ডিজিটাল অঘটন

মনে আছে, কয়েক মাস আগে আমাদের ঢাকা শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক ও চালকরা তাদের গাড়ি আর না চালানোর হুমকি দিয়েছিলেন? গত ২৭ নভেম্বর থেকে তাদের অটোরিকশা আর রাস্তায় নামাবেন না বলে পূর্ববার্তা দিয়েছিলেন। তার অর্থ হচ্ছে, সাধারণ যাত্রীরা তাদের অফিস বা কর্মস্থলে যেতে এবং কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে আর অটোরিকশা চেপে যেতে পারবে না।

এমন ধর্মঘটের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল। আমি তাদের দাবিগুলো খুব মন দিয়ে দেখেছিলাম। একটি দাবি ছিল— ‘উবার’ ও ‘পাঠাও’ সার্ভিসগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে। তারা বলেছিলেন, সাধারণ যাত্রীরা সিএনজি অটোরিকশার চেয়ে উবার ও পাঠাও বেশি পছন্দ করছে। তারা তাদের ক্রেতা হারাচ্ছেন।

গণমাধ্যমে তখন বলা হয়েছিল যে, সিএনজি অটোরিকশার চালক ও মালিকরা বেশ অসহায় বোধ করছেন এই দেখে যে, সাধারণ যাত্রীরা তাদের চেয়ে উবার ও পাঠাও বেশি পছন্দ করছে। খবরগুলো পড়ার পর আমি নিজেও দেখেছি তাদের রাস্তায় বসে থাকতে। আগে তো তাদের পাওয়াই যেত না। আর কোনো গন্তব্যে যেতে রাজি হলেও যাত্রীদের চাহিদামতো যেতে চাইতেন না। সিএনজি চেপে কাছাকাছি দু-তিন কিলোমিটারের দূরত্বে কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তাই করা যেত না। রাত হলে তো কথাই নেই। ‘যামু না’, ‘ভাই, অনেক জ্যাম ওইদিকে’, ‘মিটারে যামু না,’ ‘তিনশ টিহা’— এসব কথাই আমরা সবসময় শুনে এসেছি।

আমি নিজে একপর্যায়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ঢাকা শহরে আর ট্যাক্সি অথবা সিএনজি অটোরিকশায় চড়ব না।

একবার মিরপুর গিয়েছি দাওয়াতে। বাড়ি ফিরতে কোনো বাহন পাব না, তাই তাড়াতাড়ি বেরোতে হয়েছিল। রাত ১০টায় বেরিয়েও কিছু পেলাম না। বর্ষাকাল। বৃষ্টি হচ্ছে। আমার কোলে নয় মাস বয়সী সন্তান। কোনোমতে তাকে তোয়ালে দিয়ে ঢেকে গাড়ি খুঁজছি। রাস্তায় সারি সারি ট্যাক্সি ও অটোরিকশা। আমার গন্তব্যে কেউ যেতে রাজি নয়। ঠিক এ মুহূর্তেই আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, ‘সাধ্য না থাকলেও কালই গাড়ি কিনব। এসব আর নয়।’

তারপর অনেক বছর চলে গেছে। আমাদের দেশে ট্যাক্সি ও অটোরিকশা সার্ভিসের সুবিধা জনগণ পায়নি। আমি একা নই, সাধ্য না থাকলেও হাজার হাজার মানুষ এ শহরে গাড়ি কিনেছে শুধু এদের দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচার জন্য। এত বছর তারা তাদের দৌরাত্ম্য চালিয়ে গেছে। এখন চাকা ঘুরে গেছে। মানুষের জন্য অন্য ব্যবস্থা এসেছে। ফোনে অ্যাপের মাধ্যমে এখন বাহন ডাকা যায় এবং তা শহরের সব স্থানে ভাড়ার বিনিময়ে পৌঁছে দেয়।

আমরা এও বুঝতে পারছি যে, উবার ও পাঠাওয়ের মতো সার্ভিস আমাদের দেশে আরো আসবে। তখন এ সিএনজিওয়ালাদের ব্যবসা আর থাকবে বলে মনে হয় না। কেউ আর সিএনজি চড়বে না। তাদের দিকে কেউ তাকাবেও না।

