ্টি… অদ্ভুত …. ।

বাচ্চাদের জাগিয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। প্রাত:রাশের আয়োজন আজও ছোটমিঁয়ার পছন্দ হলো না। সাথে আনা কর্নফ্লকস্ এর জন্য ওয়েট্রেসের কাছে দুধ চাইতেই দিয়ে গেলো। নাস্তা পর্ব সেরে চেক আউট করলাম। বৃষ্টিস্নাত দিনে শুরু হলো পারো ফিরে যাবার পালা। আজ এই প্রথম দেশ থেকে বয়ে আনা শীতবস্ত্র কাজে লাগলো।

বুদ্ধমূর্তিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম। কোথাও কোথাও পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি রাস্তা অতিক্রম করে নীচে বয়ে চলেছে। কোথাও কোথাও গড়িয়ে পরা পাথর-নূড়িতে পথ ভরে আছে। বুঝলাম, দুদিনের বৃষ্টির ফল। আজ মনে হল তিনজিন একটু দ্রুত গাড়ী চালাচ্ছে।

রাস্তায় পড়ে থাকা পাথর এর পরিমান আস্তে আস্তে বাড়ছে। কোথাও কোথাও কোনোমতে একটি গাড়ী পার হতে পারে। এক সময় তিনজিন গাড়ীর গতি আরো বাড়িয়ে দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জানালো… এখানে যে ভাবে রাস্তায় পাথর পড়ে আছে, তাতে তার মনে হচ্ছে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা বড় পাথরে যে কোনো সময় বড় ধ্বস নামতে পারে। তাই সে দ্রুত পথের এই অংশটুকু পার হয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পাহাড়ী পথের সৌন্দর্যে এই কদিন বিভোর ছিলাম। আজ প্রথম পাহাড়ী পথকে ভয় পেলাম। বড় একটা পাথর কোনো ভাবে গাড়ীর উপড় পড়লেই যথেস্ট, মনে মনে ভয় পেলেও তিনজিনকে বললাম, কপালে যদি লেখা থাকে, তাহলে পড়বেই, তুমি বরং সাবধানে গাড়ী চালাও।

বিপদসংকুল অংশটুকু নির্বিঘ্নে পার হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছুক্ষন পরেই পারো শহর নজরে পড়লো। আমরা শহরের পথে না গিয়ে অন্য পথ ধরলাম। গন্তব্য চেলালা পাস, সমূদ্র সমতল থেকে বারো হাজার ফুট উপরে। এটাই ভূটানের সর্বোচ্চ স্হান, যেখানে রাস্তা গেছে, গাড়ী যায়।

পাহার বেয়ে ক্রমাগত উপরে উঠা… বৃষ্টির কারনে গতি আরো মন্হর। দুপাশের যতটুকু নজরে আসে, সুন্দর, যদিও দৃষ্টিসীমা কমে গেছে… বৃষ্টি, মেঘ আর কুয়াশায়। আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো একটি ট্যুরিস্ট বাস। বাস ভর্তি ট্যুরিস্ট।

পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথে একসময় পৌছে গেলাম চেলালা পাস। দুইপাশে ছোট দুই চুড়া, মাঝখান দিয়ে পথ চলে গেছে। দুই চুড়াতেই মৃতদের স্মরনে গাঁথা অসংখ্য বাঁশ। ভূটানে প্রতি মৃত ব্যক্তির জন্য একশত আটটি বাঁশ গাঁথা পালিত নিয়ম।

বৃষ্টি, মেঘ আর কুয়াশার জন্য ভ্যালি অদৃশ্য। সীমিত দৃষ্টিসীমায় তেমন কিছু দেখতে পেলাম না। আমাদের দূর্ভাগ্য। কিন্তু আমাদের মত অসংখ্য টুরিস্ট এসেছে আজ। বুঝলাম, এরাও হয় কাল নাহয় পরশু ভূটান ছেড়ে যাবে, তারাও আমাদের মতই কপাল পোড়া। স্বল্পসময় ক্ষেপন করে ফিরে চললাম পারোর দিকে।

সরাসরি চলে আসলাম নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে। পারোতে এর আগে এই রেস্তোরাতেই লান্চ করেছিলাম। ঢুকেই চোখে পড়লো সেই বাংলাদেশী পরিবারকে। ওরাও তাহলে আজ এখানে এসেছে থিম্পু থেকে। যথারীতি স্হানীয় খাবার দিয়ে আহারপর্ব সেরে নিলাম। এবার হোটেলে যাবার পালা।

