নিঃসঙ্গতার মন্ত্রী ও রাগ কমানোর পার্ক

একটি জাতির একাকী অথবা নিঃসঙ্গ মানুষগুলোর জন্য একজন মন্ত্রী থাকবেন এবং তিনি সবার একাকীত্ব ঘোচাতে এগিয়ে আসবেন–এ কথা হঠাৎ শুনলে খুব স্বাভাবিক মনে হবে না। অন্তত আমরা– বাঙালিরা তো মানতেই চাইবো না যে মানুষ একাকী বোধ করতে পারে।
সম্প্রতি ব্রিটেনে একজন মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে–একাকীত্বের মন্ত্রী। বাংলায় নিঃসঙ্গতা এবং একই কথা কিনা আমি জানি না, তবে সে দেশে ‘লোনলিনেস’ এবং ‘অ্যালোন’ এক কথা নয়। সেখানে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও বিষণ্নতা রেকর্ড ভেঙেছে। এই মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে এর কারণগুলো নির্ণয় করে দিকনির্দেশনা দেওয়া। ব্রিটিশ রেডক্রসের একটি সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, প্রায় নব্বই লাখ মানুষ সে দেশে প্রায়ই অথবা সব সময়ই একাকীত্বে ভোগেন। মেলিসা হিলি নামে এক লেখক নিউ ইয়র্ক টাইমসে লিখছেন যে একাকীত্ব শুধুমাত্র একটি মানসিক অবস্থা নয়। শারীরিক অবস্থাও বটে। নিঃসঙ্গ মানুষের নানা রকমের স্বাস্থ্যহানি হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডেমেনসিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম।
আবার প্রশান্ত সাগরের ওপারে, আমেরিকায়, সেখানকার সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বলছে, পঁয়তাল্লিশ বছরের বেশি বয়সের মানুষ প্রচণ্ড একাকীত্বে ভোগেন। সেখানকার একটি বড় জনগোষ্ঠী ক্রমশ সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।

সমাজ? সমাজে কারা বসবাস করেন? আমরাই। আমাদের বর্তমান সমাজ একটি প্রযুক্তি-ঘন সমাজ। সেথায় প্রযুক্তি-নির্ভর যন্ত্র নিয়ে যে যার মতো ব্যস্ত। এখন যাদের হাতের মোবাইলে ইন্টারনেট আছে, তাদের কাছেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আছে। এখনকার প্রযুক্তি লোহা-লক্কড় দিয়ে তৈরি নয়, ইন্টারনেট দিয়ে তৈরি। তা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সারাদিন কাটানো যায়।

গিয়ে দেখুন কোনও রেস্তোরাঁয়, চেয়ে দেখুন কোন দম্পতির পানে! কী দেখলেন? তারা বসে আছেন একে-অপরের পানে ফিরে, কিন্তু তাদের চেহারা একে-অপরের পানে নেই, চোখগুলো একে-অপরকে দেখছে না, তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথাও বলছেন না, তাকিয়ে আছেন এক অদ্ভুত প্রযুক্তির দিকে। কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়েই বোঝা যায় এরা একে অন্যের থেকে একা; একজনের বসবাস আরেকজনের চেয়ে অনেক অনেক দূরে। এদের নিজদের কোনও কথা নেই, আলাপ নেই, কনটেন্ট নেই– তাই এরা সামাজিক মাধ্যমে সমাজের অন্য সবার সঙ্গে কথা বলছেন। এরা দুজনে দুজনার কাছে অসামাজিক হয়ে অন্য হাজারও মানুষের সঙ্গে সামাজিকতা চালিয়ে যাচ্ছেন! তাহলে! তাহলে এই মাধ্যমে বিচরণ করলে কি মাধ্যমটিকে সামাজিক বলা যায়?

বিলেতে গিয়ে দেখেছি তারা টিউব রেলে যখন চড়েন, তখন কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। খবরের কাগজ অথবা বই পড়েন। ইদানীং তারাও ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন অথবা ফোনের তার লাগিয়ে গান শোনেন।

বাংলাদেশে আমরাও তাই করছি; আমাদের সন্তানেরাও ঠিক তাই করছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলেও তারা কানের মধ্যে হেডফোন ঢুকিয়ে গান শোনে। মনে আছে আমরা যখন একটু বড় হয়ে বাবা-মাকে ছেড়ে আলাদা ঘরে থাকা শুরু করলাম, রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া আর কখনও ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতাম না। আমাদের সন্তানেরা তা করে না। তারা যখনই ঘরে থাকে, তাদের দরজা বন্ধ থাকে। আমরা কিন্তু এখনও জানি না কী কারণে তারা দরজা বন্ধ রাখে। বাইরে কোনও বাড়িতে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গেলে সেখানে বসেও কানে হেডফোন দিয়ে রাখে। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা বলে দরজা বন্ধ রাখতে তাদের ভালো লাগে।