ট্যাক্সি সার্ভিস অনেক আগেই ব্যবসা হারিয়েছে। আমি মনে করি, এ সিএনজি অটোরিকশাচালক ও মালিকরা ভবিষ্যৎ দেখতে পারছিলেন না। ২০০৩ সালে ভারত থেকে এনে মিটার বসিয়ে এগুলো চালু করা হয়। কিছুদিন খুব ভালো চলে। তারপর চালকরা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারলেন। লোভ ও অসততা তাদের মনে ঢুকে গেল। নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া দাবি করে যাত্রীদের জিম্মি করে ব্যবসা চালাচ্ছিলেন। এমন করে চললে কোনো ব্যবসাই টেকসই হয় না। ব্যবসা করতে ক্রেতা প্রয়োজন হয়, সততা প্রয়োজন হয়। অসৎ হলে কোনো ব্যবসাই টেকসই হয় না।

এল উবার ও পাঠাও। অসততার শিকল ভেঙে যাত্রীদের মুক্ত করতে সমর্থ হলো। এ অ্যাপনির্ভর পরিবহন ব্যবস্থা খুব তাড়াতাড়িই জনপ্রিয়তা পেল। এগুলো এমন সব বাহন-কোম্পানি, যার নিজের কোনো গাড়ি নেই। তার পরও চলছে তাদের ব্যবসা। যাত্রীদের প্রতি তাদের কোনো ‘না’ নেই, যেখানেই যেতে চাই, সেখানেই যাওয়া যায়, ভাড়া মোবাইল ফোনের পর্দায় দেখা যায় এবং তার চেয়ে এক পয়সাও বেশি চায় না।

অ্যাপ ব্যবহার করার অর্থ ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করা। এ ডিজিটাল মাধ্যম একদিন এসে যে তাদের ব্যবসায় অঘটন ঘটাবে, তা এ সিএনজির মালিকরা দেখতে পারেননি। তাদের একচ্ছত্র ব্যবসার যবনিকা ঘটল এখানেই।

এখন শুনতে পাচ্ছি যে, তারাও অ্যাপ চালু করেছেন। যদিও এখনো কাউকে ব্যবহার করতে শুনিনি। তবে চালু হয়েছে বলে শুনেছি। অ্যাপ চালু হলে আর কাউকে ঠকানো যাবে না।

যে কারণে এ কথাগুলো বলছি তা হলো, ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ও আমাদের জীবনে এক মহাপরিবর্তন আনতে শুরু করেছে। আমরা যেভাবে সার্ভিসভিত্তিক ব্যবসাগুলো চালিয়ে যাচ্ছিলাম, তা এক আমূল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো করে আর ব্যবসা চালাতে পারব না। একেই আমি ডিজিটাল অঘটন বলছি।

প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে ক্রেতাদের আচার-আচরণও বদলে যাচ্ছে। শিগগিরই আমাদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় কাজ প্রযুক্তির মাধ্যমে চলবে। সব কাজ ডিজিটাল মাধ্যমে করতে আমরা খুব তাড়াতাড়িই অভ্যস্ত হয়ে পড়ব।

কয়েকটি উদাহরণ দিই।

আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, নেটফ্লিক্স ও আইফ্লিক্সের মতো কোম্পানিগুলো কী করে অডিও-ভিজুয়াল বিনোদনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনছে। টেলিভিশন দর্শকরা তাদের চোখ টিভির পর্দা থেকে হাতের সেলফোনের পর্দায় সরিয়ে নিচ্ছে। নেটফ্লিক্স ও আইফ্লিক্স নিজেরা কোনো সিনেমা তৈরি করে না। একটি প্লাটফর্ম সার্ভিস দিচ্ছে একেবারে টিকিট কেটে সিনেমা হলে সিনেমা দেখার মতো। তবে সিনেমা হলে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। আপনার সময়মতো আপনি দেখে নেবেন।

বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এ ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছে কিনা আমার জানা নেই। হয় তো করছে। তবে দেশের খবরের কাগজগুলো যখন অনলাইনে ভিডিও কনটেন্ট নিয়ে হাজির হবে তখন তাদের বিপদ হতে পারে। টেলিভিশনে বিনোদন বা খবরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতে পারে। শুধু ইউটিউবকে দেখেই আমাদের বোঝা উচিত। ইউটিউব অডিও-ভিজুয়াল দুনিয়ার সব রীতিনীতিই বদলে দিয়েছে।

বিশ্বের আরো কিছু ব্যবসার দিকে তাকালে দেখা যাবে কেমন করে ডিজিটাল বাজার তৈরি করে, ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টি করে অনেক অঘটন ঘটানো হয়েছে। ই-বে, আই-টিউনস, অ্যাপ-স্টোর ও এয়ার-বিএনবি তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ। এয়ার-বিএনবির একটিও হোটেল বা হোটেল-ঘর নেই, তার পরও এটিই হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক হোটেল কোম্পানি। শুধু আপনার ফোনের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে আপনি পেয়ে যাচ্ছেন তাদের সার্ভিস; যার কক্সবাজারে অথবা কুয়াকাটায় একটি বাড়ি আছে, তিনিই এয়ার-বিএনবির সুবাদে হয়ে উঠতে পারেন একজন হোটেল ব্যবসায়ী।

ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবসার চিন্তা মাথায় রেখে বড় বড় কোম্পানি রূপান্তর হচ্ছে এবং অন্যান্য ডিজিটাল ব্যবসা খুলছে, তা লক্ষ করার মতো। অ্যামাজনের কথাই ধরুন। এটি ছিল সাধারণ অনলাইন পুস্তক বিক্রেতা। সেখান থেকে কী করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্লাউড সেবাদানকারী হয়ে উঠেছে! গুগল কেমন করে ব্যাংকিং সেবাদানকারী হয়ে উঠছে! এগুলো সবই সম্ভব হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল বিস্ফোরণে সাড়া দেয়ার জন্য।

বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি উদাহরণ আছে, যা ঘটছে আমাদের রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। ‘ফুডপান্ডা’ নামে একটি অ্যাপ আমাদের দেশে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ভোক্তাদের আ-লা-কার্ট খাওয়া-দাওয়া ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে। তারা আমাদের বাড়িতেই তৈরি খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। এমনই আরো অনেক সার্ভিস আসবে, যা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় অচিন্তনীয় পরিবর্তন আনতে পারে। দিনাজপুরের একজন ভোক্তা সেখানে বসেই বান্দরবানের রান্না খেতে পারবেন শুধু এ ডিজিটাল ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রসারের কারণে।

আমি মনে করি, ডিজিটালক্ষেত্র ব্যবহার করে চাহিদাভিত্তিক ব্যবসা আরো জনপ্রিয় হবে এবং প্রসার আরো বাড়বে। এ দেশে ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক ব্যবসার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। সাধারণ কেনাকাটার কথা তো বলাই বাহুল্য।

আরেকটি প্রসঙ্গ অল্প করে একটু বলা প্রয়োজন। ডিজিটাল নতুনত্বের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানবসম্পদের ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন খুবই প্রয়োজন হবে। সেই মাধ্যমে আমরা নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারলে কর্মহীন হয়ে পড়তে পারি। এ বিষয়ে আরেকদিন লিখব।

সারা বিশ্বে ডিজিটালক্ষেত্র একটি মহাসত্য হয়ে উপস্থিত হয়েছে এবং প্রায় সব দেশের মানুষই ডিজিটাল গাড়ি চড়ে ভবিষ্যতের পানে রওনা দিয়েছে। এ গাড়ি খুবই দ্রুত এগোচ্ছে। আমার দেশের সবাইকে ডিজিটাল দুনিয়া ও ডিজিটালদক্ষতার কথা মনে করিয়ে দিতেই এ লেখাটি আমার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। ডিজিটাল অঘটনগুলো দেখে আমরা যেন শিউরে না উঠি।

৬,০৮৬ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “ডিজিটাল অঘটন”

  1. কাজী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

    ভাল লেগেছে পড়ে। ডিজিটাল ব্যাবসা আগামী দিনে আমাদের চিরাচরিত জীবনাযাপনে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি গ্রহন করা উচিত।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।