হোটেলে পৌছে বরাদ্দ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। কিছুক্ষন বিশ্রাম। যদিও তিনজিন আধা ঘন্টা সময় দিয়েছিলো, আমরা ঘন্টাখানেক জিরিয়ে নিলাম। বৃষ্টিতে আলস্য ধরেছে।

অবশেষে আবার বেড়িয়ে পড়লাম। যাচ্ছি মিউজিয়াম দেখতে। তিনজিন ভিতরে ঢুকার টিকি ট কেটে দিলো। প্যাকেজভূক্ত বলে এখানে আমাদের টিকেটে র টাকা দিতে হলো না। মিউজিয়ামে ঢুকেই চোখে পড়লো দেয়ালে থরে থরে সাজানো নানান মুখোশ আর তার বিবরন। ভূটানের ঐতিহ্যবাহী মুখোশ নৃত্যের শো এলইডি স্ক্রীনে দেখানো হচ্ছে, দাড়িয়ে কিছুক্ষন ঐ শো দেখলাম। অন্য একটি কক্ষে বৌদ্ধ মনিষিদের ছবি ও বর্ননা। আরেক কক্ষে নানান পশুপাখির ষ্টাফ করা নমুনা ও বিবরন। স্যুভেনীর শপ ও আছে। মিউজিয়ামে ঢোকার সময় মোবাইল/ক্যামেরা কিছু সাথে নিতে না দেয়ায় এখানে কোনো ছবি তুলতে পারিনি।

মিউজিয়াম থেকে বেড়িয়েই পাশে জং। সামান্য ঘুরে দেখলাম। ধ্বংস হয়ে যাওয়া ড্রুগেল জং দেখার কথা ছিলো, কিন্তু বৃষ্টির কারনে তা বাদ দিলাম।  শহরেরে পথ ধরলাম।

পারোতে আরো একদিন আছি। এই শেষদিন আমাদের যাবার কথা টাইগার নেস্ট। কিন্তু দুদিন ধরে যে ভাবে বৃষ্টি হল তাতে আমি সন্দিহান হয়ে পড়লাম এই ব্যাপারে। পাহাড়ে পথ এই বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে যাবার কথা। বউ বাচ্চা সহ সেখানে যাওয়া মনে হয় না সম্ভব হবে।  তিনজিনকে জিজ্ঞাসা করলে জানালো এরকম বৃষ্টি চলতে থাকলে সবার যাওয়া ভালো হবে না। আর যদি রোদ উঠে, তাহলে যাওয়া যাবে।

কিন্তু পথতো অনেক পিচ্ছিল ও কাদা হয়ে আছে, বৃষ্টি না থাকলেও তা কি শুকিয়ে যাবে? আমার প্রশ্নে নেতিবাচক মাথা নাড়লো সে। অবশেষে তাকে বললাম, আচ্ছা, যদি টাইগার নেস্টের বদলে হা ভ্যালীতে যেতে চাই, যাওয়া যাবে? সম্ভবত, বললো তিনজিন, তবে অফিসে কথা বলে কনফার্ম করতে হবে।

শহরে কিছক্ষনের জন্য থামলাম। চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে, কালেকশনের জন্য দুএকটা স্যুভেনীর কেনা দরকার। অবশ্য আজ কিনব না, দোকানে দোকানে ঘুরে পছন্দ করে রাখব। যদি টাইগার নেস্টের ওখানে কমদামে পাই কিনে ফেলবো, নাহলে কাল বিকালে এখানে পছন্দ করা দোকানে এসে ঝটপট কিনে ফেলবো।

দোকানে দোকানে ঘুরতে ঘুরতে সুভেনীর পছন্দ করার পাশাপাশি সহধর্মিনীর সাথে আগামীকালের করনীয় ঠি ক করে ফেললাম। সিদ্ধান্ত হলো, আবহাওয়া যাই হোক, আমি টাইগার নেস্টে যাবো। যদি আবহাওয়া অনূকুলে থাকে তাহলে সবাই যাবে।