আমরা (বাঙালিরা) একাকীত্বের কীর্তন গেয়েছি অনেক। একাকীত্ব নিয়ে গল্প-কবিতা লিখেছি; একাকীত্বের মাঝে সুখ খুঁজেছি অঢেল; প্রেমিক বা প্রেমিকা আমাদের একা করে দিয়ে চলে গেলে সেই একাকীত্বকে রোমান্টিকতা দিয়ে ভরে দিয়েছি। একসময় মনে হতো একাকীত্ব ছাড়া আমাদের কবিতাই লেখা হয় না। দেখুন এক কবি কি লিখেছেন, ‘একাকীত্ব আমাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে, হারিয়ে যাচ্ছি …।ভুলে যাচ্ছি নীলিমার তীরে নৌকা বাঁধার কথা হাতড়ে পাচ্ছি না নিজেকে জীবনের অভ্যন্তরে ।’

কবিতাটি পড়লে কবিকে সত্যিই একা মনে হয়। আবার মনে হয় একাকীত্বকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমন হাজারও বাংলা কবিতা আছে যেগুলো পড়লে মনে হয় একাকীত্ব অথবা নিঃসঙ্গতাকে সাথী করে এক ধরনের দুঃখবিলাসী জীবনযাপনে ইচ্ছে কবিদের। সাহিত্য মানুষেরই চিন্তার প্রতিফলন এবং আমাদের কবিদের প্রকাশ দেখলে বোঝা যায় আমরা এক-একজন কতটা নিঃসঙ্গ। আবার যারা নিজেদের নিঃসঙ্গ মনে করেন না, এই কবিতাগুলো পড়লে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। সাহিত্য মানুষের মাথায় গেঁথে যায়। তাই সাহিত্য পড়েও অনেক সময় আমরা একা বোধ করি।

কিন্তু একাকীত্ব মানুষ যখন পছন্দ করতে শুরু করে সেই একাকীত্বের কোনও ক্ষতিকর দিক আছে কিনা আমরা বাংলাদেশে এখনও জানি না। আমাদের সমাজে অনেকে একাকীত্ব ঘোচাতে মাদকের মাঝে ডুবে থাকতে চান; মাদকাসক্ত অনেকে নিজেকেই পছন্দ করেন না। মার্ক টোয়েন একবার (মাদকাসক্তদের নিয়ে নয়) বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ একাকীত্ব হলো নিজেকেও ভালো না লাগা’। আমার প্রশ্ন, ‘আসলে কি নিজেকে ভালো লাগা, না নিজের কাজকে ভালো লাগা? মানুষের জীবনে অনেক কাজ। সেই কাজগুলো করতে পারলেই নিজেকে খুব ভালো লাগার কথা। তাহলে কি যে সমাজে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেশি, সে সমাজে একাকী মানুষের সংখ্যাও বেশি? তাহলে যে সমাজে বেকার নেই, সেখানে নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন?’ জাপানের মানুষের তেমন কোনও অর্থাভাব বা কর্মহীনতা আছে বলে আমি জানি না; তবুও সেখানকার পুরো একটি জেনারেশন একাকী মারা যাচ্ছেন বলে গণমাধ্যম বলছে। এই জনগোষ্ঠীর সব আছে– বাড়ি, গাড়ি, খাবার, চিকিৎসা– সব; শুধু কাছে নেই তাদের সন্তানেরা। এদের কথা পড়ে আমার মাদার তেরেসার কথা মনে হয়। তিনি বলেছিলেন, একাকীত্বের চেয়ে ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য আর নেই।

আমার এক ছোট ভাই জাজাফী দূরালাপনিতে জানালো, ‘একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা এক নয়। অনেক সময় আমরা একসঙ্গে বসেও একাকী বোধ করি। কোনও কিছু ভালো লাগে না, মনটা অন্য কোথাও থাকে। আর নিঃসঙ্গতা হলো কারো সঙ্গে না থেকে একা-একা থাকার কোনও মুহূর্ত। কোলাহলে থেকেও মানুষ একা হতে পারে, তবে নিঃসঙ্গের পাশে কেউ থাকে না’।

