দিন-তারিখ মনে নেই, সালটা ছিলো ২০০৩। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে আমাদের প্রায়ই এ জেলা থেকে সে জেলা করতে হতো। এটুকু বেশ মনে আছে, বাসাটার পাশে একটা প্রকান্ড হাসনাহেনা গাছ ছিলো। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় বাসাটা ফুলের গন্ধে ম ম করতো।
বাবা ছিলেন সরকারী কলেজের অধ্যাপক। কলেজ থেকে অল্প দূরে একটা ভাড়া বাসায় উঠেছিলাম আমরা। একতলা ছোট বাসা, সাথে লাগোয়া উঠান, আর বাসার পেছনে আম-কাঁঠাল-মেহগণি গাছের জঙ্গল। বাড়িওয়ালা শহরে থাকতো, বাসায় তাকে কোনওদিন আসতে দেখেছি বলে মনে পড়েনা।
আমি রাহাত, দুই বোনের পরে বাবামায়ের একমাত্র ছেলে। ছোটবেলায় তাই আদরযত্নের কমতি ছিলো না। তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি, বাসায় অ আ ক খ শিখছি। আপারা বড়জন ক্লাস ফাইভে পড়তো, ছোটজন ক্লাস থ্রিতে। তারা স্কুলে চলে গেলে আর আব্বু কলেজে যাওয়ার পরে বাসায় সারাদিন খালি আমি, বুয়া আর আম্মু। বুয়ার কথা স্পষ্ট মনে আছে, কারণ এমন সরল মানুষ আমি বোধহয় দুটো দেখিনি। মাঝবয়সী, কালোমতন, মার চেয়ে একটু খাটো ছিলেন। আমাকে খুব আদর করতেন। পরে শুনেছিলাম, পরপর তিনবার মরা ছেলে হওয়ার পরে বুয়ার স্বামী তাকে তালাক দিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছিলো।
বাসাটা নিরিবিলি জায়গায় ছিলো, তখনও এখনকার ঘিঞ্জিপাড়াগুলোর মতো অল্প জায়গায় একগাদা বাড়ি তৈরী শুরু হয়নি। আমাদের বাসার বারান্দা থেকে ভালমত তাকালে অবশ্য যে আশেপাশে দু’চারটা ঘর-দালান চোখে পড়তো না, তা নয়। আব্বুর কলেজে হেঁটে যেতে প্রায় দশ মিনিটের মতো সময় লাগতো, কয়েকবার গেছিও।
তো আপারা স্কুলে যাওয়ার পরে আমার করার মতো ঠিক কিছুই থাকতো না। বাসায় টিভি ছিলো অবশ্য, তবে ওই এলাকায় তখনও ডিশ লাইন আসেনি। সকালে খাওয়াদাওয়ার পর সারাদিন বাসায় ঘুরতাম, দুপুরে বিটিভিতে কার্টুন হতো, সেটা দেখতাম। আব্বু আর আপুরা বিকালে আসলে খুব আনন্দ হতো।
বাসাটার কিছু সমস্যা ছিলো। বাসায় ওঠার পরে আব্বু-আম্মুরা বেশ ভালোরকমেই শুনেছিলেন এ ব্যপারে। তবে আব্বু কলেজে ফিজিক্স পড়ান আর আম্মু এক হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা। এসব কুসংস্কারে আমল করেন নি।
একদিন সকালে খেয়েদেয়ে বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ খেয়াল হলো, কে যেন হাসনাহেনা গাছ থেকে ফুল পাড়ছে। সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠে গিয়ে আম্মুকে ডাকলাম। আম্মু-বুয়া দুজনই ছুটে আসলো, কিন্তু যেই বললাম, “দেখো কে যেন আমাদের ফুল চুরি করতে আসছে!” অমনি দুজনই হেসে উঠলো। বুয়া বললো, “এলাকার মানুষজন ওমন দু’চারটা ফুল ছিঁড়েই। কিছু বলতে হয় না।”
এত কিছু বুঝতাম না তখন, খুব রাগ হলো। বাচ্চারা বোধহয় স্বার্থপর হয়, আমাদের বাসার গাছ থেকে কেউ ফুল পাড়বে এটা মেনে নিতে পারলাম না। উঠোনে বের হলাম ফুলচোরকে শায়েস্তা করবার জন্য। কিন্তু বের হয়ে দেখি, কেউ নেই। ঠিক করলাম, পরেরবার এলে উচিৎ শিক্ষা দেব।
সেদিন রাতটা ছিলো পূর্ণিমার। ফোঁটা হাসনাহেনার গন্ধে বাসা ভরপুর। আম্মু রাতের ভাত রান্না করছে, বুয়া বাড়ি চলে গেছে। আপুরা হোমওয়ার্ক করছে, আব্বু বোর্ডের খাতা নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি আদর্শলিপির পাতায় দেয়া ছবির মর্মোদ্ধারে নিমগ্ন। হঠাৎ বারান্দার দরজা দিয়ে খেয়াল করলাম, সকালের চোর আবার এসে হাজির হয়েছে। এবকার আর নিস্তার নেই। বারো ইঞ্চি কাঠের স্কেল নিয়ে উঠানে বের হলাম, সাদা কাপড় পড়ে চোর ফুল ছেঁড়ায় ব্যস্ত। ভাবলাম, কাছে গিয়ে দেব একটা বাড়ি। আস্তে আস্তে কাছে এগোলাম। চোর বোধহয় টের পেলোনা। কিন্তু মারার জন্য যেই স্কেল তুলেছি, ওমনি সে ঘুরে দাঁড়াল। চোরের একবারে মুখোমুখি আমি।
কিন্তু চোরের মুখ কই? এটা তো একটা কঙ্কালের খুলি। বাবার কলেজের বায়োলজী ল্যাবে এমন একটা দেখেছি। কঙ্কালটা হঠাৎ দু’হাত বের করে আমার দিকে তেড়ে এল। আমি একটা গলাফাটানো চিৎকার দিলাম, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল।
চোখ খুলে দেখি, বাসার বিছানায় শুয়ে আছি। বামপাশে বড়আপু বাতাস করছে, আব্বু-আম্মু-ছোটআপু বিছানার চারপাশে ঘিরে আছে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “এমন চিল্লানি দিলি কেন?” সব খুলে বললাম। সব শুনে মা, বললেন, “হয়তো জ্যোৎস্নার আলোয় চোখে ধাঁধা লেগেছিলো, তাই ওসব দেখেছে।” সবাই একবাক্যে মাকে সমর্থন করলো।
এরপর আরও দু’বছর ঐ বাসায় ছিলাম। আর কিছু ঘটেনি। আমার ফুলচোর ধরার শখ মিটে গিয়েছিলো অবশ্য।