হোটেলে ফিরে তিনজিনকে সেই মোতাবেক জানিয়ে দিলাম। সকালে সাতটার মধ্যে যাত্রা শুরু করতে হবে, জানালো তিনজিন, তাহলে দুপুর একটার মধ্যে টাইগার নেস্ট দেখে ফিরে আসতে পারবো। ঠিক আছে, তাহলে তুমি সকাল সাতটায় তৈরী থেকো, বললাম তিনজিনকে। সায় দিয়ে রাতের জন্য বিদায় নিলো তিনজিন।

রাতে ডিনার শেষে নিজেদের মধ্যে আবারো আলোচনা করলাম। হিসাব করলাম টাইগার নেস্টের উচ্চতা দশ হাজার ফুট। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ক্যাফেটারিয়া প্রায় অর্ধেক পথ, মানে পাঁচ হাজার ফিট। নামগিল দুদিনের মাথায় থিম্পু থেকে বিদায় নেবার আগে পাহাড়ে উঠার জন্য তিনটা ঘোড়া বুক করে রেখেছিলো। ঘোড়ায় চড়ে উঠার পরেও হাজার পাঁচেক ফিট পায়ে হেঁটে উঠতে হবে। নাফের জন্য ব্যাপারটা অত সহজ হবে না। আর বাচ্চা ছেলে, যদি মাঝপথে বেকে বসে, তাহলে আরেক সমস্যা।

অতএব শেষ সিদ্ধান্ত হলো যে কাল টাইগার নেস্টে আমি একাই যাবো, ওরা হোটেলেই থাকবে বা পারো শহরে ঘুড়বে অথবা রোদ থাকলে তারা আরেকবার চেলালা পাস চলে যাবে। আজ তো আমরা সেখানে কিছুই দেখতে পারি নাই।

রাতে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। কম্বলের নীচে আরামে ঘুমালাম। এখানে কোনো হোটেলেই এসি চোখে পড়ে নাই এই কয়দিনে। কিন্তু সবখানেই রুম হিটার আছে। ফ্যান আছে, কিন্তু এক হোটেলে তো ফ্যানও ছিলো না। আসলে সারা বছর আবহাওয়া এমন থাকে যে এসির প্রয়োজন পড়ে না।

শীত শীত আমেজে কম্বলের ওম এ আরামে ঘুমিয়ে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গেলাম। সাত সকালে বের হতে হবে। সাতটায় তিনজিন রেডি হয়ে থাকবে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাহিরে তাকালাম বৃষ্টির অবস্থা দেখতে। বৃষ্টি নেই, ভালো খবর।

দুরের পাহারের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করলাম, আর বৃষ্টি হবে কিনা। ঠি ক বুঝতে পারলাম না। এখানকার আবহাওয়ার চরিত্র বিচিত্র… এই রোদ এই বৃষ্টি। তবে অক্টোবর মাসের এই সময় নাকি এই বৃষ্টিটা একেবারেই হঠাৎ… সাধারণত এই সময় নাকি এরকম টানা বৃষ্টি হয়না। মেঘের ছায়া খুঁজতে যেয়ে দুর পাহাড়ে হঠাৎ দেখি সাদা চূড়া… অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে কিছুটা সময় লাগলো যে ওটা আসলে স্নো… স্বচক্ষে এই প্রথম পাহাড়ের বরফে ঢাকা শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গ দেখা।

এরমাঝে সহধর্মিনীর ও ঘুম ভেঙ্গেছে। তাকেও ডেকে বরফে ঢাকা পাহাড়চুড়া দেখালাম। সেও উচ্ছসিত। বললাম ছেলেমেয়ে ঘুম থেকে উঠলে ওদেরকেও দেখিয়ো।

সকাল পৌনে সাতটায় বের হয়ে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। এখানে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে ডাইনিংয় রেডি থাকে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে। টোস্টেড ব্রেড, স্ক্র্যামবল্ড এগ, বাটার, পরিজ, কলা আর কফি খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। তৈরী তিনজিন, আমাকে দেখেই গাড়ী স্টার্ট দিলো। রওনা হলাম টাইগার’স নেস্টের পথে। যেতে পঁচিশ/তিরিশ মিনিট লাগবে।