সেই তো! পাশে থাকা একটি বড় ব্যাপার। আমরা কে কতটা একে-অপরের পাশে থাকতে পারছি, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সবার জীবনেই একটি সময় আসতে পারে যখন কেউ পাশে থাকে না। না বন্ধু, না স্ত্রী, না ছেলেমেয়ে, না সহকর্মীরা! এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে কতজন আমরা কি জানি? আমরা কি আদৌ বিষয়টি নিয়ে ভাবি? কেউ কেউ হয়তো ভাবি। ইংল্যান্ডের সরকার বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে। যদিও আরও আগেই ভাবা প্রয়োজন ছিল,তারপরও তারা ভেবেছেন এবং একজন মন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি ইংল্যান্ডের এই মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাই তিনি যেন আসলেই সে দেশের নিঃসঙ্গ মানুষদের জন্য কিছু করতে পারেন।

আরেকটি বিষয় এখানে টেনে না আনলে মনে শান্তি পাচ্ছি না। আমাদের ঢাকা শহরের কথা। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মেয়র সম্প্রতি হঠাৎ বলেছেন যে তিনি এ শহরে রাগ কমানোর একটি পার্ক তৈরি করতে চান। সেখানে গান-বাজনা থাকবে, বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে।

খবরটি দিয়েছিল বিবিসি বাংলা; তবে পুরো খবর দেয়নি। সে জন্যে মেয়রের মনে কী কী ছিল তা জানা যায়নি। তবে আমরা কিছুটা ধারণা করতে পারি।

প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, রাগের কথা আমাদের মেয়রের মনে এলো কেন? তার কাছে কি মনে হয়েছে ঢাকাবাসী রেগে আছে? কেন রেগে থাকবে? রাগের কী আছে তাদের জীবনে? যদি রেগেই থাকে, তাহলে কার ওপর এই রাগ? সংসারে অশান্তি? রাস্তায় ট্রাফিকের কারণে রাগ? খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়েছে? ব্যবসা করতে গিয়ে বেশি-বেশি ঘুষ দিতে হচ্ছে? বাড়ির গেটে কারা যেন বর্জ্য ফেলে গেছে, সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে?

তবেই দেখুন; আমাদের ‘জাদু’র শহরে রাগের কারণের অন্ত নেই। বুদ্ধিমান মেয়র। বুঝেছেন যে তার শহরের বাসিন্দারা সবসময় রেগে থাকেন। সে কারণেই হয়তো তিনি ‘রাগ কমানোর’ পার্কের কথা বলেছেন। যদিও রাগের কারণগুলো দূর করে দিলে আর কোনও রাগ কমানোর পার্কের প্রয়োজন হয় না। তবে ভালো লাগছে তিনি আমাদের রাগের খবর রাখতে চেয়েছেন এবং তা কী করে কমানো যায় তা চিন্তা করেছেন। কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে জনগণের রাগ কমানোর জন্যে ভদকার মূল্য খুবই কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল যেন জনগণ সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনও বিক্ষোভ না করে। কম দামে ভদকা পেয়ে জনতা খুশি। সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো!

অতটা চরমপন্থার কথা আমি বলবো না, তবে মেয়রের এই ভাবনাটি আমার ভালো লেগেছে। এই মানুষটি যে জনতার রাগ নিয়ে চিন্তা করেছেন, তাই ভালো লেগেছে। ক্ষমতাশালীরা রাস্তার উলটো দিক দিয়ে গাড়ি চালিয়ে গেলেই তো আমরা রেগে যাই। এ বিষয় সব ক্ষমতাশালী বোঝেন না, পাত্তাও দেন না। এই তো সেদিন, ভিআইপি মানুষদের জন্যে রাস্তায় একটি আলাদা লেন চালু করার প্রস্তাব এসেছিল। এই চিন্তাই জনতার রাগের একটি প্রধান কারণ হতে পারে। শুধুমাত্র ট্রাফিক যটে বসে থাকলেই আমাদের মনে কতটা রাগ উৎপন্ন হয় ভেবে দেখুন তো!

রাগের কারণগুলো আমাদের জীবন থেকে দূর করার তেমন কোনও তৎপরতা আমাদের চোখে পড়ে না; রাগের কারণগুলো বাড়ানোর প্রচেষ্টাই চোখে পড়ে। আমার আনন্দ লাগছে এই ভেবে যে আমাদের এই মেয়র রাগ নিয়ে চিন্তা করেছেন;তাকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি সরকারে থেকে বুঝেছেন যে রাগের আসল কারণগুলো দূর করা এ দেশে সম্ভব নয়, তাই তিনি বিকল্প ভেবেছেন। মানুষ রেগে থাকলে দেশ স্বাভাবিকভাবে চলে না, কোথাও চলেনি।

৫,৭২৯ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।