যেতে যেতে ভাবলাম… শরীরের যে অবস্হা, পারবো তো মন্দির পর্যন্ত উঠতে। ব্যায়াম/মর্নিং ওয়াক বা খেলাধুলা… এই সবের সাথে সংশ্রব নেই আজ বহু বছর। তার উপড় ব্যাংকের চাকুরী, বসে বসে কাজ, এয়ার কন্ডিশন্ড অফিস… নিজেকে ফার্মের মুরগির মত মনে হল। শরীর যদিও শক্ত সমর্থ আছে (আমার ধারনা), দমের অবস্হা সুবিধার না।

সেই কবে ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে বেড়িয়েছি.. সাতাশ বছর… ছয় বছরের কঠিন ট্রেইনিং শরীরকে ভালই গড়ে দিয়েছিলো…. সেই ফুয়েলেই এতদিন চলেছি… কিন্তু রিফুয়েলিং এর সময় সমাগত।

আন্ডার ওয়াটার ডাইভার এক বাল্যবন্ধুকে বলেছিলাম, ডাইভিং শিখতে চাই… বন্ধু বলেছিলো… সাঁতার কাটতে থাক… যেদিন ১০০ মিটার সুইমিংপুল ননস্টপ আটবার এপার ওপার করতে পারবি সেদিন আমাকে জানাস… এটা মিনিমাম কোয়ালিফিক্শল। আমি এখন ২৫ মিটার সুইমিংপুল তিনবার এপার ওপার করতে পারি… মিনিমাম কোয়ালিফিকেশন যে কবে অর্জন করবে! আমার কি আন্ডার ওয়াটার ডাইভিং আর শেখা হবে না? বন্ধু … !

তিনজিনের কথায় বাস্তবে ফিরে আসলাম… ঘাড় ঘুড়িয়ে ডানে উপরে তাকাতেই পাহাড়চূড়ায় মন্দির দেখতে পেলাম, টাইগার’স নেস্ট। যেতে হবে ঐ চূড়ায়… সমুদ্র সমতল থেকে ১০,০০০+ ফিট উপড়ে।

পারো নদী পার হলাম ব্রিজ দিয়ে.. নদীর তীব্র স্রোত আর ঢেউ দেখে মিলাতে পারলাম না সাতদিন আগের সেই শান্ত নদীর সাথে। পাহার থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি নদীকে ভয়ংকর সুন্দর করে তুলেছে। পাহাড়ের গাছপালার ভিতরে আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম টাইগার’স নেস্ট বেস এ। অনেক লোকজনের সমাগমে ব্যাস্ত। অনেকে বাচ্চাদেরকেও নিয়ে এসেছে দেখে মনে মনে আফসোস করলাম, কেনো সবাইকে নিয়ে আসলাম না!! ভাল রোদ উঠেছে… পথ হয়ত শুকিয়ে যাবে।

এখান থেকে আমি একা। তিনজিন হোটেলে ফিরে যাবে। ওদের সাথে থাকবে আর একটার সময় এখানে ফিরে আসবে আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে।

বেস থেকে আবারো দেখেনিলাম টাইগার’স নেস্ট। এতদূর থেকেও চোখে পরে নেমে আসা ঝর্নাধারা। এই সেই গুহা যেখানে অষ্টম শতকে বৌদ্ধগুরু পদ্মাসম্ঙা ধ্যানে বসেছিলেন। কথিত যে দীর্ঘ তিন বছর তিন মাস তিনদিন তিনঘন্টা তিনি এখানে গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। পরবর্তিতে ১৬৯২ সালে এখানে প্রথম আনুষ্ঠানিক মন্দির স্হাপন করা হয়। পারো টাক্সটাং… টাইগার’স নেস্ট… Takstang Palphug Monastery নামেও পরিচিত।

উপড়ে উঠার জন্য তিনটা ঘোড়া আগেই বুক করা ছিলো, পরিবার না আসায় দুটো ঘোড়ার টাকা জলে গেলো। আমি একটা ঘোড়া পেলাম। জীবনে এর আগে কখনো ঘোড়ায় চড়িনি। ঘোড়া সংক্রান্ত যা কিছু বিদ্যা অর্জন করেছি তার জন্য ধন্যবাদ সেবা প্রকাশনী আর হলিউড ওয়েস্টার্ন মুভিকে। ঘোড়ার গাইড আমাকে যে ছবক দিলো, থিওরিটিকাল সেই তত্ব আগেই জানাছিলো, শুধু মিলিয়ে নিলাম। আমার ঘোড়ায় চড়া দেখে ঘোড়ার মালিক জানতে চাইলো আমি এর আগে ঘোড়ায় চড়েছি কিনা। তাকে না সুচক জবাব দেয়ায় একটু অবাক হলো।

শুরু হলো আরোহন পর্ব। আমি একা বলে অন্য একটা দলের সাথে আমাকে নিয়ে সবাই রওনা হলো। প্রথম ঘোড়ায় চড়া বলে শুরুতে একটু আড়স্টতা ছিলো, অচিরেই তাও চলে গেলো। দুলকি চালে চলতে থাকলাম। পথে দুই জায়গায় ঘোড়াকে পানি খাওয়ানো হলো। একঘন্টার মধ্যে ঘোড়ার পথ শেষ হয়ে গেলো। ক্যাফেটারিয়ার কাছে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লাম। সবে অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছি। সকাল নয়টা বাজে। ক্যাফেটারিয়তে গিয়ে আগে ভারমুক্ত হলাম।

ব্যালান্স ঠিক রাখার জন্য বেজ থেকে একটা লাঠি নিয়েছিলাম। সাথে শুধু এই লাঠি আর এক বোতল পানি। দম নিয়ে পথ বেয়ে উঠা শুরু করলাম। কিছুদুর যাবার পর মনে হলো আর শ্বাস নিতে পারছিনা। হৃদযন্ত্র আর তাল মেলাতে পারছে না। বসে পড়ে কতক্ষন বিশ্রাম নিলাম। এভাবে উঠা যাবে না। স্ট্রেটেজি পাল্টে ফেললাম। আর জোড় কদমে হাঁটা নয়.., আস্তে আস্তে হাটতে হবে, কিছুক্ষন পর পর সামান্য বিরতিতে। পরের পথ পুরোটা সেইভাবেই উপড়ে উঠলাম। উপড় থেকে আছড়ে পরা পানির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। তবে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ উঠার পর মনে হলো মন্দিরের দিক থেকে জপের শব্দ শুনতে পেলাম।

পাইনের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ক্রমাগত উপড়ে উঠা। অসামান্য অপরুপ সৌন্দর্য। মোবাইলের ক্যামেরায় যতটুকু সম্ভব এই সৌন্দর্যকে ধরার চেষ্টা করেছি। এক সময় চোখের সামনে ভেসে উঠলো মন্দিরের অবয়ব। এখনো বেশ পথ বাকি। এখান থেকে পাথুরে সিড়ি বেয়ে পথ নেমে গেছে, তার পর আবার উর্ধমুখী সিড়ি যেয়ে শেষ হয়েছে মন্দিরের মুখে।

সিড়ি থেকে মন্দির ও আঁশে পাশের সৌন্দর্যে দম আটকে গেলো। সিড়ি নামা যেখানে শেষ, সেখানে শক্তিশালী এক ঝরনা প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে প্রায় দুইশত ফুট উপড় থেকে। ধীরে সুস্হে নেমে এলাম ঝরনার গোড়ায়। ফোটা ফোটা বৃষ্টি একটু আগেই শুরু হয়েছিলো। মেঘ আর বৃষ্টিতে সৌন্দর্য যেনো কয়েকগুন বেড়ে গেলো। পথের ক্লান্তি নিমেষে ভূলে গেলাম।

ঝরনার গোড়ায় ছোট একটা ব্রিজ… ঝরনা পাড় হয়ে মন্দিরে যাবার জন্যে। এই ব্রিজের নীচ দিয়ে ঝরনা নেমে গেছে আরো নীচে। শেষ কোথায় ব্রিজে দাড়িয়ে বুঝতে পারলাম না।

সিড়ি পথ বেয়ে উঠে গেলাম মন্দিরে। মোবাইল জমা রেখে ঢুকে পড়লাম মন্দিরের ভিতরে। ঘড়িতে তখন সোয়া দশটা বাজে। প্রায় মিনিট ত্রিশেক ছিলাম মন্দিরের ভিতর। বের হয়ে এসে কতক্ষন বসে বসে আঁশে পাশের সৌন্দর্য অবলোকন করলাম। কখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এবার মনে হলো, না বাচ্চাদের সাথে না এনে ভালোই করেছি।

ফেরার পথ ধরলাম। থেমে থেমে নানান এঙ্গেলে মন্দিরের  ও ঝরনার ছবি নিতে নিতে পাথুরে সিড়ির প্রান্তে পৌছে গেছি। সময় তখন সাড়ে এগারো, সকাল। ধিরে ধিরে নেমে আসতে লাগলাম, কিন্তু একসময় মনে হলো, এভাবে নামলে দেরী হয়ে যাবে, তিনজিন এসে বসে থাকবে। তার উপড় আজই শেষ দিন। কিছু কেনাকাটা বাকি, লাগেজও গুছাতে হবে। বিকল্প পথ ধরলাম। পায়ে হাঁটা সাধারন পথ ছেড়ে শর্টকাট পথে নামা শুরু করলাম, যা অনেক বেশী ঢালু, তবে আমার পথের দূরত্ব কমে গেলো। দ্রুতই পৌছে গেলাম ক্যাফেটারিয়াতে।

আবারো ভারমুক্ত হয়ে নিলাম। পেয়ালা সাইজের এক কাপ কফি আর চারটা বিস্কিট খেলাম, একশত বিশ রুপিতে। আবার নামা শুরু। উপড় থেকে শর্টকাট নামার পথ আগে দেখে নিচ্ছি.. যাতে নীচে নেমে যেনো মূল পথেই থাকি, হারিয়ে না যাই। মেটামুটি তাড়াতাড়িই নেমে এলাম, শিডিউল সময়ের মধ্যেই। তিনজিন চলে এসেছে… আমাকে দেখে হেসে হাত নাড়ালো।

পরিশ্রান্ত আমি কতক্ষন বসে জিরিয়ে নিলাম। তিনজিন জানালো যে সবাই হোটেলে অপেক্ষা করছে, আমি গেলে লাঞ্চ এ বের হবে। আচ্ছা, ঠি ক আছে, কিন্তু আমি এখানে কিছু সুভেনির কেনাকাটা করবো। পাহাড়ের পাদদেশে একটা ষ্ট্রীট মার্কেট এর মত আছে। এখানে তুলনামূলক ভাবে সস্তায় সুভেনির পাওয়া যায়। ঘণ্টা খানেক সময় নিয়ে কিছু সুভেনির কিনলাম।

অতঃপর হোটেলের উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম। হোটেলে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তারা সকালে পাহাড়ে স্নো দেখেছে কিনা। দুজনেই অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানালো যে তারা দেখেছে এবং এটা তাদের জন্য অনেক exciting ছিলো। পথে যেতে যেতে তারা জানতে চাইলো আমি পাহাড়ে যেতে পেরেছি কিনা, চূড়ায় উঠতে পারলাম কিনা,  সেখানে আমি কি দেখলাম? একটা অনেক বড় ঝরনা ছিলো শুনেই ছেলে লাফ দিয়ে বললো… বাবা আমাকে নিতা, আমি ঝরনায় গোসল করতাম। ছেলেকে কথা দিলাম যে সে আরেকটু বড় হলে তাকে ও তার বোনকে নিয়ে ঐ পাহাড়ে আবার যাবো।

যাচ্ছি গতকালের সেই রেস্তোরাঁয়, যেখানে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম। তিনজিন জানালো, আজো সেই একই মেন্যু, তবে শেষ লান্চ বলে আজ সে বাড়তি হিসাবে মম অর্ডার করেছে শুধু নাফের অনেক পছন্দ বলে। পাহাড় এ যাওয়ার কারনে বোধহয় আজ ক্ষুদা বেশী লেগেছিলো, ভরপেট ঠেসে খেলাম। এরপর ধূমায়িত এক কাপ কফি পুরো চাঙ্গা করে দিলো।

এরমাঝে আবারো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির মধ্যেই বের হলাম, টাইগার্স নেস্ট এর পাহাড়ের পাদদেশে, উদ্দেশ্য, সবাই নীচ থেকে টাইগার্স নেস্ট এর মন্দির দেখবে। গন্তব্যে যখন পোঁছালাম, তখন ভালই বৃষ্টি হচ্ছে, মন্দির দেখা যাচ্ছে না। বৃষ্টি কমে কিনা দেখার অপেক্ষায় আবারো সুভ্যেনির মার্কেটে ঘুরাঘুরি। সহধর্মিণী কিছু আইটেম কিনল। এরমাঝে বৃষ্টিও ধরে এলো। এবার সবাই নীচ থেকে পাহাড়ের মাথায় মন্দিরের দেখা পেলো। ততোক্ষণে বিকাল শেষ হওয়ার পথে। শহরের পথে চললাম। শহরে পৌঁছে তিনটা বাছাইকরা দোকানে গিয়ে গতকালেরপছন্দ করে রাখা কিছু স্যুভেনির কিনে ফেললাম।

এরপর গিন্নির বাজার। ভূটানীজ শুকনা মরিচ, লোকাল চিজ… সবশেষে কিছু স্হানীয় আপেল। ততক্ষনে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। ফিরে চললাম হোটেলে। কাল সেই ভোঁর পাঁচটায় এয়ারপোর্টে যাবার জন্য বের হতে হবে। তিনজিন জানালো যে সকালে আমাদের ব্রেকফাস্ট প্যাকেট রেডি থাকবে, রিসেপ্শন থেকে নিয়ে নিতে।

ডিনার শেষে লাগেজ গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম। যথারীতি ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে সবাই তৈরী হয়ে চেক আউট করলাম হোটেল থেকে। এয়ারপোর্টে পৌছে গেলাম সাড়ে পাঁচটার আগেই। তিনজিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভিতরে।

এখন পর্যন্ত যা হয়নি দেশের বাইরে গেলে, এবার তাই হলো। এয়ারপোর্টে এসে জানতে পারলাম, ফ্লাইট ডিলেইড.. দুইঘন্টা। আহ্ হা … আগে জানতে পারলে কি ভালো হত…. আরো দুইটা ঘন্টা ঘুমাতে পারতাম..

ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। সময় কাটানোর জন্য ডিউটি ফ্রি শপগুলোতে ঢু মারলাম। মূল্যতালিকা চোখ কপালে তুলে দিলো.. পারো শহরের চেয়েও বেশী দাম … একই জিনিস। দিগুনের মতো। ভাগ্যিস সব আগেই কিনে ফেলেছিলাম।

ডিলেইড ফ্লাইটের কারনে ড্রুক এয়ারের তরফ থেকে হাল্কা স্ন্যাকস ও কফি পরিবেশন করলো। খেয়ে নিলাম। বিদেশ ভ্রমনে গিয়ে সাদা চামড়াধারীদের কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছি… লজ্জার কিছু নেই… যেখানে খাবার ফ্রি বা কমপ্লিমেন্টারী… সেখানে বিনা ওজরে খেয়ে নেয়া .. পেট পুরো… প্রয়োজনে হাতে করেও নিয়ে যাওয়া যায়… প্রথমবার যখন বিদেশ যাই… কমপ্লিমেন্টারী ব্রেকফাস্ট… কিছুটা লজ্জায় কম কম করে খাচ্ছি… দেখি সাদা চামড়ার এক ভদ্রলোক ও তার সংগিনী খাওয়া দাওয়া শেষ করে বেড়িয়ে যাবার সময় দুই হাতে দুইটা করে কলা নিয়ে সুন্দর চলে গেলো। এরপর থেকে আমিও আর লজ্জা পাইনা।

গত সাতটা দিন ভূটানে ঘুড়লাম… কোথাও কোনো কোলাহল শুনিনি…. কাউকে উঁচু স্বরে কথা বলতে শুনিনি…. সাতদিনে আমাদের গাড়ী মাত্র তিনবার হর্ন বাজিয়েছে…  আর আজ অষ্টম দিনে প্রথম কোলাহল আর উচ্চস্বরের কথাবার্তা শুনতে পেলাম… এয়ারপোর্টে… পর পর তিনটি ফ্লাইট… চট্টগ্রাম, কোলকাতা আর ঢাকা…..

অবশেষে বিমানে উঠার ডাক পেলাম, সোয়া নয়টা বাজে। বিমান ছাড়তে ছাড়তে সাড়ে নয়টা। টেক অফের পর মেয়েকে বললাম … বাহিরের দৃশ্যাবলী ভালো করে দেখতে…. এমন সিনিক বিউটি আর সহজে দেখতে পাবে না… মোবাইলটা তার হাতে দিয়ে বললাম কিছু ছবি তুলে রাখো…. আশেপাশের সবাইকে দেখি ব্যাস্ত যার যার ক্যামেরা নিয়ে….

বিমান উড়ে চলেছে.. গন্তব্য ঢাকা.. বিদায় ভূটান।

৫,৯১৬ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।